বাংলাদেশে গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে ১ হাজার ৪০০ জনের মতো নিহত হয়েছেন। তাদের বেশির ভাগের মৃত্যু হয়েছে রাইফেল ও শটগানের গুলিতে। হাজার হাজার মানুষ গুরুতর আহত হয়েছেন। ওই সময় নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বয়কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তাদের নির্দেশেই বিক্ষোভ দমনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো।
বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার (ওএইচসিএইচআর) ভলকার টুর্ক জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সময় দুপুরে এ রিপোর্ট প্রকাশ করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের আমন্ত্রণে ওএইচসিএইচআর বাংলাদেশে এসে ওই তদন্ত করেছিল।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশ ও র্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ১১ হাজার ৭০০ জনকে তখন আটক করা হয়েছিল। যারা নিহত হয়েছে তাদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ শিশু। পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা শিশুরা টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছে ও পঙ্গু হয়েছে। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তখন পদ্ধতিগত ও সংগঠিতভাবে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অংশ হয়ে উঠেছিল।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর আরও স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের পরামর্শ দিয়েছে ওএইচসিএইচআর। একই সঙ্গে সংস্থাটি রাজনৈতিক দলকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। এতে র্যাব বিলুপ্ত করা এবং সামরিক বাহিনীর কর্মপরিধি সুনির্দিষ্ট করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ওএইচসিএইচআরের এই রিপোর্টকে স্বাগত জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। যারা আইন ভঙ্গ করেছে এবং মানুষের মানবিক ও নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করেছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
তবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেছেন, ‘এই রিপোর্টে ইউনূস সরকারের মতামতের প্রতিফলন ঘটেছে। কারণ ৫ আগস্টের পর থেকে দেশে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের কোনো পরিবেশই নেই।’
তিনি বলেন, ‘তখন সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ মোকাবিলা করে দেশ এবং জনগণের জানমাল রক্ষার জন্য আইনি পন্থা অবলম্বন করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সিনিয়র কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে রিপোর্টে মনগড়া তথ্য দেওয়া হয়েছে। কারণ এখন কোনো কর্মকর্তার পক্ষে সরকারের বাইরে গিয়ে সত্যি তথ্য দেওয়ার সুযোগ নেই।
এদিকে মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন বলেছেন, ‘বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে আইনবহির্ভূত যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, সেটি ওএইচসিএইচআরের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তখনকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের এ দায় অস্বীকারের কোনো সুযোগই নেই।’
প্রসঙ্গত, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় ৮২৬ জন নিহত ও ১১ হাজার ৩০৬ জন আহতের একটি তালিকা সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে।
সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের বিচার কার্যক্রম শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই সাবেক সরকারের অন্তত ৮০ জন সাবেক মন্ত্রী ও এমপিকে আটক করা হয়েছে।
ওই রিপোর্টে ওএইচসিএইচআর বলছে, এটা বিশ্বাস করার ভিত্তি আছে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকার এবং এর নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কাঠামো, আওয়ামী লীগের সহিংস গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে একত্রিত হয়ে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে পদ্ধতিগতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল।
এর মধ্যে রয়েছে কয়েক শ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে মারাত্মক শারীরিক নিপীড়ন ও বলপ্রয়োগ, ব্যাপকহারে নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও আটক এবং নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের নিপীড়ন। এসব কারণে বিক্ষোভের সময় এমন যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলছে জাতিসংঘ। রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র অংশ এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জ্ঞাতে, সমন্বয়ে ও নির্দেশনায় এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, যেসব বিষয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে রয়েছে জীবনের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার, ব্যক্তি নিরাপত্তা, নির্যাতন ও বাজে আচরণ থেকে মুক্ত থাকার অধিকার, ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদার অধিকার, ন্যায়বিচারের অধিকার, ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে প্রতিকার পাওয়ার অধিকারের মতো বিষয়গুলো।
বিজিবি, র্যাব, ডিজিএফআই, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সরাসরি অপারেশনের বিষয়ে আদেশ ও অন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন রাজনৈতিক নেতারা, যা তাদের বিক্ষোভকারী ও অন্য বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত করেছিল। এর মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্বিচারে গ্রেপ্তারের মতো ঘটনা ছিল।
রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের পুলিশের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের ৯৫ জন সদস্যের নাম এবং তাদের ভূমিকা কী ছিল, তার বিস্তারিত বিবরণ ওএইচসিএইচআরকে সরবরাহ করা হয়েছে। পুলিশের মতে, এসব ব্যক্তিই বিক্ষোভের সময় সহিংস হামলায় ব্যবহারের জন্য নাগরিকদের অস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন। যাদের অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ১০ জন তখনকার সংসদ সদস্য, ১৪ জন আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা, ১৬ জন যুবলীগ, ১৬ জন ছাত্রলীগ নেতা এবং ৭ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন।
রিপোর্টে বলা হয়, পুলিশ ও অন্য নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর দ্বারা শিশুরা টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া অমানবিক পরিবেশে আটক, নির্যাতন ও বিভিন্ন ধরনের আপত্তিকর আচরণের শিকার হয়েছে। নারী ও কন্যাশিশুরাও নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের হামলার শিকার হয়েছেন। বিশেষত শুরুর দিকে বিক্ষোভের সম্মুখ সারিতে থাকা নারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকরা মারাত্মকভাবে আক্রমণ করেছেন। নারীরা যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ছিল লিঙ্গভিত্তিক শারীরিক সহিংসতা ও ধর্ষণের হুমকি। কয়েকটি ডকুমেন্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে।
ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য, ছবি এবং ভিডিও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ওএইচসিএইচআর নিশ্চিত হয়েছে, সশস্ত্র আওয়ামী লীগ সমর্থকরা বিক্ষোভ দমনের জন্য পুলিশের সঙ্গে আক্রমণে অংশ নিয়েছিলেন। এ ছাড়া পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও বিভিন্ন জায়গায় লোকজনকে থামিয়ে তল্লাশি চালিয়েছিলেন, বিক্ষোভকারীদের আটক করেছিলেন এবং সংগঠিত ও পূর্বপরিকল্পিতভাবে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছিলেন।