সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায় কার্যকর করা হয়েছে। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্য পদগুলো সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হবে। এতে কোটাসংক্রান্ত ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর জারি করা প্রজ্ঞাপনসহ আগের সব পরিপত্র, প্রজ্ঞাপন, আদেশ, নির্দেশ ও অনুশাসন বাতিল করা হয়। প্রজ্ঞাপনটি অবিলম্বে কার্যকর করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপন জারির পর বেলা আড়াইটায় গুলশানে নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রজ্ঞাপনটির বিস্তারিত তুলে ধরেন। তার সঙ্গে ছিলেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. এ আরাফাত, জনপ্রশাসন সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী এবং আইন ও বিচার বিভাগের সচিব গোলাম সারওয়ার।
সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালত সংস্কারের যে রায় দিয়েছেন তা সম্পূর্ণ প্রতিপালন করা হয়েছে। আপিল বিভাগের রায়ের একটা দাড়ি, কমা, সেমিকোলন বদলানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। যেহেতু সেটা নেই, সেহেতু তারা (আদালত) যে রায় দিয়েছেন সেভাবেই আমরা প্রতিপালন করেছি। এই প্রজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপনসহ আগের সব প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়েছে।’
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘কোটা আন্দোলনের ঘটনায় আগে যে সহিংসতা হয়েছে তা তদন্তের জন্য এক সদস্যবিশিষ্ট বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি কাজ শুরু করেছেন। পরিস্থিতি একটু শান্ত হলেই তিনি স্পটগুলো ঘুরে দেখবেন। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে যেসব সাধারণ ছাত্রছাত্রী আহত হয়েছেন, তাদের চিকিৎসার ব্যাপারে সরকার দেখভাল করবে। সাধারণ শিক্ষার্থী যারা কোটাবিরোধী শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছিলেন তাদের বিরুদ্ধে মামলার ব্যাপারে তথ্য পেলে তা প্রত্যাহারের বিষয়টি আমরা অবশ্যই দেখব। সরকার শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে এবং সব ছাত্রছাত্রীর সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘প্রথমে ছিল কোটা সংস্কার চেয়ে আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের চাওয়া বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এখন শিক্ষার্থীদের উচিত নিজ নিজ জায়গায় ফিরে গিয়ে পড়াশোনা শুরু করা। এটা তাদের কাছে আমার আহ্বান।’
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী সব গ্রেডে নিয়োগ: আইনমন্ত্রী বলেছেন, সর্বোচ্চ আদালত এখানে পরিষ্কারভাবে চারটা ক্যাটাগরিতে সব গ্রেডে নির্ধারিত কোটা নিশ্চিত করে দিয়েছেন। এটা সর্বোচ্চ আদালতের রায়। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই এবং এর বাইরে যাওয়ার সরকারের কোনো অভিপ্রায়ও নেই।
বিসিএসসহ অন্যান্য নিয়োগ: আইনমন্ত্রী বলেন, ৩১ জুলাই যে পরীক্ষাটা আছে এবং পরবর্তী সব নিয়োগই এই প্রজ্ঞাপনের আলোকেই বিবেচনা করতে হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখবে।
নারী কোটা ও অন্যান্য বিষয়ে ভবিষ্যতে সংশোধন: আইনমন্ত্রী বলেন, সর্বোচ্চ আদালত অত্যন্ত বিচক্ষণ রায় দিয়েছেন। এটা সুদূরপ্রসারী। সর্বোচ্চ আদালত যদি শুধু রায়ের কার্যকারিতা এখানেই শেষ করে দিতেন, তা হলে এটা বদলানোর প্রয়োজন হলে আবার রিভিউ (পুনর্বিবেচনার আবেদন) করতে হতো। কারণ এটা সর্বোচ্চ আদালত। ততদিনে রিভিউয়ের সময়ও শেষ হয়ে যেত। সে জন্য সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, ‘ভবিষ্যতের কথাই ওনারা বলেছেন, সেই ভবিষ্যতে যদি প্রয়োজন হয়, তখন দেখা যাবে। আদালত সরকারের পলিসি ম্যাটারে হাত দিতে চাননি। সরকারের কখনো যদি মনে হয়, এটা বাতিল, পরিবর্তন, কমানো বা বাড়ানো প্রয়োজন তখন সেটা করা যাবে। এ জন্য আর কোর্টে যেতে হবে না। এখন সেটা করা হচ্ছে না তার কারণ হচ্ছে, সর্বোচ্চ আদালত যে রায়টা দিয়েছেন সেটাতে হাত দিলে আইনের শাসনের প্রতি মারাত্মক হাত দেওয়া হবে। সে জন্য এটা আমরা করব না।’
প্রজ্ঞাপনের প্রেক্ষাপট বর্ণনায় আইনমন্ত্রী বলেন, ২০১৮ সালে একটা পরিপত্রের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এই কোটা বাতিল করেন। এর পর মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন সন্তান হাইকোর্টে একটা রিট পিটিশন দায়ের করেন। রিটের শুনানি হওয়ার পর হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ রায় দেন, সেই রায়ে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ও বাতিল করেন। কোটা বাতিলের পক্ষে রায় প্রকাশের পর তিন দিনের মধ্যে আপিল বিভাগে আপিল করে সরকার। আপিল করার আগেই যদিও কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা হাইকোর্টে যখন মামলাটির শুনানি হয় কোনো পক্ষভুক্ত হয়নি। সরকার যখন আপিল করে তখনো তারা পক্ষভুক্ত হয়নি। সেই ক্ষেত্রে যখন আপিলটি আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চে পাঠানো হয় সেইটাকে ‘শুনবে’ বলে একটা তারিখ দেন। তখন আন্দোলনকারীরা এই আপিল শুনানির আগে একটা পক্ষভুক্ত হন। তাদের পক্ষভুক্তের দরখাস্তের ওপরে যখন শুনানি হয় তখন আপিল বিভাগ একটা আদেশ দেন। সেই আদেশে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলেন যে, স্ট্যাটাস কো-মেইনটেইন করতে হবে। আরও বলেন যে, হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে কোটা বাতিল করার পরিপত্র বাতিলের যে আদেশ দিয়েছিলেন সেটা অকার্যকর থাকবে, যতদিন পর্যন্ত আপিল বিভাগের এই শুনানি না হবে। তার মানে হচ্ছে, সেই দিন থেকে বাংলাদেশে কোটা ছিল না। এবং তারিখ নির্ধারণ করেন যে, ৭ আগস্ট এই মামলার শুনানি হবে।
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন একদিকে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা যখন আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল এর সুযোগ নিয়ে কিছু মহল এই আন্দোলনকে অন্য দিকে প্রবাহিত করার জন্য সহিংসতা অবলম্বন করেন। একপর্যায়ে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা বলেন যে, তারা আন্দোলন চালানোর পাশাপাশি আলোচনায় বসতে চান। আমি প্রধানমন্ত্রীর আদেশে বলি যে, যখনই তারা বসতে চায় আমরা রাজি আছি। সেই সংবাদ সম্মেলনে আমি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলি, কোটাবিরোধী আন্দোলনের যে মামলাটা আপিল বিভাগে ৭ আগস্ট শুনানি আছে, সেটা এগিয়ে আনতে আমরা ব্যবস্থা করব। সেই দিনই অ্যাটর্নি জেনারেল দরখাস্ত করলে আপিল বিভাগ মামলাটা এগিয়ে এনে ২১ জুলাই শুনানির দিন ধার্য করেন। আপিল বিভাগ ২১ জুলাই এই মামলার শুনানি করেন এবং একটা সবিস্তারিত রায় দেন। সেখানে আপিল বিভাগ সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে তারা কোটার ব্যাপারে একটা নির্দেশনাও দেন।’ প্রজ্ঞাপন জারির পর গেজেট নোটিফিকেশন প্রায় হয়ে গেছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, এটা পরিষ্কার হয়েছে- এই আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এতে জঙ্গি, বিএনপি-জামায়াত, ইসলামী ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা এক হয়ে এই আন্দোলনে সংযুক্ত হয়ে দেশ নষ্ট করার চেষ্টা করেছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সমস্যা যেহেতু সমাধান করে দিয়েছি, সেহেতু আমাদের বিশ্বাস যে নতুন করে কোনো সমস্যা তৈরি করা হবে না এবং পরিস্থিতির অবনতি হবে না। তবে যদি কোনো অপশক্তি পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করে সেটার ব্যাপারে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব। আমরা ধৈর্য ধরেছি, কারণ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা চেয়েছি এবং এখনো চাচ্ছি এই কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বাড়ি ফিরে যাক। এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করার মতো যথেষ্ট সক্ষমতা সরকারের আছে।’ কারফিউ প্রত্যাহার কবে নাগাদ হতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, জনজীবনে স্বস্তি ফিরে এলেই কারফিউ প্রত্যাহার হবে। জনজীবনে স্বস্তি ফিরে আসছে তার ফলশ্রুতিতে কারফিউর বিরতি বাড়ানো হচ্ছে। আস্তে আস্তে যতই জনজীবনে স্বস্তি ফিরে আসছে, ততই কারফিউর মেয়াদ কমিয়ে আনা হচ্ছে।
পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থীর প্রকৃত সংখ্যা বের করা হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তথাকথিত আন্দোলনে কতটুকু অংশে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল এবং কোন কোন জায়গায় শিক্ষার্থী ছিলেন, শিক্ষার্থীদের পেছনে কারা ছিলেন সেটা আগে নিরূপণ করতে হবে। আর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ধার্য করার জন্য আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলার পর এবং তার আগেই একটা অ্যাসেসমেন্ট করা হচ্ছে। এখন যেটা দেখছি, সেটা হলো কিছুটা আছে তথ্য, কিছুটা আছে অপতথ্য, আর কিছুটা গুজব। তথ্যের যে বিভ্রাট সেটাকে ব্যবহার করেই জনমনে সার্বক্ষণিক এক ধরনের আবেগ, উত্তেজনা বা সেটাকে ব্যবহার করে নাশকতামূলক কাজগুলোর ক্ষেত্রে জাস্টিফিকেশন করা হচ্ছে। সুতরাং এই পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়ার পরেই আমাদের পক্ষে সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হবে আসলে কারা কারা শিক্ষার্থী ছিলেন এবং শিক্ষার্থী কোন কোন প্রতিষ্ঠানের ছিলেন। সেটা এই মুহূর্তে নিরূপণ করা খুবই কঠিন।’