ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়েছেন। এটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মানুষের জন্য খুবই আশার কথা। ড. ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা অন্য যে কারও চেয়ে অনেক বেশি, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের মানুষ তাকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে পেয়ে অনেক খুশি। দেশের এই ক্রান্তিকালে ছাত্ররা তাকে দায়িত্ব নিতে রাজি করাতে পেরেছে। ছাত্রদের আহ্বানে তিনি সাড়া দিয়েছেন। এটি নিঃসন্দেহে দেশের জন্য খুবই ভালো দিক।
বিশেষ করে তার এই দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হওয়া একটি শুভবার্তা বলেই মনে হয়। আন্তর্জাতিক বিশ্বও তাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অভিনন্দন জানিয়েছে। তার সঙ্গে একত্রে কাজ করার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের একজন গুণী মানুষ। তিনি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সমর্থ হবেন বলেই মনে হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটি সমৃদ্ধ ভাবমূর্তি আছে। তিনি দেশ পুনর্গঠনে সারা বিশ্বের যে সহযোগিতা পাবেন, সেটা অন্য কারও পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সারা বিশ্ব তাকে যেভাবে সমর্থন জানিয়েছে এবং ভবিষ্যতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারসহ সবক্ষেত্রে যে সহযোগিতার আশ্বাস তিনি পেয়েছেন, তা অন্য কারও পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। দেশের ধ্বংসপ্রায় অর্থনীতি পুনর্গঠনে ড. ইউনূস কাজ করবেন এবং নিঃসন্দেহে তিনি ভালো কাজ করবেন বলেই আমাদের আশাবাদ।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশ ও দেশের বাইরে একজন গুণী মানুষ হিসেবে সমাদৃত। একই সঙ্গে তিনি একজন নোবেল বিজয়ী বিদ্বান ব্যক্তি। বাংলাদেশকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে তিনিই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ইতিবাচকভাবে। প্যারিসে অলিম্পিক আয়োজনের মতো বিশাল আয়োজনে ফ্রান্স তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তাদের মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্যতম।
অলিম্পিক আয়োজনে তিনি একজন উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। সারা বিশ্বের মানুষ ড. ইউনূসকে চেনেন এবং ভালোবাসেন। চীন, আমেরিকা, ভারতসহ সারা পৃথিবীতেই তিনি একজন সমাদৃত নাম হিসেবে পরিচিত। তার সমকক্ষ এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আর কেউ নেই।
ছাত্ররা যে তাকে রাজি করাতে পেরেছে, এটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিশেষ করে ছাত্রদের অনেক বড় কৃতিত্ব। তিনিও দায়িত্ব নিতে রাজি হয়েছেন, এটি নিঃসন্দেহে দেশের জন্য অত্যন্ত ভালো খবর। ইউনূস দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এটি আমাদের জন্যই নিঃসন্দেহে আশার কথা।
কিছুদিন আগে ছাত্রদের কোটা আন্দোলন থেকেই একসময় দেশব্যাপী অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়। কিন্তু ছাত্ররা তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে অটল থাকে। তাদের আত্মত্যাগ, একই সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ সাহসী পদক্ষেপের কারণে সরকারের পতন ঘটে।
ছাত্রদের এই বিজয়কে নতুন করে স্বাধীনতা অর্জন মনে করে সারা দেশের মানুষ আজ আনন্দ উৎসব করছে। যদিও দুষ্কৃতকারীরা দেশে একটি অরাজকতা ও ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে।
এই মুহূর্তে সরকারের প্রথম কাজ সন্ত্রাস দমন এবং দেশের মানুষের নিরাপত্তা বিধান করা। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন- সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীসহ সবকিছু নতুন করে ঢেলে সাজানো। যারা অপরাধ সংঘটিত করেছে, তাদের আইনানুগ বিচারের মাধ্যমে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। দেশকে এগিয়ে নিতে এবং গঠনমূলক অবকাঠামো নির্মাণে সর্বত্রই একটি সংস্কার জরুরি।
ড. ইউনূসের কাছ থেকে এটাই প্রত্যাশিত যে, তিনি সে ক্ষেত্রে দূরদর্শী ভূমিকা রাখবেন। ছাত্র ও জনমানুষের সঙ্গে তার অংশগ্রহণ দেশের মানুষকে আশাবাদী করেছে। তিনি সেই প্রত্যাশা পূরণের কথাই দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারকে কতগুলো বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সে ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি দেশকে স্থিতিশীল করাই সরকারের এখন প্রথম কাজ। শান্তিশৃঙ্খলা পরিবেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়েই দেশ পুনর্গঠনের কাজ শুরু করতে হবে। যারাই দেশের শান্তিশৃঙ্খলার বিঘ্ন সৃষ্টি করবে তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে সচেতন থাকতে হবে। এ জন্য জরুরি ভিত্তিতে রাষ্ট্রযন্ত্র সংস্কার করতে হবে।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, আনসার, ভিডিপিসহ সব স্তর সংস্কার জরুরি। দেশের জন্য ক্ষতিকর জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করে সেখানে দেশপ্রেমিক, সৎ, মেধাবী, দক্ষ, যোগ্য ও দায়িত্বশীলদের সুযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। যারা বছরের পর বছর দুর্নীতি ও বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিল এবং আছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
ড. ইউনূস এমন একজন ব্যক্তিত্ব, দেশে-বিদেশে যার সমর্থন রয়েছে। বিশ্বজুড়ে যার খ্যাতি ও সম্মান রয়েছে এবং যাকে বিশ্বের মানুষ শ্রদ্ধা করে এবং তার বিকল্প নেই। এমন একজনের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয়। তিনিই শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মানুষের জীবনের নিরাপত্তাদানসহ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের অভীষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবেন।
আরও একটি ব্যাপার হলো, মেধাবী তরুণদের সঙ্গে অভিজ্ঞতার সমন্বয় করে যে নতুন টিম গঠিত হলো তাদের খ্যাতি বিশ্বজুড়েই রয়েছে। তারা প্রত্যেকেই ন্যায়নিষ্ঠ ও যোগ্যতার বিচারে স্বনামে পরিচিত। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের প্রধান বিরোধী দলসহ সব রাজনৈতিক দল, অরাজনৈতিক সংগঠন এবং দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সমর্থন নিয়ে কাজ করবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশ পুনর্গঠনে যে ভিশন নিয়ে কাজ শুরু করেছেন, তাকে সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। অর্থাৎ গতিশীল কাজের লক্ষ্যে তাকে সবার সহযোগিতা করা প্রয়োজন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতানুগতিকভাবে কাজ করেন না। তার কাজের ধরন অন্য রকম। কাজেই এ কথা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করা যায় যে, ইউনূসের মাধ্যমে দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। ব্যক্তিজীবনে খুবই সুস্থির ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কোনো ক্ষমতালিপ্সা নেই। কাজেই তার মাধ্যমে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে অনেক সমস্যার সমাধান হবে, এটুকু নিঃসন্দেহে আশা করা যায়।
লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা