বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলেন। এ ধরনের ঘটনা দেশে খুবই কম ঘটে। আফ্রিকার দেশে মাঝেমধ্যে এমন ঘটনা দেখতে পেতাম। ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশে যে বিপুল সম্পদ ও প্রাণহানি ঘটল। এতে পুলিশ বাহিনীও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হলো। বাংলাদেশ পুলিশের নবনিযুক্ত আইজিপি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশকে তার কর্মস্থলে যোগদান করতে বলেছেন।
কারণ সরকার পতনের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা একদমই ভেঙে পড়েছে। ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় লুটপাট, ডাকাতি শুরু হয়েছে। দেশে যখন আইনশৃঙ্খলা ভেঙে যায়, তখন এমন ঘটনা সচরাচর ঘটে থাকে। তবে পুলিশের মধ্যে যে ভয়ভীতি ঢুকেছে, তাতে স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগবে। পুলিশের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করাটা স্বাভাবিক। কারণ অনেক পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন এবং এখনো অনেকে আহত অবস্থায় রয়েছেন।
বাংলাদেশের অনেক থানা পুড়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে পুলিশকে তার কর্মস্থলের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে পেতেও সময় লাগবে। তা ছাড়া অনেক থানা থেকে অস্ত্র ও গুলি বেহাত হয়েছে। পুলিশের অনেক গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশের যানবাহন দরকার।
পুলিশ সদস্যদের অফিসে বসার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সাধারণ জনগণকে পুলিশের সাহস জোগাতে হবে। পুলিশকে বন্ধু হিসেবে কাছে টেনে নিতে হবে। পুলিশের মধ্যে যে ভয় বা ট্রমা তৈরি হয়েছে, তা কাটতে অনেক সময় লাগবে।
দেশে এখন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে এবং উপদেষ্টারা দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন। উপদেষ্টারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথা বলবেন। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে দেশের আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। পুলিশ ইতোমধ্যে কর্মস্থলে যোগ দেওয়া শুরু করেছে। পুলিশেরও প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে।
দেশে কিছু দুষ্কৃতকারী এরই মধ্যে লুটপাটের সুযোগ পেয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে। তা ছাড়া এলাকাভিত্তিক ছাত্র ও যুবকরা নিরাপত্তার স্বার্থে টহল দিচ্ছে। এটা খুব ভালো দিক যে, মানুষের মধ্যে আত্মরক্ষার বোধ তৈরি হয়েছে।
নিরাপত্তার দায়িত্ব দেশের সব মানুষের। সবাই যদি এলাকা ভাগ করে নিয়ে রাতের বেলা টহল দেয়, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে। এলাকার মুরব্বিরা এ ধরনের নেতৃত্ব দিতে পারেন। অভিভাবকরা এলাকার নিরাপত্তার জন্য তাদের সন্তানদের সজাগ থাকতে বলতে পারেন। দেশে এখন ক্রান্তিকাল। এই দুঃসময়ে শুধু পুলিশের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে হবে না। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে।
দেশের ক্রান্তিলগ্নে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের কথা শোনা যাচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক। কারও ব্যক্তিরোষ থাকলে সে এই সুযোগে তা কাজে লাগাচ্ছে, যা মোটেও ঠিক নয়। আমরা কিছু ইতিবাচক দিক দেখতে পাচ্ছি, তা হলো- বিভিন্ন এলাকার মসজিদের মাইক থেকে ডাকাত আক্রমণের জন্য সতর্কতা প্রচার করা হচ্ছে।
কোথাও আক্রমণ হলে সঙ্গে সঙ্গে দল বেঁধে সেখানে গিয়ে ডাকাত প্রতিরোধ করছে। বিভিন্ন মাদ্রাসার ছেলেরাও মন্দির পাহারা দিচ্ছে। বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জায়গা। এখানে সবাই শান্তিতে বসবাস করবে। দেশের নিরাপত্তার বিষয়টি শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ছেড়ে দিলে হবে না। এখন সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ এখন তো কোনো স্বাভাবিক সময় নয়। এখন অস্বাভাবিক সময়।
রাস্তাঘাটে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে ছাত্ররা। দেশের দুঃসহ সময় ছাত্ররা অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। দেশের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কঠিন কাজ। এ ধরনের কাজ সাধারণ মানুষ করতে পারবে না। প্রশিক্ষণের ব্যাপার আছে, ধৈর্যের ব্যাপার আছে। ট্রাফিক আইনকানুন আছে। দেশের ক্রান্তিকালে ছাত্ররা বড়জোর দু-চার দিন করতে পারে। পেশাদারত্ব না থাকলে কি কেউ এটা করতে পারে?
ছাত্ররা অনেক সহযোগিতা করছে। এখন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে। এখন পুলিশ ধীরে ধীরে ট্রাফিক দায়িত্বসহ থানার সব দায়িত্বে ফিরে আসবে। হয়তো একটু সময় লাগবে। ঢাকা শহরে পুলিশ আগে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে যেতে পারে। তার পর দেশের অন্যান্য জায়গায় শুরু করতে পারে।
পুলিশের মধ্যে অনেক ভয় কাজ করছে। এ জন্য সাধারণ মানুষকে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি আবার জনগণের মারধর খায়, সেই ভয় বা আতঙ্ক পুলিশের মধ্যে কাজ করছে।
পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। মানুষের প্রতিও পুলিশের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। বিগত কয়েক দিনে পুলিশ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বন্ধনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। সেই অভাবটা পূরণ করতে হবে। পুলিশ মানুষের জন্যই কাজ করে।
তাই সাধারণ মানুষকে পুলিশের সঙ্গে কথা বলে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে হবে। পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা বা বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। পুলিশকে রাজনৈতিক দল এত ব্যবহার করলে মানুষের আস্থা হারানোটা স্বাভাবিক। পুলিশকে অস্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ফলে বিগত কয়েক বছরে পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে।
দেশের অনেক থানা ও কারাগার থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এগুলো পুলিশ উদ্ধার করবে। তা না হলে অরাজকতা আরও বাড়বে। পুলিশকে আগে কাজ করতে দিতে হবে। তার পর পুলিশ সিদ্ধান্ত নেবে কোনটা আগে ও পরে করবে। পুলিশ একসঙ্গে সব কাজ করতে পারবে না।
এখন দেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে। উপদেষ্টারা পুলিশের সঙ্গে কথা বলবেন। এখন পুলিশের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব থাকবে না। পুলিশ এখন ভালোভাবে কাজ করতে পারবে। দেশে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে, তাদের ওপর আমরা আশাবাদী। এই সরকার অচিরেই কাজ শুরু করবে।
আশা করি, দেশে ভালো কিছু হবে। বাংলাদেশের অনেক কিছুই পরিবর্তন হবে। বাংলাদেশের এই সংকটময় মুহূর্ত অচিরেই কেটে যাবে এবং দেশ অনেক এগিয়ে যাবে, সেই প্রত্যাশা করি।
লেখক: সাবেক আইজিপি, বাংলাদেশ পুলিশ