বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য প্রিন্ট’কে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্য প্রিন্ট-এর সিনিয়র সম্পাদক মৌসুমী দাস গুপ্ত। গত ৫ আগস্ট সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন খবরের কাগজ-এর সিনিয়র সহ-সম্পাদক সানজিদ সকাল
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন এবং তার বোনকে নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করে ভারতে পৌঁছেছেন। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
ড. ইউনূস: বাংলাদেশে আমরা এখন স্বাধীন ও সার্বভৌম। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা দখল করে রাখা হয়েছিল। শেখ হাসিনা শক্তি ব্যবহার করে স্বৈরশাসকের মতো আচরণ করছিলেন। তিনি সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন। এখন বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীন মতামত পোষণ করতে পেরেছেন। বাংলাদেশের জনগণ দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে সারা দেশে বিজয় উদযাপন করছে। আমি তরুণদের স্বাগত জানাই এমন একটি বিজয় অর্জনের জন্য।
তরুণরা সবাইকে একত্রিত করতে পেরেছে এবং দেশবাসীকে মুক্ত করেছে। সবাই স্বাধীনতার স্বাদ খুঁজে পেয়েছে এবং আনন্দ উল্লাস করছে। আমরা আবার নতুন করে দেশকে পুনর্গঠন করতে পারব। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। এবার নতুন করে দেশ আবার মুক্ত হলো। আমরা দেশকে নতুন করে সাজাতে পারব। বাংলাদেশকে সুন্দর একটি দেশে রূপান্তর করতে চাই। আমরা সেভাবেই প্রতিজ্ঞা করব। ছাত্র ও তরুণরা আমাদের ভবিষ্যতের নেতৃত্ব দেবে। আমরা সেটাই দেখার জন্য সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি।
বাংলাদেশের জন্য পরবর্তী ভবিষ্যৎ কী হতে পারে? সেনাপ্রধান দেশের ক্ষমতা দখল করে নিয়েছেন এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবেন। সেই অন্তর্বর্তী সরকারকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ড. ইউনূস: আমি আশা করি, সবকিছু ঠিকমতোই হবে। শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেছেন। আমরা এখন মুক্ত। আমরা যা চাইব, সেই মোতাবেক সিদ্ধান্ত নিতে পারব। পূর্বের ইস্যুগুলো বিলীন হয়ে যাবে। সবকিছুতেই নতুন কিছু নিয়েই আমরা যাত্রা শুরু করব।
বাংলাদেশে যা ঘটছে তাতে আপনার কি কোনো ভূমিকা থাকতে পারে?
ড. ইউনূস: আমি সব সময় জনগণের সঙ্গে কাজ করতে চাই। ক্ষুদ্রঋণ, সামাজিক ব্যবস্থা ও অন্য সবকিছু নিয়েই দেশকে পুনর্গঠন করতে হবে। আমি আগামী দিনগুলোতে কাজ করার ভালো সুযোগ পাব। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে আমি কাজ করার তেমন কোনো পরিবেশই পাইনি। কারণ তিনি সব সময় আমার পেছনে লেগেছিলেন এবং তাড়া করে বেড়িয়েছেন। আমি এখন নিজেকে সম্পূর্ণভাবে দেশের কাজে নিয়োজিত করতে চাই, যা আগে কখনো পারিনি।
আপনার শিগগিরই বাংলাদেশে ফেরার কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?
ড. ইউনূস: অবশ্যই, আমি খুব শিগগিরই বাংলাদেশে ফিরব। গণযোগাযোগ মাধ্যমে ফুটে উঠেছে যে, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নং বাড়িতে আগুন দিয়েছে। শেখ মুজিবের যত ম্যুরাল ছিল তা ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিব ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলন সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
ড. ইউনূস: দেশের বর্তমান দৃশ্য দেখেই বোঝা যায় শেখ হাসিনা নিজের জন্য কী অর্জন করেছেন। তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য কতটুকু করে যেতে পেরেছেন। তিনি দেশের জন্য যে অপূরণীয় ক্ষতি করেছেন, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটল। বাংলাদেশে যে ঘটনা ঘটেছে সে ক্ষেত্রে তরুণদের দোষ দেওয়া যাবে না। শেখ হাসিনার ব্যক্তিকর্মের ফলেই এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজগুলো হলো।
আপনি কি মনে করেন শেখ হাসিনা তার পিতার উত্তরাধিকার হিসেবে সুনাম ও ঐতিহ্য ক্ষুণ্ন করেছেন?
ড. ইউনূস: শেখ হাসিনা তার পিতার গৌরব পুরোটাই নষ্ট করে দিয়েছেন।
বাংলাদেশের ওপর আমেরিকার কোনো প্রভাব আছে কি না? বাংলাদেশের এই ট্রানজিশন মুহূর্তে আমেরিকা কি কিছু করতে পারে?
ড. ইউনূস: জনগণ মনে করে যে ভারত বাংলাদেশের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় ভূমিকা পালন না করার জন্য আমেরিকার ওপর জনগণ অসন্তুষ্ট। কারণ বাংলাদেশের সবকিছুই ভারতের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। এ কারণে বাংলাদেশের মানুষ আমেরিকার ওপর হতাশ।
আমেরিকা ও ভারত দুই দেশই বাংলাদেশের ওপর ভূমিকা রাখবে। আমার অভিযোগ হলো, আমেরিকা এতদিনে কম ভূমিকা পালন করেছে এবং ভারত সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে। তবে বর্তমানে আমেরিকা ও ভারত কেমন ভূমিকা পালন করবে, আমি তা জানি না। ভবিষ্যৎ পরিস্থিতিতে দুই দেশ কেমন ভূমিকা রাখবে তাও বোঝাতে পারছি না।
ভারত কীভাবে বাংলাদেশে ওপর প্রভাব ফেলতে পারে? বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়তে পারে কি না?
ড. ইউনূস: বাংলাদেশ ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। তা ছাড়া আমরা সার্কভুক্ত দেশ। আমরা নিঃসন্দেহে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাই। বাংলাদেশেকে কীভাবে পুনর্গঠন করে সাজানো যায়, সেই চিন্তা মাথায় রেখে ভারতের এগিয়ে আসা উচিত। আমরা ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই।
আমরা উভয় দেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্মানবোধ ও মতবিনিময়ে সুসম্পর্ক বজায় রাখব। বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচিত সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠুক।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সভাপতি খালেদা জিয়া অসুস্থ রয়েছেন এবং সরকার বিরোধী দলকে কোণঠাসা করে রেখেছিল। অদূর ভবিষ্যতে বিএনপি রাজনীতিতে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারে?
ড. ইউনূস: আমরা শেখ হাসিনা সরকার নিয়ে আলাপ করছিলাম। গতকাল আর আজকের মধ্যে অনেক ব্যবধান রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে বিএনপি কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। আমরা বলতে পারছি না যে, ভবিষ্যতে বিএনপি কী করতে পারবে? অন্য কোনো দল বা ছোট দল এগিয়ে আসতে পারে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বা অন্য কোনো দল আগামী নির্বাচনে এগিয়ে আসতে পারে কি না?
ড. ইউনূস: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দলকে বারবার মোকাবিলা করেছে। অবশেষে শেখ হাসিনা সরকার জামায়াতে ইসলামী দলকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। অতএব, এই দল নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন নেই। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী অন্য কোনোভাবে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এটা এখন অনুমান করা কঠিন।
বিএনপি কিছুটা নীরব রয়েছে। কারণ বিএনপি সব সময় আওয়ামী লীগের দ্বারা বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। এখন যেহেতু দেশ মুক্ত, সেহেতু তারা নির্বাচনে বড় ভূমিকা পালন করতে পারবে। আমরা জনগণের কাছে যাব। জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে কোন দল থাকবে, আর কোন দল থাকবে না এবং কোনো দল পুনরায় নতুন করে শক্তিশালী হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন কোনো দলের আবির্ভাব ঘটতে পারে কি না? এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
ড. ইউনূস: অবশ্যই হতে পারে। নতুন কোনো দলের আবির্ভাব হতে পারে। তরুণরাই ভবিষ্যতের নেতৃত্ব দেবে। তরুণরাই দেশকে নতুন করে শক্তি জোগাবে। প্রাচীন ধারণা ও চিন্তাচেতনা ধারণ করা জাতির জন্য ঠিক হবে না। আমাদের ভাবতে হবে তরুণদের নিয়ে।
তরুণরাই দেশের দায়িত্ব নেবে এবং তারাই দেশকে পুনর্গঠন করবে। তরুণরা দেশের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। তরুণদের অগ্রগামী হতে সেই ভিত্তি তৈরি হয়েছে। তরুণরা আমাদের দেশকে মুক্ত করেছে। এবারের আন্দোলনে দেশে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে। মুক্তিযোদ্ধারাই সিদ্ধান্ত নেবেন দেশ কোন দিকে আগাবে।
বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আপনার আহ্বান কী?
ড. ইউনূস: বিজয়কে উপভোগ করুন। বাংলাদেশ এখন মুক্ত। জনগণকে গণতন্ত্রের মূলতন্ত্রে ফিরে আসার আহ্বান করছি। দেশে এখন কথা বলার স্বাধীনতা রয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকবে এবং আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারব। আমরা যদি চেষ্টা করি, বাংলাদেশকে সৃষ্টিশীল ও শক্তিশালী দেশ হিসেবে গঠন করা সম্ভব।
আমরা একটি আদর্শ দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে দেখতে চাই। সার্কমুক্ত দেশ হিসেবে আমরা বাংলাদেশকে পুনর্গঠন করে দেখাতে চাই। যেখানে প্রত্যেকে প্রত্যেককে সহযোগিতা করবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বড় আকারে রূপ ধারণ করেছিল। অল্প সময়ের মধ্যে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করল এবং তিনি দেশত্যাগ করলেন। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
ড. ইউনূস: দেশ পরিবর্তনের বড় উদাহরণ এই ছাত্র আন্দোলন। দেশে আন্দোলন হওয়া উচিত বলে ছাত্ররা অনুভব করে এবং তারা তা প্রকাশ করে দেখিয়ে দিয়েছে। দেশে গণতন্ত্রের সূচনা হচ্ছে। এই মুহূর্তে সব বাধা অতিক্রম করতে হবে। তরুণ প্রজন্মের সব বাধা অতিক্রম করার সেই ক্ষমতা রয়েছে।
বাংলাদেশকে সৃজনশীল দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে তরুণরা খুবই নিবেদিত। তরুণরা বাংলাদেশকে ভালোবাসে। বাংলাদেশকে পৃথিবীর শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য তরুণরাই যথেষ্ট। তারা একটি সম্মানজনক জাতি উপহার দেবে।