ঢাকা ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪

স্বাস্থ্যনিরাপত্তার জন্য দরকার শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থা

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৪, ১১:৫১ এএম
স্বাস্থ্যনিরাপত্তার জন্য দরকার শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থা
ডা. মুশতাক হোসেন

কোভিড-১৯ মহামারিকে সেই সব দেশ ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছে, যেসব দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক, বিশেষায়িত তৃতীয় স্তরের স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো পর্যন্ত সুসংগঠিত ও সুসজ্জিত রয়েছে; স্বাস্থ্যসেবার সবগুলো ধাপে রয়েছে প্রয়োজনীয় জনবল ও সাজসরঞ্জাম এবং কর্তৃপক্ষ সব স্তরের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমকে সমান গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থাপনা করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়াসুস ৭৩তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে বলেছেন, ‘কোভিড-১৯ কেবল একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা নয়, এটি এই সত্যকে দেখিয়েছে যে, ঘাত-প্রতিঘাতসহনীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছাড়া কিংবা স্বাস্থ্যের সামাজিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং পরিবেশগত নির্ধারকদের আমলে না নিয়ে স্বাস্থ্যনিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা যায় না।’

সীমান্ত পেরিয়ে দেশে দেশে মানুষের স্বাস্থ্যকে তাৎক্ষণিক বিপন্ন করতে পারে- এমন পরিস্থিতিতে যেসব কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ ও মোকাবিলা করতে সক্ষম সেগুলোই স্বাস্থ্য নিরাপত্তাব্যবস্থা। নতুনভাবে জন্ম নেওয়া সংক্রামক রোগ থেকে শুরু করে ওষুধ প্রতিরোধী (অ্যান্টি মাইক্রোবায়াল রেজিস্ট্যান্স) অণুজীব পর্যন্ত অনেক বিষয়ই স্বাস্থ্য নিরাপত্তাজনিত জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ও ক্রয় করতে সক্ষম, ধারাবাহিকভাবে প্রয়োজন অনুযায়ী জনবল ও স্বাস্থ্যসেবা সামগ্রীর জোগান দেওয়ার সক্ষমতাকে একটা দেশের স্বাস্থ্যনিরাপত্তা অর্জন বলা যায়। সামগ্রীগুলোর মধ্যে রয়েছে ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধবহির্ভূত সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সরঞ্জাম। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী বিরূপ বা জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি শনাক্ত করা, যাচাই করা, রিপোর্ট করা, সাড়া দেওয়া প্রভৃতি বিষয়ে একটি দেশের সক্ষমতাকেও স্বাস্থ্যনিরাপত্তা অর্জন বলে। মোটা দাগে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যনিরাপত্তা হলো জরুরি জনস্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিরোধ, শনাক্ত ও সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা।

বিশ্বের দেশগুলো ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ক্রমবর্ধমানভাবে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে এবং পরস্পর নির্ভরশীলভাবে বিকশিত হচ্ছে। মানুষ, পণ্য ও তাদের সম্পর্কিত পরিষেবাগুলো সহজেই এক অঞ্চল এবং এক দেশ থেকে বিভিন্ন অঞ্চল ও বিভিন্ন দেশে চলাচল করছে। এই বৈশিষ্ট্যটি জাতীয় ও বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তাব্যবস্থাকে জটিল করে তুলেছে। এটি একদিকে যেমন বাধা, অপরদিকে নতুন সুযোগও বটে। এতে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট জনস্বাস্থ্য দুর্ঘটনা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারে, যেমনটি দেখা গেছে কোভিড-১৯ মহামারিতে। 

সাম্প্রতিক অন্যান্য ঘটনাতেও দেখা গেছে যে, বড় আকারের এবং গুরুতর জনস্বাস্থ্য জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বর্তমান প্রস্তুতি কত অপর্যাপ্ত। দক্ষিণ আমেরিকায় জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কিংবা পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাস রোগের প্রাদুর্ভাবের মতো বড় ঘটনা এবং কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের নির্মমভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, জনস্বাস্থ্যের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রস্তুতি দরকার বৈশ্বিক স্বাস্থ্যনিরাপত্তার সব স্তরে। এ ধরনের জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর চাপ তৈরি করতে পারে এবং সমাজের বিভিন্ন অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। 

স্বাস্থ্য নিরাপত্তাব্যবস্থাকে উন্নত করা শুধু খরচের বিষয় নয়, বরং এটা একটা বিনিয়োগ। বিভিন্ন গবেষণার ফল থেকে বোঝা যায় যে, স্বাস্থ্যনিরাপত্তা প্রস্তুতির জন্য যে খরচ হবে, এ বিষয়ে উদাসীন থেকে কোনো প্রস্তুতি না নিলে তার জন্য ক্ষতির অর্থমূল্য অনেক গুণ বেশি। স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যনিরাপত্তা প্রস্তুতির জন্য খরচের তুলনায় আসন্ন সত্যিকারের জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তাৎক্ষণিক যে খরচ হতে পারে তা বহু গুণে বেশি। যদি স্বাস্থ্যনিরাপত্তা তথা স্বাস্থ্য খাতে বাজটে বরাদ্দ না বাড়ানো হয়, তবে জনস্বাস্থ্যের বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পথে একটি অবিরাম বাধা হিসেবেই থেকে যাবে।

জাতীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যনিরাপত্তা জোরদার করার নানা চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে এর সক্ষমতা প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে। আমাদের মতো নিম্নমধ্য আয়ের দেশগুলো বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবা চালু রাখার পাশাপাশি স্বাস্থ্যের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সম্পদ জোগাতে হিমশিম খেয়েছে। এ ধরনের জরুরি পরিস্থিতিতে আমাদের মতো দেশগুলোতে কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন ও বিশেষায়িত মানবসম্পদ দ্রুত বৃদ্ধি করতে বাইরের সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে। এ ধরনের দক্ষ ও বিশেষায়িত জনবল স্বাস্থ্যের জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় নির্ধারক ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে যাদের শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থা রয়েছে, তারা স্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থার সময় দ্রুত স্বাস্থ্যচাহিদার বিশাল ঢেউ সামাল দিতে বিরাট বাধার মুখোমুখি হয়েছে। যেমনটি দেখা গেছে কোভিড-১৯ মহামারির সময়। 

এ সময় আরও একটি সমস্যা আমাদের মতো নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোকে পোহাতে হয়েছে। আয়-নির্বিশেষে সব দেশকে মহামারি পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যচাহিদার বিশাল ঢেউ সামলাতে তীব্র বাজার প্রতিযোগিতার কারণে প্রয়োজনীয় মেডিকেল-সামগ্রী ও ওষুধ জোগাড় করতে নিদারুণ সংকটে পড়তে হয়েছে। নিকট অতীতের এ সংকট দেশগুলোকে তাদের এসব সামগ্রী উৎপাদনের সক্ষমতা কতটুকু এবং কোথায় কোথায় ঘাটতি আছে তা চিহ্নিত করার তাগিদ দিচ্ছে। এটা দরকার এ কারণে, এ রকম তীব্র ও ব্যাপক জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয় তার জন্য কতটুকু প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে তা জানা। এ ধরনের পরিস্থিতি অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্য পরিষেবার বিদ্যমান ব্যবস্থাকেও হুমকির মুখে ফেলেছে।

এ ক্ষেত্রে কার্যকর সমন্বিত শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থা একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্যনিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তুলতে অবদান রাখতে পারে, যা জনস্বাস্থ্যের বিরূপ ঘটনা ও হুমকিকে আরও ভালোভাবে প্রতিরোধ, শনাক্ত ও মোকাবিলা করতে পারে। এর ফলে বিশ্ব আরও স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ হয়ে উঠবে।

কয়েকটি গবেষণা এটা বিশেষভাবে দেখিয়েছে যে, একদিকে নির্ভরযোগ্য টেকসই স্বাস্থ্যব্যবস্থা শক্তিশালী করা এবং সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করার চেষ্টা; অপরদিকে জাতীয় ও বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নয়ন করার চেষ্টা- এ দুই চেষ্টার মধ্যে সমক্ষেত্র রয়েছে। ঘাত-প্রতিঘাতসহনীয় ও সাড়াদানে সক্ষম স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যনিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে যার উত্তর দরকার- (ক) কোন কোন ক্ষেত্রে সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে; (খ) স্বাস্থ্যব্যবস্থা, স্বাস্থ্যনিরাপত্তা ও অন্যান্য সেক্টরের সংযোগস্থলগুলো কোথায়; (গ) এসব সংযোগস্থলে বাধাগুলো কীভাবে অতিক্রম করা যায় এবং (ঘ) জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার জন্য বহু খাত ও বিষয়ভিত্তিক যেসব সুযোগ রয়েছে তা কীভাবে কাজে লাগানো যায়। 

স্বাস্থ্যনিরাপত্তার জন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে- (ক) সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে এ বিষয়ে এবং কীভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও ভালো স্বাস্থ্যনিরাপত্তায় অবদান রাখা যায় সে বিষয়ে ঐকমত্যে আসা; (খ) জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতির কারণে সৃষ্ট চাহিদা মেটাতে স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য সেক্টরের কোন কোন অংশ ভূমিকা নেবে তা চিহ্নিত করা; (গ) একটি দেশ স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সেক্টরে বহুপক্ষীয় ও বিষয়ভিত্তিকভাবে জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনায় কীভাবে অগ্রাধিকার নির্ণয় করবে, কর্মকাণ্ডগুলো পরিবীক্ষণ করবে এবং বাজেট বরাদ্দ করবে তা ঠিক করা; (ঘ) আন্তর্জাতিক অংশীদার ও উন্নয়ন সহযোগীরা খরচের কোন কোন ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রদান করবে, কত ভালোভাবে সেটা করা যাবে এবং আর্থিক জোগান কীভাবে টেকসই থাকবে সে বিষয়ে সহাযোগিতা করা এবং (ঙ) বড় কী কী বাধা আসতে পারে তা চিহ্নিত করা।

এটি এককভাবে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। মানবস্বাস্থ্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে প্রাণীর স্বাস্থ্য, কৃষির স্বাস্থ্য, খাদ্যের নিরাপত্তা, পরিবেশের স্বাস্থ্য। এটাকে ‘এক স্বাস্থ্য’ দৃষ্টিভঙ্গি বলা হয়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ‘এক স্বাস্থ্য সেক্রেটারিয়েট’-এর অংশীদার। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে ‘এক স্বাস্থ্য’ দৃষ্টিভঙ্গিতে আন্তমন্ত্রণালয় সমম্বয়ের জন্য ‘এক স্বাস্থ্য সেক্রেটারিয়েট’ গঠিত হয়। অদূর ভবিষ্যতে এর সঙ্গে যুক্ত হবে কৃষি মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয়। তবে মহামারির মতো জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজে নামতে হয়। ভবিষ্যৎ জরুরি জনস্বান্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিষয়টি আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে।

লেখক: জনস্বাস্থ্যবিদ ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) 

২০২৫ সালে ইউক্রেনে কি শান্তি ফিরে আসবে?

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০২ পিএম
২০২৫ সালে ইউক্রেনে কি শান্তি ফিরে আসবে?
ড. ডায়ানা গালিভা

২০২৪ সালজুড়েই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান ছিল। রাশিয়া ভেলিকা নোভোসিল্কা এবং ভুহলেদার অঞ্চলকে তার সুবিধাজনক যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে রেখে দিয়েছে। দোনেৎস্ক ওব্লাস্টের সামনের লাইনটি আরও উত্তাল হয়ে উঠছে। কারণ, এখানে যুদ্ধের প্রস্তুতি এমনভাবে করা হয়েছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় অনেক বড় পরিসরে। ২০২৪-এর আরেকটি স্বতন্ত্র দিক ছিল গত আগস্টে কুরস্ক আক্রমণ। 

যেখানে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী রাশিয়ায় আক্রমণ করেছিল। অন্যদিকে অক্টোবরের মধ্যে রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেনের দখলকৃত প্রায় অর্ধেক অঞ্চল পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়। এই অঞ্চলটিই ছিল ২০২৪ সালের রণাঙ্গনের বড় ক্ষেত্র। আশা করা হচ্ছে, নতুন কূটনৈতিক কৌশল এবং গতিশীলতা দেখা দেবে আগামী বছর। ২০২৫ সালে কি ইউক্রেনে শান্তির দেখা মিলবে? 

ইউক্রেনে যত দ্রুত সম্ভব শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়, তা নিয়ে ভাবছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। নভেম্বরে জি-২০ নেতারা রিওডি জেনেরিও শীর্ষ সম্মেলনে তাদের চূড়ান্ত ঘোষণা দেন। সেখানে তারা ‘হুমকি বা শক্তি প্রয়োগের নিন্দা করে ব্যাপক, ন্যায়সংগত এবং টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন করে সব প্রাসঙ্গিক এবং গঠনমূলক উদ্যোগ’ নিতে চেষ্টা করেন। ২০২৪ সালে নিজ নিজ মিত্র এবং অংশীদারদের মাধ্যমে উভয় পক্ষে সামরিক, আর্থিক এবং রাজনৈতিক সমর্থন অব্যাহত রাখার বিষয়টি লক্ষ করা গেছে। 

ইউক্রেনকে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করছে। জার্মানিভিত্তিক কিয়েল ইনস্টিটিউটের মতে, ইউরোপ ২০২২ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়া থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ইউক্রেনকে সমর্থন করার জন্য ১২৫ বিলিয়ন ডলার এবং যুক্তরাষ্ট্র ৯০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। যুক্তরাজ্য এই দুই বছরে ইউক্রেনের জন্য অন্যতম প্রধান সাহায্যদাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। যুক্তরাজ্য আশ্বাস দিয়ে বলেছে, ‘যতদিন লাগে’ তারা ইউক্রেনকে প্রতিবছর ৩ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দেবে।
 
রাশিয়াও তার নিজ মিত্রদের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থন পেয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো উত্তর কোরিয়ার ভূমিকা। গত সপ্তাহে জি-৭ এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের সময় গ্রুপটি রাশিয়াকে ‘দায়িত্বহীন ও হুমকিমূলক পারমাণবিক বক্তব্য’ দেওয়ার জন্য নিন্দা করেছে। মস্কোর প্রতি উত্তর কোরিয়ার সমর্থনকে বিপজ্জনক বলে মনে করছে বিশ্ববাসী। এর আগেও উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়া তাদের সমন্বিত কৌশলগত অংশীদারি চুক্তিতে অনুমোদন করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া কুরস্ক অঞ্চলে ১০ হাজার সৈন্য পাঠানো এবং মহাকাশে প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করার জন্য উত্তর কোরিয়াকে অভিযুক্ত করেছে। 
অন্যান্য দেশ, যেমন- ইউনাইটেড আরব আমিরাত তাদের নিরপেক্ষ রাজনৈতিক অবস্থান বজায় রেখেছে। ইউনাইটেড আরব আমিরাত মধ্যস্থতা করে যাচ্ছে। এর ইতিবাচক দিক হলো সেপ্টেম্বরে দুই পক্ষ থেকে ১০৩ জন যুদ্ধবন্দির বিনিময়। 

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় হলো- দুই পক্ষের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। রাশিয়া ডিনিপ্রোর ওপর আক্রমণে ওরেশনিক হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে। মস্কো ব্যাখ্যা করেছে, রাশিয়ার ভূখণ্ডকে লক্ষ্যবস্তু করে কিয়েভ মার্কিন এবং যুক্তরাজ্যের তৈরি বা সরবরাহ করা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া ছিল এই আক্রমণ। মস্কো কখনোই তার পারমাণবিক সক্ষমতা দেখায়নি। তবে তারা ‘ভয়ংকর’ অস্ত্র তৈরি করে যাচ্ছে। যেহেতু উভয় পক্ষই  তাদের গতি, দূরত্ব এবং প্রভাব বিস্তারের জন্য সুবিধা খোঁজে, তাই আগামী দিনে ভারী এবং উন্নত অস্ত্রের বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। 

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৫ সালে দুই পক্ষের মধ্যে কোনো শান্তিচুক্তির আশা কি দেখা দেবে? ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি একটি ‘শান্তি সূত্র’ প্রস্তাব করার চেষ্টা করেছিলেন। ইউক্রেনের সমগ্র অঞ্চল থেকে রাশিয়ার প্রত্যাহারের দাবিগুলো নিয়ে গত জুনে সুইজারল্যান্ড শীর্ষ সম্মেলনের সময় একটি রূপরেখা দেওয়া হয়েছিল। যদিও প্রচেষ্টাগুলো সফল হয়নি। কারণ গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো আলোচনায় রাশিয়া বা ইসরায়েলের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতিকে সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে তারা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। 

পূর্ববর্তী পরামর্শগুলোও সেই সম্মেলনে আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল। যেমন, গত মে মাসে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান শান্তি আলোচনা আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যখন চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়াং ই ‘শান্তিই শক্তি’র মাধ্যমে দুই বছরের ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে চেয়েছিলেন। 

এই ব্যর্থতার পর জেলেনস্কি অক্টোবরে আবার যুদ্ধ শেষ করার জন্য তার ‘বিজয় পরিকল্পনা’ উপস্থাপন করেন। এর মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট অস্ত্র ব্যবহারের অনুরোধ এবং অবিলম্বে ন্যাটোতে যোগদানের ‘নিঃশর্ত’ আমন্ত্রণ। তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার এবং ন্যাটোর নতুন মহাসচিব মার্ক রুটের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে তার দেশের জন্য সশস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা জোরদার করতে ইউরোপ সফর শুরু করেন। নভেম্বরে জি-৭ বৈঠকে নেতারা ইউক্রেনের প্রতি তাদের ‘যতদিন সময় লাগে’ বলে সমর্থন পুনঃপ্রকাশ করেন। কারণ, জেলেনস্কি ‘কূটনৈতিক উপায়ে’ ২০২৫ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার আশা করেছিলেন। ক্রেমলিন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল যে, জেলেনস্কির পরিকল্পনা ন্যাটো এবং রাশিয়ার মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যেতে পারে। 

অনেক পর্যবেক্ষক জানুয়ারিতে ওভাল অফিসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আনুষ্ঠানিক প্রত্যাবর্তনের জন্য উদ্বিগ্নভাবে অপেক্ষা করছেন। কারণ তিনি ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে’ যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো বিশদ বা স্পষ্ট পরিকল্পনা দেওয়া হয়নি। গত মাসে রিপোর্ট করা হয়েছিল যে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ট্রাম্পের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে আলোচনা করার জন্য উন্মুখ ছিলেন। কিন্তু তিনি আঞ্চলিক মূল বিষয়গুলো ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে অস্বীকার করেছিলেন। 

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ২০২৪ সালে ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের কোনো সমাধান হয়নি। এমনকি অস্ত্রশস্ত্র এবং নতুন দেশ এই যুদ্ধে সম্পৃক্ততার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। উভয় পক্ষের বক্তৃতার মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ রয়েছে, যেখানে ‘বিজয়’ ও  ‘শান্তি’র পরিবর্তে অন্য কোনো অর্থ বহন করছে। এমনকি ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন কিছুটা দুর্বল করলেও ইউরোপীয় নেতাদের দৃঢ় অবস্থান বজায় রাখার সম্ভাবনা বেশি। রাশিয়া সম্ভবত তার বর্তমান মিত্রদের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলবে, বিশেষ করে যতদূর সামরিক প্রতিরোধ বজায় রাখা যায়।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের দ্রুত সমাধান হওয়াটা কঠিন। অন্তত যতক্ষণ না প্রধান অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে নেতৃত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে। ২০২৫ হতে পারে শান্তি নির্মাণের বছর। এটি অর্জনের জন্য অনেক প্রচেষ্টা করা হবে। মনে হচ্ছে, কোনো ধরনের ব্রেকিং পয়েন্ট বা সিদ্ধান্তে না পৌঁছানো পর্যন্ত রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট কাটবে না। 

লেখক: একাডেমিক ভিজিটর, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় 
আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল  

রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধ করা জরুরি

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৮ এএম
রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধ করা জরুরি
সৈয়দ ফারুক হোসেন

আইকিউএয়ারের ২০২৩ সালের বছরভিত্তিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণ বেশি বাংলাদেশে। এ তালিকায় ১ নম্বরে বাংলাদেশ। এর পর রয়েছে পাকিস্তান, ভারত, তাজিকিস্তান ও বুরকিনা ফাসো। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় ১ নম্বরে ছিল ভারতের নয়াদিল্লি। এর পর রয়েছে ঢাকা, বুরকিনা ফাসোর ওয়াগাডুগু, তাজিকিস্তানের দুশানবে ও ইরাকের বাগদাদ। শীত এলে বায়ুদূষণ আরও বাড়ে। বাংলাদেশ ও রাজধানী শহর ঢাকায় বায়ুদূষণের সমস্যাটি নতুন নয়। শুষ্ক মৌসুমে বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা প্রায়ই ১ নম্বরে থাকে।

 সম্প্রতি গত শুক্রবার ছুটির দিনে রাত পৌনে ৯টায় বিশ্বের ১২৫টি শহরের মধ্যে দূষণের দিক দিয়ে ঢাকা ছিল তৃতীয়। শীর্ষে ছিল পাকিস্তানের লাহোর, দ্বিতীয় ভারতের নয়াদিল্লি। সাধারণত একিউআই স্কোর ৫০ থেকে ১০০-এর মধ্যে থাকলে ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ বলা হয়। স্কোর ১০১ থেকে ২০০-এর মধ্যে থাকলে ‘অস্বাস্থ্যকর’, স্কোর ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে থাকলে ‘খারাপ’ এবং ৩০১ থেকে ৪০০ স্কোর হলে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়। বছর বছর বায়ুর মানের অবনতি হচ্ছে। 

ঢাকার রাস্তায় বের হলেই দেখা যায়, খোঁড়াখুঁড়ি অথবা নির্মাণকাজ চলছে; সেখানে ধুলোবালি যথেচ্ছভাবে ছড়াচ্ছে। রাস্তায় বের হলেই দেখা যায়, বহু পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় বাস, লেগুনার মতো যানবাহন কালো ধোঁয়া ছেড়ে চলাচল করছে, বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে। মূলত ঢাকায় বায়ুদূষণের বড় উৎস নির্মাণকাজ। এর পর রয়েছে ইটভাটা ও কারখানা, আন্তর্দেশীয় দূষিত বায়ু এবং রান্নার চুলা। ঢাকার বাতাসে অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদানের সঙ্গে চারটি উপাদানের আশঙ্কাজনক উপস্থিতি রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা, সালফার ডাই-অক্সাইড ও ব্ল্যাক কার্বন।

 শীতের শুরু থেকেই ঢাকার বায়ুমান কখনো চরম অস্বাস্থ্যকর এবং কখনো বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে যায়। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য শহরে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের বাইরে যাওয়া নিষেধ করা হয়। এ ছাড়া বায়ুদূষণ দূর করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। একটি সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর নগরের জন্য আয়তন অনুযায়ী জনসংখ্যা সীমিত রাখা, গাছপালা ও জলাভূমি রক্ষা করা আর বায়ু-মাটিদূষণ নিয়ন্ত্রণে রাখাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন বিশেষজ্ঞরা। এসব কারণে ঢাকার অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে। এক যুগ ধরে ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উৎস হিসেবে ইটভাটাকে মনে করা হতো। কিন্তু এই জরিপ বলছে, ঢাকার বাতাসে দূষিত বস্তুর উৎস হিসেবে ইটভাটার স্থান দখল করেছে যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া। দূষিত বাতাসে কঠিন ও তরল পদার্থ উড়ে বেড়ায়, যার মধ্যে রয়েছে কাচ, ধোঁয়া বা ধুলা, যেগুলোকে ‘বস্তুকণা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এসব বস্তুকণার মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী বলা হয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ‘বস্তুকণা ২.৫’। যেটি মানুষের চুলের ব্যাসের মাত্র ৩ শতাংশ, যেটি মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে যায়। 

এই দূষণ সবচেয়ে বেশি হয় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে; যা মূলত গাড়ির ইঞ্জিন বা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপন্ন হয়। ঢাকার বাতাসে ভেসে বেড়ানো অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা পাওয়া গেছে প্রতি ঘনমিটারে ৮৬ মাইক্রোগ্রাম, যা ২০০৩ সালে ছিল ৭২ মাইক্রোগ্রাম। ডব্লিউএইচও বলছে, বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার সহনীয় মাত্রা ৫ মাইক্রোগ্রাম। ঢাকার বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ পাওয়া গেছে ৮ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম, যা ২০০৩ সালে ছিল ৫ মাইক্রোগ্রাম। ডব্লিউএইচওর মানদণ্ড অনুযায়ী, বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইডের সহনীয় মাত্রা ৪০। অর্থাৎ সালফার ডাই-অক্সাইড সহনীয় মাত্রার চেয়ে কম রয়েছে ঢাকার বাতাসে। কিন্তু এটা বাড়ছে। গত বছর যা ছিল মাত্র ৬ মাইক্রোগ্রাম। ঢাকায় বর্ষায় ডেঙ্গুর ভয়, শীতে বায়ুদূষণের ভয়, সারা বছর থাকে শব্দদূষণ- মানুষ এসব সমস্যায় এখন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। 

বায়ু দূষিত হলে মানুষের শ্বাসতন্ত্রের রোগ বেড়ে যায়। ঘরে ঘরে যেমন সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত মানুষ বাড়ে, তেমনি হাসপাতালে বাড়ে শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মানুষের ভিড়। বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি হয় শ্বাসতন্ত্রের রোগ। এর মধ্যে হাঁপানি, ফুসফুসের কাশি ছাড়াও লাং ক্যানসার, স্ট্রোক ও কিডনির সমস্যা হয়। এদিকে বায়ুমানের সূচক ২০০ অতিক্রম করলে একে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ বলে ধরা হয়। বায়ুদূষণের কারণে সারা দেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় ৫ বছর ৪ মাস।

 ঢাকায় কমেছে প্রায় ৭ বছর ৭ মাস। অর্থাৎ ঢাকায় বায়ুদূষণ না থাকলে আমরা আরও প্রায় ৭ বছর ৭ মাস বেশি বাঁচতে পারতাম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর ৬ মাস। লাইফ ইনডেক্সের গবেষণা মতে, ১৯৯৮ সালে বায়ুদূষণের কারণে গড় আয়ু কমেছিল প্রায় ২ বছর ৮ মাস, ২০১৯ সালে সেটি ৫ বছর ৪ মাসে দাঁড়িয়েছিল। গবেষণা বলছে, সারা দেশের ৬৪টি জেলার প্রতিটিতেই বায়ুদূষণের হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী অন্তত ৩ গুণ বেশি। বায়ুদূষণের সঙ্গে মানুষের গড় আয়ুর বিষয়টি জড়িত। 

গত কয়েক যুগে এই শহরের সবুজ এলাকা ও জলাভূমি হারিয়েছে, আর বাতাস-মাটি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়েছে। গত এক বছরে বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর বসবাসযোগ্যতা নিয়ে যে কয়টি জরিপ হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান ছিল তলানিতে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার ভারতের রাজধানী দিল্লিবাসী। বায়ুদূষণ লাইফ ইনডেক্সের তথ্যমতে, বায়ুদূষণের কারণে সারা বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু কমেছে ২ দশমিক ২ বছর। স্থায়ীভাবে দূষণ বন্ধ করা গেলে বিশ্বের মানুষের গড় আয়ু ৭২ থেকে ৭৪ বছর হতো, যা সার্বিক হিসাবে ১৭ বিলিয়ন জীবন-বর্ষ। রাজধানী ঢাকায় গত ১০ বছরে বায়ুদূষণ বেড়েছে ৮৬ শতাংশ। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বায়ুদূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু ২ থেকে ৯ বছর পর্যন্ত কমছে। এর ফলে নানা ধরনের কঠিন অসুখের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করাই বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় শিকার।

 পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্মল বায়ু ও টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পের বাতাসের মান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজধানীর বায়ু ২০১৪ সালে ১৬৫ দিন বিপজ্জনক ছিল। ২০১৫ সালে দূষণের মাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৮ দিন। পর্যায়ক্রমে ২০১৬ সালে ১৯২ দিন, ২০১৭ সালে ২১২ দিন, ২০১৮ সালে ২৩৬ দিন, ২০১৯ সালে ২৮৩ দিন ঢাকার বায়ু দূষিত ছিল, যার ধারাবাহিকতায় ২০২০ ও ২০২১ সালে বায়ুদূষণের তালিকায় প্রথম হয় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। মৃত জীবদেহের পচনের ফলে অনেক ধরনের দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাস যেমন মিথেন, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি বাতাসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে বায়ুর দূষণ ঘটায়। মহাকাশ থেকে ভূপৃষ্ঠে আগত উল্কাপিণ্ড, মহাজাগতিক ধূলিকণা প্রভৃতি বাতাসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে বায়ুর দূষণ ঘটায়।

মানুষের দৈনন্দিন কার্যকলাপের ফলে প্রতিনিয়ত অবাঞ্ছিত বস্তু বাতাসে মিশ্রিত হচ্ছে, এগুলোকেই মনুষ্যসৃষ্ট কারণ বলে। শিল্পাঞ্চলের কারখানা থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, হাইড্রো কার্বন, ধাতব কণা, ধোঁয়া প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে বাতাসে মিশ্রিত হয়ে বাতাসকে দূষিত করে। বিভিন্ন যানবাহনে জীবাশ্ম জ্বালানির (পেট্রোল ও ডিজেল) দহনের ফলে বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত হয়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান বায়ুদূষক কার্বন মনো-অক্সাইডের প্রায় ৭০ শতাংশ এই যানবাহন থেকে নির্গত হয়। এ ছাড়া যানবাহনের ধোঁয়ায় প্রচুর নাইট্রোজেনের অক্সাইড থাকে, যা বায়ুকে দূষিত করে তোলে।

 যানবাহনের আধিক্যের জন্য শহরাঞ্চলের বাতাস বেশি দূষিত হয়। বায়ুমণ্ডলকে দূষণমুক্ত রাখতে নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করা প্রয়োজন। গাছ অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে, তাই প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষ রোপণ করলে বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন গ্যাসের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা হয়। জীবাশ্ম জ্বালানি দহনে বাতাস বেশি দূষিত হয়। তাই এগুলোর পরিবর্তে দূষণমুক্ত সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জোয়ার-ভাটার শক্তি প্রভৃতি ব্যবহার করা প্রয়োজন। সালফারবিহীন কয়লা ও সিসাবিহীন পেট্রোল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাসের সাহায্যে যানবাহন চালানোর মাধ্যমে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। 

বায়ুদূষণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন প্রয়োগ করে দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বায়ুদূষণের উৎস বা কারণ এবং কুফল সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বোধ জাগিয়ে তুললে বায়ুদূষণ রোধ করা সম্ভব। দুই কারণে ঢাকার বায়ু বেশি দূষিত হচ্ছে। প্রথমটি বাতাসের দূষিত উপাদান বাতাসেই রয়ে যাচ্ছে। এর বাইরেও রয়েছে শহরে বড় প্রকল্পের কাজ, নির্মাণাধীন ভবনের কাজ, যানবাহনের ধোঁয়ায় ঢাকার বায়ুর চাপ বেশি। এই দূষিত অংশ বায়ুর নিম্নস্তরে ২০০৩০০ ফুট ওপরে অবস্থান করছে। বর্তমানে বায়ুদূষণে ধুলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গাড়ি ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া। বর্তমানে বাতাসে ধুলা আগের চেয়ে পরিমাণে বেড়েছে। আগে এত মেগা প্রজেক্ট (বৃহৎ প্রকল্প) ও গাড়ি ছিল না। 

পাশাপাশি ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জলাশয় ভরাট হওয়ায় ধুলার নতুন উৎস জন্মেছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ধুলা এমনিতে বেশি। এরপর কয়েক বছর ধরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে উন্মুক্ত পরিবেশে নতুন নতুন নির্মাণযজ্ঞ বাড়িয়েছে ধুলাদূষণ। মেট্রোরেলের মতো বড় প্রকল্প, পূর্বাচল সিটি ও বছিলার মতো কিছু অঞ্চল এবং অজস্র ছোট আবাসন প্রকল্প এর মধ্যে রয়েছে। যোগ হয়েছে মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধের মতো খানাখন্দে ভরা কিছু রাস্তা। এসব স্থান ছাড়াও রাজধানীর প্রবেশমুখ গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, পূর্বাচল, কেরানীগঞ্জ, টঙ্গীসহ আরও কিছু এলাকায় ধুলার আধিক্য দেখা যায়। ঢাকা শহর ক্ষমতার চেয়ে তিন থেকে চার গুণ স্থাপনা ধারণ করে আছে। এরপরও শিল্পায়ন, কংক্রিটের ভবন, আবাসন প্রকল্প হচ্ছে। 

বাফার এলাকাগুলো মাটি ও বালু দিয়ে ভরাট করে নির্মাণযজ্ঞ চলছে। ফলে দূষণ রোধের এলাকাগুলো উল্টো দূষণ বাড়াচ্ছে। শুধু পানি ছিটিয়ে উষ্ণ আবহাওয়ায় ধুলা বেশিক্ষণ ভিজিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এই অবস্থার মধ্যেও গত বছর পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বায়ুদূষণ রোধে নির্দেশিকার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। নির্দেশিকায় রাস্তা নির্মাণের সময় নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, বিটুমিনের ওপর বালু না ছিটিয়ে মিনি অ্যাসফল্ট প্যান্টের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, রাস্তার পাশের মাটি কংক্রিট বা ঘাসে ঢেকে দেওয়া, রাস্তা পরিষ্কারের ঝাড়ুর পরিবর্তে ভ্যাকুয়াম সুইপিং ট্রাক ব্যবহার, বড় সড়কে কমপক্ষে দুবার পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নেওয়া কোনোটি কার্যকর করার উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে এখনই জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।

লেখক: সাবেক রেজিস্ট্রার, বিএসএফএমএসটিইউ
[email protected]

জাতীয় ঐক্য সব সময় ভালো উদ্যোগ: ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৫০ পিএম
আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৫৪ পিএম
জাতীয় ঐক্য সব সময় ভালো উদ্যোগ: ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

জাতীয় ঐক্য সব সময় ভালো, দেখা যাক এটার ফলাফল কী দাঁড়ায়। তবে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হয়েছে। মূলত পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে, প্রাদেশিক সরকারের সঙ্গে।

কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে খুব একটা বড় রকমের মতবিরোধ হয় নাই। ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুবই গভীর। আমরা অনেক কিছুই আমদানি করি। রপ্তানির দিক থেকে যদিও কম। দুটিই প্রতিবেশী দেশ। তাই চেষ্টা করা হচ্ছে সম্পর্কটা ঠিক রাখার; সম্পর্ক যাতে অবনতি না হয়।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

সংকটে সবাইকে একত্রিত করা ভালো অগ্রগতি: ড. দিলারা চৌধুরী

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৪২ পিএম
আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৫০ পিএম
সংকটে সবাইকে একত্রিত করা ভালো অগ্রগতি: ড. দিলারা চৌধুরী
ড. দিলারা চৌধুরী

আমি মনে করি, এটা একটা ইতিবাচক বিষয়। একটা ভূমিকা প্রধান উপদেষ্টা নিয়েছেন। ছাত্রদের সঙ্গে বসেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসেছেন। এই সংকটে সবাইকে একত্রিত করা হয়েছে। এটা অত্যন্ত ভালো অগ্রগতি।

ভারতের বিষয়ে আমাদের এখন কথা বলতে হবে। আমরা আমাদের নাগরিককে গ্রেপ্তার করতে পারব না? চিন্ময় তো বাংলাদেশের নাগরিক। তার জন্য এ রকম করবে? তাহলে আমাদের স্বাধীনতা আছে নাকি। আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। ঐকমত্যে সবাইকে নিয়ে আসছেন, আমি খুবই খুশি। জনগণও খুশি হবে। আমাদের দেশের ওপর হুমকি এসেছে, আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে ড. ইউনূসকে সমর্থন দেব। এর বাইরে যে কথা বলবে সে দেশদ্রোহী।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

লেবাননের যুদ্ধবিরতি এবং বিশ্ব পরিস্থিতি

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৯ এএম
লেবাননের যুদ্ধবিরতি এবং বিশ্ব পরিস্থিতি
হর্ষ কাকর

যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের দীর্ঘ আলোচনার পর ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধের পর এই যুদ্ধবিরতি হয়। এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে, যাদের বেশির ভাগই নির্দোষ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‌এই চুক্তিটি লেবাননে যুদ্ধ বন্ধ করবে এবং লেবানন থেকে পরিচালিত হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হুমকি থেকে ইসরায়েলকে নিরাপদ করবে।’ তারা আরও বলেন, ‘‌এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী শান্তি পুনরুদ্ধারের পরিস্থিতি তৈরি করবে। উভয় দেশের বাসিন্দাদের নিরাপদে তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে দিন।’ 

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘আমরা চুক্তি কার্যকর করব এবং যেকোনো লঙ্ঘনের জন্য আমরা জবাব দেব।’ চুক্তি অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে এই যুদ্ধবিরতি ৬০ দিনের জন্য হবে। পশ্চিম এশিয়ায় সংঘাতের একটি অংশের অবসান হওয়ায় বিশ্ব এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। লেবাননে সংঘাতে এখন পর্যন্ত ১ দশমিক ২ মিলিয়ন লেবানিজ এবং ৬০ হাজার ইসরায়েলিকে বাস্তুচ্যুত করেছে। লেবাননের মতে, তাদের প্রায় ৩ হাজার ৭০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে, যেখানে ইসরায়েলের ৭৫ জন সৈন্য ও ৪৫ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। ইউনাইটেড নেশন সিকিউরিটি কাউন্সিল রেজল্যুশন-১৭০১ চুক্তি অনুসারে ২০০৬ সালের ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ বিরোধের অবসান ঘটেছিল। ২০০৬-এর মতো, শুধু লেবাননের সশস্ত্র বাহিনী এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীরা লেবাননের লিতানি নদীর দক্ষিণে কাজ করবে। তার মানে হচ্ছে, হিজবুল্লাহ বাহিনী সীমান্ত থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পিছু হটবে যখন ইসরায়েলি বাহিনী লেবানন ছেড়ে দেবে।

২০০৬ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তি উভয় পক্ষই লঙ্ঘন করেছে। হিজবুল্লাহ ভূগর্ভস্থ কাঠামো নির্মাণ করছে এবং ইসরায়েলি বিমান নিয়মিতভাবে লেবাননের ওপর দিয়ে উড়ছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে আক্রমণ শুরু না করা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি বহাল ছিল। এটি উল্লেখ করা উচিত যে, উভয় যুদ্ধবিরতি (২০০৬ এবং বর্তমান) ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে, লেবাননের মধ্যে নয়। বিশ্ব হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে মনোনীত করা সত্ত্বেও তাদের বৈশ্বিক অস্তিত্ব রয়েছে বলে স্বীকার করেছে। বর্তমান যুদ্ধবিরতিতে সংঘাতে জড়িত সব পক্ষের জন্য জয়জয়কার বজায় থাকবে বলে আশা করা যায়। 

জো বাইডেনের এটা বিশেষ অর্জন, যদিও তার প্রেসিডেন্সির শেষ পর্যায়ে এসে এটি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে যদি এই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হতো, তাহলে কমলা হ্যারিসের উপকার হতে পারত। যুক্তরাষ্ট্রকে তার সীমা প্রসারিত করতে হচ্ছে। ইসরায়েল ও ইউক্রেনকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করার পাশাপাশি ভবিষ্যতের যেকোনো অপারেশনের জন্য নিজস্ব মজুতও বজায় রাখা হচ্ছে। নেতানিয়াহু আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার তিনটি কারণ ঘোষণা করেছেন।

প্রথমত, ইসরায়েলকে তার প্রধান প্রতিপক্ষ ইরানের দিকে মনোযোগ দিতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধবিরতি একটি ‘নিশ্বাস’ হিসেবে আভির্ভূত হয়েছে, কারণ ইসরায়েলি বাহিনী তাদের মজুত পুনরায় পূরণ করার সুযোগ পাচ্ছে। অবশেষে হামাস ও হিজবুল্লাহর অপারেশন আলাদা হয়ে যায়। আরও একাধিক কারণ রয়েছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী কিছুটা ক্লান্ত। সিএনএন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী অতি ধার্মিকদের বিরুদ্ধে ১১২৬টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। 

ইসরায়েল সুপ্রিম কোর্ট স্থির করেছিলেন যে, গোঁড়া ধার্মিক ইহুদিদের সামরিক চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া যাবে না। একজন ইসরায়েলি সামরিক মুখপাত্র অতি-অর্থোডক্স ইহুদিদের আদেশের খসড়া তৈরির বিষয়ে মন্তব্য করার সময় এমনভাবেই উল্লেখ করেছেন। ‘আইডিএফে (ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী) অনেক সৈন্যের প্রয়োজন। আমাদের ১০ হাজারের মতো সৈন্য রয়েছে কিন্তু এটি স্থিতিশীল পরিসংখ্যান নয়। কারণ দুর্ভাগ্যবশত আমাদের হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি।’ হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি হলে সৈন্য নিয়োগের চাহিদা কমে যাবে। অন্যদিকে ইসরায়েল সরকারের মধ্যে সংঘাতের আচরণ ও নেতানিয়াহুর কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র নিয়েও মতানৈক্য রয়েছে। 

ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে কখনোই পরাজিত করতে পারেনি। ২০০৬ সালে যুদ্ধবিরতির আগে উভয় পক্ষই হতাহত হয়েছিল। তখন তারা সেই যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানিয়েছিল। কারণ তারা পরে সংগ্রাম করার সুযোগ খুঁজেছিল। ইসরায়েল শিক্ষা নিয়েছিল এবং এই অভিযানে তারা তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিল। হিজবুল্লাহও পরিবর্তন এনেছিল এবং ধারাবাহিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও আরেকটি যুদ্ধবিরতি জোরদার করতে সক্ষম হয়েছিল। এবারের যুদ্ধে ইসরায়েল লক্ষ্যবস্তুতে বোমা হামলার মাধ্যমে হিজবুল্লাহর সিনিয়র নেতাদের নির্মূল করেছে। পেজার বোমার আঘাতে মাধ্যম স্তরের নেতাদের মেরে ফেলেছে। তা ছাড়া বিমানবাহিনী হিজবুল্লাহর রকেট স্টোরেজ ডিপো এবং উৎপাদন কেন্দ্রে বোমা হামলা করে। 

যা-ই হোক, এগুলো রকেট উৎক্ষেপণ বন্ধ করতে তেমন কিছু করেনি। হিজবুল্লাহও ২০০৬ সাল থেকে অনেক কিছুই শিখেছিল। যুদ্ধবিরতির কয়েক দিন আগে হিজবুল্লাহ ২৫০টিরও বেশি রকেট নিক্ষেপ করেছিল। লেবাননে অনুপ্রবেশ করা ইসরায়েলি বাহিনী ২০০৬ সালে বা এখন পর্যন্ত খুব বেশি সফল হতে পারেনি। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও হিজবুল্লাহ সব সময় ফিরে এসেছে। ইসরায়েলের জন্য বিশেষ কঠিন হবে। কারণ তারা গাজায় হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলায় লেবাননের বেসামরিক লোকের হতাহতের ঘটনায় শুধু হিজবুল্লাহ লাভবান হয়েছে। কারণ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো নির্দোষ মানুষের মৃত্যুর মাধ্যমে সমর্থন লাভ করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে এটি ইসরায়েলের বৈশ্বিক অবস্থানকে শক্ত করে যাচ্ছে। ইসরায়েল এখন সিরিয়ার পাশাপাশি ইয়েমেনেও হামাস, ইসরায়েলবিরোধী গোষ্ঠীর দিকে মনোনিবেশ করতে পারে।

ইসরায়েল সচেতন রয়েছে যে, এই যুদ্ধবিরতি হিজবুল্লাহকে তার কাঠামো ও সামরিক শক্তি পুনর্নির্মাণ করতে সক্ষম করবে। ভবিষ্যতে কোনো একসময় আবার যুদ্ধ শুরু হবে। অবিলম্বে সেই যুদ্ধ না-ও হতে পারে, তবে ঘটবে। এটা সময়ের ব্যাপার কিন্তু উভয় দেশের নাগরিকদের জন্য কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। হামাস ও হিজবুল্লাহর প্রধান সমর্থক ইরানের ভবিষ্যতের জন্য তাদের অন্তত প্রক্সি সুরক্ষিত থাকা অপরিহার্য। হিজবুল্লাহকে বাঁচাতে গিয়ে হামাসকে আত্মত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ইরানের জন্য হামাস, হুতি এবং হিজবুল্লাহ শপথকারী এক মিত্র এবং তাদের একমাত্র শত্রু ইসরায়েল। তাদের সবাই একসঙ্গে ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না। ইরান নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। 

এই যুদ্ধবিরতি প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ কারণেই হিজবুল্লাহ প্রধান নাইম কাসিমকে যুদ্ধবিরতির অনুমোদন দিয়েছে। হিজবুল্লাহকেও পুনরুদ্ধার করতে হবে। ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের শত্রুতা অব্যাহত রয়েছে। যুদ্ধবিরতির অন্যতম কারণ এটি দুই পক্ষের সক্ষমতা, জনশক্তি, কাঠামো এবং অস্ত্রশস্ত্রের মজুত পুনর্নির্মাণ করে। যদিও এতে অনেক হতাহত হয়েছে। তবে তারা সচেতন যে, তারা যুদ্ধে হারেনি। তারা যুদ্ধ এবং পরবর্তী পর্যায়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে চূড়ান্ত বিশ্লেষণে, ইসরায়েল এবং হিজবুল্লাহ উভয়ই জানে এটি স্থায়ী শান্তিচুক্তি নয়। এটা কতদিন চলবে তা কেউ জানে না। বর্তমানে উভয় পক্ষের বাহিনী এবং জনগণও যুদ্ধে ক্লান্ত। এই ক্লান্তিই উভয় পক্ষকে অন্তত অল্প সময়ের জন্য শান্তিতে থাকতে বাধ্য করতে পারে। 

লেখক: ভারতীয় সেনাবাহিনীর 
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল
দ্য স্টেটসম্যান থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল