বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি ছাত্রদের পক্ষে লেখালেখি করেছেন এবং পথে নেমে আন্দোলনে সমর্থন করেছেন। তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন খবরের কাগজ-এর সিনিয়র সহ-সম্পাদক সানজিদ সকাল
খবরের কাগজ: বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে। বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদ জনগণের আকাঙ্ক্ষা কতটুকু পূরণ করবে বলে মনে হয়।
ড. তাসনিম সিদ্দিকী: অধ্যাপক ড. ইউনূসের তত্ত্বাবধানে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে, এর প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা ও সমর্থন রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার খুবই দ্রুত গঠন করা হয়েছে। কারণ সময়টা ছিল খুবই ক্রান্তিকাল। যাদের নিয়ে এই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে, তারা সবাই বিচক্ষণ এবং অন্তিম অভিজ্ঞতার মানুষ। অধ্যাপক ড. ইউনূস সাহেব অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অনেক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন। প্রতিকূলতা দূর করার জন্য ধীরে ধীরে হয়তো আরও উপদেষ্টা নিয়োগের প্রয়োজন পড়বে।
খবরের কাগজ: অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে পারবে কি?
ড. তাসনিম সিদ্দিকী: গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা একটা কঠিন ব্যাপার। সাধারণ ছাত্রছাত্রী, জনতা আস্থা রেখেছে এবারের অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের উদ্দেশ্য শুধু নির্বাচন সম্পূর্ণ করা নয়, আরেক দল ক্ষমতায় এসে আবার যেন কর্তৃত্ববাদী সরকারে পরিণত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা। তাহলে এত মানুষের প্রাণ দিয়ে কী লাভ হলো। এখন এই সরকারের দায়িত্ব প্রতিটা জায়গায় সংস্কার করা।
বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি জায়গায় সংস্কার আনতে হবে। কারণ প্রতিটি জায়গা দলীয়করণ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল। এগুলো ঠিক করতে গেলে একটু সময় প্রয়োজন। যদি উপদেষ্টারা তাদের কাজগুলো করতে একটা নির্ধারিত সময় পান, তাহলে তারা সঠিকভাবে করতে পারবেন। দেশে কীভাবে নিরপেক্ষ ও যৌক্তিক গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা যায়, পুরোনো যারা ডেমোক্র্যাট আছেন, তারা সহযোগিতা করবেন। যদি আমরা মনে করি, আগামী তিন মাস বা ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে দেওয়া দরকার, তখন হয়তো আসল সংস্কার করা সম্ভব হবে না।
খবরের কাগজ: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অচিরেই খুলে দেওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে কি না?
ড. তাসনিম সিদ্দিকী: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর বন্ধ রাখার মতো পরিস্থিতি নেই। দ্রুতই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া দরকার। সবকিছুকেই স্বাভাবিক নিয়মে নিয়ে আসতে হবে। আমরা দেখতে পারছি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রক্টররা পদত্যাগ করছেন। তারা একেবারেই দলীয়-ভিত্তিক কাজ করতেন। ছাত্রদের দাবি ছিল, রাজনীতি চাই বাইরে, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থাকবে রাজনীতিমুক্ত। অর্থাৎ গণরুম থাকবে না। সবাই স্বাধীনভাবে চলতে চায়।
এই কাজগুলো করতে হলে সে ধরনের মেধা ও শক্তিসম্পন্ন ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ করতে হবে। সেই সব প্রভোস্টকে নিয়োগ করতে হবে, যাদের কোনো দলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে তাদেরই, যারা রাজনীতি করেন না। যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অনেক বেশি, যারা সমাজ সম্পর্কে অনেক সচেতন, এমন শিক্ষকদেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ ও দায়িত্ব দিতে হবে। এভাবে সংস্কার করলে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া সম্ভব।
খবরের কাগজ: অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে আন্তর্জাতিক সমস্যার মোকাবিলা করতে পারবে? এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
ড. তাসনিম সিদ্দিকী: প্রফেসর ড ইউনূসকে বিশ্বের কে না চেনে? তিনি বিশ্বনন্দিত ও জ্ঞানী মানুষ। তিনি যদি বৈশ্বিক চাপ মোকাবিলা না করতে পারেন, তাহলে কে পারবে? আমেরিকা ড. ইউনূসকে সমর্থন করে অভিনন্দন জানিয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে ড. ইউনূসের সরাসরি সংযোগ রয়েছে। চায়না ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। আমদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এতদিন শুধু একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংযোগ রেখে বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক চালু রেখেছে।
বাংলাদেশে এমন গণ-অভ্যুত্থান হতে পারে, ভারত কখনো ভাবতেই পারেনি। তাদের গোয়েন্দা সংস্থা সঠিক তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা গোয়েন্দা বিভাগের ওপর উষ্মা প্রকাশ করেছে। ভারতের বিশ্বাস ছিল- শেখ হাসিনা সরকার টিকে থাকবে এবং যেভাবেই হোক শেখ হাসিনার মাধ্যমে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে। কিন্তু মানুষের মধ্যে কী চাহিদা তা এখনো ভারত সরকার বুঝতে পারছে না। হাসিনা সরকার তিস্তা চুক্তি, মোংলা বন্দর এবং যেখানে ভারতের ব্যবসায়ীদের আগ্রহ আছে, সেখানেই তিনি ভারতকে ছাড় দিয়েছেন।
ভারতের স্বার্থ যেভাবে রক্ষা হয় সেভাবে তিনি চুক্তি করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের স্বার্থের কথা সব সময় চিন্তা করা উচিত। ভারতের সঙ্গে আমাদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই এবং তাদের সঙ্গে আমাদের সাংস্কৃতিক মিল রয়েছে। মূল অসুবিধা হলো, বাংলাদেশে পরপর তিনটা নির্বাচনে মোদি সরকার এভাবে একটা দলকে সহযোগিতা করে বিশ্ব জনমত তৈরি করে জনসাধারণের ভোটাধিকারকে একেবারে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। সে কারণেই বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ আছে।
ভারতের এখন বন্ধুত্ব করতে হবে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে। কখনোই একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক নয়। ভারত এমন কিছু কাজ করছে, যা কূটনৈতিকভাবে ঠিক করছে না। এখন হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর সঙ্গে যা হয়েছে তা মোটেও উচিত হয়নি। বিষয়টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিকে নিয়ে যাওয়া ঠিক নয়। অথচ ভারত সেটাই করছে। ভারত এটাকে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর আঘাত হানা হয়েছে বলে সারা বিশ্বে ছড়াচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে বিষয় কিন্তু তা নয়। বাংলাদেশে যারা ঘোর আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছে, তাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর আঘাত এসেছে। আমাদের বোঝতে হবে এরা কোন হিন্দু জনগোষ্ঠী। এটা গণহারে সব হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর হচ্ছে, নাকি যারা আওয়ামী লীগপন্থি রাজনীতি করে তাদের ওপর হয়েছে। সেটাও যদি হয়ে থাকে তাও অন্যায়।
তবে এটা আওয়ামী লীগের ওপর অসন্তোষ, কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয়। এই বিষয়গুলো ভারতকে বোঝতে হবে। ভারতের গণমাধ্যমে ভুল প্রচার করা হচ্ছে। ভারত সরকারের উচিত এই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করা। বরং এই সরকারকে আরও অস্থিতিশীল করে দিচ্ছে। এটা ভারতের জন্যও ভালো নয়।
খবরের কাগজ: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, এটা কতটুকু সার্থক হবে বলে মনে হয়?
ড. তাসনিম সিদ্দিকী: বিচার বিভাগকে তো সম্পূর্ণ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। ছাত্র আন্দোলনের সময় যেভাবে আদালত নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিয়েছেন, আমরা দেখি- সরকার যেভাবে বলল কোর্ট সেভাবেই একটা রায় দিয়ে দিলেন অর্থাৎ কোটা বাতিল করা ভুল হয়েছে, পুরোনোটা বহাল থাকবে। এটা নির্বাহী আদেশ, বিচার বিভাগের এটা এখতিয়ার নেই। তবু তারা এই আদেশ দিয়েছিলেন।
কেন দিয়েছিলেন? বিচার বিভাগ বলেছে, ‘শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন, তাই’। পরবর্তী যে নাটক, তা হলো- আবার আপিল করা হয়েছে। পরে ছাত্র আন্দোলন যদি না হতো, তাহলে তা বলবৎ রেখে সরকার বলত, আদালতের ওপর তো আমরা কথা বলতে পারি না। একই কাজ তারা করেছিলেন, আদালতের অজুহাত দেখিয়ে তিনি ওটাকে সঙ্গে সঙ্গে আইন করে অধ্যাদেশ বাতিল করালেন। উচ্চ আদালত সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে হবে।
খবরের কাগজ: আমলাতান্ত্রিক সংস্কার কতটুকু প্রয়োজন বা এটা সংস্কার সম্ভব কি না?
ড. তাসনিম সিদ্দিকী: সবার আগে আমলান্ত্রিক সংস্কার প্রয়োজন। আগে তো রাষ্ট্রকে পরিচালনা করতে হবে। সব বিভাগ চালাতে হবে। ঊর্ধ্বতন যারা সরকারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিলেন তারা অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেকে অফিসে আসছেন না।
এই মানুষগুলোকে সরাতেই হবে। আর যারা ভালো মানুষ, ঠিকমতো কাজ করতে চান- এ ধরনের মানুষকে পুনরায় সংগঠিত করতে হবে। এটা বিশাল কাজ। আবারও আমি বলব, একটা কমিশন গঠন করতে হবে।
খবরের কাগজ এগিয়ে যাক, এই কামনা রইল।
খবরের কাগজ: আপনাকে ধন্যবাদ।