জীবন রহমান জিম। এক আত্মবিশ্বাসী তরুণ। কলেজছাত্র জীবন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেন। কিন্তু পুলিশের ছররা গুলিতে তিনি আহত হন। একটি গুলি তার ডান চোখে লাগে। গুলিটি এখনো চোখের মধ্যে রয়ে গেছে।
ঢাকার ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেটিনা বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন জীবন। চিকিৎসকরা তাকে পরামর্শ দিচ্ছেন অস্ত্রোপচারের। অর্থাভাবে জীবনের পরিবার এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। ছররা গুলিটি অপসারণ না করলে তার ডান চোখ যেকোনো সময় নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এখন চোখ নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবন ও তার পরিবার।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হিসেবে জীবনের বাবা রবিউল ইসলাম রংপুর নগরীর শান্তিনগর খামার এলাকায় ছোট্ট একটি পানের দোকান চালান। তার মা জামিলা বেগম গৃহিণী। পাঁচ সদস্যের পরিবারে আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও রবিউল ও জামিলা তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখী জীবনযাপন করছিলেন।
গত ১৯ জুলাই নগরীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে ডান চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয় জীবনের। পুলিশের গুলিতে জীবনের শরীরে অন্তত ১০টি রাবার বুলেট বিদ্ধ হয় এবং তিনি গুরুতর আহত হন।
নগরীর শান্তিনগর খামার এলাকায় আলাপকালে জীবন (২৩) বলেন, ‘তার স্বপ্ন ছিল পুলিশ কর্মকর্তা হয়ে পরিবারে দরিদ্র বাবা-মায়ের জন্য সম্মান, সুখ ও সচ্ছলতা নিয়ে আসা।’ কিন্তু দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়ার কারণে তার স্বপ্নের সঙ্গে জীবনের ঘটনাপ্রবাহগুলো মসৃণভাবে যায়নি। তার ডান চোখ এখন স্থায়ীভাবে অকার্যকর হওয়ার পথে।
রংপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (বাণিজ্য বিভাগ) পাস করার পর তিনি শহরের লালবাগ এলাকার রংপুর কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। ২০২১ সালে উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষায় (বাণিজ্য বিভাগ) পাস করার পর তিনি অনার্স কোর্সে রংপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হন। বর্তমানে তিনি সেখানে অনার্স (হিসাববিজ্ঞান) দ্বিতীয় বষের্র ছাত্র। জীবন বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। তার একমাত্র বোন রাবেয়া বাসরি (১৩) শহরের সমাজ কল্যাণ বিদ্যা বীথি গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী।
জীবন বলেন, ‘ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে জাতিকে মুক্ত করতে জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে তিনি নিয়মিতভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন। ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী শহিদ আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যার পর দেশের অন্যান্য স্থানের মতো রংপুরেও পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ রূপ নেয়।’
জীবন বলেন, ‘১৯ জুলাই বিকেল ৪টার দিকে গ্র্যান্ড হোটেল মোড়ে মিছিলে যোগ দিয়ে মিনি সুপার মার্কেট অফিস, সিটি মার্কেট ও জেলা পরিষদ কার্যালয় এলাকায় মিছিল করি। এ সময় পুলিশ মিছিলে রাবার বুলেট, টিয়ারশেল ও গুলি ছুড়তে থাকে। একসময় হরিজন সম্প্রদায়ের মন্দিরের কাছে শিশু হাসপাতালের দিকে যাই। পুলিশ তখন এলাকাটি ঘিরে ফেলে। বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে হরিজন সম্প্রদায়ের মন্দিরের সামনে অতি কাছ থেকে পুলিশ আমাকে লক্ষ্য করে অন্তত ১০টি রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এসব বুলেট আমার মাথা, হাত ও শরীরের অন্যান্য অংশে বিদ্ধ হয়। শরীর রক্তাক্ত হয়ে যায়।’
কারমাইকেল কলেজের ছাত্র আবু বকর সিদ্দিক (২৬) স্থানীয়দের সহায়তায় জীবনকে উদ্ধার করে রিকশাযোগে শাপলা চত্বর মোড়ে পাঠান। শাপলা চত্বর মোড়ে যাওয়ার সময় জীবন মাকে মোবাইল ফোনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা জানান।
দ্রুতই মা জামিলা বেগম এবং খালা ইসমত আরা আলো তাকে শহরের ধাপ মেডিকেলের পাশে ডা. আবদুল হাকিমের বাসায় নিয়ে যান। নিরাপত্তার কারণে এবং পুলিশি হয়রানি এড়াতে ডা. হাকিম জীবনকে দর্শনার প্রাইভেট সেক্টর দীপ আই কেয়ার ফাউন্ডেশনে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। পুলিশি হয়রানি এড়াতে দীপ আই কেয়ার ফাউন্ডেশনও বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। উপায় না পেয়ে জামিলা বেগম তার ছেলে জীবনকে আরপিএমসিএইচে ভর্তি করেন।
জীবন বলেন, ‘ডাক্তাররা আমার শরীর থেকে মাত্র একটি রাবার বুলেট বের করতে পারে। বাকি ৯টি গুলি ভেতরে থেকে যায়। এগুলোর মধ্যে আমি স্পষ্টতই এখন পাঁচটি ছররা অনুভব করছি। একটি ডান চোখের ভেতরে থাকায় সেখানে আমি সর্বদাই যন্ত্রণা ভোগ করছি।’
জীবনের মা জামিলা বলেন, জীবনের জন্য ওষুধ কেনা, চেকআপ করা এবং ছেলে ও মেয়ের লেখাপড়া ও প্রাইভেট টিউশনের জন্য মাসে ১৫ হাজার টাকার মতো খরচ মেটানো এখন আমাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছে।’
জীবনের বাবা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার ছেলের ডান চোখ থেকে ছররা গুলি অপসারণের জন্য পদক্ষেপ নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আকুল আহ্বান জানিয়েছেন।
জীবন বলেন, ‘আমার ডান চোখের রেটিনা গুলির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে ডাক্তাররা জানিয়েছেন। চোখটি বাঁচানোর জন্য দ্রুত অস্ত্রোপচার করা উচিত।’
চোখের চিকিৎসার বিষয়ে কথা বলতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সারজিস আলমের সঙ্গে দেখা করতে চান জীবন। কিন্তু অর্থাভাবে তিনি ঢাকায় আসতে পারছেন না বলে জানা গেছে। সূত্র: বাসস