দরিদ্র পরিবারে জন্ম আশরাফুলের। বাবার দুই বিয়েতে সংসারে টানাপোড়েনে সমবয়সীরা যখন বড় হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে লেখাপড়া করে তখন আশরাফুল কচি হাতে হাতুড়ি, বাটাল নিয়ে শুরু করে জীবনসংগ্রাম। ১৩ বছর বয়সে কাঠমিস্ত্রির কাজে যোগ দেয়। কাঁধে নেয় পরিবার চালানোর দায়িত্ব। চার ভাইবোনের লেখাপড়া, চিকিৎসা ও সংসার চালানোর ব্যয়- এ সবকিছুর দায়িত্ব ছিল আশরাফুলের ওপরেই।
এই সংগ্রামের মাঝেই সবার মুখে মুখে শুনে আর টেলিভিশনে সংবাদ দেখে আশরাফুল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন সম্পর্কে জানতে পারে। জানতে পারে, বৈষম্য নিরসনের দাবিতে তরুণ ছাত্ররা রাজপথে প্রাণ দিচ্ছেন। রক্ত গরম হয়ে যায় আশরাফুলের। হাতুড়ি, বাটাল রেখে নিজের কর্মস্থল থেকে বন্ধুদের সঙ্গে ছাত্র-জনতার মিছিলে যোগ দেয় আশরাফুল। আরিফ নামে এক বন্ধু মিছিল থেকে ফেরত আসার অনুরোধ করেছিল তাকে। কিন্তু আশরাফুল ফেরেনি। একসময় পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় আশরাফুলের। শোকের ছায়া নেমে আসে তার দরিদ্র পরিবারে। অবশ্য এখন শোককে শক্তিতে পরিণত করে আশরাফুলের স্বপ্ন পূরণে নতুন করে প্রতিজ্ঞা নিয়েছে শোকবিহ্বল পরিবারটি।
আশরাফুল (১৭) হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় জাতুকর্ণপাড়া ডুগিহাটির আব্দুর রউফ ও মাহমুদা বেগমের ছেলে। বানিয়াচংয়ের গ্যানিংগঞ্জ বাজারে একটি ফার্নিচারের দোকানে মাসিক ১২ হাজার টাকা বেতনে কাজ করত। আশরাফুলরা দুই ভাই ও চার বোন। এর মধ্যে আশরাফুল চতুর্থ। বড় বোন লুবনা আক্তারের বিয়ে হয়েছে। এর পরের জন রোজমা আক্তার শায়েস্তাগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে ও তৃতীয় বোন তাইমা আক্তার হবিগঞ্জ শহরের বৃন্দাবন সরকারি কলেজে স্নাতকে লেখাপড়া করছেন। আশরাফুলের ছোট বোন তৈয়বা আক্তার দশম শ্রেণি ও সবার ছোট আব্দুর রকিব অষ্টম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। তাদের সবার লেখাপড়া, চিকিৎসা ও সংসার চালানোর ব্যয় নির্বাহ হতো আশরাফুলের রোজগার দিয়েই।
আশরাফুলের মা মাহমুদা বেগম জানান, আশরাফুল প্রতিদিন সকালে কাজে গিয়ে রাতে বাড়ি ফিরত। গত ৫ আগস্টও রোজকার মতো বের হয়েছিল। পরে কর্মস্থল থেকে বন্ধুদের সঙ্গে ছাত্র-জনতার মিছিলে যোগ দেয়। এরপর গুলিতে তার মৃত্যু হয়।
আশরাফুলের বাবা দ্বিতীয় সংসার করছেন। তার পক্ষে সব ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছে না বলেই অপরিণত বয়সের আশরাফুলই শ্রমঘামে তার পাঁচ ভাইবোনকে আগলে রেখেছিল। তার চলে যাওয়ায় পাঁচ ভাইবোনের লেখাপড়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
মাহমুদা বেগম ছেলের হত্যাকাণ্ডের বিচার ও তাকে শহিদের মর্যাদা দিতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। মাহমুদা বেগম বলেন, ‘পাড়ার মানুষ কয়- কেল্লাইগ্যা পোলারে মিছিলে ফাডাইছলায়? আমি তারারে কইয়্যা দিছি- আমার পোলা শহিদ অইছে।’
তিনি আরও বলেন ‘আশরাফুল যাওয়ার সময় কইয়্যা গেছে, রাইতে আমার লাগি লাকড়ি আর জিয়ল মাছ (শিং, মাগুর) লইয়্যা বাড়িত আইব। এরপরে খবর ফাইলাম পোলা আমার গুলি খাইয়্যা মারা গেছে।’ আশরাফুলের ছোট বোন তৈয়বা আক্তার বলে, ‘আমার ভাই আমাদের মাথার ওপরে ছায়া ছিল। আমরা তার হত্যার বিচার চাই।’
বানিয়াচংয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমন্বয়ক ডি এইচ রাজু বলেন, “আশরাফুলের পরিবার অতিশয় দরিদ্র। সে ‘শহিদ’ হওয়ায় পুরো পরিবার এখন অকুল পাথারে পড়েছে।” তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকার ও সমাজে বিত্তবানদের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানান তিনি।
গত ৫ আগস্ট বেলা ১১টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা সাগরদীঘির পশ্চিমপাড় ঈদগাহ মাঠ থেকে মিছিল বের করে। গ্যানিংগঞ্জ বাজার প্রদক্ষিণ শেষে মিছিলকারী ৪ থেকে ৫ হাজার লোক বড় বাজার শহিদ মিনারে গিয়ে জড়ো হন। পরে বিক্ষুব্ধ লোকজন মিছিল নিয়ে থানার সামনে গেলে পুলিশের সঙ্গে তাদের কথা-কাটাকাটি হয়। আন্দোলনকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। ঘটনার সময় পুলিশ রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলে চারজনসহ সাতজন নিহত হন।
পরে একজন সাংবাদিক ও বানিয়াচং থানার এসআই সন্তোষের মৃত্যু হয় এই আন্দোলনে। পরদিন গুলিবিদ্ধ আরেকজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সূত্র: বাসস