সিলেটে একদিকে তীব্র গরম অপরদিকে দিনে রাতে ১০ থেকে ১২ ঘন্টা লোডশেডিং। ভাদ্র মাসের অসহনীয় নগরীর বাসিন্দাদের দুর্ভোগের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে এই লোডশেডিং। কিন্তু এই লোডশেডিং সমস্যার কোনো সমাধান দিতে পারছে না সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড।
সিলেট নগরীর একাদিক বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সিলেটের এই লোডশেডিংয়ে স্থানীয় বিদ্যুৎ বিভাগের কোনো হাত নেই। কারণ গ্রিড পর্যায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টার (এনএলডিসি) থেকে। এই এনএলডিসি থেকে যে বরাদ্দ দেওয়া হয় এটা সঠিক নয়। কারণ যখন বিদ্যুতের চাহিদা পরিমাপ করা হয় তখন এনএলডিসি থেকে বলা হয়, কোনো কিছু বন্ধ করা যাবে না। এই চালু অবস্থায় যখন লোড পরিমাপ করে তখন সর্বোচ্চ চাহিদা ৩০ শতাংশ কম থাকে। কারণ তখন গ্রাহকদের ফ্রিজ, আইপিএস, ব্যাকআপ লাইট, চার্জিং ফ্যান লোড নেয় না। কিন্তু যখন বিদ্যুৎ থাকে না তখন আইপিএস, ফ্রিজ, চার্জিং লাইট ফ্যান লোড নেবে। যার ফলে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বিদ্যুতের চাহিদা ৩০ থেকে ৪০ মেগাওয়াট বেড়ে যায়। কিন্তু এনএলডিসি বিদ্যুৎ বরাদ্দ দেয় স্বাভাবিক সময়ের অনুপাতে। যার ফলে লোডশেডিং হয়ে যায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। কিন্তু কাগজে পত্রে এনএলডিসি দেখায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ লোডশেডিং।
অপরদিকে ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টারের (এনএলডিসি) সারাদেশের জোনভিত্তিক বিদ্যুতের চাহিদা, সরবরাহ এবং লোডশেড শিটে দেখা যায়, সারাদেশের নয়টি জোনের মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে কোনো লোডশেডিং দেয় না এনএলডিসি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সিলেটসহ কয়েকটি জোনে স্থানীয় ঘাটতি দেখিয়ে চাহিদার তুলনায় কম বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।
গত ৪ সেপ্টেম্বরের এনএলডিসির সারাদেশের জোনভিত্তিক বিদ্যুতের চাহিদা, সরবরাহ এবং লোডশেড শিটে দেখা যায়, ঢাকা জোনের বিদ্যুতের চাহিদা দেওয়া হয়েছে ১২২৩.৯ মেগাওয়াট। এই চাহিদার প্রেক্ষিতে এনএলডিসি ঢাকা জোনে বিদ্যুৎ সরবরাহ দিয়েছে ১২২৪ মেগাওয়াট। চট্টগ্রাম জোনের বিদ্যুতের চাহিদা দেওয়া হয়েছে ৮৮২.০ মেগাওয়াট। এই চাহিদার প্রেক্ষিতে এনএলডিসি চট্টগ্রাম জোনে বিদ্যুৎ সরবরাহ দিয়েছে ৮৮২ মেগাওয়াট।
পক্ষান্তরে ওইদিন সিলেট জোনে বিদ্যুতের চাহিদা দেওয়া হয় ২১৫.৪ মেগাওয়াট। এই চাহিদার প্রেক্ষিতে এনএলডিসি সিলেট জোনে বিদ্যুৎ সরবরাহ দিয়েছে ১৭৮ মেগাওয়াট। এবং স্থানীয় ঘাটতি দেখিয়ে সিলেটে ৩৭.৪ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে বলা হয়।
এনএলডিসি এর এই বৈষম্যমূলক লোড বরাদ্দ দেওয়া প্রায় বছর দেড়েক ধরে চলছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম থেকে তুলনামূলক অনেক কম চাহিদা থাকার পরও অদৃশ্য কারণে সিলেটে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ বরাদ্দ দিচ্ছে না এনএলডিসি। একদিকে তাদের সঠিক লোড পরিমাপ না করা এবং ক্রটিপূণভাবে যে লোডের চাহিদা নেওয়া হয় সেটাও পুরোপুরি না দেওয়ায় সিলেট জোনের বাসিন্দাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) সূত্রে জানা যায়, সিলেট বিভাগে পল্লী বিদ্যুৎ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের গ্রাহক রয়েছেন প্রায় ২৬ লাখ। ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টার থেকে চাহিদার থেকে কম বিদ্যুৎ সরবরাহ করলে পিক আওয়ারে লোডশেডিং করা হয়। দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ধরা হয় ডে-পিক আওয়ার। বিকাল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্তও থাকে পিক আওয়ার।
এদিকে এই পিক আওয়ারের হিসেবে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ না পেলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে কমপক্ষে ১১ ঘন্টা লোডশেডিং করতে হয় সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের। অপরদিকে প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে গ্রাহকরা ক্ষিপ্ত হন স্থানীয় বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে।
অনেক সময় দায়িত্বরত প্রকৌশলী, অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীদের মারধরও করেন ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা। অনেকেই আবার ফোন করে অশ্লীল ভাষায় গালাগালিও করেন বলে জানান সিলেটের বিভিন্ন বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) সিলেট বিতরণ বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শামস-ই আরেফিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই লোড মেনেজন্টে করে এনএলডিসি। তারা আমাদের বলে আজ লোড মাপা হবে। আজ কোনো লাইন বন্ধ করবেন না। সব চালু থাকবে। কিন্তু আমাদের বক্তব্য ছিল মিটারে ইতোমধ্যে সর্বোচ্চ লোড রেকর্ড হওয়া আছে। আপনার এই ডিমান্ড থেকে লোড দেন। কিন্তু তারা এটা থেকে নেয় না। মনে করেন আপনার বাসায় সারাদিন বিদ্যুৎ থাকলে বাসার এসি, ফ্রিজ, আইপিএস, লাইট ফ্যান সব চার্জ হয়ে থাকবে। তখন তারা কোনো লোড নেবে না। কিন্তু যখন বিদ্যুৎ থাকবে না তখন এসব বিদ্যুৎ নেওয়া শুরু করবে। তাহলেতো চাহিদা বেড়ে যাবে। ওই গ্যাপটা কারো নজরে আসতেছে না। আমরা চাচ্ছি সিলেটে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াতে। আমরা আগেও এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। মন্ত্রণালয়ের অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি যারা ভিজিট করতে আসে তাদের মিটিং, ডিসি অফিসের মিটিংয়েও আমি এই লোড বরাদ্দের বিষয়টা নিয়ে বলেছি কিন্তু তৎকালীন ডিসি সাহেব ধমক দিয়ে আমাকে চুপ করিয়ে দেন। উনি বলতেন বিদ্যুৎ নিয়ে কোনো কথা বলবেন না। বেশি বিদ্যুৎ পাচ্ছে সিলেট।’
এ ব্যাপারে সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল কাদির খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিদ্যুতের লোড ম্যানেজমেন্ট আমাদের হাতে নেই। দীর্ঘদিন ধরে আমরা আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়টা বুঝানোর চেষ্টা করছি। আমরা আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে অবগতও করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। অথচ এই লোডশেডিংয়ে আমাদের কোনো হাত নেই। তারপরও জনগণের ক্ষোভের শিকার আমরাই হই।’
সিলেটে বিদ্যুতের লোড বরাদ্দে বৈষম্যের ব্যাপারে পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশের সিস্টেম অপারেশন অফিসের প্রধান প্রকৌশলী ও ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টারের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বি এম মিজানুল হাসান খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত দুদিন থেকে আমরা ঢাকাতেও লোডশেড দিচ্ছি। যেহেতু এখন আমাদের বিদ্যুতের ক্রাইসিস বেড়েছে সেজন্য সব জোনে লোডশেড সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য ঢাকাতেও কিছু লোডশেড দেওয়া হয়েছে।’
সারা বাংলাদেশে একই অনুপাতে লোডশেড করতে কোনো উদ্যোগ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এটাই ইমপ্লিমেন্ট করার চেষ্টা করছি। পার্সেন্টিজ অনুযায়ী লোডশেড করার পরিকল্পনা হচ্ছে। আমাদের বর্তমানে ১০ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ লোডশেডিং আছে।’
কাগজে কলমে আর গ্রাহক পর্যায়ে লোডশেডিং চিত্র ভিন্ন কেন এই প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। তিনি বলেন, সবার সহযোগিতা চাচ্ছি। এই ক্রাইসিস থাকবে না। আগামী ১৫ তারিখ পর এই ক্রাইসিস কমে যাবে।
অমিয়/