ঢাকা ২৫ ভাদ্র ১৪৩১, সোমবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সাক্ষাৎকার: ড. তাসনিম সিদ্দিকী সবার আগে আমলাতান্ত্রিক সংস্কার প্রয়োজন

প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২৪, ১১:৫১ এএম
আপডেট: ১৩ আগস্ট ২০২৪, ১১:৫২ এএম
সবার আগে আমলাতান্ত্রিক সংস্কার প্রয়োজন
ড. তাসনিম সিদ্দিকী

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি ছাত্রদের পক্ষে লেখালেখি করেছেন এবং পথে নেমে আন্দোলনে সমর্থন করেছেন। তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন খবরের কাগজ-এর সিনিয়র সহ-সম্পাদক সানজিদ সকাল

খবরের কাগজ: বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে। বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদ জনগণের আকাঙ্ক্ষা কতটুকু পূরণ করবে বলে মনে হয়।

ড. তাসনিম সিদ্দিকী: অধ্যাপক ড. ইউনূসের তত্ত্বাবধানে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে, এর প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা ও সমর্থন রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার খুবই দ্রুত গঠন করা হয়েছে। কারণ সময়টা ছিল খুবই ক্রান্তিকাল। যাদের নিয়ে এই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে, তারা সবাই বিচক্ষণ এবং অন্তিম অভিজ্ঞতার মানুষ। অধ্যাপক ড. ইউনূস সাহেব অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অনেক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন। প্রতিকূলতা দূর করার জন্য ধীরে ধীরে হয়তো আরও উপদেষ্টা নিয়োগের প্রয়োজন পড়বে। 

খবরের কাগজ: অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে পারবে কি? 

ড. তাসনিম সিদ্দিকী: গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা একটা কঠিন ব্যাপার। সাধারণ ছাত্রছাত্রী, জনতা আস্থা রেখেছে এবারের অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের উদ্দেশ্য শুধু নির্বাচন সম্পূর্ণ করা নয়, আরেক দল ক্ষমতায় এসে আবার যেন কর্তৃত্ববাদী সরকারে পরিণত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা। তাহলে এত মানুষের প্রাণ দিয়ে কী লাভ হলো। এখন এই সরকারের দায়িত্ব প্রতিটা জায়গায় সংস্কার করা। 

বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি জায়গায় সংস্কার আনতে হবে। কারণ প্রতিটি জায়গা দলীয়করণ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল। এগুলো ঠিক করতে গেলে একটু সময় প্রয়োজন। যদি উপদেষ্টারা তাদের কাজগুলো করতে একটা নির্ধারিত সময় পান, তাহলে তারা সঠিকভাবে করতে পারবেন। দেশে কীভাবে নিরপেক্ষ ও যৌক্তিক গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা যায়, পুরোনো যারা ডেমোক্র্যাট আছেন, তারা সহযোগিতা করবেন। যদি আমরা মনে করি, আগামী তিন মাস বা ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে দেওয়া দরকার, তখন হয়তো আসল সংস্কার করা সম্ভব হবে না। 

খবরের কাগজ: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অচিরেই খুলে দেওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে কি না? 

ড. তাসনিম সিদ্দিকী: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর বন্ধ রাখার মতো পরিস্থিতি নেই। দ্রুতই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া দরকার। সবকিছুকেই স্বাভাবিক নিয়মে নিয়ে আসতে হবে। আমরা দেখতে পারছি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রক্টররা পদত্যাগ করছেন। তারা একেবারেই দলীয়-ভিত্তিক কাজ করতেন। ছাত্রদের দাবি ছিল, রাজনীতি চাই বাইরে, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থাকবে রাজনীতিমুক্ত। অর্থাৎ গণরুম থাকবে না। সবাই স্বাধীনভাবে চলতে চায়। 

এই কাজগুলো করতে হলে সে ধরনের মেধা ও শক্তিসম্পন্ন ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ করতে হবে। সেই সব প্রভোস্টকে নিয়োগ করতে হবে, যাদের কোনো দলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে তাদেরই, যারা রাজনীতি করেন না। যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অনেক বেশি, যারা সমাজ সম্পর্কে অনেক সচেতন, এমন শিক্ষকদেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ ও দায়িত্ব দিতে হবে। এভাবে সংস্কার করলে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া সম্ভব। 

খবরের কাগজ: অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে আন্তর্জাতিক সমস্যার মোকাবিলা করতে পারবে? এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?  

ড. তাসনিম সিদ্দিকী: প্রফেসর ড ইউনূসকে বিশ্বের কে না চেনে? তিনি বিশ্বনন্দিত ও জ্ঞানী মানুষ। তিনি যদি বৈশ্বিক চাপ মোকাবিলা না করতে পারেন, তাহলে কে পারবে? আমেরিকা ড. ইউনূসকে সমর্থন করে অভিনন্দন জানিয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে ড. ইউনূসের সরাসরি সংযোগ রয়েছে। চায়না ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। আমদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এতদিন শুধু একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংযোগ রেখে বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক চালু রেখেছে। 

বাংলাদেশে এমন গণ-অভ্যুত্থান হতে পারে, ভারত কখনো ভাবতেই পারেনি। তাদের গোয়েন্দা সংস্থা সঠিক তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা গোয়েন্দা বিভাগের ওপর উষ্মা প্রকাশ করেছে। ভারতের বিশ্বাস ছিল- শেখ হাসিনা সরকার টিকে থাকবে এবং যেভাবেই হোক শেখ হাসিনার মাধ্যমে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে। কিন্তু মানুষের মধ্যে কী চাহিদা তা এখনো ভারত সরকার বুঝতে পারছে না। হাসিনা সরকার তিস্তা চুক্তি, মোংলা বন্দর এবং যেখানে ভারতের ব্যবসায়ীদের আগ্রহ আছে, সেখানেই তিনি ভারতকে ছাড় দিয়েছেন। 

ভারতের স্বার্থ যেভাবে রক্ষা হয় সেভাবে তিনি চুক্তি করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের স্বার্থের কথা সব সময় চিন্তা করা উচিত। ভারতের সঙ্গে আমাদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই এবং তাদের সঙ্গে আমাদের সাংস্কৃতিক মিল রয়েছে। মূল অসুবিধা হলো, বাংলাদেশে পরপর তিনটা নির্বাচনে মোদি সরকার এভাবে একটা দলকে সহযোগিতা করে বিশ্ব জনমত তৈরি করে জনসাধারণের ভোটাধিকারকে একেবারে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। সে কারণেই বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ আছে। 

ভারতের এখন বন্ধুত্ব করতে হবে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে। কখনোই একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক নয়। ভারত এমন কিছু কাজ করছে, যা কূটনৈতিকভাবে ঠিক করছে না। এখন হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর সঙ্গে যা হয়েছে তা মোটেও উচিত হয়নি। বিষয়টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিকে নিয়ে যাওয়া ঠিক নয়। অথচ ভারত সেটাই করছে। ভারত এটাকে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর আঘাত হানা হয়েছে বলে সারা বিশ্বে ছড়াচ্ছে। 

প্রকৃতপক্ষে বিষয় কিন্তু তা নয়। বাংলাদেশে যারা ঘোর আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছে, তাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর আঘাত এসেছে।  আমাদের বোঝতে হবে এরা কোন হিন্দু জনগোষ্ঠী। এটা গণহারে সব হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর হচ্ছে, নাকি যারা আওয়ামী লীগপন্থি রাজনীতি করে তাদের ওপর হয়েছে। সেটাও যদি হয়ে থাকে তাও অন্যায়। 

তবে এটা আওয়ামী লীগের ওপর অসন্তোষ, কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয়। এই বিষয়গুলো ভারতকে বোঝতে হবে। ভারতের গণমাধ্যমে ভুল প্রচার করা হচ্ছে। ভারত সরকারের উচিত এই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করা। বরং এই সরকারকে আরও অস্থিতিশীল করে দিচ্ছে। এটা ভারতের জন্যও ভালো নয়। 

খবরের কাগজ: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, এটা কতটুকু সার্থক হবে বলে মনে হয়?

ড. তাসনিম সিদ্দিকী: বিচার বিভাগকে তো সম্পূর্ণ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। ছাত্র আন্দোলনের সময় যেভাবে আদালত নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিয়েছেন, আমরা দেখি- সরকার যেভাবে বলল কোর্ট সেভাবেই একটা রায় দিয়ে দিলেন অর্থাৎ কোটা বাতিল করা ভুল হয়েছে, পুরোনোটা বহাল থাকবে। এটা নির্বাহী আদেশ, বিচার বিভাগের এটা এখতিয়ার নেই। তবু তারা এই আদেশ দিয়েছিলেন। 

কেন দিয়েছিলেন? বিচার বিভাগ বলেছে, ‘শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন, তাই’। পরবর্তী যে নাটক, তা হলো- আবার আপিল করা হয়েছে। পরে ছাত্র আন্দোলন যদি না হতো, তাহলে তা বলবৎ রেখে সরকার বলত, আদালতের ওপর তো আমরা কথা বলতে পারি না। একই কাজ তারা করেছিলেন, আদালতের অজুহাত দেখিয়ে তিনি ওটাকে সঙ্গে সঙ্গে আইন করে অধ্যাদেশ বাতিল করালেন। উচ্চ আদালত সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে হবে। 

খবরের কাগজ: আমলাতান্ত্রিক সংস্কার কতটুকু প্রয়োজন বা এটা সংস্কার সম্ভব কি না?

ড. তাসনিম সিদ্দিকী: সবার আগে আমলান্ত্রিক সংস্কার প্রয়োজন। আগে তো রাষ্ট্রকে পরিচালনা করতে হবে। সব বিভাগ চালাতে হবে। ঊর্ধ্বতন যারা সরকারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিলেন তারা অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেকে অফিসে আসছেন না। 

এই মানুষগুলোকে সরাতেই হবে। আর যারা ভালো মানুষ, ঠিকমতো কাজ করতে চান- এ ধরনের মানুষকে পুনরায় সংগঠিত করতে হবে। এটা বিশাল কাজ। আবারও আমি বলব, একটা কমিশন গঠন করতে হবে।

খবরের কাগজ এগিয়ে যাক, এই কামনা রইল।

খবরের কাগজ: আপনাকে ধন্যবাদ।

শিক্ষাব্যবস্থাকে বদলাতে যা প্রয়োজন

প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:১৯ এএম
আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:১৯ এএম
শিক্ষাব্যবস্থাকে বদলাতে যা প্রয়োজন
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

জ্ঞানের অনন্ত বিশ্বে পা ফেলার প্রস্তুতি ও অনুপ্রেরণা দেয় শিক্ষা। এটি দীর্ঘসময় নিয়ে হয় এবং এতে সাময়িক বলে কিছু নেই অথবা আকর্ষণীয় কোনো মোড় নেওয়া নেই। শিক্ষা মনকে জাগায়, চিন্তা ও বোধের এলাকায় সমুন্নতি ঘটায়। বাংলাদেশের পক্ষে পুরোমাত্রায় সমকালীন হওয়ার জন্য যে শিক্ষা প্রয়োজন, তাকে হতে হবে সবচেয়ে সাম্প্রতিক, যদিও শিক্ষার ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সঙ্গে একটা নিবিড় সংযোগ থাকতে হবে। শিক্ষা হবে বিষয়ভিত্তিক কিন্তু ব্যাপক, যাকে বলা যায় উদার মানবিক।

মুখস্থনির্ভর, নোটবই-গাইডবই এবং টিউশনে পথ হারানো, শুধু লিখিত পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা সমসাময়িক হতে পারে না। তা হলে তা কীভাবে আমাদের আগামীতে পৌঁছে দেবে? বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সেই আগামীতে পৌঁছানোর জন্য তৈরি নয়। বর্তমান সময়কেই তা ধারণ করতে পারছে না, নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং উঁচুমানের যত দক্ষতা ও যোগ্যতার সমাহারে ক্রমিক সমুন্নতি সম্ভব যেসব পথে, সেসব পথে তা হাঁটবে কী করে? 

আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের সামনে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। এই সমস্যা ও সহিংসতাসংকুল পৃথিবীতে কোনো দেশই কোনো দেশের প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি। কাজেই আমাদেরও নির্ভর করতে হবে আমাদের নিজেদের শক্তির ওপর। সেই শক্তি শুধু অর্থনীতির শক্তি নয়, এটি এক সম্মিলিত শক্তি- যা মেধা, জ্ঞান ও প্রযুক্তি, সমাজ ও সংস্কৃতি, উদ্ভাবন ও নতুন চিন্তা, প্রকৃতি ও পরিবেশের মতো অনেক ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যের যোগফল। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রসর হওয়ার কথা বলি, কিন্তু এই প্রযুক্তি কি আমরা তৈরি করি? আমরা কৃষির ক্ষেত্রে অগ্রগতির পরিসংখ্যান দিই, কিন্তু কৃষিপ্রযুক্তির কতটা আমাদের উৎপাদন? আমরা পরিবেশ নিয়ে চিন্তিত হই, কিন্তু পরিবেশকে সুস্থ রাখার কয়টা উপায় আমরা আবিষ্কার করছি? 

আমাদের শিক্ষাকে বাজারবান্ধব করার জন্য উদারবাদী অর্থনীতির প্রবক্তারা তাদের নানা সংস্থার (যেমন, বিশ্বব্যাংক) মাধ্যমে আমাদের চাপে রাখেন, কিন্তু এই বাজার কি আমাদের শর্তে চলে, না পশ্চিমের? আমরা এখন ব্যস্ত শিক্ষাকে চাকরিজীবী এবং কর্মকর্তা করার দিকে পরিচালিত করতে।

চাকরিজীবী আর কর্মকর্তারা কখনো পরিবর্তন আনতে পারেন না, তাদের কর্মক্ষেত্রে নিয়মমাফিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা ছাড়া কিছু করাও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ওপরে যেসব ক্ষেত্রের উল্লেখ করা হলো, তার প্রতিটিতে সবচেয়ে সাম্প্রতিক জ্ঞান ও দক্ষতা লাভের জন্য যেসব প্রস্তুতি আমাদের থাকার প্রয়োজন, তা আমাদের অর্জিত হয় না নানা প্রতিবন্ধকতার জন্য; যার মধ্যে আছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অনুপস্থিতি, প্রয়োজনীয় অর্থের অপ্রতুলতা এবং শিক্ষা প্রশাসনে গতিশীলতার অভাব।

একুশ শতকের শিক্ষায় ভাষা ও গণিত, তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞান, পরিবেশ ও কৃষি, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি এবং যোগাযোগ দক্ষতাসহ নানা বিষয়ে সবচেয়ে সাম্প্রতিক জ্ঞান ও দখল থাকাটা এক আবশ্যিক শর্ত।

অথচ আমাদের ভাষাশিক্ষা ত্রুটিপূর্ণ- মাতৃভাষাতেই বলা ও লেখার দক্ষতা আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর নেই। ফলে অন্য কোনো ভাষায় তাদের দক্ষতা অর্জনের বিষয়টি কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। গণিত ও বিজ্ঞানে আমাদের শিক্ষার্থীদের দখল কাঙ্ক্ষিত মাত্রার নয়। তাদের যোগাযোগ দক্ষতা নিম্ন পর্যায়ের। গ্রাম ও শহরের, উচ্চ ও নিম্নবিত্তের মধ্যে বৈষম্য প্রকট। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক ডিজিটাল বৈষম্য। মেয়েদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অংশগ্রহণ আশানুরূপ নয়। শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যারা পড়ান, তাদের এক বড় অংশের ভাষাজ্ঞান দুর্বল। তা ছাড়া মুখস্থনির্ভরতার কারণে শিক্ষার্থীদের সক্ষমতার অনেকটাই অনাবিষ্কৃত থেকে যায়।

আমাদের চাই ভালোমানের স্কুল, সেই স্কুলগুলোতে থাকবে উন্নত গ্রন্থাগার, গবেষণাগার, অডিটোরিয়াম, খেলার মাঠ। আমাদের চাই সত্যিকার সৃজনশীল, উদ্ভাবনী শিক্ষা, চিন্তার গভীরতা, দক্ষতার সর্বোত্তম প্রকাশ। চাই উন্নত পাঠ্যবই এবং প্রশিক্ষিত, মেধাবী শিক্ষক এবং আনন্দিত পাঠদান ও পাঠ গ্রহণ। এ জন্য পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে বদলাতে হবে এবং তা করার জন্য প্রয়োজন কয়েকটি আবশ্যকতার বাস্তবায়ন। এগুলো হচ্ছে শিক্ষাকে একুশ শতকের উপযোগী করার জন্য রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অব্যাহত সমর্থন, প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের অঙ্গীকার ও তার বাস্তবায়ন, শিক্ষার আমূল পরিবর্তনের জন্য একটি সাহসী নীতি, মেধাবী শিক্ষকদের এই পেশায় আকৃষ্ট করার জন্য শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় করা, বিদ্যায়তনগুলোর সঙ্গে সমাজের গূঢ় সংযোগ তৈরি করা, সেগুলো পরিচালনা এবং সার্বিকভাবে শিক্ষাঙ্গন থেকে রাজনীতি নির্মূল করা, পাঠক্রমকে আকর্ষণীয় করা এবং পরীক্ষার বোঝা কমিয়ে, মুখস্থ বিদ্যাকে গুরুত্ব না দিয়ে, নোটবই ইত্যাদিকে বিদায় দিয়ে, টিউশনকে একেবারে অপ্রয়োজনীয় করে চমৎকার একটা শিখন-শিক্ষণ পদ্ধতির প্রয়োগ এবং শিক্ষা প্রশাসনকে বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে আনা। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জীবনদক্ষতাসহ সব ধরনের দক্ষতার উন্নতি ঘটিয়ে বই পড়ার প্রতি তাদের আকৃষ্ট করে, সাংস্কৃতিক নানা চর্চায় তাদের উৎসাহিত ও জড়িত করে, খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে, প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করে শিক্ষাকে তাদের মালিকানায় তুলে দেওয়া।

অত্যাবশ্যক যেসব কাজের তালিকা দেওয়া হলো- যেগুলোর অনুপস্থিতিতে শিক্ষা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই পড়ে থাকবে। তবে আমার বিশ্বাস, এর সব কটি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব। 

এক করপোরেট কর্তাকে তার এক সহকর্মী জিজ্ঞেস করেছিলেন, যে জরুরি কাজটা তার করার কথা, তা কবে করে দিতে হবে। কর্তা বলেছিলেন, গতকাল। অর্থাৎ এক মুহূর্তও নষ্ট করা যাবে না। 

আমাদেরও এই কথাটা মনে রাখা উচিত। আমার দুঃখ, সাধ্য থাকলেও শিক্ষায় উন্নতি ঘটানোর সাধ আমাদের এখনো তৈরি হয়নি। যেদিন হবে- হতেই হবে, কারণ তা না হলে আমরা একুশ শতকের দৌড়ে পা হড়কে পড়ে যাব- সেদিন হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে।

 আমাদের মেধা আছে, মেধার কমতি নেই, কিন্তু মেধার লালন হয় না। আমার ৫০ বছরের শিক্ষকতায় দেখেছি- প্রত্যন্ত, অবহেলিত এক জনপদ থেকে উঠে আসা একটি ছেলে বা মেয়ে অনেক দ্বিধা এবং অসম্পূর্ণতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে অনুকূল পরিবেশ পেয়ে কী চমৎকারভাবে নিজেকে মেলে ধরেছে। আমি নিশ্চিত, সারা বাংলাদেশে যদি আমরা সেই শিক্ষা দিতে পারতাম, যার একটি অতি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা আমি এই লেখায় দিয়েছি, তাহলে মাত্র এক-দেড় দশকে দেশটি একুশ শতকের জন্য শুধু তৈরিই হতো না, অনেক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতেও সক্ষম মনে রাখতে হবে।
 
(গত বছরের অক্টোবরে খবরের কাগজ উদ্বোধনী সংখায় লেখাটি ছাপা হয়েছিল। বর্তমানে শিক্ষা নিয়ে যে নতুন চিন্তাভাবনা হচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে লেখাটি ঈষৎ সংক্ষিপ্ত করে আবার ছাপা হলো)

লেখক: শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক

অর্থনীতি সক্রিয় করতে করণীয়

প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:১৪ এএম
অর্থনীতি সক্রিয় করতে করণীয়
রাজেকুজ্জামান রতন

শিক্ষা নেওয়ার কথা এলে সবাই বলেন, অতীত থেকে শিক্ষা নাও। বিগত সরকারের শাসনামলে দেশের অর্থনৈতিক খাত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফলে শিক্ষা নিতে হবে অতীতের ভুল থেকে। গত ১৫ বছরেরও বেশি সময়ে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়া হয়েছিল, যার বোঝা একটা বড় বিপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যেকোনো দেশের সরকারের জন্য ঋণের উৎস প্রধানত দুটি। একটি অভ্যন্তরীণ ঋণ ও অন্যটি বৈদেশিক ঋণ। অভ্যন্তরীণ ঋণ বেশি নিলে বিনিয়োগকারীরা ঋণ নিতে পারে না আর বৈদেশিক ঋণ বেশি হলে নানা ধরনের শর্তের জালে আটকা পড়তে হয় দেশকে। 

তাই ঋণ সেটা অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক যাই হোক না কেন, দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বেই। ফলে দেশ এবং জনগণের কথা ভাবলে সতর্কভাবেই ঋণ নেওয়া উচিত। বিগত বছরগুলোয় আওয়ামী লীগ সরকার যে ঋণ করেছে, তার বড় একটা অংশ এসেছে দেশীয় উৎস থেকে। দেশীয় উৎসের মধ্যে বেশির ভাগ ঋণ করা হয়েছে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, পদত্যাগের সময় শেখ হাসিনার সরকার ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ রেখে গেছে। এ ঋণ পরিশোধের দায় বর্তেছে বর্তমানে ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। শুধু যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে এ ঋণের দায় বহন করতে হবে তা নয়, পরবর্তীকালে যেসব সরকার আসবে, তাদেরও এ দায় বহন করতে হবে। সরকার আসবে সরকার যাবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঋণের এই বোঝা দেশের জনগণকেই বহন করতে হবে। ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলে বলা হতো, ভারতের কৃষকরা হলো সেই হতভাগা, যারা ঋণের মধ্যেই জন্মে এবং মরে। They are born in debt, live in debt and die in debt. আজ বাংলাদেশের জনগণ সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। সরল হিসেবেও দেখা যাচ্ছে আজ যে শিশুর জন্ম হবে, তার মাথার ওপর থাকবে কমপক্ষে ১ লাখ টাকার ঋণের বোঝা। বেঁচে থাকলে ঋণের বোঝা টেনে চলতে হবে এবং মৃত্যুতেও এ ঋণের দায় থেকে নিষ্কৃতি মিলবে না। একটি জাতির জন্য এরকম ঋণের বোঝা কতটা অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে, তা কি সরকার ভাববে না? ব্যাংক থেকে এবং বিদেশ থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের ঋণ নেওয়া প্রসঙ্গে এই দায়িত্বশীলতার প্রশ্নটাই এখন বিতর্ক তৈরি করছে। 

দেশ পরিচালনা করতে, নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে টাকা তো লাগবে। এই টাকার পুরোটা দেশের অভ্যন্তর থেকে সংগ্রহ করতে না পারলে ঋণ নিতেই হবে। কিন্তু কী শর্তে এবং কী পরিমাণ ঋণ নেওয়া যেতে পারে, সে ব্যাপারে সঠিক বিশ্লেষণ জরুরি। তা না হলে অপ্রয়োজনীয় ঋণ এবং ঋণের কঠিন শর্ত অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে পারে। উন্নয়নের মোহ তৈরি আর লুণ্ঠনের মহোৎসবের ফলে দেশীয় এবং বিদেশি সব উৎস থেকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ নিয়েছে বিগত সরকার। অর্থনীতিবিদদের একটা বড় অংশ মনে করেন দেশের অভ্যন্তর থেকে সরকারের ঋণ কম নেওয়াই উচিত। তারা তাই বিদেশি মুদ্রায় ঋণ করাকে ভালো মনে করেন। যদি বিচার-বিবেচনা না করে বিদেশি ঋণ না নেওয়া হয়, তা যে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, পৃথিবীর বহু দেশের মতো বাংলাদেশেও তার প্রমাণ আছে। ঋণের সুদ এবং আসল শোধ দিতে বাজেটের বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে। আর শর্ত মানতে গিয়ে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির দাম বাড়াতে হচ্ছে বারবার।  

উন্নয়ন না গণতন্ত্র- এই আওয়াজ তোলা হয়েছিল আর উন্নয়নের মহিমা কীর্তন করা হয়েছে। এটা করতে গিয়ে শেখ হাসিনার সরকার কঠিন শর্তেও বিদেশি ঋণ নিয়েছে। যথার্থ প্রয়োজন নিরূপণ না করে এবং বাছবিচার না করে ঋণ নেওয়ার ফলে সরকারের দায়দেনা বেড়েছে বিপুল। অর্থনীতিতেও সহ্যক্ষমতা বিবেচনা করতে হয়। এই বিবেচনায় ঋণ পরিস্থিতি প্রায় সহ্যক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছেন। অর্থ বিভাগ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশি-বিদেশি ঋণের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোট ঋণের স্থিতি ১৬ লাখ ৫৯ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। নিয়ম অনুযায়ী ঋণের হিসাব হালনাগাদ করা হয় প্রতি তিন মাস অন্তর। সেই হিসাবে মার্চ, জুন শেষে ঋণের স্থিতি দাঁড়াবে ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে দেশের অভ্যন্তর থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ হবে ১০ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা, আর বিদেশি ঋণের পরিমাণ হবে ৮ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসের শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৭৯০ কোটি মার্কিন ডলার। প্রতি ডলার ১১৮ টাকা দরে হিসাব করলে তা ৮ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা দাঁড়ায়। কিন্তু বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে প্রতি ডলারের মূল্য ১২১ টাকা। সুতরাং, দেশীয় মুদ্রার মূল্যে বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৮ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি। অথচ গত ডিসেম্বর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৪ লাখ ৫ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে বিদেশি ঋণের স্থিতি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য। 

টাকার অঙ্কে যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের স্থিতি দেশের অতীতের তিনটি বড় বাজেটের সমান। বিপুল পরিমাণ ঋণ শোধ এবং সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে বাজেটের ওপর ভীষণ চাপ পড়বে। বড় বাজেটের আত্মপ্রসাদ লাভের মানসিকতা গড়ে তোলা হয়েছে অতীতের বছরগুলোতে। এর  ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হলে আগামী বাজেটের সময় আরও ঋণ করতে হবে, অর্থাৎ বাজেটে ঋণসহায়তা প্রয়োজন হবে। এসব ঋণ চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকে। ঋণ নেওয়া, ঋণের সুদ দেওয়া, আসল পরিশোধ করা, আবার ঋণ নেওয়ার বিষয়টি এমনভাবে চলতে চলতে ঋণের ফাঁদে পড়ে যায় দেশ। ফলে সাবধান থাকতে হয় যেন ঋণ গ্রহণ অর্থনৈতিক সক্ষমতার বাইরে চলে না যায়। 

আওয়ামী লীগের প্রায় ১৫ বছরে গড়ে ওঠা কয়েকটি অলিগার্ক গোষ্ঠী ফুলেফেঁপে বিশাল আকার ধারণ করেছিল। এরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ করেছিল পরিশোধ না করার জন্য। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এরা ব্যাংক দখল করেছিল ব্যাংকগুলোকে পঙ্গু করে ফেলার জন্য। প্রভাব খাটিয়ে রি-শিডিউল করার নামে এমনসব নিয়ম চালু করেছিল, যার ফলে ঋণ পরিশোধ না করেও ঋণখেলাপি হতে হয়নি। কিন্তু এর ফলে বেশকিছু ব্যাংক নিরাময় অযোগ্য রোগে রুগ্‌ণ হয়ে পড়ে। পদ্মা ব্যাংকের মতো কিছু ব্যাংক তৈরি করা হয়েছিল সাধারণ মানুষের আমানত লুটপাট করার জন্য। কিছু ব্যাংকের অ্যাডভান্স টু ডিপোজিট অনুপাত এতটাই নেতিবাচক অবস্থায় পড়েছে যে, আমানতকারীদের চেকের অর্থ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে তারা। অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, তাদের অন্য ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে।  

একটু পেছনে তাকানো যাক! আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি যখন  নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। কিন্তু যখন ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হলো, তখন দেখা যাচ্ছে গোটা ঋণ পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে। ঋণের পরিমাণ ৬ গুণ বেড়েছে, এমনকি বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ নিয়েও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

কিন্তু আশঙ্কায় কুঁকড়ে গেলে তো চলবে না, সংকটের সমাধান করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরা, মেগা প্রকল্পের মোহ পরিত্যাগ করা, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো, যাচাই করে ঋণ নেওয়া এখন গুরুত্বপূর্ণ। লুণ্ঠনমূলক অর্থনীতি সমাজে বৈষম্য বাড়ায়, এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। পরিবর্তনের ধাক্কা যেন রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে নতুনভাবে সাজায়, এ আকাঙ্কা মানুষের আছে। দুর্নীতিবাজ বলা সহজ, কিন্তু দুর্নীতির যে চক্র গড়ে উঠেছে তা ভাঙার কঠিন কাজটা এখন জরুরি। সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিলে এবং আস্থার পরিবেশ তৈরি করার ওপর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো নির্ভর করছে।  

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) 
[email protected]

শিক্ষা খাতে সংস্কার: সবার ওপর মানবসম্পদের উন্নয়ন

প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:২০ এএম
শিক্ষা খাতে সংস্কার: সবার ওপর মানবসম্পদের উন্নয়ন
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
২০২৪-এর ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপট ছিল ব্যক্তি ও সামষ্টিক পর্যায়ে আয়-উপার্জন ও ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার অধিকারপ্রাপ্তিতে বিদ্যমান প্রচণ্ড বৈষম্যের বিরোধিতা; বিরোধিতা ছিল মানবসম্পদ উন্নয়নে ও নিয়োগে মেধা অবমূল্যায়নের প্রয়াস-প্রচেষ্টাকে রুখে দেওয়া; ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মধ্যগগনে অবস্থানকারী তাজা তরুণ জনগোষ্ঠীকে ডিজাস্টারে পরিণত করার কূটকৌশলের মর্মমূলে আঘাত হানা, যাতে শিক্ষিত বেকারের ভারে ন্যুব্জ দেশ, সমাজ ও অর্থনীতিকে একটি স্বনির্ভর অবয়বে গড়ে তোলা যায়। সে নিরিখে শিক্ষা খাতে সংস্কারকে অন্যতম এবং অগ্রগণ্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা এবং চিন্তাচেতনার চৌহদ্দিতে আনা আবশ্যক। 
 
এই মুহূর্তে করণীয়: শিক্ষায় সবাইকে সর্বজনীন সক্ষমতা ও দক্ষতার পথে পেতে হলে এই মুহূর্তেও (১) প্রথম ও প্রধান করণীয় হলো সবাইকে পাঠকক্ষে ফিরতে হবে, ফেরাতে হবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালনের পর এখন শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষকসমাজ এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই দায়িত্ববোধ জেগে ওঠা দরকার হবে যে, যার যার পাঠক্রম ভালোভাবে শেষ করতে হবে। বকেয়া কোনো পরীক্ষায় অংশ না নেওয়ার যৌক্তিক দাবি থেকে সবার সার্বিক স্বার্থে সরে আসতে হবে। 
 
কিছুটা বাড়তি সময় নিয়ে হলেও সব পরীক্ষায় সবাইকে অংশ নিতে হবে এ জন্য যে, ভবিষ্যতের দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ পরীক্ষার সনদ দেশে কিংবা বিদেশে উচ্চশিক্ষা, এমনকি মধ্যপর্যায়ে চাকরি-বাকরি লাভের ক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে দাঁড়াবে। তীব্র প্রতিযোগিতার বিশ্বে দুর্বল সনদ নিয়ে টিকে থাকা যাবে না। আমরা টিকতে না পারলে সে চাকরি ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে বিদেশিরা। বৈষম্য নিরসনের আন্দোলনের সফলতা ভণ্ডুল ও ভঙ্গুর করার ক্ষেত্রে পাঠবিমুখ হয়ে থাকার চেয়ে আত্মবঞ্চনা ও বৈষম্য বৃদ্ধি আর কোনো কিছু হতে পারে না। 
 
(২) শিক্ষককে, শিক্ষা প্রশাসনকে সম্মান ও সমীহ করতে হবে। যার যা দোষত্রুটি আছে তার প্রতিবিধান হবেই হবে, তবে এর জন্য ধৈর্য ধরতে হবে। নিজেরা সজাগ, নিজেরা আইন ও ব্যবস্থাপনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলে, ঐক্যবদ্ধ থাকলে অপশক্তি পলায়ন করতে বাধ্য হবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাম্প্রতিক সাফল্য তো তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। 
 
স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপসমূহ: বাংলাদেশে ইতোমধ্যে নানান শিল্পোদ্যোগে এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে এর অর্থনীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। দেশটি কৃষি এবং ট্রেডিং-নির্ভরতা থেকে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে অগ্রসরমাণ। বাংলাদেশ জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ একটি দেশ। সে কারণে স্বাভাবিকভাবেই দেশের কর্মক্ষম জনগণকে কর্মকুশল-দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার অনিবার্যতা মাহেন্দ্রক্ষণে উপনীত। 
 
কেননা ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ সৃজনশীল কর্মক্ষম জনসমষ্টির আওতায় চলে এসেছে, যা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড নামে পরিচিত। সনাতন শর্তানুযায়ী, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড মূলত তিন দশক পর্যন্ত সৃজনশীল এবং উন্নয়ন অভিসারী অভিযাত্রায় থাকে। ইতোমধ্যে তার এক দশকের বেশি সময় চলে গেছে; সামনে আরও দেড়-দুই দশক বাকি আছে। 
 
এ সময়ের মধ্যে বিদ্যমান কর্মোপযোগীদের উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত করতে না পারলে বা তাদের উপযুক্ত কর্মসম্পাদনে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে না পারলে কিংবা তাদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে তারা অলসতায় শয়তানের কর্মশালায় যোগ দিতে পারে কিংবা অকর্মণ্যতায়-হতাশায় নিমজ্জিত হতে পারে; যে পরিস্থিতিতে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ডিজাস্টারে পরিণত হতে পারে। 
 
কেননা সমাজে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে গেলে উৎপাদনশীলতায় বা জিডিপিতে তাদের অবদান বঞ্চিত হয় দেশ এবং তারা নিজেরাই নিজেদের, পরিবারের ও দেশের জন্য বোঝা বা বিপদের বা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর সেই ক্ষতির ধকল কাটিয়ে উঠতে জাতির জন্য প্রয়োজন হবে প্রচুর সময় এবং এর জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দিতে হবে বিশেষ মাশুল।
 
বিগত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা এ দেশের জনগণকে বিশেষ করে যুবসমাজকে এখনো পর্যাপ্ত যথাযথ দক্ষ জনসম্পদে বা প্রশিক্ষিত লোকবল হিসেবে গড়ে তুলতে পারেনি। যার জন্য এ দেশ থেকে বিদেশে যাচ্ছে অদক্ষ শ্রমিক আর বিদেশের দক্ষ জনবল এ দেশের মধ্য ও উচ্চতর পদগুলোতে বেশি বেতনে নিয়োজিত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রচুর বিশ্ববিদ্যালয় সমাপনকারী ডিগ্রিধারী শিক্ষিতের সংখ্যা বেড়েছে; কিন্তু তাদের দেশের উদীয়মান শিল্পে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগযোগ্য হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে না। 
 
বাংলাদেশি তরুণ উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপকদের মধ্যে প্রায়োগিক জ্ঞানের নিম্নগামিতা, প্রশিক্ষণ এবং অধিক শিক্ষা গ্রহণে যুগপৎভাবে সুযোগ ও আগ্রহের অভাব। বাংলাদেশের জন্য উঠতি বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে টিকে থাকা কিংবা অধিকতর যোগ্যতা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মতো উপর্যুক্ত ও দক্ষ জনবলের যেমন প্রয়োজন, তেমনি টেকসই ও লাগসই প্রযুক্তি প্রয়োগ এবং সমন্বয়ে দক্ষ জনবলের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তার সঙ্গে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকুশলতা। 
 
এই প্রয়োজনীয়তার বিপরীতে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার গুণগত মান কমে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন সম্প্রসারণমূলক কর্মকাণ্ডে নতুন নতুন যেসব চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে, সেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে তা মোকাবিলা করার জন্য পর্যাপ্ত ও উপর্যুক্ত লোকবলের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে।
 
ইতোমধ্যে বাংলাদেশে শিল্প, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের যে কর্মসম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে উপযুক্ত দেশীয় লোকবল সংস্থান করা যাচ্ছে না; অথচ সেগুলো বিদেশিদের দ্বারা পূরণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস শিল্প একটি অতি সম্ভাবনাময় শ্রমিকনির্ভর শিল্প। সেখানে মধ্য পর্যায়ের অধিকাংশ ব্যবস্থাপক, পরিচালক, নকশাকার হিসেবে নিয়োজিতরা বিদেশি। 
 
এর ফলে দেশি শিক্ষিত বেকারকে কর্মসংস্থানের চাহিদায় টানাপোড়েন সৃষ্টি হয় এবং চাকরি না পেয়ে বাংলাদেশে শিক্ষিত তরুণরা হতাশায় নিমজ্জিত। একই সময়ে দেশের টেকনিক্যাল শিক্ষার পরিবর্তে সাধারণ শিক্ষার জয়যাত্রা অব্যাহত থাকায় দক্ষ জনবল সরবরাহের পরিস্থিতি এমন একটি নেতিবাচক পর্যায়ে যাচ্ছে যে, দীর্ঘ মেয়াদে তাতে এক করুণ ও আত্মঘাতী পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
 
এহেন পরিস্থিতি থেকে কার্যকরভাবে পরিত্রাণ পেতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। গালভরা শব্দমাখা, দেশি-বিদেশি কনসালট্যান্ট ও বিদেশি সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের মাধ্যমে অনুসন্ধান পরীক্ষা-পর্যালোচনার পথে থাকার চেয়ে একটি আত্মনির্ভরশীল পরিস্থিতি সৃজনে নিজেদের ভাবনায় বা উদ্যোগে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়-
 
১. দেশের জনবলকে দেশে নিয়োগ বা আত্তীকরণ নিশ্চিত করা। বাইরের বায়ারের চাপে কিংবা বাইরের কর্মীদের স্মার্টনেসের যুক্তিতে তাদের নিয়োগ করা থেকে বিরত থেকে দেশীয়দের নিয়োগে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তথা চাহিদা সৃষ্টি করতে হবে। দেশে কর্মসৃজনের সুযোগ সৃষ্টি না করে বিদেশে পুঁজি পাচার করা আত্মঘাতী অপরাধ। বিদেশে নয়, নিজেরা যদি নিজেদের দেশে লোকবল নিয়োগের জন্য পদ সৃষ্টি না করি, তা হলে দেশীয়দের চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে না। দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে।
 
২. পেশাজীবী ও শিল্পগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠান নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী লোকবল তৈরির জন্য বিশেষায়িত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারেন। ইতোমধ্যে বিজিএমইএসহ কয়েকটি সংস্থা নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউট গড়ে তুলছে। কিন্তু সেসবের বাস্তবায়ন বড্ড ধীরগতিসম্পন্ন এবং অনেক ক্ষেত্রে দক্ষ লোকবল তৈরির কাজ এখনো শুরু হয়নি, শুরু হলেও মানসম্মত ফল পেতে দেরি হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, সময় কারও জন্য বসে থাকবে না।
 
৩. বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করছে, তাদের ভাষা ও টেকনিক্যাল জ্ঞান বাড়াতে হবে। তাদের সৃজনশীলতার বিকাশ-ভাবনা গতানুগতিক অবয়বে না রেখে তাদের জন্য নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি বিশেষ ব্যবস্থাপনাধীনে ভাষাচর্চা ও ব্যবহারের দক্ষতা অর্জনের জন্য আলাদা ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তা না হলে বিদ্যমান শিক্ষার্থীরা শ্রমবাজারে গতানুগতিক অদক্ষ অবস্থায় প্রবেশ করবে। 
 
৪. অদক্ষ শ্রমিক প্রেরণের পথ পরিহার করে বিদেশে দক্ষ শ্রমিক প্রেরণের লক্ষ্যে এবং দেশে দক্ষ জনবল সৃষ্টির জন্য আলাদাভাবে বিশেষ তহবিল গঠন করে বিশেষ কার্যক্রম/উদ্যোগ নিতে হবে। বিদ্যমান সব বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রকৃতপক্ষে কি শেখানো হচ্ছে, তা কঠোর তদারকিতে এনে সেখানে গুণগত শিক্ষাদান নিশ্চিত করতে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে।
 
৫. অদক্ষের পরিবর্তে দক্ষ জনবল প্রেরণ করতে পারলে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। দেশে দক্ষ জনবল পাওয়া গেলে, বিদেশিদের নিয়োগ বন্ধ হলে ব্যাপক বিদেশি মুদ্রার সাশ্রয় ঘটবে। সরকারকে সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এই লাভ-লোকসানের সমীকরণটি যথাবিবেচনায় নিয়ে সাধারণ শিক্ষার পরিবর্তে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি মনোযোগী এবং যেখানে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের গুণগত মান বজায় রাখার ব্যাপারে কড়া তদারকি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যেসব প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ করবে, তাকে সুলভ করতে কর রেয়াত কিংবা প্রণোদনা দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে।
 
৬. কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রমে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ভাষা শিক্ষাসহ বিশেষ প্রায়োগিক জ্ঞানের পাঠ্যসূচি কার্যক্রম সংযুক্তকরণ। উচ্চ মাধ্যমিকে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রাক্কালে দেশি-বিদেশি ভাষায় দখল ও দক্ষতা যাচাই করতে হবে। প্রয়োজনে ২-৩ মাসের একটা কোর্স করিয়ে ভর্তিতে উপযুক্ততা যাচাই করার পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে।  
 
৭. বিদেশে দক্ষ শ্রমিক প্রেরণে সচেষ্ট থাকা। অদক্ষ শ্রমিক প্রেরণের ক্ষেত্রে তাদের প্রেরণ-ব্যয় যাতে সীমিত থাকে, সেদিকে লক্ষ রাখা। কেননা অদক্ষ শ্রমিকরা বিদেশে বেশি বেতন পায় না, অথচ তাদের যেতে যদি বেশি অর্থ ব্যয় হয়, তা হলে তাদের প্রত্যাবসনের দ্বারা প্রকৃতভাবে অর্থনীতি কোনোভাবে উপকৃত হবে না।
 
৮. সাধারণ শিক্ষা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত রেখে সাধারণ শিক্ষা এবং পরবর্তী পর্যায়ে প্রায়োগিক বা বৃত্তিমূলক টেকনিক্যাল শিক্ষার দিকে অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে ধাবিত করা। শুধু উচ্চ মেধাসম্পন্ন ও গবেষণা-ইচ্ছুকরা উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে যেতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাধারণ শিক্ষা পর্যায়ক্রমে নিরুৎসাহিত করা।
 
৯. শিক্ষা পাঠ্যক্রমে নীতি-নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ এবং বিভাজন ও বৈষম্য 
 
বৃদ্ধির বিরুদ্ধে সোচ্চার ও সজ্ঞান প্রতীতি ও প্রত্যয় জাগাতে হবে। 
 
জনসম্পদ উন্নয়নে বিদ্যমান এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা এবং উন্নত পর্যায়ে উত্তরণ শুধু জরুরি নয়, অনিবার্যও বটে। এখনই যদি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের দিকে নজর না দেওয়া হয়, তা হলে আগামী ১৫ বছরের আগে সেই দক্ষ জনবলের সাক্ষাৎ মিলবে না। 
 
ততদিনে বর্তমানে বিদ্যমান বেকার ও অদক্ষ শিক্ষিত জনসম্পদ ওপরে ও নিচের জন্য জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে থাকবে। ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধান পর্যায়ে বিদেশিদের নিয়োগ অব্যাহত থাকলে বা রাখলে দেশের চাকরির বাজার দেশীয়দের জন্য আরও অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। এ বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে। 
 
লেখক: সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের চেয়ারম্যান

ওয়াসায় জনগণের মালিকানা কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:১৭ এএম
ওয়াসায় জনগণের মালিকানা কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?
এস এম নাজের হোসাইন
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হলো। ইতোমধ্যে স্বৈরাচারের অনেক দোসর নিজেরাই পদত্যাগ ও পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন। বহুল আলোচিত ঢাকা ওয়াসায়ও তার ধাক্কা লেগেছে। আজীবন লিজ নেওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইতোমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন। দীর্ঘ ১৬ বছর ঢাকা ওয়াসাসহ সব ওয়াসার অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও জনগণের মালিকানা নিয়ে অনেক আলোচনা করা হলেও তার সুফল পাওয়া যায়নি। 
 
কারণ এগুলো কাউকে কাউকে দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দেওয়া হয়েছিল বিগত সরকারের আমলে। প্রায় সময় গ্রাহক পর্যায়ে পানির দাম বৃদ্ধির খড়্গ নেওয়া হতো লোকসান কমানোর কথা বলে। যদিও ক্যাবসহ নানা নাগরিক সংগঠনের ভিন্নমত থাকলেও সেটি আমলে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা ছিল না। রাবার স্ট্যাম্পের মতো একটি পরিচালনা পর্ষদ ছিল, যা অনেকটাই লোক দেখানো।
 
পানি প্রত্যেক নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্র তার নাগরিকদের অন্ন, বস্ত্র, খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থানসহ মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করবে। সে আলোকে রাজধানী ও আশপাশ এলাকায় জনগণের অত্যাবশ্যকীয় পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ঢাকা ওয়াসাকে। যদিও রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থাটির সরবরাহকৃত পানির মান নিয়ে রয়েছে নানা মহলের অভিযোগ। 
 
শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানিও সরবরাহ করতে পারে না ওয়াসা। এ ছাড়া পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও অপর্যাপ্ত। তবু নিয়মিতই মুনাফা করে আসছিল ঢাকা ওয়াসা। প্রতিনিয়তই ঢাকা ওয়াসা প্রতি অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা করে আসছে। এর পরও নানা অজুহাতে প্রতিবছর পানির মূল্য বাড়ায় ঢাকা ওয়াসা। আর মন্ত্রণালয় সেখানে সায় দেয়। 
 
আলোচনার সুবিধার্থে অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া ঢাকা ওয়াসার আর্থিক প্রতিবেদনের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। এতে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ওয়াসা মুনাফা করেছিল প্রায় ৩৯৭ কোটি টাকা। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ২৯৪ কোটি টাকা লোকসান করেছে সংস্থাটি। লোকসানের কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, পরিচালন তথা বেতন-ভাতা, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, বিক্রয় ও বিতরণ ইত্যাদি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি। এ ছাড়া সরকার থেকে গৃহীত ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। চলতি অর্থবছরও ওয়াসা লোকসান করবে বলে প্রাক্কলন করেছে।
 
ক্যাবসহ বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার মূল সমস্যা হলো ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ পানি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নিত্যনতুন প্রকল্প নিতে বেশি আগ্রহী। পানি উৎপাদন, বিতরণ ও ব্যবহারে অনিয়ম দূর করা গেলে এবং ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটানো হলেই লোকসান কমানো সম্ভব। কারণ ঢাকা শহরে যেখানে পানি আছে সেখানে প্রচুর পানির অপচয় হচ্ছে, আর যেখানে নেই সেখানে শুধু হাহাকার। কয়েক দিন আগে পুরো পানি সরবরাহ লবণাক্ত ও ঘোলাটে হয়ে পড়েছিল। 
 
ওয়াসার নীতিনির্ধারকদের হাতে সে খবর ছিল না। পরে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির কারণে কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত হয়। এতে প্রমাণিত হচ্ছে, ওয়াসা কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমে তদারকি ও কাজের গুণগত মান উন্নয়নে কোনো তৎপরতা নেই। আর অবৈধ সংযোগ, সিস্টেম লস পুরোটা খামচে ধরেছে ওয়াসাকে। অনেক জায়গায় ওয়াসার পানির পাইপ থেকে বিপুল পরিমাণ পানি নিঃসরণ হয়ে স্যুয়ারেজের লাইনে চলে গেলেও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ কোনো খবরই রাখে না। ওয়াসা চলমান প্রকল্পগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নকাজে তদারকিতে বিরূপ মনোভাব রয়েছে। 
 
এ ছাড়া যেটি সবচেয়ে ভয়ংকর তা হলো, ওয়াসার পরিচালনা পর্ষদে ভোক্তাদের কোনো সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব নেই। ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন, ১৯৯৬ অনুসারে ঢাকা ওয়াসা পরিচালনা পর্ষদ গঠনের বিষয়ে বলা হয়েছে, পরিচালনা পর্ষদে সরকারের প্রতিনিধি, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, শিল্প ও বণিক সমিতির প্রতিনিধি, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ-এর প্রতিনিধি, সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধি, বার কাউন্সিলের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ-এর প্রতিনিধি এবং পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। 
 
প্রত্যেক প্রতিনিধি তাদের সংশ্লিষ্ট সংগঠন কর্তৃক মনোনীত হলেও পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধি ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্তৃক তারই আজ্ঞাবহকে মনোনীত করে থাকেন। বর্তমান ওয়াসার বোর্ড চেয়ারম্যানও একই প্রক্রিয়ায় মনোনীত। স্বাভাবিক কারণেই ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্তৃক মনোনীত বোর্ড সদস্য বা চেয়ারম্যান যে-ই হোক না কেন, তার পক্ষে তার মনোনয়নদানকারীর কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলা কি আদৌ সম্ভব? আইনের মারপ্যাঁচে বলা আছে, একজন ব্যক্তি কীভাবে পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধিত্বকারী হতে পারেন? 
 
তবে পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিনিধি হতে হলে তাকে ভোক্তাদের সঙ্গে সংযোগ থাকতে হবে। আর সরকার ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ প্রণয়ন করেছে। যেখানে ধারা নং ৫-এর ১৬ উপধারায় বলা আছে, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ভোক্তাদের প্রতিনিধিত্ব করবে। তারই ধারাহিকতায় ক্যাব সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ভোক্তা র্স্বাথসংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণী ও কমিটিগুলোতে প্রতিনিধিত্ব করে এলেও ঢাকা ওয়াসায় তা মানা হয়নি। 
 
দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আর একটি জটিল সমস্যা হলো শাসনব্যবস্থায় সমাজের সব শ্রেণি ও পেশার প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণের অভাব। যদিও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মালিক সব জনগণ বলা হলেও বর্তমানে শাসনব্যবস্থায় সমাজের সকল পর্যায়ের নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত। এ জন্য সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা আবশ্যক। এই সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার বিষয়টি রাজনীতিতে অনুপস্থিতির কারণে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম, অবজ্ঞা ও সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। 
 
যার প্রভাব পড়েছে রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী সংস্থার ব্যবস্থাপনায়ও। যেখানে অনেক খাতে শুধু সরকারি কর্মকর্তা আর ব্যবসায়ী মিলেমিশে নীতিনির্ধারণ করে থাকেন। অথচ এখানে নাগরিকদের অংশগ্রহণ বা যাদের জন্য এই সেবা সার্ভিস, তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকে না। তবে অনেক জায়গায় এসব পদও সমাজের ওপরতলার লোকজন দখল করে নেন। নীতিনির্ধারক মহল চিন্তাও করে না, যার জন্য এই সেবা বা বিধান, তাদের কোনো মতামতের প্রতিফলন দরকার আছে কি না? 
 
তাই এখন ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি দূর করা, শুধু গ্রাহক পর্যায়ে প্রতিনিয়তই দাম বাড়ানোর চেয়ে সরকারি সেবা সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা অনেক বেশি জরুরি। একই সঙ্গে পানির দাম বাড়ানোর আগে গণশুনানির আয়োজন করে ভোক্তাদের মতামত নিয়ে সেবার মান ও দাম নির্ধারণে ভূমিকা নিতে হবে। 
 
কারণ ওয়াসা রাষ্ট্রীয় প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। জনগণের করের টাকায় এর ব্যয়ের একটি বড় অংশ নির্বাহ করা হয়। সে কারণে জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। পরিচালন ব্যয়, ঘাটতি ও ঋণ পরিশোধসহ নানা অজুহাতে ভোক্তা পর্যায়ে পানির দাম বাড়ানোর খোঁড়া যুক্তি থেকে বের হয়ে এসে সেবা সংস্থাটির ব্যবস্থাপনার মান, পানি ব্যবহারকারীদের সত্যিকারের অংশগ্রহণ, কাজের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে প্রতিষ্ঠানটির দুর্বলতা কাটানো সম্ভব। 
 
লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)

বিশেষ সাক্ষাৎকার: সিরাজুল ইসলাম চোধুরী শিক্ষক যদি লাঞ্ছিত হন, তাহলে শিক্ষাই লাঞ্ছিত হয়

প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:০১ এএম
শিক্ষক যদি লাঞ্ছিত হন, তাহলে শিক্ষাই লাঞ্ছিত হয়
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের এই ক্রান্তিকালে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রথিতযশা এই শিক্ষাবিদ। শিক্ষকদের যখন লাঞ্ছিত, অপমানিত ও জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে, ঠিক তখনই এর লাগাম টেনে ধরতে চান সমাজ রূপান্তরকারী এই শিক্ষক। এ ব্যাপারে তিনি কথা বলেছেন খবরের কাগজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র সহ-সম্পাদক সানজিদ সকাল

খবরের কাগজ: সরকার পতনের পর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। শিক্ষকরা লাঞ্ছনা-বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন, এই বিষয়টা আপনি কীভাবে দেখছেন? 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা আঘাত আনে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। এটা শুধু শিক্ষককে ব্যক্তিগতভাবে লাঞ্ছনা করা হয় না, পুরো জাতি লাঞ্ছিত হয়। শিক্ষক যদি লাঞ্ছিত হন, তাহলে শিক্ষাই লাঞ্ছিত হয়। শিক্ষক যদি অপমানিত হন ও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়, সেটা হবে জাতির জন্য কলঙ্ক। যদি কোনো শিক্ষককে জুতার মালা গলায় পরানো হয়, তাহলে সেই শিক্ষক আর শিক্ষক থাকেন না। সেই আঘাতটা শুধু একজন শিক্ষকের ওপর আসে না, পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আসে। শিক্ষকদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। 

ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্কটাই বদলে ফেলতে হবে এবং মধুর হতে হবে। ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্ক হতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ। এটা মানতেই হবে যে, ছাত্ররা সব সময়ই শিক্ষকদের আদর্শ হিসেবে মানবে। শিক্ষককে বীর হিসেবে অনুকরণ করতে হবে। সেই অনুকরণীয় মানুষটাকে যদি খাটো করে ফেলা হয়, তাদের যদি কোনো সম্মান না থাকে, তাহলে শিক্ষায় তার অধিকারই থাকে না। তখন তিনি আর শিক্ষক থাকেন না। 

শিক্ষকদের ওপর আক্রমণ করাটা সংক্রামক ব্যাধির মতো। একবার এক শিক্ষকের ওপর আক্রমণ করলে সব জায়গাতেই এর প্রভাব পড়ে। সবাই পাওয়ার বা শক্তি প্রয়োগ করতে চায়। আমরা দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক শাসনের অধীন ছিলাম। আমাদের ক্ষমতার অভাব আছে। ক্ষমতা যখন যে যতটুকু পায়, সেই ক্ষমতাটার অপব্যবহার করে। ক্ষমতা পেলেই মানুষ ক্ষমতার অপব্যবহার করে। যারা ক্ষমতা থেকে একসময় বঞ্চিত হয়, তারাই ক্ষমতা পেলে সেটাকে অপব্যবহার করে। 

এমনিতেই ক্ষমতা সব সময়ই অপব্যবহারমুখী। শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীল কাজে নিয়োগ করা হয়নি। এখন শিক্ষার যে পদ্ধতি তাতে শিক্ষার্থীরা স্কুল শেষ করে কোচিং সেন্টারে চলে যায়। তারা গাইড বই ব্যবহার করছে। তারা ক্লাসরুমে বেশি সময় দিচ্ছে না। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্য সৃজনশীলতা সৃষ্টি হচ্ছে না। শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। শিক্ষা এখন কেনাবেচার পণ্যতে পরিণত হয়েছে।  

খবরের কাগজ: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন আনা দরকার কি না। অন্যদিকে ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্কে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, যা আগের দিনে এমন সম্পর্ক ছিল না। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী? 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: জাতি গঠনে ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে সুনিবিড় সম্পর্ক থাকা উচিত। বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে হলে অবশ্যই শিক্ষকের মর্যাদা দিতে হবে। এমনিতেই আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা দুর্দশাগ্রস্ত। আমাদের দেশের সন্তানরা প্রাথমিক পর্যায়ে এসেই ঝরে পড়ে। আমাদের দেশের শিক্ষার বড় দুর্বলতা হলো তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা। বর্তমান বিশ্বে তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা কোনো দেশে আছে বলে মনে হয় না। একটা শ্রেণির ওপর নির্ভর করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তিন ধারায় ভাগ করে রেখেছে। এই তিন শিক্ষা ধারা একদিন অবলুপ্ত হবে। 

বর্তমানে এই তিন ধারা ছাড়াও আরও শ্রেণিবিন্যাস হচ্ছে। এর মূল কারণ হলো শ্রেণি বিভাজন। মাতৃভাষার মাধ্যমে যে শিক্ষা তা আমরা জাতিকে দিতে পারছি না। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়াকেই প্রধান ধারা করার কথা ছিল। বাঙালি জাতি বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলা ভাষাকে কেন শিক্ষার মাধ্যম করা গেল না, সেটা আমাদের জাতির একটা বড় দুর্বলতা। শিক্ষার ক্ষেত্রে এই জায়গাটায় আমাদের ভাবতে হবে। লক্ষ করা যাচ্ছে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জবরদখল চলছে। রাজনৈতিক পরিচয় বহন করে এমন অনৈতিক কাজগুলো করা হচ্ছে। দেশে সরকার পতন হলে কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনভাবে দখল করতে হবে? এমনকি বিদ্যালয়ও এর থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। শিক্ষকদের অপমান করা হচ্ছে, লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। 

এমনকি নারী শিক্ষিকাদের লাঞ্ছিত করে তার কক্ষ থেকে বের করে দিচ্ছে তারই শিক্ষার্থীরা। এমন তো কখনো হওয়ার কথা নয়। 
শিক্ষকদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। শিক্ষদের বিরুদ্ধে তালিকা করা হচ্ছে। এসব কাণ্ড করা হচ্ছে একবারেই নিজস্ব স্বার্থের কারণে। এটা কোনো আদর্শ হতে পারে না। শিক্ষক লাঞ্ছনা, শিক্ষকদের ওপর নির্যাতন এবং জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা খুবই খারাপ কাজ। এ ধরনের ঘটনা কিন্তু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ঘটছে না। এমনকি কওমি মাদ্রাসাগুলোতেও ঘটছে না। এই ঘটনাগুলো ঘটছে মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। মূলধারার শিক্ষাতেই তারা আঘাত করছে। মূলধারার শিক্ষাটা নানান রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। 

খবরের কাগজ: বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম কি আগের কারিকুলামে ফিরিয়ে আনা হবে? বর্তমান শিক্ষা কারিকুলামে নতুন প্রজন্ম প্রকৃত শিক্ষা পাচ্ছে কি? বর্তমান শিক্ষা কারিকুলামে কোনো পরিবর্তন দরকার আছে বলে কি আপনি মনে করেন? 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সবকিছুই পরিবর্তন হয়। তারও একটা নিয়মনীতি আছে। শিক্ষা কারিকুলাম আগের কারিকুলামে গেলে ভালো হবে, নাকি মন্দ হবে সেটা কোনো বিষয় নয়। হঠাৎ করে শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তন করা হলো একধরনের স্বৈরাচারী মনোভাব। শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে বিশদ আলোচনা করা ও প্রস্তুতির দরকার ছিল। শিক্ষা কারিকুলাম বারবার পরিবর্তন করা হচ্ছে, এটা ঠিক নয়। 

একবার সৃজনশীল, আবার নতুন কারিকুলাম। পরীক্ষার বিষয় কখনো বাড়ানো হয়, আবার কমানো হয়। এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে। যারা দলনিরপেক্ষ, সেসব শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করে পরামর্শ নিতে হবে। শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই শিক্ষাসংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষকরা প্রস্তুত নন, অভিভাবকরাও প্রস্তুত নন। অভিযোগ উঠেছে যে, ছাত্ররা এখন পড়তে চায় না। কী এমন করা হলো যে ছাত্ররা পড়তে মনোযোগী হচ্ছে না। এটা জাতির জন্য অশনিসংকেত। 

খবরের কাগজ: শিক্ষার্থীরা কেন পড়াশোনায় মনোযোগী হচ্ছে না। এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের অটোপাস দেওয়া হচ্ছে, এতে কি শিক্ষার্থীরা মেধাহীন হয়ে পড়বে না? এই বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এইচএসসি পরীক্ষায় অটোপাস দেওয়াটা মোটেও ভালো হয়নি। এর আগেও একবার অটোপাস দেওয়া হয়েছিল। আইয়ুব খানের আমলে তিন বছরের বিএ কোর্স চালু করা হয়েছিল। ওই সময়েও ছাত্ররা বিএ কোর্সের মেয়াদ দুই বছর করার জন্য আন্দোলন করেছিল। তখন যারা বিএ কোর্সে দুই বছর অতিক্রম করেছিল তাদের অটোপাস দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওই দুর্বলতাটা এখনো আমাদের দেশে রয়ে গেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে একধরনের শূন্যতা বিরাজ করছে। 

এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় যেভাবে অটোপাস দেওয়া হলো, তাতেও একধরনের শূন্যতা তৈরি হবে। ছাত্ররা নিজেদের গড়ে তুলতে পারবে না। এসব ছাত্র দিন দিন হীনম্মন্যতায় ভুগবে। তাদের মনের ভেতরে সব সময় একধরনের ব্যাধি কাজ করবে যে, আমরা পরীক্ষা না দিয়েই পাস করেছি। অন্যরাও এদের দেখে বলবে যে, পরীক্ষা না দিয়েই এরা এসেছে। এটা ব্যক্তি মানুষের যেমন সারা জীবনের দুঃখ, তেমনি জাতির জীবনেও এক ধরনের দুঃখ।

খবরের কাগজ: খবরের কাগজের সঙ্গে থাকার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: খবরের কাগজকেও ধন্যবাদ।