পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ হাজার শিক্ষকের পেনশন স্কিম আন্দোলন ছিল মেধাবীদের প্রতি সুবিচার ও বৈষম্য বিলোপের আন্দোলন। ২০০৬ সালে সামরিক সরকার পাঁচ-ছয়টি লেফটেন্যান্ট জেনারেলের পদ তৈরি করে এবং সেনাপ্রধানের পদটিকে জেনারেল পদে উন্নত করে। ক্ষোভ সঞ্চারিত হয় আমলাতন্ত্রে। তাদের খুশি করতে সৃষ্টি করা হয় সিনিয়র সচিবের পদ।
সেই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষোভ- কেন এই বৈষম্য? ২০১৫ সালে পে-স্কেল দিলে ক্ষোভ আরও ঘনীভূত হয়। দাবি করা হয় লাখ লাখ পরীক্ষার্থীকে পরাজিত করে তারা সরকারি চাকরি পান। সুতরাং তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের থেকে বেশি মেধাবী ও যোগ্য। নবম পে-স্কেলের প্রণেতা ড. ফরাসউদ্দিন দাবি করেন, সেই ব্রিটিশ আমলেই সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন উচ্চতর ছিল।
হায়রে বাঙালি, যে ব্রিটিশ শাসন আমাদের নিঃশেষ করে দিয়েছে, যে ব্রিটিশ শাসন পরাস্ত করে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, সেই ব্রিটিশ আইন হলো দৃষ্টান্ত! ফলে ১ জুলাই থেকে আন্দোলন শুরু হয় মেধাকে মূল্যায়ন না করে প্রত্যয় পেনশন স্কিম চালুর বিরুদ্ধে। ক্ষোভের আরও কারণ- শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত বিভিন্ন কমিশনে আমলাদের পদায়ন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ পদে আমলা নিয়োগ।
২০১৫ সালে শিক্ষকদের আন্দোলনের ফলে সরকার ২০১৬ সালে কিছুটা ছাড় দিলেও প্রতিশ্রুতির স্বতন্ত্র পে-স্কেল ও সুপার গ্রেড তারা পাননি। সরকার ও সাধারণ মানুষের একটি প্রশ্ন: কেন বর্তমান শিক্ষকরা আগামী দিনের শিক্ষকদের পেনশন নিয়ে আন্দোলন করছেন? শিক্ষক হিসেবে আমি নিজের কাছে এই প্রশ্ন বারবার করেছি। আমি আগামী দিনের শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনাও করেছি। আমার প্রশ্ন হলো- শিক্ষক হিসেবে আমার কি আগামী দিনের শিক্ষকদের সম্পর্কে ভাববার অধিকার নেই? আমি কি উন্নত বাংলাদেশের চিন্তা করতে পারি না? আমার মেধাবী ছাত্ররাই শুধু নয়, আমার সন্তানও হতে পারে আগামী দিনের শিক্ষক। আমি যদি এখন আমার সন্তানের কথা না বলি, তবে পিতার দায়িত্ব পালন করছি কি?
আমি চেয়েছি আগামী দিনের শিক্ষকদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণ হয়ে উঠুক ভালো শিক্ষকে; যারা উদ্ভাবন করার সক্ষমতা রাখে। আমরা যদি আগামী দিনের শিক্ষকদের জন্য কোনো আকর্ষণ সৃষ্টি না করি, তবে সে কেন এ দেশে থাকবে? তাকে প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশিরা অতীতের মতো নিয়ে যাবে।
মেধাবীদের প্ৰলোভন দেখিয়ে করপোরেট সেক্টর ভালো ছাত্রটিকে নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হচ্ছে। কিন্তু তাকে যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানজনক বেতন-ভাতা ও পেনশন দেওয়া হয়, তবে সে তো সমগ্র জাতির কল্যাণ বয়ে আনবে। জাতির কল্যাণ ভাবনা বিবেকবান হিসেবে শিক্ষকদের দায়িত্ব। তাদেরই দায়িত্ব আগামী প্রজন্মের জন্য ভাবা।
আমরা জানি, পৃথিবীর ভূখণ্ড দখল হয়ে গেছে। ফলে আমাদের স্বাধীনতা সংকুচিত। কিন্তু মেধা পারে উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে। সে জন্য সমাজের উচিত মেধাকে মূল্যায়ন করা।
আমরা পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে ভাবছি এবং সেটা আগামী প্রজন্মের কথা চিন্তা করেই ভাবছি। আমরা যে টেকসই উন্নয়নের কথা আমাদের রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছি, সেটি প্রমাণ করে আগামী প্ৰজন্মের জন্য একজন শিক্ষকের ভাববার অধিকার আছে। আমাদের সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ চাইছে। সেটাও ওই আগামী দিনের নাগরিকের জন্য।
আমাদের সরকার শতবর্ষের ডেল্টা প্ল্যান করেছে, সেটাও ওই আগামী দিনের অনাগত শিশুদের জন্য নয় কি?
আমি শিক্ষক। আমি আগামী দিনের শিক্ষকের সঙ্গে হয়তো আরও কিছুদিন কাজ করব। তারা দেখবে আমি তাদের জন্য সরকারকে কিছু বলিনি। আমি যখন অবসর নেব মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে, সেদিন নতুন শিক্ষকদের বুক চিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসবে।
অনেকেই প্রশ্ন করেছেন- কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন দেব? আমার পাল্টা প্রশ্ন: আমাদের আশপাশের দেশ কি উন্নত বেতন দিচ্ছে না? পত্রিকায় দেখেছি, প্রত্যয় পেনশন স্কিম ভারতে চালু আছে। যদি ভারত উচ্চতর বেতন দিয়ে থাকে, তবে আমাদের দেশের শিক্ষকদের জন্য দাবি থাকতে পারে না?
একজন শিক্ষক ও একজন সেবকের মধ্যে একটি পার্থক্য: একটি ভালো মানের বীজ উদ্ভাবনে একজন শিক্ষক গবেষণায় অবদান রাখেন। তার অবদান বয়ে আনে বিশ্বমানুষের কল্যাণ। আর সেই বীজটি দেশের চাষিদের কাছে বিতরণ করেন রাষ্ট্রের সেবক। একজন ভালো শিক্ষক একজন ভালো সেবক সৃষ্টিতেও অবদান রাখবেন, যা সেবকের পক্ষে সম্ভব হয় না।
আসুন, ওই ত্রুটিপূর্ণ বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার অর্জন দেখে যেমন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়, তেমনভাবে সেবক নিয়োগ দেওয়া হোক। যার যা অর্জন সেটা দিয়ে মূল্যায়ন করলে শিক্ষার মান বাড়বে। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় আরও মনোযোগী হবে। শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে। জাতি সুনাগরিক ও সুফল পাবে। ভালো মা লাগে ভালো সন্তান পেতে হলে, তেমনি ভালো শিক্ষক থাকলে ভালো নাগরিক গড়া সম্ভব।
প্রত্যয় স্কিম গ্রহণযোগ্য করতে ১০ শতাংশ সরকারি অবদানের পরিবর্তে ১৭ শতাংশে উন্নত করতে পারত এবং কেউ চাইলে পেনশন মাসে মাসে না নিয়ে একসঙ্গে উত্তোলন করার সুযোগ রাখা যেতে পারে। যদিও সেটি বাতিল করা হয়েছে।
শিক্ষকের মর্যাদা কেবল কাগুজে হয়ে আছে। সেখান থেকে শিক্ষাকে মুক্ত করার সময় এসেছে। বৈষম্যমুক্ত সমাজ নির্মাণে বৈষম্যমূলক পেনশন ও বেতন কাঠামো অন্যতম প্রতিবন্ধকতা যেন না হয়- যার যে যোগ্যতা ও কাজ তা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হোক। নতুবা আগামী প্রজন্মের কাছে আমাদের মাথা নিচু হয়ে যাবে।
ন্যায় ও ন্যায্যতার মানদণ্ড রাষ্ট্রের ভিত্তি। সেটা সেই ৫ হাজার বছর আগে দার্শনিক প্লেটো তার ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে দেখিয়ে দিয়েছেন। ন্যায় ও ন্যায্যতার মানদণ্ডের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক মর্যাদা নিরূপণ করা হয়। আরবরা ধনী হয়েও উন্নত নয়। উন্নত বাংলাদেশ গড়তে শিক্ষকদের দাবিকে ন্যায় ও ন্যায্যতার মানদণ্ডে বিচার করি।
আজকের আমলারা ত্রুটিপূর্ণ বিসিএস পরীক্ষার দোহাই দিয়ে দাবি করেন- তারা শিক্ষকদের থেকে বেশি মেধাবী। তারা আরও বলেন, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট নাকি বিসিএস দিলে ফেল করবে। আমরা কী দেখছি? আমরা দেখছি লাইব্রেরিতে শিক্ষার্থীর ভিড়, বিসিএস গাইড নিয়ে ঢুকছে। সেখানে সকালে এসে লাইন দিচ্ছে।
পৃথিবীর কোথাও কি এমন ঘটছে? বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের যে মূল পড়ালেখা সেটা বাদ দিয়ে তারা গাইড পড়ে আমলা হচ্ছে। ফলে তাদের জ্ঞানের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। আর সে কারণে জাতি কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই জাতির কল্যাণে তথা কথিত বিসিএস পরীক্ষা সংস্কার করা একান্ত জরুরি।
লেখক: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়