পেশাগত কারণে যতবার দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি গিয়েছি, ততবারই শুনেছি জলপাইগুড়ি হলো টি, টিম্বার এবং তিস্তার জায়গা। তিস্তা নদীর সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশের একটা সংযোগ রয়েছে। তিস্তার উৎস সিকিমে।
এই তিস্তাই এখন আন্তর্জাতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে। জাতিপুঞ্জের সনদে আছে- নদীর উৎস যে দেশে তারাই জলের সিংহভাগ পাবে। কিন্তু নিচের দিকে যে দেশগুলো আছে, তাদেরও জলের ভাগ দিতে হবে।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং থেকে শুরু করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বারবার চাইছেন, এই নদীর জলের অংশ বাংলাদেশকে দেওয়া হোক। এই আন্তর্জাতিক নিয়ম ১৪ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মানতে রাজি নন। তিনি কোনো আইনই মানবেন না। গত সোমবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় গলার স্বর চড়িয়ে তিস্তা চুক্তি মানি না, মানব না বলেছেন।
তিনি আন্তর্জাতিক নিয়ম বা কূটনৈতিক সম্পর্ক কী, তা হয় ভুলে গেছেন বা জানেন না। সোমবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় রেকর্ড করে রাখলেন, ভবিষ্যতে ভারত সরকার যদি তাকে না জানিয়ে ঢাকার সঙ্গে চুক্তি করে, সেই চুক্তি বৈধ বলে তিনি কখনোই স্বীকার করবেন না।
এবার দেখা যাক তিনি ঠিক কী বলেছেন? তিনি বলেছেন, তিস্তার জল বাংলাদেশকে দেওয়া সম্ভব নয়। আমাদের নাকের ডগা দিয়ে জল কেটে বাংলাদেশকে দেওয়া হবে। এটা মানব না! অসম্ভব। বস্তুত, তিস্তার জলচুক্তি নিয়ে তার আপত্তি এবার আরও নির্দিষ্ট করে বিধানসভায় নথিভুক্ত করে দিয়েছেন তিনি।
ভুটানের নদীর প্লাবনে পশ্চিমবঙ্গে বন্যা মোকাবিলা নিয়ে আলোচনার সময় মমতা বলেছেন, এখন বাংলাদেশকে জল দেওয়া হলে উত্তরবঙ্গের মানুষ খাওয়ার জল পাবেন না। সেচের জল তো দূর। মমতা আরও বলেছেন, বাংলার মানুষের কাছে আমরা দায়বদ্ধ।
তারাই আমাদের নির্বাচিত করেছেন। এ ক্ষেত্রে কোনো আপস করব না। বিরোধী দল বিজেপি প্রশ্ন তুলেছে, তিস্তার জলবণ্টন চুক্তি ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের বিষয়। রাজ্যের বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী কীভাবে তা নিয়ে ঘোষণা করতে পারেন।
তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে দিল্লি ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে এই টানাপোড়েন বহুদিনের। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলে তার সুর চড়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা না করেই মোদি সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে অভিযোগ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তার কথায়, কংগ্রেস বা বিজেপির আগের সরকারের সময় এ রকম হয়নি। বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আগে রাজ্য সরকারের মত নেওয়া হয়েছিল। তার পর জ্যোতি বসুকে বাংলাদেশে সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল। সেই সূত্রে মোদি সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা না করেই চুক্তি করা হচ্ছে।
বিধানসভার বক্তৃতায় মমতা বলেন, দিল্লিতে সদ্যসমাপ্ত নীতি আয়োগের বৈঠকে এই দাবি জানিয়ে এসেছেন তিনি। ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সুসম্পর্কের কথা উল্লেখ করে তিনি এ বিষয়ে আলোচনা করে নেওয়ার কথাও বলেছেন।
সেই সূত্রেই মমতা গঙ্গার ভাঙন ও ফারাক্কা বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে দিল্লির বঞ্চনার কথা জানিয়েছেন। ফারাক্কার চুক্তি হয়েছিল বাংলাদেশের সঙ্গে ১৯৯৬ সালে। তখনো পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওই চুক্তির কোনো বিরোধিতা করেনি।
যে সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শেখ হাসিনার চিঠি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তাকে চিঠি দেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য চিঠি লিখে জানিয়ে দেন, রাজ্য সরকারের কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি ছিল না কংগ্রেসেরও। তখন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন আবু বরকত আতাউল গনি খান চৌধুরী।
শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সেচমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক মালদহে গিয়ে গনি খান চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান। কারণ বাংলাদেশের জিয়াউর রহমান ফারাক্কার জল নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জে নালিশ করেছিলেন। সেই নালিশের জবাব দিতে ইন্দিরা গান্ধী বরকত গনি খানকে রাষ্ট্রপুঞ্জে পাঠিয়েছিলেন।
রাষ্ট্রপুঞ্জে নানা দেশের প্রতিনিধিদের তিনি জিয়ার অভিযোগের অসারতা ব্যাখ্যা করেন প্রায় ৫০ দিন ধরে। সে সময় রাষ্ট্রপুঞ্জ জানিয়েছিল, এটা কোনো আন্তর্জাতিক বিষয় নয়, ভারত ও বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয়। দুই দেশকে আলোচনা করে তা ঠিক করতে হবে। তবে সে সময় রাষ্ট্রপুঞ্জ ‘রাইপেরিয়ান রাইটস’, অর্থাৎ নদীর তলার দিকের দেশগুলোকেও জলের ভাগ দিতে হবে বলে উল্লেখ করে দিয়েছিল।
এবার তিস্তার পরিস্থিতির দিকে নজর দেওয়া যাক। মমতার বিধানসভার বক্তব্য শুনেই এই রাজ্যের বিরোধী সিপিএম-কংগ্রেস বলেছে, কূটনীতি কী, সেটাই এই মহিলা বোঝেন না। এই রাজ্যের গোয়েন্দারা অস্বীকার করেনি যে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ওপার বাংলার রাজাকারদের একটা শ্রেণির সুসম্পর্ক আছে।
২০১২ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ঢাকা সফরের আগে তিস্তা চুক্তির প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর জন্য জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন ভারতের সেচসচিবকে সঙ্গে নিয়ে মমতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। তাকে ঢাকা সফরে যাওয়ার কথাও বলেন।
মমতা যাননি। ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মনমোহনের দূত মেননকে। কিন্তু উত্তর-পূর্ব রাজ্যের বাকি ছয়জন মুখ্যমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ঢাকা সফর করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য সচিব ছিলেন প্রসাদ রায়।
প্রসাদ রায়কে শিবশঙ্কর মেনন বলে এসেছিলেন, আপনার মুখ্যমন্ত্রীকে একটু ইংরেজি শেখান। উনি কোনো কথা বুঝতে পারছেন না বা বোঝার চেষ্টা করছেন না। আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই।
সেখান থেকে আমরা এক ইঞ্চিও নড়ব না। এটাই ভারতবর্ষের বিদেশ নীতির মূল কথা। মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ঢাকা সফরে না গেলেও পরবর্তী সময়ে মমতা কিন্তু নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ঢাকায় গিয়েছিলেন।
প্রয়াত সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার, যিনি জলপাইগুড়ির লোক, বলেছিলেন, তোর্সা নদীর উৎপত্তি ভুটানে। তার সঙ্গে তিস্তার কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ মমতা তোর্সার জল ঢাকাকে দেওয়ার কথা বলেছিলেন।
ভারতের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। মমতার এই জেদ নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে নানা মহলে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ওয়াকিবহাল মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, রাজাকারদের সঙ্গে কি তাহলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটা গোপন সম্পর্ক আছে?
ওয়াকিবহাল সূত্র মনে করে, বাংলাদেশের একশ্রেণির সন্ত্রাসবাদীর সঙ্গে মমতার গোপন যোগাযোগ আছে। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের একশ্রেণির ব্যবসায়ীর সঙ্গেও মমতার দীর্ঘদিন ধরে গোপন যোগাযোগ আছে।
করোনাকালে এসব ব্যবসায়ী বিশেষ বিমানে কলকাতায় এসে মমতার মন্ত্রিসভার দুজন মন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে কালীঘাটে গিয়ে মমতার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাদের মধ্যে এক মন্ত্রী এখন দুর্নীতির দায়ে জেলে। অপর মন্ত্রী এখন বাংলাদেশের ওপর ছড়ি ঘোরানোর কাজে ব্যস্ত। এই পরিস্থিতিতে তিস্তা চুক্তি কি ঝুলেই থাকবে? নাকি এই সমস্যার একটা সুষ্ঠু সমাধান হবে।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক