রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের প্রত্যয় ব্যক্ত করে গত মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। সংস্কার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভবিষ্যতে সমাজের সব স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণে রাষ্ট্র পরিচালনার উপায় খুঁজতে সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের সংস্কারের প্রস্তাবনা তৈরির জন্য পৃথক ৬টি কমিশন গঠন করা হয়েছে।
এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক, নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান হয়েছেন ড. বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান হয়েছেন ড. ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হয়েছেন আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী।
শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে খবরের কাগজ। এর মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা আগামী সপ্তাহের শুরুতে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করবেন এবং দেশের সার্বিক সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারা প্রবর্তন, নির্বাচনব্যবস্থা প্রণয়ন, সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাবনা দেওয়ার চেষ্টা করবেন বলে তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে।
উন্নত দেশের মতো পুলিশের প্রস্তাবই দেব: সফর রাজ হোসেন, সাবেক সচিব
আমি তো এখনো কোনো চিঠি পাইনি। এখনো কমিটির কার্যপ্রণালি বা টার্মস অব রেফারেন্স- কমিটিকে কী করতে হবে, কমিটিতে কারা থাকবেন, একচুয়ালি সরকার কী চায় এবং কমিটির অন্য সদস্য কারা হবেন সে সম্পর্কে এখনো অফিশিয়ালি কোনো কাগজপত্র পাইনি। আমরা ভাবব যে, আমাদের পুলিশ উন্নত দেশের মতো হবে। সে জন্যই আমরা হয়তো স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাব করব।
তবে রাজনৈতিকভাবে পুলিশকে ব্যবহার ঠেকানোর বিষয়টি হয়তো আমরা পুরোটা প্রস্তাবনায় আনতে পারব না। কারণ পুলিশের ওপর সরকারের রাজনৈতিক যে নিয়ন্ত্রণ, সেটা বোধহয় আমার টার্মস অব রেফারেন্সের মধ্যে আসবে না। সেটা হয়তো সংবিধান নিয়ে যারা কাজ করছেন (সংবিধান সংস্কার কমিশন) তারা ঠিক করতে পারেন যে, কীভাবে সরকারের সেন্ট্রালাইজ ক্ষমতাকে ডিসেন্ট্রালাইজ করা যায়।
বর্তমানে যে সংবিধান আছে, এ সংবিধান অনুযায়ী যা হবে সে রকমই চলবে। সংবিধান সংস্কার করলে তখন সে ব্যাপারটা আলাদা কিছু হবে। নির্বাহী ক্ষমতা কীভাবে ব্যবহার করা হবে সেটা তো সংবিধান বা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। আমরা হয়তো পুলিশের অর্গানোগ্রাম নিয়ে কাজ করব। আর হয়তো পুলিশ রিলেটেড যেসব আইন আছে সেগুলো নিয়ে কাজ করব।
আমার টিমে আরও পাঁচ থেকে ছয়জনকে নেওয়া হবে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে দেখা করব। আমরা হয়তো আগামী ১ অক্টোবর কমিশনের প্রথম বৈঠকে বসব। সেই বৈঠকে কর্মপরিকল্পনা ও একটি রূপরেখা তৈরি করব।
আনুষ্ঠানিক চিঠি পেলে কাজের চৌহদ্দি বোঝা যাবে: শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি
আমার কাজটা কী? তা আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো জানি না। খবরের কাগজ এবং টেলিভিশনে দেখেছি মাত্র। আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পেলে এবং কমিশনে আর যারা থাকছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে করণীয় ঠিক করা যাবে। তা ছাড়া আনুষ্ঠানিক চিঠি থেকেও হয়তো কাজের চৌহদ্দি সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে।
দায়িত্ব পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে বসেও সুপারিশমালা প্রস্তুতের কাজ এগিয়ে নেওয়া যাবে। আমি বিচার বিভাগে ছিলাম। আইনজীবী ছিলাম। পরে বিচারক হয়েছি। হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলাম, সর্বশেষ আপিল বিভাগের বিচারপতি ছিলাম। আমার ওপর যদি দায়িত্ব এসে থাকে, তাহলে নিম্ন আদালতের ব্যাপারে আরও খোঁজখবর নেব। কারণ এখন নিম্ন আদালতের সব খবর বলতে পারব না। সব মিলে সবার সঙ্গে আলোচনা করেই সুপারিশ করা যাবে।
গত দেড় দশকে বিচার বিভাগের পরিস্থিতি এখন এন্ডলেস গেমের মতো হয়ে গেছে। যে যা খুশি তা করেছে। আমি ‘সঠিক’ শব্দটা ব্যবহার করতে চাই। সঠিক বিচার কি হয়েছে? হয়নি। কারণ যিনি বিচার করেছেন, তিনি চাপে ছিলেন। যিনি বিচার করাচ্ছেন, তিনি নিজের মতো করিয়েছেন। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা তো চাকরি করেছে, খেয়েছে, ঘুমিয়েছে, পেট ভরেছে! ওই সময়ের বিচারের কথা না বলাই ভালো।
বিচারকরা যেন শিরদাঁড়া সোজা করে বিচার করতে পারেন সে বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করব। বিচারকদের কারও কাছে যেন হাত পাততে না হয়, বিচারকদের ছেলেমেয়ে অসুস্থ হলে কর্মস্থলে থাকা বিচারককে বাড়ির কথা যেন চিন্তা করতে না হয়। ছেলেমেয়ের পড়াশোনার জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে না হয়।
যখন ওকালতিতে ঢুকি, সত্তরের দশকের শুরুর দিকে, তখন থেকেই আমাদের চিন্তাভাবনায় আছে বিচার বিভাগ সরকারের অধীনে থাকলে কখনো সুষ্ঠু বিচার হবে না। এটা পরিষ্কার কথা। এ বিষয়ে মতামত থাকবে আমার।
আইনের একই বই মামলার পক্ষের লোক, বিপক্ষের লোক এবং বিচারক সবাই পড়েন। পরে একটা রায় দেন বিচারক। তবে ভিন্নমত হয় কেন? এখানেই স্বাধীনতা।
সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ সুগম করার পরিকল্পনা: বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)
নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার করার জন্য আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কমিশন গঠন করার পর এর কার্যপ্রণালি ঠিক করা হবে। আমাদের তিন মাসের সময় দেওয়া হয়েছে। আমরা ১ অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করব।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার করার মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখার জন্য করণীয় নির্ধারণ প্রধান কাজ। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ সুগম করবে। একই সঙ্গে নির্বাচন পদ্ধতিকেও পরিশীলিত করতে হবে।
পাশাপাশি নিজেদের আচরণ, রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল আচরণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও উন্নতি ঘটাতে হবে।
নির্বাচনকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
কার্যপরিধি অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার করা হবে: শাহদীন মালিক, বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান
সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বিজ্ঞপ্তি, দিকনির্দেশনা, কার্যপরিধি এখনো দেওয়া হয়নি। সরকার এ নিয়ে আমাকে কিছুই বলেনি। আমার সঙ্গে কয়জন সদস্য থাকবে, কিছুই জানি না। আর এ তো আমার একার নির্বাহী সিদ্ধান্ত না, সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এটা করতে হবে।
আগে সরকার থেকে যোগাযোগ করা হোক, কার্যপরিধি বলা হোক, কয়জন সদস্য থাকবে, এটা না হলে এই অবস্থায় আমার চিন্তার কোনো স্কোপ (সুযোগ) নেই।
আমি একটা বললাম কিন্তু সরকার অন্য জিনিস চায়, তাহলে প্রথম দিন থেকে সরকারের মুখোমুখি হয়ে তো কোনো লাভ নেই। আমি আগে জেনে নিই, তারপর জানাব।