ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। কিন্তু এই ৫ আগস্টও সরকারকে রক্ষায় পুলিশ ‘সর্বাত্মকভাবে মাঠে ছিল’। ‘মার্চ টু ঢাকা’ থামাতে বিক্ষোভকারীদের শহরের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছাতে বাধা দিতে তখনো পুলিশ অনেক জায়গায় প্রাণঘাতী গুলি চালাচ্ছিল। এদিন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, চানখাঁরপুল, শাহবাগ, রামপুরা, বাড্ডা, উত্তরার আজমপুর, সাভার ও আশুলিয়ায় পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে। সাভারে সেদিন ভ্যানভর্তি লাশ পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্দোলনরত নেতাদের প্রকাশ্য ঘোষণা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব জানতে পারেন, ৫ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রস্থলে বড় প্রতিবাদ মিছিলের পরিকল্পনা করছেন আন্দোলনকারীরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৪ আগস্ট দুই দফায় উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। বৈঠকে এই কর্মসূচি মোকাবিলার পরিকল্পনা হয়। এর একটি বৈঠক হয় সকালে। আরেকটি বৈঠক হয় সন্ধ্যার পর।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪ আগস্ট সকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। ওই বৈঠকে সেনা, বিমান, নৌ, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই, পুলিশ ও পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধানরা অংশ নেন। বৈঠকে শেখ হাসিনা সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন। তারা ‘মার্চ টু ঢাকা’ প্রতিরোধের জন্য আবার কারফিউ জারি ও তা বলবৎ করার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
একই দিন সন্ধ্যার পর প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে (গণভবন) আরেকটি বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নিজে অংশ নেন। অন্য অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসার/ভিডিপির প্রধান, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার ও সেনাবাহিনীর কোয়ার্টারমাস্টার জেনারেল। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, বৈঠকে সেনাপ্রধান ও অন্যান্য নিরাপত্তা কর্মকর্তা ঢাকা রক্ষার বিষয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন।
বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা দেয়, কোনো বিরতি ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের জন্য কঠোর কারফিউ চলবে। আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী একটি বিবৃতি দেন। তিনি দেশবাসীকে ‘এই সন্ত্রাসীদের শক্ত হাতে দমন’ করার আহ্বান জানান।
বৈঠকগুলোতে অংশ নেওয়া ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, বৈঠকে একটি পরিকল্পনার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছিল যে প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে বিক্ষোভকারীদের ঢাকার কেন্দ্রস্থলে প্রবেশে বাধা দিতে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করা হবে। সেনাবাহিনী ও বিজিবি সাঁজোয়া যান ও সেনা মোতায়েন করে ঢাকার প্রবেশের পথগুলো অবরুদ্ধ করবে, বিক্ষোভকারীদের প্রবেশে বাধা দেবে। অন্যদিকে পুলিশ ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিয়ন্ত্রণ’ করবে।
৫ আগস্ট প্রথম প্রহরে (রাত ১২টা ৫৫ মিনিট) শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের তৎকালীন মহাপরিচালক বিজিবির মহাপরিচালককে পরপর দুটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পাঠান। সেই বার্তাগুলোর হার্ডকপি পেয়েছে ওএইচসিএইচআর। হার্ডকপির তথ্য অনুসারে, প্রথমটি ছিল একটি ফরোয়ার্ড করা সম্প্রচারিত বার্তা, যা আন্দোলনের নেতাদের বলে মনে হয়। এতে তারা ঢাকায় প্রবেশের পথগুলো সম্পর্কে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বার্তাটি প্রতিরক্ষা আদেশের রূপরেখার একটি ভিডিও রয়েছে। এতে প্রতিরক্ষার প্রথম ও দ্বিতীয় লাইন, একটি তৃতীয় দূরপাল্লার ইউনিট, একটি ব্যাকআপ ইউনিট, একটি পশ্চাদভাগের বাহিনীর কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মার্চ টু ঢাকা’ থামাতে, বিক্ষোভকারীদের শহরের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছাতে বাধা দিতে তখনো পুলিশ অনেক জায়গায় বিক্ষোভকারীদের ওপর প্রাণঘাতী গুলি চালাচ্ছিল। পুলিশের একজন কমান্ডার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘ সেদিন (৫ আগস্ট) সকাল থেকেই সেনাবাহিনী জানত, শেখ হাসিনার পতন হয়ে গেছে। কিন্তু পুলিশ জানত না। তাই পুলিশ তখনো সরকারকে রক্ষা করতে সর্বাত্মকভাবে মাঠে ছিল।’
ওএইচসিএইচআর ওই দিন বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের গুলি করার ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। সব কটির ধরন ছিল একই। উদাহরণস্বরূপ, চানখাঁরপুলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তারা ও অন্যান্য পুলিশ রাইফেল থেকে প্রাণঘাতী গুলি করেছেন। শাহবাগের দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করা বিক্ষোভকারীদের থামাতে তারা কম প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, পুলিশ যাকে দেখছিল, তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল।
রামপুরা ব্রিজ পার হয়ে বাড্ডায় যাওয়ার চেষ্টাকালে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে পুলিশ ধাতব গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। এতে শিক্ষার্থী বিক্ষোভকারীরা আহত হন। ওই এলাকায় সকালে গুলিতে আহত বেশ কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
উত্তরার আজমপুরে পুলিশের গুলিতে আহত ১২ বছর বয়সী এক বালক বলেছে, পুলিশ ‘সব জায়গায় বৃষ্টির মতো গুলি চালাচ্ছিল’। কীভাবে সে ওই স্থানে অন্তত এক ডজন মৃতদেহ দেখেছিল, সেই বর্ণনা করেছিল।
৫ আগস্ট সকালে যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ ও আনসার সদস্যরা থানা ও এর কর্মকর্তাদের রক্ষায় বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করার নির্দেশ পান। তারা থানার ভেতর এবং আশপাশে অবস্থান নিয়ে বিপুলসংখ্যক বিক্ষোভকারীর ওপর প্রাণঘাতী রাইফেল ও শটগান দিয়ে গুলি চালান।
ঘটনাস্থলে মোতায়েন থাকা কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, কিছু বিক্ষোভকারী পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করছিলেন। বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী নিহত হন। বহুসংখ্যক আহত হন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন অটিস্টিক ব্যক্তিও ছিলেন, তার শরীরে দুটি গুলি লেগেছিল।
সাভার বাসস্ট্যান্ডের আশপাশে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়। এতে বিপুলসংখ্যক হতাহত হন। একজন সাংবাদিক এলাকাটির বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তারা তাকে বলেছিলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের জোর করে মোতায়েন করেছেন।
৫ আগস্ট বিকেলে বিক্ষোভকারীরা আশুলিয়া থানাকে নিশানা করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিপুলসংখ্যক জনতা থানাটি ঘেরাও করেন। পুলিশ বারবার পিছু হটার চেষ্টা করলেও তারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে অগ্রসর হতে থাকেন। জবাবে পুলিশ প্রাণঘাতী গুলিভর্তি সামরিক রাইফেল ব্যবহার করে নির্বিচার গুলি চালায়।
ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশে পুলিশ পরে গুলিবিদ্ধ মৃতদেহগুলো একটি ভ্যানে স্তূপ করে। তারা গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মনে হচ্ছিল, তারা কাজটি করেছে এই আশায় যে মৃতদেহ পোড়ানোর বিষয়টি এই মিথ্যা ধারণা তৈরি করবে যে এসব লোক আন্দোলনকারীদের হাতে নিহত হয়েছেন।