বাংলাদেশে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার বিদ্যমান আইনে সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতা ও বিশিষ্টজনেরা। নির্বাচন কমিশনারদের দায়মুক্তির বিধানযুক্ত ২০২২ সালে প্রণীত আইনটি দ্রুত সংস্কার করে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নির্মোহ সৎ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সার্চ কমিটি ও নতুন ইসি গঠনের তাগিদ দিয়েছেন তারা। নিরপেক্ষ কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকার ছাড়া এ দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা।
শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ’ শীর্ষক এক পলিসি ডায়ালগ অনুষ্ঠানে তারা এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে আয়োজক সংস্থা ডেমোক্র্যাসি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষে নীতি প্রস্তাব তুলে ধরে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন সংস্থাটির মুখ্য পরিচালক ডা. মো আবদুল আলিম।
তিনি বলেন, ‘যেকোনো নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নির্বাচন কমিশন নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকেই শুরু হয়। সেই লক্ষ্যে ইসি নিয়োগ প্রক্রিয়া সরকারের প্রভাবমুক্ত রাখতে তিনি সংস্থাটির পক্ষ থেকে পাঁচ দফা সুপারিশ তুলে ধরেন।
সুপারিশগুলো হলো-
১. প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২ পুনর্লিখন বা একটি নতুন আইন প্রণয়ন এবং বিদ্যমান আইনটি স্থগিত করা; অনুসন্ধান কমিটি গঠন করতে হবে সরকারি এবং নাগরিক সমাজের মধ্য থেকে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় পেশাদারদের নিয়ে।
২. ইসি নিয়োগের যোগ্যতার মানদণ্ডে পেশাদারত্ব, রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা, নৈতিক সততা, পূর্ববর্তী চাকরিতে বুদ্ধিবৃত্তিক সততা, প্রয়োজনীয় যোগ্যতা-দক্ষতা, চারিত্রিক স্বাধীনতা ও শক্তি, সব নির্বাচনি অংশীজনের কাছে সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা এবং একটি বস্তুনিষ্ঠ অবস্থান বজায় রাখার সংকল্প থাকা।
৩. ইসি নিয়োগ আইনে একটি উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা এবং ব্যাপকভিত্তিক পরামর্শ গ্রহণমূলক নির্বাচন প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত থাকবে, যার মধ্যে উন্মুক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া, সাক্ষাৎকার গ্রহণ, সব স্তরে নাম প্রকাশ এবং নাগরিকদের মতামত গ্রহণের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। প্রতিটি পদক্ষেপ, কর্মকাণ্ড, যোগাযোগ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, আন্তরিক ও সহজ-সরল হতে হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়ার সব তথ্য সব পর্যায়ে জানাতে হবে।
৪. আইনে একটি উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা এবং ব্যাপকভিত্তিক পরামর্শ গ্রহণমূলক নির্বাচন প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত থাকবে, যার মধ্যে উন্মুক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রদান, সাক্ষাৎকার গ্রহণ, সব স্তরে নাম প্রকাশ এবং নাগরিকদের মতামত গ্রহণের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। প্রতিটি পদক্ষেপ, কর্মকাণ্ড, যোগাযোগ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, আন্তরিক এবং সহজ-সরল হতে হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়ার সব তথ্য সব পর্যায়ে অবহিত করতে হবে।
৫. নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এমন একটি পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে, যা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদর্শগত পার্থক্য থাকলেও একধরনের সহমত নিশ্চিত করে।
আলোচনায় সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু উল্লেখ করে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমি মনে করি বিদ্যমান আইনেও নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। কিন্তু আমরা দেখেছি কমিশনের দায়িত্বে যারা থাকেন তারা সেই ক্ষমতা সঠিক ও সৎভাবে প্রয়োগ করেন না। এ কারণে কেবল ভালো কমিশন গঠন করেই ভালো নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। তার জন্য দরকার রাজনৈতিক দলগুলোর ও সরকারের সদিচ্ছা। আর সেটার জন্য অবশ্যই নিরপেক্ষ বা অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজন। কারণ বিগত নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।’
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিটির প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘দায়মুক্তির বিধান যুক্ত করে ২০২২ সালে প্রণীত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে যে আইন, তাতে যাকে খুশি তাকে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেওয়া সম্ভব। এর ফলে আগের নির্বাচন কমিশন পোস্ট অফিসের ভূমিকা পালন করেছে, যা সংবিধানের লঙ্ঘন। রাজনৈতিক ঐকমত্য ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে তার কমিটি প্রস্তাব করবে বলেও জানান এই বিশ্লেষক।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, ‘আগামীর নির্বাচন কমিশনে তিনি নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে দেখতে চান। নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সার্চ কমিটি হতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোসহ সব স্তরের প্রতিনিধিদের মতামতের ভিত্তিতে। বিতর্কিত ২০২২ সালের ইসি গঠনের আইন বাদ দেওয়ার দাবি জানান তিনি। দলটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহকারী সম্পাদক রুমিন ফারহানা বলেন, সার্চ কমিটির মাধ্যমে পাওয়া নাম নিয়ে আবার রাজনৈতিক দলের কাছে ফিরে যেতে হবে, কারণ রাজনৈতিক দলগুলো এর সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার। কারণ যদি সরকার, দল ও রাজনৈতিক দলগুলো আন্তরিক না হয়, শুধু নিরপেক্ষ কমিশন দিয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। পরিবর্তন জরুরি।’
সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠনের পক্ষে মত দেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী। তিনি বলেন, ‘সার্চ কমিটি করার আগে প্রয়োজন বিদ্যমান আইনটি সংস্কার করা। কারণ বিদ্যমান আইনে নির্দিষ্ট দলের প্রভাব/পক্ষপাত সুযোগ রয়েছে। এমনভাবে কমিশন গঠন প্রক্রিয়া প্রণয়ন করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতেও কোনো সরকার তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে।’
আলোচনায় সাত শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধি নিয়ে সাত সদস্যের সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন গণ-অধিকার পরিষদের প্রেসিডেন্ট নুরুল হক নূর। একই সঙ্গে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও আনুপাতিক হারে নির্বাচনব্যবস্থার কথা বলেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘বিচার বিভাগকে কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন কমিশন গঠনে যুক্ত করা উচিত হবে না। সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও ছাত্র প্রতিনিধির সমন্বয়ে সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রফেসর আশরাফ আলী আকন্দ বলেন, ‘কোনো কমিশনার সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করলে তাকে আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা থাকতে হবে।’
এ ছাড়া আলোচনায় জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বক্তব্য রাখেন।
ডেমোক্র্যাসি ইন্টারন্যাশনাল আয়োজিত এই পলিসি ডায়ালগে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, এবি পার্টি, গণ-অধিকার পরিবষদ, গণফোরাম, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসহ ১০ দলের নেতারা এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। তবে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ডেমোক্র্যাসি ইন্টারন্যাশনালের চিফ অব পার্টি ডানা এল. ওল্ডস। সঞ্চালনা করেন প্রফেসর ড. রওনক জাহান।