ঢাকা ৩১ ভাদ্র ১৪৩১, রোববার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রং-রেখায়, পারফরম্যান্সে হত্যার প্রতিবাদ

প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৪, ১০:১৯ এএম
আপডেট: ০৩ আগস্ট ২০২৪, ১০:২৫ এএম
রং-রেখায়, পারফরম্যান্সে হত্যার প্রতিবাদ
ছবি: খবরের কাগজ

প্রতিবাদে মুখর তরুণের নিস্তব্ধ দেহ পড়ে আছে সড়কে; পাশে সাঁজোয়া যান। সিঁড়িঘরে গুলিবিদ্ধ শিশু, উনুনের পাশে রক্তাক্ত গৃহিণী। নগরীর অলিগলিতে এখন নিদারুণ আর্তনাদ; স্বজন হারানো মানুষের বিলাপে ভারী পদ্মাপারের গ্রাম। স্বজন হারানো মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে; সচকিত প্রতিবাদে শাসকের বিরুদ্ধে স্লোগান তোলে মুহুর্মুহু। শিল্পীরাও সেই প্রতিবাদে শামিল হন। প্রতিবাদী পঙ্ক্তিতে কবি ফুটিয়ে তোলেন বিক্ষুব্ধ সময়ের ইতিহাস। বৃষ্টিভেজা শহর জেগে ওঠে প্রতিবাদী গণসংগীতে। ক্যানভাসে, গানে, কথায়, কবিতায় হত্যার প্রতিবাদ করেছেন শিল্পী, কবি, সংস্কৃতিকর্মীরা।

শুক্রবার (২ আগস্ট) ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে আবাহনী মাঠের সামনে প্রতিরোধী শিল্পীদের এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়। তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও এই আয়োজনে শামিল হন দৃশ্যশিল্পী, আলোকচিত্রশিল্পী, পারফরম্যান্স-শিল্পী, সংগীতশিল্পী, কবি, লেখক, গবেষক, স্থপতি, শিল্প সংগঠকরা। সহিংসতায় নিহতদের মর্মন্তুদ আর্তনাদ নিয়ে দীর্ঘ ক্যানভাসে লাল রঙের প্রতিবাদী ছবি আঁকেন শিল্পীরা। এরপর ‘আস্থা-অনাস্থা’ শিরোনামে পারফরমিং আর্ট পরিবেশন করেন শিল্পীরা; এই পারফরম্যান্সে ফুটে ওঠে নিদারুণ হাহাকার। 

মাইকে কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবি ও আন্দোলনের বিষয়টি বর্ণনা করেন একজন শিল্পী। শিল্পীরা সড়কের ওপরে মিছিলের আবহ সৃষ্টি করেন, তুলে ধরা হয় গুলিবর্ষণের ঘটনা। লাল রঙে রঞ্জিত হয়ে ওঠে শিল্পীদের শরীর। তখন ঝুম বৃষ্টি লাল রং শরীর বেয়ে নেমে আসে রাজপথে। এরপর মাইকে গুলিতে নিহত আবু সাঈদসহ একেক জন নিহত মানুষের নাম ডাকা হতে থাকে। আর অংশগ্রহণকারীরা ‘উপস্থিত’ বলে সাড়া দিতে থাকেন। নাম না জানাদের জন্য বলা হয়েছে ‘অজ্ঞাত’। শিল্পীদের সঙ্গে জনতাও ‘উপস্থিত’ বলে সাড়া দিয়েছেন। এ সময় উপস্থিত বেশ কজন নারী কান্নায় ভেঙে পড়েন।

পারফরমিং আর্ট পরিবেশন ছাড়াও শিল্পীরা উদ্দীপনাময় গণসংগীত ও আবৃত্তি পরিবেশন করেন। আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্য ‘জনতায় আস্থা, স্বৈরাচারে অনাস্থা’ এই স্লোগানসহ ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’ এমন বিভিন্ন স্লোগানে এলাকা মুখর করে তোলা হয়।

পারফরম্যান্সে অংশ নেন অসিত রায়, নুজহাত তাবাসসুম, আয়মান, আনন, জোহান, সাজন, জাহিদ ইসলাম, জাকির হোসেন, সোহেলী, আফসানা শারমিন, অপূর্ব, অনিকা, আদৃতা, অহর্নিশ, শেহজাদ চৌধুরীসহ অনেকে।

সমাবেশে নিহত মানুষের সঠিক সংখ্যা প্রকাশ, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হত্যাকাণ্ডের তদন্ত, বিচারের দাবি করা হয়। হত্যাকাণ্ডের দায় নিয়ে সরকারের পদত্যাগের দাবি তোলেন তারা। 

গান, আবৃত্তি, স্লোগান, ঘোষণা পাঠের মাঝে বক্তব্য দিয়েছেন বিশিষ্ট নাগরিকরা। নারীনেত্রী ফরিদা আক্তার, বেসরকারি সংস্থা ব্রতী ও উত্তরসূরির কর্ণধার শারমিন মুর্শিদ, লেখক রেহেনুমা আহমেদ, কবি সাখাওয়াত টিপু, অভিনেত্রী সুমনা সোমা বক্তৃতা করেন। আয়োজকদের পক্ষে সমাবেশের বিবৃতিপত্র পাঠ করেন কবি অরূপ রাহী। বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানাও এই সমাবেশে অংশ নেন। 

আয়োজনে সমাপনী বক্তব্যে আহ্বায়ক শিল্পী মোস্তফা জামান বলেন, ‘শিল্পীসমাজ চলমান রাষ্ট্রীয় অনাচার, অবিচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কর্তব্য মনে করে এই সমাবেশের আয়োজন করেছে। বহু বছর ধরে দেশে গণতান্ত্রিক পরিসর অনুপস্থিত। গণমানুষ রাজনৈতিক অধিকার হারিয়েছে, ভোটাধিকার বঞ্চিত হয়েছে। নিবর্তনমূলক আইনের মাধ্যমে মতপ্রকাশের অধিকার রুদ্ধ করা হয়েছে। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে যখন ছাত্রদের কোটা সংস্কারের দাবি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছে এবং তা দমনের নামে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চলেছে, তখন শিল্পীসমাজ ছাত্র-জনতার সঙ্গে সংহতি জানাতে পথে নেমেছে। এই আন্দোলন চলবে।’

বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বললেই রাজাকার
দেশে সাধারণ মানুষদের কেউ ন্যায্য অধিকার বা গণতন্ত্র নিয়ে কথা বললে সরকার তাকে ‘রাজাকার’ ট্যাগ দেয় বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে। গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত উদীচী আয়োজিত সাংস্কৃতিক সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন। 

অমিত দে বলেন, ‘যখনই মানুষ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে, তখনই কোনো না কোনো ইস্যুকে সামনে এনে মানুষের মনোযোগ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চালায় সরকার ও ক্ষমতাসীন দল। বারবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে সরকার মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করছে।’

উদীচীর সমাবেশস্থলের সামনে সহিংসতায় নিহতদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একটি প্রতীকী কফিন রাখা হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান। বক্তৃতা করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহসভাপতি মাহমুদ সেলিম, প্রবীর সরদার, জামসেদ আনোয়ার তপন, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের সাধারণ সম্পাদক প্রণয় সাহা, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন, যুব ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম নান্নু প্রমুখ। 

বক্তারা বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো একটি শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলনকে দমন করতে গিয়ে নজিরবিহীন দমন-পীড়ন, নির্বিচারে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করেছে রাষ্ট্র। প্রথমে ছাত্রলীগ এবং পরে পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি ও সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করে নির্বিচারে দুই শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের দায় কোনোভাবেই সরকার এড়াতে পারে না। 

লেখক-সাহিত্যিকরাও শামিল হলেন প্রতিবাদে 
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সারা দেশের হত্যা ও সহিংসতার প্রতিবাদে গতকাল বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে ‘কবি-লেখক সমাজ’। এ আয়োজনে যোগ দেন গীতিকার শহীদুল্লাহ্ ফরায়েজী, অধ্যাপক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, কবি টোকন ঠাকুর, সাদাত হোসাইন, কিংকর আহসান, কবি ইমরান মাহফুজ, কবি মাহফুজা অনন্যাসহ আরও অনেকে। 

কথাসাহিত্যিক সাদাত হোসাইন বলেন, ‘যে চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, যে স্বাধীনতার স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমরা নাগরিক অধিকার নিয়ে বসবাস করতে চেয়েছিলাম, তা ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে, গেছে। এখন আমরা এমন এক স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশে বাস করি, যেখানে কথা বলতে ভয় পাই, লিখতে ভয় পাই, আমাদের দাবি জানাতে ভয় পাই। এই গণতন্ত্রে শাসকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যাবে না। তাদের সমালোচনা করা যাবে না। এ কেমন স্বাধীনতা?’

রাওয়ার সেমিনারে বক্তারা ‘শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন’

প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩৭ পিএম
আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:০৭ পিএম
‘শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন’
গতকাল রাজধানীর মহাখালীতে রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (রাওয়া) উন্মুক্ত আলোচনা সভায় বক্তৃতা রাখেন বক্তারা। ছবি: খবরের কাগজ

সেনাবাহিনীকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে পুলিশকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছিলেন সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সেনাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী আগস্ট মাসে বিপ্লবী জনতার পাশে দাঁড়িয়ে আবারও প্রমাণ করেছেন তারা দেশ ও জনগণের পক্ষে।

শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) সকালে রাজধানীর মহাখালীতে রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনে (রাওয়া) গত ‘জুলাই ও আগস্ট মাসে বিপ্লবে সশস্ত্র বাহিনীর অবদান এবং বিপ্লবোত্তর ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া) ও রাওয়া রিসার্চ অ্যান্ড স্টাডি ফোরাম এই দুই সংগঠন এ সেমিনারের আয়োজন করে।

সেমিনার শেষে উন্মুক্ত আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা তাদের মতামত তুলে ধরেন। এ ছাড়া গত ১৫ বছরে যেসব কর্মকর্তা সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন তারা আলোচনায় যুক্ত হন।

আলোচনায় চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহালসহ যে সেনা অফিসার দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন ও শেখ হাসিনার সরকারের অবৈধ কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করেছেন তাদের বিচারের দাবি জানানো হয়।

সেমিনারে অতিথি বক্তা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘৫ আগস্টের পর দেশের মানুষ নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। অনেক মানুষের বুক থেকে পাথর নেমে গেছে। এই স্বপ্ন যারা দেখাল- তারা কারা? তারা হচ্ছে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা। তাদের ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে আমরা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছি।’

তিনি আরও বলেন, আগস্টে ছাত্র-জনতার এই বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। কুচক্রী মহল পুলিশকে বিভিন্নভাবে উসকানি দিয়ে তাদের কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছে, যাতে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। তারা আনসার সদস্যদের উসকানি দিয়েছে, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীরা ডাক্তারদের মাঠে নামিয়ে চিকিৎসাসেবা থেকে সবাইকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করেছে। তারা এখন দেখছি, বিদ্যুৎ নিয়ে খেলা শুরু করেছে। তাদের সব ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে।

অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদুজ্জামান বলেন, স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা জঙ্গি কায়দায় দেশ পরিচালনা করেছেন। তিনি নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। জনগণের সব অধিকার হরণ করেছিলেন, শুধু ক্ষমতায় থাকার জন্য। কিন্তু ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মুখে তিনি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।

অতিথি বক্তা ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘দেশের কিছু সুশীল সমাজের বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন, এত টাকা দিয়ে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর লালন-পালনের দরকার নেই। আমি তাদের বলব, তারা এখনো সেনা