রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় সাংবাদিক রাহনুমা সারাহর (৩২) মরদেহ পাওয়া গেছে। গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২ টার দিকে হাতিরঝিলের পানিতে মরদেহ ভাসতে দেখে এক পথচারী তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সারাহ বেসরকারি চ্যানেল জিটিভির নিউজরুম এডিটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার স্বামী ঢামেক হাসপাতালে গিয়ে মরদেহ শনাক্ত করেন।
সারাহর মৃত্যু নিয়ে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আত্মহত্যা করেছেন নাকি কেউ তাকে হত্যা করেছে সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছু জানতে পারেনি পুলিশ। মৃত্যুর আগে মঙ্গলবার রাত ১২ টার দিকে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন সারাহ। তাতে ফাহিম ফয়সাল নামে তার এক বন্ধুকে ট্যাগ করে তিনি কয়েকটি ছবিও পোস্ট করেন। যেখানে ছবিতে ফাহিমও রয়েছেন। ট্যাগ করা ছবির ক্যাপশনে তিনি লেখেন, তোমার মতো বন্ধু থাকা খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। আশা করি, খুব শিগগির তোমার স্বপ্ন পূরণ করবে। আমি জানি, আমাদের অনেক পরিকল্পনা ছিল। দুঃখের বিষয় হলো, পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলাম না। আল্লাহ তোমার জীবনের সব আশা বাস্তবায়ন করুন।
লেখা শেষে তিনি দুটি ভালোবাসার ইমোজি জুড়ে দেন। তার ১ ঘণ্টা আগে আরেক পোস্টে রাহনুমা লেখেন, ‘জীবন্মৃত হয়ে থাকার চাইতে মরে যাওয়াই ভালো।’ ওই পোস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে কপালে পতাকা বাঁধা কয়েকটি ছবিও যুক্ত করা হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, সারাহর মৃত্যুর বিষয়টি তারা তদন্ত করছেন। বিশেষ করে হাতিরঝিলে তিনি কি রাতে একাই গিয়েছিলেন, নাকি কেউ তাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওই এলাকার একাধিক সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পুলিশ পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সার্বিক বিষয় বিবেচনায় রেখেই তদন্ত করছে।
পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে হাতিরঝিল থানাধীন সড রেস্টুরেন্টের সামনে হাতিরঝিল চক্রাকার বাস কাউন্টারের উল্টাপাশে পানিতে এক নারীর মরদেহ ভাসতে দেখেন পথচারীরা। সাগর নামে এক ব্যক্তি তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
খবর পেয়ে হাতিরঝিল থানা পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ওই হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া মো. সাগর নামে ওই পথচারী ঢামেক হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, ওই নারীকে লেকে ভাসতে দেখেন পথচারীরা। কিন্তু কেউ তাকে উদ্ধার করতে চাচ্ছিলেন না। পরে আমি তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাই। পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে তার শরীরে কোথাও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। পুলিশ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, পানিতে ভাসমান অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়েছে।
বুধবার (২৮ আগস্ট) সরেজমিনে গেলে সড রেস্টুরেন্টের লোকজন জানান, রাতের বেলায় ওই এলাকায় লোকজন কম চলাচল করে। তারা মরদেহ উদ্ধারের বিষয়টি পরে জেনেছেন।
সারাহর স্বামী সায়েদ শুভ্র খবরের কাগজকে জানান, সাত বছর আগে তারা বিয়ে করেছেন। তাদের বিয়েতে দুই পরিবারের মত ছিল না। তিনি আরও বলেন, মঙ্গলবার সারাহ অফিসে গিয়ে রাতে আর বাসায় ফেরেনি। পরে জানতে পারি সে হাতিরঝিলে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে। বেশ কিছুদিন আগ থেকে আমার স্ত্রী বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চাচ্ছিল। আমরা দুজনই কাজী অফিসে গিয়ে ডিভোর্স সম্পন্ন করব বলে কথা ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঘিরে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে কাজী অফিসে যাওয়া হয়নি। তিনি দাবি করেন সারাহর সঙ্গে তার কোনো ঝগড়া হয়নি।
তিনি আরও বলেন, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সারাহ বাসা ভাড়ার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিল। পরে আমি তাকে ফোন করে বলি, রাতে তো তুমি বাসায় আসতে, তাহলে অন্যকে দিয়ে কেন টাকা পাঠিয়েছ? আমার প্রশ্নের উত্তরে সে বলে ‘আমি ব্যস্ত আছি’। এরপর সারাহ ফোন রেখে দেয়। শুভ জানান, তারা কল্যাণপুরের একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন।
এদিকে, সারাহর মৃত্যুর পর তার বন্ধুরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোক প্রকাশ করে পোস্ট দিচ্ছেন। তার এক বন্ধু নাজমুস সাকিব ফেসবুকে লিখেছেন, সারাহ অনেক দিন থেকে ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন। চিকিৎসাও নিয়েছিলেন। সবাই তাকে আশ্বস্ত করেছিল যে তিনি ঠিক হয়ে যাবেন।
ঢামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বুধবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সারাহর বাবা বখতিয়ার শিকদার মেয়ের মরদেহ গ্রহণ করেন। দুপুর ১ টার দিকে মরদেহের ময়নাতদন্ত করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রভাষক ফারহানা ইয়াসমিন। তিনি সারাহর মরদেহের একাধিক টিস্যু সংগ্রহ করেন।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর পুলিশ তার মৃত্যুর কারণ জানাতে পারবে বলে জানা গেছে। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, দুই বোনের মধ্যে সারাহ ছিলেন ছোট। জানাজা শেষে তাকে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলায় কৃষ্ণপুর এলাকায় দাফন করা হবে।
হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম খবরের কাগজকে জানান, হাতিরঝিল লেকের পানিতে এক নারীর নিথর দেহ ভাসছিল। পথচারীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।