বিদ্যমান সংবিধান সংস্কার না করে নতুন সংবিধান পুনর্লিখনের প্রস্তাব দিয়েছে ছাত্র-জনতার প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটি। সেই লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’-এর কাছে ৬৯ দফা প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি। তাদের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, দেশে দুবারের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।
মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) জাতীয় সংসদ ভবনের কেবিনেট কক্ষে জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রতিনিধির সঙ্গে মতবিনিময় শেষে ওই প্রস্তাবনামা গ্রহণ করেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ।
ছয় পৃষ্ঠার ওই প্রস্তাবগুলোতে জাতীয় নাগরিক কমিটির মূলনীতি পাঁচটির মধ্যে রয়েছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্র।
রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে জাতীয় নাগরিক কমিটির ৯টি প্রস্তাবনা হলো রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হবেন; জনগণের সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন; দুবারের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না; একজন রাষ্ট্রপতি পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচন করতে পারবেন না; রাষ্ট্রপতি সংসদের উভয় কক্ষের যৌথ সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবেন; আইনের দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে মনোনীত ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন; অন্যান্য সাংবিধানিক পদেও আইনের দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে নিয়োগ দেবেন এবং রাষ্ট্রপতি দণ্ড মওকুফ বা ক্ষমা ঘোষণা করতে পারবেন। তবে এ ক্ষেত্রে সংসদের উচ্চকক্ষের প্রস্তাব/পরামর্শ লাগবে।
সরকারপ্রধানের (প্রধানমন্ত্রী) ক্ষেত্রে নাগরিক কমিটির ১২টি প্রস্তাব দিয়েছে। উল্লেখযোগ্যগুলো হলো প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি একই সঙ্গে নিজ দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হতে পারবেন না; জীবনে দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না এবং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর রাষ্ট্রের আর কোনো পদেই তিনি আসীন হবেন না; কোম্পানি বা ব্যবসায়ী উদ্যোগের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ থাকবে; প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সব সম্পদ এবং সম্পত্তি স্টেট ব্যাংকের অধীনে চলে যাবে; কোনো সাংবিধানিক পদের নিয়োগে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে পারবেন, তবে তা পালন করা রাষ্ট্রপতির জন্য আবশ্যকীয় হবে না; সাংবিধানিক পদে নিয়োগ ও অপসারণ আইন দ্বারা নির্ধারিত হবে এবং সাংবিধানিক পদে আসীন কাউকে অপসারণ করার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর থাকবে না।
সংসদের ক্ষেত্রে ১০টি প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে জাতীয় পরিষদে ১০০ আসন থাকবে। এখানে নির্বাচন হবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে। আইন সভায় ৩০০টি আসনে সরাসরি ভোট হবে। সেখানে সংরক্ষিত আসন রাখা যেতে পারে। জাতীয় পরিষদের ১০০ আসনের মধ্যে কমপক্ষে ৩৩টি আসনে পেশাজীবী-কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-আইনজীবী-চিকিৎসক-প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-সাংবাদিকসহ আইন দ্বারা তফসিলভুক্ত পেশা এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষকে মনোনয়ন দিতে হবে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ৭টি প্রস্তাবনা দিয়েছে নাগরিক কমিটি। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন, সব বিভাগে হাইকোর্ট, বিচার বিভাগের আলাদা সচিবালয় গঠনের প্রস্তাব করেছে সংগঠনটি। এ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাস্তবায়নের জন্য ৬টি প্রস্তাব দিয়েছে নাগরিক কমিটি।
মতবিনিময় শেষে সংগঠনের প্রস্তাবিত বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন ও মুখপাত্র সামান্তা শারমিন। আখতার হোসেন বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিদ্যমান সংবিধান বাতিল হয়ে গেছে। তা ছাড়া এই সংবিধান দেখলে মনে হয় এটা আওয়ামী লীগের দলিল। এ জন্য এই সংবিধান সংস্কার বা সংশোধন নয়, সম্পূর্ণ নতুন করে সংবিধান রচনা করতে হবে।
নতুন সংবিধানে কেউ স্বৈরাচারী বা ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে পারে, এমন কোনো সুযোগ রাখতে চাই না। এ ছাড়া সংবিধান রচনার পর গণপরিষদই রূপ নেবে আইন সভায়।’
সংবিধান সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ, সদস্য ফিরোজ আহমেদ, মুস্তাইন জহির, সুমাইয়া খায়ের, মোহাম্মদ ইকরামুল হক, মইন আলম ফিরোজী, ইমরান সিদ্দিকী। মতবিনিময় শেষে জাতীয় নাগরিক কমিটি কমিশনের কাছে লিখিত প্রস্তাব হস্তান্তর করে।