মুক্তিযুদ্ধ সময়কালীন আমরা যুদ্ধ দেখেছি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গেই ছিলাম এবং নিজেরা যুদ্ধ করেছি। খুবই দুঃখের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে, আমাদের জীবদ্দশায় আমরা এ ধরনের ঘটনা কখনো দেখব ভাবিনি। এটা আমাদের চিন্তার বাইরে ছিল। তার পরও যা ঘটে গেল, মিডিয়ার কল্যাণে যা দেখেছি, আমরা আশঙ্কিত, একই সঙ্গে আতঙ্কিত বোধ করেছি। এই ধরনের পরিস্থিতি ঘটবে এটা আমাদের কারও কাম্য ছিল না। আমাদের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছিল ন্যায়সংগত দাবি নিয়ে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন শিক্ষাবান্ধব মানুষ।
তিনি ছাত্রদের ডেকে নিয়ে আশ্বস্ত করতে পারতেন। তিনি বলতে পারতেন, আমরা দেখছি। তোমরা লেখাপড়ায় ফিরে যাও। কিন্তু তা না বলে তিনি যা বললেন, এতে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ আরও বেড়ে গেল। প্রথমদিকে আমাদের নীতিনির্ধারকরা কেউই বুঝতে পারেননি যে, এটা স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়বে।
তার পর বিভিন্ন উসকানিমূলক কথাবার্তা বিভিন্ন মহল থেকে আসতে লাগল, এমনকি সরকারি দলের মধ্য থেকেও। আমাদের শিক্ষার্থীরা বয়সে তরুণ। স্বভাবতই তাদের রক্ত গরম থাকবে। আমার প্রশ্ন হলো- যেটা শুরুতেই সামাল দেওয়া যেত, সেটা সামলানোর চেষ্টা কেন করা হলো না!
এর মধ্যে নানা ধরনের অসাধুচক্র, স্বার্থান্বেষী মহল ঢুকে গেছে। তাদের মধ্যে আবার প্রতিক্রিয়াশীল চক্র আছে। তারা এই সুযোগটা নিতে চেষ্টা করেছে। সাধারণ মানুষ ও অভিভাবকদের মধ্যে এই ক্ষোভ ছড়িয়ে গেছে। ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলব না। একটি প্রাণ গেলেও সেটা যে বা যারাই করে থাকুক, তাৎক্ষণিকভাবে সরকারের উচিত ছিল তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। যারা মারা গেছেন অথবা আহত হয়েছেন, গ্রেপ্তার হয়েছেন, ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে ক্ষোভটা সংক্রমিত হয়েছে।
ফলে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, বাজার, আমাদের রেমিট্যান্স সবকিছুতেই একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। নীতিনির্ধারকদের এই দূরদর্শিতার অভাবটুকু আমাদের খুব কষ্ট দিয়েছে। যখন তারা লাগাম টানার চেষ্টা করেছেন ততদিনে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে।
স্বাধীনতাবিরোধী ক্ষতিকারক শক্তি সবাই মাঠে নেমে গেছে। ফলে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত, পর্যুদস্ত। এমনকি একজন রিকশাচালককে প্রশ্ন করলেও তিনি হতাশা ব্যক্ত করেন। মাঠের কৃষক জানতে চান তার কি অপরাধ যে, দেশের এমন অবস্থা হবে? এ আত্মজিজ্ঞাসা সবার মনে।
দেশে কেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হলো! এখন দাবি তিনটি; প্রথমত স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে হবে। সেটা মারদাঙ্গা করে নয়। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নয়। নীতিনির্ধারকরা বলেছেন, কাউকে যেন আন্দোলন করার সময় আটক করা না হয়। ছাত্রছাত্রীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে আন্দোলন বা মারদাঙ্গা করতে নামেনি। যারা মৌন মিছিল বের করেছিল, সেখানেও কেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হস্তক্ষেপ করবে?
শুধুমাত্র একজন-দুজনকে বদলি করলেই কি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব? মুগ্ধর মতো কত মুগ্ধ প্রাণ হারাল; জিজ্ঞাসাবাদ না করেই ছাত্রছাত্রীকে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়েছে, এ কেমন হঠকারিতা? যতক্ষণ না এগুলো বন্ধ হবে অসন্তোষ বাড়তেই থাকবে।
আমরা আশঙ্কা করছি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটাই পিছিয়ে গেছে। কভিডও এতটা ক্ষতি করতে পারেনি। আমাদের মূল কারণটা খুঁজে দেখতে হবে। কেন এরা আন্দোলন করছিল? সেটা শ্রমবাজারের জন্যই তো। সুদূরপ্রসারী কারণটিও আমাদের লক্ষ্য করতে হবে। প্রতি বছর লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার দেশে তৈরি হচ্ছে। তাদের মধ্যে এই অবস্থায় অসন্তোষ ছিল। কাজেই তাদের দীর্ঘমেয়াদি একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
শুধু সরকারি চাকরি নয়, তাদের জন্য শ্রমবাজার আরও সম্প্রসারিত করতে হবে। কেন আমাদের শিক্ষার্থীদের ভালো চাকরি হয় না? ভারত-শ্রীলঙ্কা থেকে ম্যানেজমেন্টে আমাদের লোক আনতে হয়। এর কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেও যথেষ্ট গলদ আছে।
আন্দোলনকারী মেধাবী শিক্ষার্থীরা আগামীতে দেশের নেতৃত্ব দেবে। একসময় তারা দেশের এমপি-মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপ্রধান হবে। এসব দেখে তারা রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার যদি সঠিকভাবে সামাল দিতে না পারে, অশুভ শক্তি সব সময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেষ্টা করেছে এবং করবে। এ ধরনের ঘটনা সব সময়ই ঘটেছে। সেই জায়গাটিতে কেন আমরা দূরদর্শিতার পরিচয়টুকু দিতে পারলাম না?
’৬৯-এর আন্দোলন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আমরা আন্দোলনে গিয়েছি। স্লোগান দিয়েছি- এসবই ছিল শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে। তরুণ শিক্ষার্থীরা কোনো রাজনৈতিক দল বা শক্তির অঙ্গসংগঠন নয়। কাজেই তাদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক আচরণ না করে বরং উচিত ছিল ছাত্রদের শান্ত করা। এতগুলো তাজা প্রাণ আমাদের থেকে হারিয়ে গেল। এত রক্তক্ষয় দেখতে হবে কখনো ভাবিনি। সবকিছুর জন্যই জবাবদিহির দরকার আছে।
আমাদের সবচেয়ে বড় দুঃখ হলো, আমাদের ছাত্রছাত্রীরা আন্তর্জাতিক বিশ্বের সঙ্গে চলতে গিয়ে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ছে। এক ধরনের ইমেজ সংকট ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে। রেমিট্যান্স ৩০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। দেশের ইমেজ সংকট, অর্থনৈতিক সংকট, শিক্ষা সংকট ইত্যাদি সবকিছু আমাদের সামাল দিতে হবে এখনই। দীর্ঘদিন ধরেই সবকিছু সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
এসবকিছু চিন্তাভাবনা করেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমার কথা হচ্ছে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা কখনো জ্বালাও-পোড়াও করে না; সহিংসতা করে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। বিশেষ করে সেতু ভবন, বিটিভি, মেট্রোরেলসহ বড় বড় স্থাপনাগুলোতে আঘাত করার সময় আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোথায় ছিল?
সেতু ভবন ২-৩ ঘণ্টা ধরে পুড়ল। এখন হেলিকপ্টার থেকে পানি ঢেলে আগুন নেভানো যায়। হেলিকপ্টারগুলো কেন কেনা হয়েছে? আমাদের সন্তানদের ব্রাশ ফায়ার করার জন্য? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাদের আমরা ট্যাক্স দিয়ে পালনপালন করি, যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্য, এরা কী করেছে? এদের সবাইকে দায়দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের ইন্টেলিজেন্স কী করে?
চার দিন ধরে অসন্তোষ চলছিল। এরা এই সময় কী করেছে? রাস্তায় যারা নেমেছিল তাদের পেছনেই ছিল সব দৃষ্টি। নিজেদের দায়িত্ব এরা সঠিকভাবে পালন করেনি। এত বড় সহিংসতা হয়ে গেল তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল না? তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই? যখন সেতু ভবন পোড়ানো হচ্ছিল, বিটিভি পোড়ানো হচ্ছিল, তখন এরা কোথায় ছিল? তাদের কাছে কেন সব তথ্য ছিল না? হাজার কোটি টাকা তাদের পেছনে খরচ করা হয়।
দেশের হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়ে গেল কোনো গোয়েন্দা সংস্থা তথ্য কেন দিতে পারল না? এরকম হাজারও প্রশ্ন আজ তৈরি হয়েছে। সবকিছুই চিন্তাভাবনা, যাচাইবাছাই করার দরকার আছে। কাজেই যারা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাদের অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা