উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের একপাশে বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, অন্যপাশে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। একটির ঐতিহ্য অপরটির সম্ভাবনা দুটিই এই অভ্যুত্থানের ভেতরে ছিল। ঐতিহ্যটি অবশ্য আরও পুরোনো; ১৮৫৭-তে উপমহাদেশে সিপাহি অভ্যুত্থান হয়েছিল, পাশাপাশি কৃষক বিদ্রোহ ঘটেছে, সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা আমরা জানি, বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও ঐতিহ্যটা প্রবহমান ছিল। ১৯৪৫-এর শেষ দিকে, বিশেষভাবে বাংলায় একটি প্রায়-বিপ্লবী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, যেটিকে দমন করা হয়েছে প্রথমে নির্বাচন দিয়ে, তার পর দাঙ্গা ঘটিয়ে, এবং আরও পরে সাতচল্লিশের দেশ ভাগ সম্ভব করে।
বায়ান্নতেও একটা অভ্যুত্থান ঘটে, যার পরিণতিতে চুয়ান্ন সালে নির্বাচন দেওয়া হয় এবং পরে সামরিক শাসন চলে আসে; ওই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধেই ছিল উনসত্তরের অভ্যুত্থান। তবে এর গভীরে ছিল আরও এক আকাঙ্ক্ষা। সেটা পাকিস্তান রাষ্ট্রের বন্ধন থেকে মুক্তির; আন্দোলনকারীদের একাংশের আকাঙ্ক্ষায় উপস্থিত ছিল সমাজবিপ্লবের স্বপ্নও। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জাতি প্রশ্ন এবং শ্রেণি প্রশ্ন দুটোই মীমাংসার জন্য চাপ দিচ্ছিল। বাস্তবে ভারতীয় উপমহাদেশটি ছিল বহুজাতির দেশ; সেখানে একজাতি তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পথ করে দেওয়া হয়েছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের আবির্ভাবের জন্য, এবং তার পরে, ওই দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই ঘটে সাতচল্লিশের দেশভাগ। বলা বাহুল্য, তাতে জাতি প্রশ্নের সমাধান হয়নি, না ভারতে না পাকিস্তানে। পাকিস্তানে বাঙালির সংখ্যা ছিল শতকরা ৫৬ জন; কিন্তু শাসন চালু হয়েছিল অবাঙালিদের; রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল ওই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই একটি অভ্যুত্থান। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি, ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জায়গায় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর পেছনে পাকিস্তানের পূর্ব ভূখণ্ডে বসবাসকারীরা ছিল ঐক্যবদ্ধ; তদুপরি ভাষা যেহেতু কোনো শ্রেণির একচেটিয়া অধিকার ও সম্পত্তি নয়, তাই ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠা সব শ্রেণির মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের অব্যাহত সংগ্রামেরও একটি অংশ ছিল বৈকি। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার প্রশ্ন এবং সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সমান অধিকারের প্রশ্ন, একত্র হয়ে গিয়েছিল।
উনসত্তরের অভ্যুত্থানে তাই জাতি ও শ্রেণি উভয় প্রশ্নেরই মীমাংসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। আন্দোলনকে প্রথমে মনে হয়েছিল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান, কিন্তু অচিরেই বোঝা গিয়েছিল যে পূর্ববঙ্গের মানুষ কেবল যে সামরিক শাসনের অবসান চায় তা নয়, পাকিস্তানি রাষ্ট্র থেকেও তারা মুক্তি চায়। স্বায়ত্তশাসনের অভাবের দরুন অসন্তোষ অবশ্য শুরু থেকেই বলা চলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই ছিল। ১৯৪০ সালের সেই লাহোর প্রস্তাবে একটি নয়, একাধিক রাষ্ট্রের কথাই বলা হয়েছিল। পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমান পাকিস্তানকে সেভাবেই দেখত। কিন্তু তার বদলে প্রতিষ্ঠা ঘটল অখণ্ড ও এককেন্দ্রিক একটি আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের, যেটিকে আরও বেশি এককেন্দ্রিক করার জন্যই একটি মাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চালু করার প্রস্তাবটা এসেছিল। পূর্ববঙ্গের মানুষ স্বভাবতই হতাশ ও বিক্ষুব্ধ হয়েছে, এবং তারা আন্দোলনে নেমেছে। ১৯৫০ সালে লিয়াকত আলী খান সংবিধানের যে অগণতান্ত্রিক মূলনীতিগুলো ঘোষণা করেন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে; দাবি উঠেছে লাহোর প্রস্তবের ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হোক। বায়ান্নতেও ওই দাবি ছিল, উনসত্তরে এসে তা আরও প্রবল হলো। এবং আন্দোলন যখন প্রবল হয়ে উঠল তখন বোঝা গেল স্বায়ত্তশাসন নয়, মানুষ আসলে স্বাধীনতাই চায়।
যে প্রশ্নটা সঙ্গত, যদিও কিছুটা প্রচ্ছন্নভাবে ছিল, সেটা হলো এবারের স্বাধীনতা কাদের নেতৃত্বে অর্জিত হবে- আগের বারের মতো জাতীয়তাবাদীদেরই, নাকি সমাজতন্ত্রীদের? আন্দোলনে উভয় ধারাই ছিল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যে তরুণরা অংশ নেয় অস্পষ্ট রূপে হলেও তারা জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রকেও যুক্ত করতে চেয়েছে; কিন্তু চুয়ান্নর নির্বাচনে যে রাজনৈতিক নেতারা সামনে চলে এসেছিলেন তারা অধিকাংশই জাতীয়তাবাদী ধারারই ছিলেন; নির্বাচনে সমাজতন্ত্রীরা অখণ্ড বঙ্গের ছেচল্লিশ সালের নির্বাচনে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেননি, চুয়ান্নতেও পারলেন না; পারার অবশ্য কথাও ছিল না। কিন্তু উনসত্তরের অভ্যুত্থানে জাতীয়তাবাদীদের পাশাপাশি সমাজতন্ত্রীরাও সামনে চলে এসেছেন। বস্তুত পরিমাণে ও গুণে তারাই ছিলেন অধিক শক্তিশালী; কিন্তু নেতৃত্ব তারা ধরে রাখতে পারেননি।
আওয়াজ ছিল দুই ধরনেরই; ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো পূর্ববাংলা স্বাধীন করো’, এবং ‘শ্রমিক কৃষক অস্ত্র ধরো, পূর্ববাংলা স্বাধীন করো’; আবার ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’, এবং পাশাপাশি ‘তোমার আমার ঠিকানা, খেত-খামার আর কারখানা’। কিন্তু সমাজতন্ত্রীরা নিজেরাই ততদিনে দুই ভাগ হয়ে গেছেন। একদল পরিচিত হয়েছেন মস্কোপন্থি হিসেবে, অন্যদলের পরিচিতি দাঁড়িয়েছে পিকিংপন্থি বলে। পিকিংপন্থিদের তুলনায় মস্কোপন্থিরা আপসপন্থি ছিলেন; কিন্তু পিকিংপন্থিরা ছিলেন কয়েকটি উপদলে বিভক্ত, উপরন্তু তাদের ওপর আবার এসে পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ির ঢেউ। তাদের কেউ কেউ সবরকমের গণসংগঠন ও শ্রেণিসংগঠন ভেঙে দিয়ে সরাসরি শ্রেণিসংগ্রামের অর্থাৎ ‘শ্রেণিশত্রু’ খতম করার এবং গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও করার অবৈজ্ঞানিক ও অবাস্তব পথ ধরেছিলেন। রাজনৈতিকভাবে প্রধান দ্বন্দ্বটা ততদিনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্রের সঙ্গে পূর্ববঙ্গবাসীর; সেই দ্বন্দ্ব বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের ‘জয় বাংলা’ আওয়াজে যেমন স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছিল সমাজতন্ত্রীদের ‘জয় সর্বহারা’ আওয়াজে তেমনভাবে আসেনি; যদিও দুই আওয়াজের ভেতর বড় একটা বিরোধ ছিল না, সর্বহারার জয় সুনিশ্চিত করার জন্যই জয় বাংলার অধিকার কায়েম করা আবশ্যক ছিল। জাতি প্রশ্নের মীমাংসা শ্রেণি প্রশ্নের মীমাংসা করার পথ করে দিতে পারত। ওদিকে কী মস্কোপন্থি কী পিকিংপন্থি উভয় ধারারই নেতৃত্বে ছিলেন মধ্যবিত্তরাই, তাদের কণ্ঠে ‘জয় সর্বহারা’ আওয়াজটি উঠতে চায়নি, উঠলেও তেমন জোরদার হয়নি, এবং তাদের ঠিকানা যে খেত-খামার-কলকারখানা সেটাও খুব পরিষ্কার ছিল না; অন্যদের কাছে তো নয়ই, তাদের নিজেদের কাছেও নয়। বাঙালিকে বীর বলা ও অস্ত্র তুলে ধরে বীরত্বকে প্রদর্শিত করার ডাকের তুলনায় দূরবর্তী শ্রমিক কৃষককে অস্ত্র ধরতে বলার ভেতর জোরটা কিছু কমই থাকার কথা। ছিলও। শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে তাই জাতীয়তাবাদীদেরই। চরিত্রগতভাবেই তারা বিপ্লবী ছিলেন না, ছিলেন আপসপন্থি এবং পুঁজিবাদী উন্নতিতে আস্থাশীল সামরিক শাসক আইয়ুব খান যখন সরে দাঁড়াতে বাধ্য হলেন এবং তারই অধীনস্থ সেনাপ্রধান ও তার তুলনায় নিম্নমানের এক ব্যক্তি, ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতায় বসিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করলেন, এবং ক্ষমতা পেয়ে ইয়াহিয়া খান যখন নির্যাতনমূলক পথ না ধরে নির্বাচনের ঘোষণা দিলেন তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, তারা স্বস্তি পেলেন এবং নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার পথ মোটামুটি উন্মুক্তই দেখতে পেলেন।
রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের জন্য নির্বাচন দিয়ে জনরোষ শান্ত করা ছিল পুরাতন কৌশল। ছেচল্লিশে নির্বাচন দিয়ে তারা একটি প্রায়বিপ্লবী পরিস্থিতিকে সামাল দিয়েছিলেন; চুয়ান্নতে নির্বাচন দিয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠা রাষ্ট্রবিরোধী শক্তিকে বিভক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। সত্তরে নির্বাচন দেওয়ার পেছনেও হিসাবটা ছিল ওই একই রকমের। আন্দোলনকারীরা বিভক্ত হয়ে যাবে, এবং ক্ষমতাসীনরা রক্ষা পাবে, আশা ছিল এইটাই। তাদের সে হিসাবটা মেলেনি; কারণ আগের আন্দোলনগুলোর ভেতরকার শক্তিটাকে ধারণ করে ও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনেক বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে কেবল মধ্যবিত্ত নয়, সব শ্রেণির মানুষই ততদিনে বুঝে নিয়েছিল যে, পাকিস্তান নামের শোষণমূলক রাষ্ট্রে তাদের জন্য আসলে কোনো ভবিষ্যৎ নেই। শত্রু হিসেবে অবাঙালি শাসকদের তাদের চেনাটাও আর অসম্পূর্ণ ছিল না।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়