প্রতিবছরের মতো এবারও রাজশাহীতে আসা অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়েছে পদ্মা নদীর অববাহিকা। মনোমুগ্ধকর এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিনই ছুটে আসেন দর্শনার্থীরা। অথচ পদ্মার চরে অতিথি পাখিদের ওপর চলছে স্থানীয় শিকারিদের নিধনযজ্ঞ। বিষটোপ-ফাঁদ পেতে তাদের শিকার করায় হুমকির মুখে পড়েছে নৈসর্গিক সৌন্দর্য।সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নির্বিচারে শিকারের কারণে পরিযায়ী পাখির আসা ক্রমেই কমছে।
জানা যায়, পৃথিবীতে প্রায় পাঁচ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে অনেক প্রজাতির পাখি নির্দিষ্ট সময়ে শীতপ্রধান দেশ থেকে এ দেশে ছুটে আসে। একটু উষ্ণতা, আশ্রয় ও খাবারের জন্য পাড়ি দেয় হাজার মাইল পথ। অথচ রাজশাহী শহরসংলগ্ন পদ্মার চরগুলোয় একশ্রেণির পাখি শিকারি আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এসব পাখি শিকার করছেন।
বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) সকালেও চরে তাদের বিষ মাখানো খাবার খেয়ে শতাধিক পাখির মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এসব পাখি নানা দামে কৌশলে বিক্রি করছেন শিকারিরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহী নগরীর তালাইমারি পদ্মার চর থেকে টি-বাঁধ এলাকা পর্যন্ত অন্তত ৮টি দল পাখি শিকার করে। তারা মাছের সঙ্গে বিশেষ এক ধরনের বিষ মিশিয়ে রাতের আঁধারে টোপ হিসেবে নির্দিষ্ট জায়গায় দিয়ে আসেন। পরে সেই খাবার খেয়ে পাখি অসুস্থ হয়ে পড়লে সেগুলো তারা ধরে গলা কেটে বিক্রি করছেন। আবার অনেক সময় পাখিগুলো ধরা পড়ার আগেই মারা যাচ্ছে। পরে রাজশাহীর বেশ কিছু বাজারে কৌশলে এসব পাখি আড়াই থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, রাজশাহীর টি-বাঁধ এলাকার চরে মৃত বা গলা কাটা অবস্থায় পাখি পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এ সময় তারা চখাচখি নামে অন্তত ১০টি পাখি মৃত অবস্থায় উদ্ধার করেছেন। তবে স্থানীয়দের আসতে দেখে পালিয়ে যান পাখি শিকারিরা।
স্থানীয় নিয়ামত আলী বলেন, ‘গভীর রাতে কিছু মানুষ চরে গিয়ে বিষ দেওয়া মাছ ফেলে আসেন। সকালে পাখিরা সেগুলো খেয়ে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকলে শিকারিরা সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে বিক্রি করেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিদিন অন্তত ৫০ থেকে ৬০টি পাখি শিকারি মেরে নিয়ে যান। এ ছাড়া তাড়াহুড়ার কারণে ১০ থেকে ১৫টি পড়ে থাকে।’
পাখিপ্রেমী ও গবেষকদের মতে, ‘এ দেশে যেসব অতিথি পাখি আসে, সেগুলো আমাদের পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অথচ কিছু অসাধু চক্র বিষটোপ, ফাঁদ পেতে এদের হত্যা করে। রাজশাহীতেও অতিথি পাখি শিকার হচ্ছে। এতে আগের মতো আর পাখি দেখা যায় না। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে।’
পাখিপ্রেমী হাসনাত রনি বলেন, ‘গত কয়েক দিন ধরেই রাজশাহীর পদ্মার চরে পাখি ধরা হচ্ছে। এসব পাখি বিষ প্রয়োগ করে মারা হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে যারা সেই পাখি কিনে খাচ্ছে তাদেরও শরীরের ক্ষতি হচ্ছে। সম্প্রতি কয়েকজন অপরাধীকে স্থানীয় কিছু পাখিপ্রেমী আটক করেন। তবে পুলিশের হাতে তুলে দিলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা ছাড়া পেয়ে যান।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিকারের কারণে পাখির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। আবার আবাসস্থল নিরাপদ মনে না হওয়া অতিথি পাখিও কম আসছে। ২০১০ সালের পর দেশে অতিথি পাখি আসার হার ১০ শতাংশ কমেছে। আগে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পদ্মায় পাখির আনাগোনা দেখা যেত। এখন ডিসেম্বর-জানুয়ারিতেও পাখি দেখতে পাওয়া যায় কম। পাখি নিধন বন্ধ না হলে পাখি আসা আরও কমে যাবে। তাই এখনই এসব বন্ধ করতে হবে। পাখির আবাসস্থল নিরাপদ করতে হবে।’
এ বিষয়ে রাজশাহী বিভাগীর বন্যপ্রাণী পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, ‘পদ্মার চরে শিকারিরা পাখি শিকার করছে বলে জেনেছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অভিযান চালানো হচ্ছে।’