
জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে ভয় দেখাতে র্যাব ও পুলিশের এভিয়েশন ইউনিট হেলিকপ্টার মোতায়েন করেছিল। সেনাবাহিনীরও এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টতা ছিল। বিক্ষোভকারীদের ভয় দেখানোর জন্য র্যাবের কালো রঙের হেলিকপ্টার মোতায়েন ছিল উল্লেখ করার মতো। এসব হেলিকপ্টার থেকে বিক্ষোভকারীদের ওপর বেআইনি বল প্রয়োগ করা হয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধান দলের প্রতিবেদনে এই হেলিকপ্টার মোতায়েন ও বলপ্রয়োগের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা ওএইচসিএইচআর তথ্যানুসন্ধান দলকে জানিয়েছেন, হেলিকপ্টার থেকে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে রাইফেল ও শটগান দিয়ে গুলি করা হয়েছে। বিশেষ করে ১৯ ও ২০ জুলাই হেলিকপ্টার থেকে রাইফেল ও শটগান দিয়ে প্রাণঘাতী গুলি ছোড়ার কথা জানিয়েছেন তারা।
প্রতিবেদনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলা হয়, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বিক্ষোভকারীদের ভয় দেখাতে আরও বেশি হেলিকপ্টার মোতায়েন করতে বলেছিলেন। তার কথামতো আন্দোলন দমাতে র্যাব হেলিকপ্টারের ব্যবহার করেছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশের মহাপরিদর্শক ও র্যাবের মহাপরিচালক দুজনই হেলিকপ্টার থেকে বিক্ষোভকারীদের ওপর কাঁদানে গ্যাসের শেল এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ার কথা স্বীকার করেছেন। তবে এই দুই কর্মকর্তার কেউ র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গুলি ছুড়েছিলেন কি না, তা নিশ্চিত করতে পারেননি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য অনুযায়ী, মিরপুরে (১৮ জুলাই), মহাখালীতে (১৮ জুলাই), ধানমন্ডিতে (১৮ ও ১৯ জুলাই), বাড্ডায় (১৯ জুলাই), মোহাম্মদপুরে (১৯ জুলাই), রামপুরায় (১৯ জুলাই), শাহবাগে (১৯ জুলাই), বসুন্ধরায় (১৯ জুলাই, ২ ও ৩ আগস্ট), গাজীপুরে (২০ জুলাই) এবং যাত্রাবাড়ীতে (২০ ও ২১ জুলাই) র্যাব ও পুলিশের হেলিকপ্টার থেকে বিক্ষোভকারীদের ওপর বারবার কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া হয়। সেই সঙ্গে রামপুরায় ১৮ জুলাই সাউন্ড গ্রেনেডও ছোড়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য অনুযায়ী, ১৯ থেকে ২১ জুলাই হেলিকপ্টার থেকে বাড্ডা, বসুন্ধরা, গাজীপুর, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, মহাখালী, মোহাম্মদপুর এবং রামপুরা এলাকায় গুলি ছুড়তে দেখা গেছে। ৫ আগস্ট যমুনা ফিউচার পার্ক এলাকায় হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলি এক ব্যক্তির শরীরে আঘাত করেছিল বলেও তথ্য পেয়েছে ওএইচসিএইচআর। তারা সেটি যাচাই করে দেখেছে।
ওএইচসিএইচআরকে দেওয়া র্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, র্যাব হেলিকপ্টার থেকে ৭৩৮টি কাঁদানে গ্যাসের শেল, ১৯০টি সাউন্ড গ্রেনেড এবং ৫৫৭টি স্টান গ্রেনেড ছুড়েছে। তবে তারা ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত হেলিকপ্টার থেকে একবারও রাইফেল অথবা শটগান দিয়ে গুলি ছোড়েনি বলে দাবি করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হেলিকপ্টার থেকে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে বিক্ষোভকারীদের ভিড় লক্ষ্য করে নির্বিচার গুলি ছোড়া স্বাভাবিকভাবেই মানবাধিকারে সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কিন্তু হেলিকপ্টার থেকে মারণঘাতী গুলি ছোড়া হয়েছিল কি না, সে ব্যাপারে ওএইচসিএইচআর নিশ্চিত হতে পারেনি।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ের হেলিকপ্টার থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর অ্যাকশনের বেশ কয়েকটি ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখেছে ওএইচসিএইচআর। তারা দেখেছে, র্যাব ও পুলিশের হেলিকপ্টারে থাকা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ছেন। দূর থেকে দেখলে ওই লঞ্চারগুলো রাইফেল অথবা শটগানের মতো দেখতে লাগে। তবে ওএইচসিএইচআর এমন কোনো ভিডিও হাতে পায়নি, যেখানে হেলিকপ্টার থেকে পরিষ্কারভাবে রাইফেল অথবা শটগান দিয়ে গুলি ছোড়ার বিষয়টি বোঝা যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রত্যক্ষদর্শীরা যে সময়ে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো হয়েছে বলে দাবি করছেন, সে সময় সরকার মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে রেখেছিল। ফলে তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ওয়েবসাইটে ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না। যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে হেলিকপ্টার থেকে রাইফেল বা শটগান দিয়ে গুলি ছোড়ার বিষয়টি যেমন নিশ্চিত করতে পারছে না, তেমনি বাতিল করতেও পারছে না।
তথ্যানুসন্ধানী দল বলেছে, ওপর থেকে আঘাতে যারা হতাহত হয়েছেন, তাদের কেউ কেউ ওপর থেকে ছোড়া কোনো রাইফেলের আঘাত পেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। অথবা ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়েছিল, যা পরে ভূমিতে পড়ার সময় কারও গায়ে আঘাত করতে পারে।
এ বিষয়ে আরও তদন্ত প্রয়োজন বলে মত দিয়েছে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দল। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পূর্ণ সহযোগিতা জরুরি বলে মন্তব্য করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে যারা ওই সময় হেলিকপ্টারে দায়িত্বে ছিলেন, তাদেরও তদন্তের আওতায় আনা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে।