রাজধানীতে পূজা-অর্চনা, নাচ-গান ও শুভেচ্ছা বিনিময়ে গারো সম্প্রদায়ের ‘ওয়ানগালা’ উৎসব পালিত হয়েছে। শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে এই কর্মসূচি উযাপিত হয়। এতে গারোদের বাইরেও বাঙালিসহ আরও অনেক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ অংশ নেন।
উৎসবে আসা গারো নারীদের পরনে দেখা গেছে ঐতিহ্যবাহী দকমান্দা ও টি-শার্ট। উৎসব প্রাঙ্গণে ছিল ঐতিহ্যবাহী নানা পণ্যের স্টল। সকালে জাতীয় সংগীত পরিবেশনা ও পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে উৎসবের সূচনা হয়। পরে শোভাযাত্রা বের করা হয়। থক্কা ও শস্য উৎসর্গের মধ্য দিয়ে শুরু হয় উৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা। এ ছাড়া ছিল বর্তমান ও সাবেক নকমা-নকমামিচিকদের (ওয়ানগালা উদযাপন কমিটির প্রধান) ওয়ানগালার শুভেচ্ছা বিনিময় পর্ব।
উৎসব-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এবার জুমচাষ, চিগিং দক্কা দিগিং সিক্কা, ট্রক্কা-মেসাসহ নানা ঐতিহ্যবাহী আয়োজনের পাশাপাশি উৎসব স্মরণিকা ও ক্যালেন্ডারের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন সাহিত্য পত্রিকা ‘থকবিরিম’-এর সম্পাদক কবি মিঠুন রাকসাম। তিনি বলেন, ‘গারোদের জাতিসত্তার যে আত্মপরিচয়, তা হলো ওয়ানগালা। এই উৎসবের সঙ্গে আমাদের শিকড়ের সম্পর্ক। এই উৎসব আমাদের আত্মপরিচয়ের পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐক্যেরও ভিত্তি রচনা করে।’
এ সময় দেখা যায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর। তারা মূলত ‘বাংলার গীতরঙ্গ’বিষয়ক পাঠের অংশ হিসেবে উৎসবে আসেন বলে জানিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক কামালউদ্দিন কবির। তিনি বলেন, ‘আমাদের বিভাগের একটি কোর্স আছে ‘বাংলার গীতরঙ্গ’। এটি পাঠের অংশ হিসেবে সারা দেশে কী কী গীতরঙ্গ আছে তা অনুসন্ধান করি। এই কোর্স পাঠের অংশ হিসেবেই আমরা এই উৎসবে শিক্ষার্থীদের নিয়ে এসেছি। তারা এই উৎসবে এসে আমাদের বিচিত্র গীতরঙ্গ, বাদ্য ও নাট্যের সঙ্গে পরিচিত হবে, ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হবে- এমনটি আমাদের প্রত্যাশা।’
আয়োজকরা বলেছেন, প্রতিবছর ১০ হাজারের বেশি মানুষের অংশগ্রহণে উৎসবটি বার্ষিক মিলনমেলায় রূপ নেয়। নিজেদের সংস্কৃতির অতি পরিচিত গানের তালে তালে নাচতে থাকে তারা। বছরে এক দিন নিজেদের পোশাক পরার এবং সবার সঙ্গে নিজেদের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান উপভোগের সুযোগ পান অংশগ্রহণকারীরা।
গারোরা বিশ্বাস করেন, শস্য দেবতা ‘মিশি সালজং’ পৃথিবীতে প্রথম ফসল দিয়েছিলেন এবং তিনি সারা বছর পরিমাণমতো আলো-বাতাস, রোদ-বৃষ্টি দিয়ে ভালো শস্য ফলাতে সহায়তা করেন। তাই নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় ‘মিশি সালজং’কে ধন্যবাদ জানাতে উৎসবের আয়োজন করেন তারা।
ঢাকা ওয়ানগালা-২০২৪-এর নকমা বা প্রধান অন্ত ঘাগ্রা বলেন, ‘এটি মূলত আমাদের দেবতাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানানোর উৎসব। হাজার বছর ধরে আমাদের পূর্বপুরুষরা এই উৎসবটি করে আসছেন।’ ১৯৯৪ সাল থেকে ঢাকায় এই উৎসবটি প্রতীকীরূপে আয়োজন করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান ।
অন্ত ঘাগ্রা বলেন, ‘অতীতে গারোদের জীবন ও জীবিকা ছিল মূলত কৃষিনির্ভর, যা ছিল জুমচাষভিত্তিক। তারা তাদের কৃষিবর্ষের শেষ দিকে খেতের ফসল ঘরে তোলার সময় নকমার (গ্রামপ্রধান) নেতৃত্বে গ্রামের সবাইকে নিয়ে ‘ওয়ানগালা’ উৎসব উদযাপন করতেন। ওয়ানগালা ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উৎসব।’ অন্ত ঘাগ্রা আরও বলেন ‘ঢাকা ওয়ানগালা শুধু একটি উৎসব নয়, এটি আমাদের গারো সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের প্রতীক। পূর্বপুরুষদের সংগ্রাম এবং ঐতিহ্যের ধারাকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এই উৎসব আমাদের শিকড়ের প্রতি ভালোবাসা এবং একতার প্রতীক। খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করলেও গারোরা আদি ফসল উৎসব ওয়ানগালার স্মৃতি এবং ঐতিহ্য আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন।’
ঢাকা ওয়ানগালা-২০২৪ উদযাপন কমিটির সেক্রেটারি অটুট আরেং বলেন, ‘এই উৎসবে আমুয়া, রুগালার মতো ধর্মীয় আচার পালন করা হয়। তারপর শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং শুভেচ্ছা বিনিময়। এতে নিজস্ব ভাষায় গান গেয়ে শোনান গারো শিল্পীরা।’ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ গারোদের ঐতিহ্যবাহী জম নাচ জানিয়ে তিনি বলেছেন, শহুরে জীবনের কর্মব্যস্ততার ফাঁকে দিনভর গারো সম্প্রদায় এই উৎসবে নিজেদের মতো করে আনন্দে মেতে থাকে।
মাহফুজ