ভঙ্গুর রাষ্ট্রগুলোর এক সূচকে দক্ষিণ এশিয়াকে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি অস্থিতিশীল অঞ্চল হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে সর্বাধিকসংখ্যক ব্যর্থ রাষ্ট্র এবং তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং এখন বাংলাদেশের মতো দেশগুলো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ভেঙে পড়েছে।
প্রতিটি রাষ্ট্রেই গৃহযুদ্ধের মতো অবস্থা বিরাজ করছে। ভৌগোলিকভাবে এ দেশগুলো খুবই কাছাকাছি এবং ঔপনিবেশিক ইতিহাস প্রায় একই। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো জটিল সংকটের মুখোমুখি, যা জরুরিভাবে সমাধান করা দরকার।
ভারত এসব দেশের ওপর আঞ্চলিক শক্তি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে চায়। গণতান্ত্রিক দেশগুলোর অশান্তির মূল কারণগুলো বোঝা এবং তার সমাধান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব দেশের রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ বা বন্ধুত্বহীন শাসনব্যবস্থা স্থাপনের সম্ভাবনা ভারতের নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর গণতান্ত্রিক ব্যর্থতার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এই অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় জাতিগত এবং ধর্মীয় সমস্যা বিরাজমান। এ ছাড়া শক্তিশালী রাজনৈতিক এবং আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি।
পশ্চিমা দেশগুলোর ঔপনিবেশিক শাসনের সময় এই দেশগুলো তাদের সামাজিক কাঠামো তৈরি করতে অনেক সংগ্রাম করেছে। শ্রীলঙ্কার ‘অভিজাত শাসনের’ প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল সিংহলি এবং তামিলদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখা।
এই পদ্ধতিটি ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। কিন্তু এটি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। ফলে দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।
একইভাবে সামরিক শাসন এবং গণতান্ত্রিক শাসনের মধ্যে বাংলাদেশের ঘন ঘন পরিবর্তন হওয়ায় দেশের রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতা তুলে ধরেছে। সাম্প্রতিক বিক্ষোভগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, জনগণ ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার ‘দ্য অরিজিন অব পলিটিক্যাল অর্ডার’ এবং ম্যাকিয়াভেলির ‘অবজারভেশন অব গভর্ন্যান্স ইকো’ চ্যালেঞ্জগুলো যেভাবে সমাধান করা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতিতে তা প্রয়োগ করা যেতে পারে।
এই অঞ্চলের বিভিন্ন জাতি, ভাষাগত গোষ্ঠী এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর বিভেদের কারণে রাজনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠাকে জটিল করে তোলে। চলমান জাতিগত ও ধর্মীয় সংঘাতগুলো জাতীয় পরিচয় এবং শাসন কাঠামো তৈরিতে আরও বাধা সৃষ্টি করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অঞ্চলগুলো কার্যকর গণতন্ত্র আনতে ব্যর্থ হয়েছে। এই অঞ্চলে পদ্ধতিগত গণতন্ত্রের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ও সমতা নিশ্চিত করার পরিবর্তে প্রক্রিয়া তৈরিতে বেশি সময় ব্যয় করে। যদিও গণতান্ত্রিক আদর্শ সংবিধানে নিহিত রয়েছে, কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে।
ইসলামিক মতাদর্শে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান রয়েছে। কিন্তু ভারতে ‘হিন্দুত্ববাদ’ বিরাজমান। এ মতাদর্শগত ভিন্নতা আঞ্চলিক বৈষম্য এবং সংঘাতকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে, যা গণতান্ত্রিক ধারা এবং অনুশীলনের মধ্যে গভীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। এই সংকট মোকাবিলায় কার্যকরী আঞ্চলিক কাঠামোর অভাব রয়েছে।
দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (SAARC) আন্তরাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্ব প্রশমিত করতে বা আঞ্চলিক একীকরণকে উন্নীত করতে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর দ্বিপক্ষীয় বিরোধ, বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের ঐতিহাসিক এবং আঞ্চলিক বিরোধ, যা সম্মিলিত আঞ্চলিক অগ্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
অধ্যাপক হ্যাপিমুন জ্যাকব তার প্রবন্ধ ‘দ্য অ্যান্ড অব সাউথ এশিয়া’য় খুব সুন্দরভাবে এশিয়ার সংযোগবিচ্ছিন্নতা তুলে ধরেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ খুব কমই তাদের আঞ্চলিক পরিচয় দেয়। ‘দক্ষিণ এশিয়া’ শব্দটিকে একীভূত সত্তার চেয়ে ভৌগোলিক পরিমাপ হিসেবে সবাই বেশি দেখে।
এই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতা বৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দিতে হবে। আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ বা বহিরাগত দেশের দেওয়া সমাধানের ওপর নির্ভর করা শুধু জটিলতা বাড়ায়। স্থিতিস্থাপক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, প্রকৃত গণতন্ত্রকে আলিঙ্গন করা এবং আঞ্চলিক সংহতি বৃদ্ধির জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর যৌথ প্রচেষ্টা অপরিহার্য।
বিশ্বব্যাংক এই অঞ্চলটিকে একটি সম্ভাবনাময় জায়গা হিসেবে তুলে ধরেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনা শুধু টেকসই শান্তি এবং সহযোগিতামূলক শাসনের মাধ্যমেই সম্ভব।
যেহেতু দক্ষিণ এশিয়া এখন জটিল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, সেহেতু এই অঞ্চলের নেতাদের নিজস্ব শক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার পথ নির্ধারণ করতে হবে। আঞ্চলিক নেতৃত্বের সুযোগ এবং দায়িত্ব উভয়ই গ্রহণ করে তাদের গণতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সময় এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, প্রতিরক্ষা এবং কৌশলগত অধ্যয়ন বিভাগ; শ্রী বালাজি বিশ্ববিদ্যালয়, পুনে, ভারত। দ্য স্টেটস্ম্যান থেকে সংক্ষেপিত
অনুবাদ: সানজিদ সকাল