ঘৃণা, সহিংসতা এবং দুর্দশা অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলতেই থাকবে এবং দিন দিন আরও ছড়িয়ে পড়বে। এত হত্যাকাণ্ড চলমান থাকায় ইসরায়েলের প্রতিহিংসা-বিদ্বেষ বাড়তেই থাকবে। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অঞ্চল যেমন- লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, মিসর, জর্ডান গাজা সংঘাতের মতো বিষাক্ত পরিণতি থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পেয়েছে। গাজার গণহত্যার প্রতিবাদে ওয়াশিংটন ডিসি ও ব্রিটেনে ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।...
গাজা যুদ্ধ বন্ধ করতে না পারায় মধ্যপ্রাচ্য মারাত্মক বর্বরতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ফিলিস্তিনের হামাসের রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়াকে তেহরানে হত্যা করা হয়েছে, যা ইসরায়েল ৭ অক্টোবরের নৃশংসতার প্রতিশোধ হিসেবে পালন করবে। কিন্তু ইরানের কট্টরপন্থি এবং আরব বিশ্বজুড়ে জঙ্গিগোষ্ঠী এটিকে তাদের বিশ্বাসের ওপর হুমকি হিসেবে দেখছে। তারা মনে করে, ইসরায়েল একটি বিপজ্জনক রাষ্ট্র। যেকোনো মূল্যে ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে হবে।
ঘৃণা, সহিংসতা এবং দুর্দশা অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলতেই থাকবে এবং দিন দিন আরও ছড়িয়ে পড়বে। এত হত্যাকাণ্ড চলমান থাকায় ইসরায়েলের প্রতিহিংসা-বিদ্বেষ বাড়তেই থাকবে। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অঞ্চল যেমন- লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, মিসর, জর্ডান গাজা সংঘাতের মতো বিষাক্ত পরিণতি থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পেয়েছে। গাজার গণহত্যার প্রতিবাদে ওয়াশিংটন ডিসি ও ব্রিটেনে ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও ক্রোধে ছেয়ে গেছে। জাতিসংঘের ব্যর্থতা দিন দিন আশঙ্কাজনকভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। কেউ এই বিষাক্ত ভয়াল থাবা থেকে মুক্ত হতে পারছে না।
গাজায় হামাস নেতাদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে ইসমাইল হানিয়া ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) বিচারের মুখোমুখি হওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন নেতার সাহায্য চেয়েছেন ফিলিস্তিনে যুদ্ধবিরতির জন্য। ইসরায়েলকে তার অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য করতেন তিনি। সেই সম্ভাবনাটা এখন একদম ক্ষীণ হয়ে গেল। পরিবর্তে ইসরায়েল আবারও বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য ‘ন্যায়বিচার’ দাবি করেছে। গত এপ্রিল মাসে দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলি গোপন হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ডের একজন শীর্ষ জেনারেলকে হত্যা করা হয়। এই অঞ্চলটিকে সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে ইসরায়েল। একই ধরনের অসংখ্য হত্যাকাণ্ড ইসরায়েল ঘটিয়ে যাচ্ছে।
ফিলিস্তিনে এই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। গাজায় ফিলিস্তিনের নাগরিকদের ওপর গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডের প্রধান স্থপতি নেতানিয়াহু। তাকেও তার অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য করা উচিত। আইসিসির প্রধান প্রসিকিউটর মার্কিন বিরোধিতা সত্ত্বেও এর বিচার নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সুষ্ঠু বিচার হওয়ার মতো তেমন লক্ষণ নেই। তিনি যে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন, তাতে নেতানিয়াহু নিজেই ঘাতকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবেন।
গত মঙ্গলবার দক্ষিণ বৈরুতে ইসরায়েলের বিমান হামলায় ফুয়াদ শুকুর নামে একজন সিনিয়র হিজবুল্লাহ কমান্ডার নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে আরও ভয়াবহ ধ্বংসের সূত্রপাত হতে পারে। আবারও ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে বড় আকারের যুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গত সপ্তাহে গোলান মালভূমিতে হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিশোধ হিসেবে আক্রমণটি করেছিল ইসরায়েল। সেই আক্রমণে ১২ জনের প্রাণহানি ঘটে।
তবে হিজবুল্লাহ গাজায় ইসরায়েল-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার প্রধান কারণ এটাই। হিজবুল্লাহ সংগঠনের নেতা হাসান নাসরাল্লাহ ৭ অক্টোবরের পর থেকে তুলনামূলকভাবে সংযত ছিলেন। যদিও তার হাতে বিপুল সামরিক সম্পদ ছিল। নাসরাল্লাহ বলেছেন, ‘যখন গাজায় যুদ্ধবিরতি হবে, তখন থেকেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে হামলা বন্ধ হবে।’ ইসমাইল হানিয়া ছিলেন হামাসের একজন সিনিয়র নেতা, যিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ও আলোচক। ইসমাইল হানিয়াকে ইরানে হত্যা করা হয়েছে এবং এ কারণেই ফিলিস্তিনে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা কমে গেছে।
লেবাননের কর্মকর্তাদের মতে, বৈরুতে বিমান হামলায় দুই শিশুর প্রাণহানিসহ ৭৪ জন আহত হয়েছেন। তারপর ইসরায়েল বাহিনী কয়েক মাস ধরে দায়মুক্তি দিয়ে গাজার শিশুদের হত্যা করছে। এ ছাড়া জাতিসংঘ মোট মৃতের সংখ্যা ১৫ হাজার নিবন্ধিত করেছে।
এটা এমন নয় যে, ইসরায়েল এই সীমাহীন ধ্বংসযজ্ঞের বিস্তৃত পরিণতি সম্পর্কে জানে না। তারা বলে যে, এর জন্য অনেকেই দায়ী। ইসরায়েলের একজন সামরিক মুখপাত্র বলেছেন, ‘হিজবুল্লাহর চলমান আগ্রাসন ও নৃশংস হামলা লেবানন এবং সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের জনগণকে ব্যাপক উত্তেজনার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদিও আমরা বড় আকারের যুদ্ধ ছাড়াই শত্রুতার সমাধান করতে পছন্দ করি, আইডিএফ (ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী) যেকোনো পরিস্থিতির জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত।’
ইসরায়েল বৃহত্তর যুদ্ধ এড়াতে চায় না এবং তা বাস্তবে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। হুতি শিয়া জঙ্গিদের দিয়ে তেল আবিবে ড্রোন হামলার পর ইসরায়েল এই মাসে ইয়েমেনের লোহিত সাগরের বন্দর হোদেইদাহে বোমাবর্ষণ করেছে। নেতানিয়াহু যার প্রায় প্রতিটি সমস্যার উত্তরে চরম সহিংসতা ও বোমা হামলা প্রকাশ পায়। নেতানিয়াহু এক বক্তৃতায় বলেন, ‘আমার স্পষ্ট মনে হয় যে, এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে ইসরায়েলের হাত পৌঁছাবে না।’ এটি পুরো মধ্যপ্রাচ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মতো শোনাচ্ছিল। তবু এটি এমন একটি যুদ্ধ, যেখানে ইসরায়েল শেষ পর্যন্ত জিততে পারবে না।
আবারও হুতিরা বলেছে যে, তারা ইসরায়েল এবং লোহিত সাগরে আক্রমণ করেছে। ইসরায়েল গাজাকে ধ্বংস করে দেওয়ায় বড় বিপাকে পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। হুতিদের দাবি, যদি ফিলিস্তিনে যুদ্ধবিরতি হয়, তা হলে তারা তাদের হামলা বন্ধ করবে। তারা এ বিষয়ে ঐকমত্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইইউ এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ তত্ত্বগতভাবে ফিলিস্তিনে যুদ্ধবিরতির সমর্থন করে। ফিলিস্তিনের যুদ্ধবিরতি জন্য আরব বিশ্ব ছাড়াও ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কয়েক মাস ধরে দাবি করে আসছে। কিন্তু যুদ্ধবিরতি কার্যকর হচ্ছে না।
ইরান কি ইসমাইল হানিয়া হত্যাকাণ্ডে সরাসরি পাল্টা আঘাত করবে? হিজবুল্লাহ কি আরও বাড়বে? ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর নির্যাতন ও যৌন হয়রানির কারণে বিশ্ববাসী ঘৃণার চোখে দেখবে। নেতানিয়াহুর মন্ত্রীদের সমর্থিত ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের কারণে জাতীয় বিভক্তি আরও গভীরভাবে নিমজ্জিত হবে।
মানুষ বলে মধ্যপ্রাচ্য জটিল। হ্যাঁ তাই। কিন্তু এর কোনো উত্তর নেই। এটা সত্য হতে পারে। কিন্তু রকেট থাকা সত্ত্বেও গাজা রকেট সায়েন্স নয়। এটি এত জটিল নয়। যুদ্ধ বন্ধ করুন। হত্যা বন্ধ করুন। শিশুদের বাঁচান। যুদ্ধবিরতিতে সম্মত এবং জিম্মিদের মুক্ত করুন। যদি একটু সহজ করে নেওয়া যায়, তা হলে সব সমস্যারই সমাধান করা সম্ভব।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, দ্য গার্ডিয়ান ও পররাষ্ট্রবিষয়ক পর্যবেক্ষক; দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল