গত দশ বছর ধরে ধর্মীয় উন্মাদনাকে অবলম্বন করে হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবার ভারতকে এক নতুন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে, যা হলো হিন্দু-মুসলমানের মেরূকরণ। তাদের হাতিয়ার ছিল অযোধ্যার রামমন্দির। কিন্তু কাজে দিল না। অযোধ্যা থেকে স্বয়ং বিজেপি প্রার্থীই বিপুল ভোটে হেরে গেছেন। তথ্যবিজ্ঞ মহল মনে করেন, মোদি, অমিত শাহ ও সংঘ পরিবারের প্রধান মোহন ভগবতের ডাকে রাম সাড়া দেননি।
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে কখনোই মিলিজুলি সরকার বেশি দিন টেকেনি। বর্তমান সরকারের আয়ু কদিন? এক বছর না ছয় মাস- এই প্রশ্নে এখন ভারতবর্ষ উথাল-পাথাল। তাই মোদি-অমিত শাহ জুটি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন ইন্ডিয়া জোটের কোনো অংশীদারকে ভাঙিয়ে নেওয়ার জন্য।
উল্টো দিকে রাহুল গান্ধী সাংবাদিক বৈঠক করে বলেছেন, বিজেপি জোটের অনেক শরিক আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, কিন্তু আমরা তাদের গুরুত্ব দিচ্ছি না। একই সঙ্গে কংগ্রেস সভাপতি তথা ইন্ডিয়া জোটের প্রধান মল্লিকার্জুন খাড়গে মোদিকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করে বলেছেন, মোদির সরকার সংখ্যালঘু সরকার, তাদের আমরা কোনো গুরুত্বই দিই না। এই সরকারের আয়ু ছয় মাসের বেশি হবে না।
যেহেতু মোদির সংখ্যালঘু সরকার, ছোটখাটো জোট শরিকরাও ‘আদায়’ করে নেওয়ার জন্য প্রতিদিন চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। ফলাফল ঘোষণার পরই আসরে নেমেছেন আরএসএস-প্রধান মোহন ভগবত। মোদি-অমিত শাহকে কটাক্ষ করে সংঘ পরিবারের নেতা আরও কড়া ভাষায় নাগপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, মানুষ যেন মানুষের প্রতি কোনো ঔদ্ধত্য ভাব না দেখায়, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি না দেয়।
মোদি ও অমিত শাহ সংঘের সব নীতি ও আদর্শের অবহেলা করেছেন গত দশ বছর ধরে। জনগণের জন্য যতটুকু পারবেন, সেটুকুই যেন বলা হয়। মিথ্যা প্রতিশ্রুতির কোনো জায়গা নেই, সেটাই এবারের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে প্রমাণ হয়ে গেল। মানুষের কথা শুনতে হবে, তাদের দুঃখ-কষ্টের দিকে নজর দিতে হবে। সেদিকে মন না দিয়ে বিজেপি জাত-পাতের রাজনীতি করেছে, যা সংঘের নীতি নয়। এটা যে হাস্যকর তা দেশের মানুষ বুঝতে পেরেছেন।
আরও হাস্যকর হলো, মোদি এক বিবৃতিতে দলের নেতাদের বলেছেন, রাজধর্ম পালন করুন। তিনি যখন ২০০২ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন আহমেদাবাদ শহরে ১২০০ মুসলমানকে গুলি করে মেরেছিলেন। সেই সময় যখন গোটা ভারতবর্ষ তোলপাড়, তখন সংসদে দাঁড়িয়ে অটল বিহারি বাজপেয়ির মন্তব্য এখনো আমাদের কানে ভাসে।
তিনি বলেছিলেন, মোদি রাজধর্ম পালন করছেন না। মোদিকে সরিয়ে দিতেও চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু সরাতে দেননি লালকৃষ্ণ আদভানি। এ বিষয়ে মোদির কথায় ও কাজে রয়েছে বিস্তর ফারাক। তিনি এক মুখে বলছেন যে হিন্দু-মুসলমান বিভেদ করলে তিনি সর্বজনীন জীবনে থাকার অধিকার হারাবেন, অপরদিকে লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে প্রতিটি জনসভায় তিনি মুসলমান-বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন।
আসলে বিগত বছরগুলোতে মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বে ভারতের অর্থনীতির ভঙ্গুর দশা, সাধারণ মানুষের ক্রমবর্ধমান দুর্দশা, বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তারে দমনমূলক রাজনীতি ইত্যাদি আড়াল করতে বিজেপির হাতে একমাত্র সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছাড়া আর কোনো অস্ত্র অবশিষ্ট ছিল না। জনসভায় ধর্মীয় উসকানি ছড়ালেও মোদি সাবধানী হয়েছেন এবং বুঝেছেন যে, এ দেশের সিংহভাগ মানুষ মনে করেন, এ দেশটা সবার, শুধু হিন্দুদের নয়।
ধর্মের বিভেদ কখনো পেটের ভাতের বিকল্প হতে পারে না। ভারতের বেশির ভাগ মানুষ উগ্র সাম্প্রদায়িকতাকে প্রত্যাখ্যান করে ‘ভারত’ নামক বৈচিত্র্যপূর্ণ ধারণাকে সমর্থন করেছেন, এটা যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। দীর্ঘদিন ধরে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার পরেও মোদি এ কথা অনুধাবন করেছেন যে, বিভেদমূলক রাজধর্ম দিয়ে বেশি দিন দেশ শাসন করা যায় না। তাকে এ কথা বুঝতে বাধ্য করেছেন ভারতের জনগণ।
এদিকে ২৬ দলের ইন্ডিয়া জোটের মধ্যে মমতা ‘জিঞ্জার গোষ্ঠী’ তৈরি করছেন। তার ভাইপোকে তিনি পাঠিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদব, মহারাষ্ট্রে শারদ পাওয়ারের নেতৃত্বে তিনটি আঞ্চলিক দলের সঙ্গে কথা বলতে।
তৃণমূল কখনোই রাহুল গান্ধীকে নেতা হিসেবে মান্যতা দিতে চান না, নেত্রী করতে হবে মমতাকে এবং সময় এলে তিনিই হবেন প্রধানমন্ত্রী। মমতা আরও প্রস্তাব দিয়েছেন, তাকে প্রধানমন্ত্রী করা না হলে তার ভাইপোকে করতে হবে রেলমন্ত্রী, অর্থ মন্ত্রণালয় ভেঙে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক বিষয়ে নতুন মন্ত্রণালয় তৈরি করতে হবে এবং তার দলের কাউকে সেই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিতে হবে।
আরএসএস-প্রধান মোহন ভগবত অবশ্য চাইছেন মমতাকে বিজেপি জোটেই রাখতে। কংগ্রেসের প্রতি মমতা তার বিদ্বেষ উগরে দিচ্ছেন এবং বিজেপির মতো তিনিও চাইছেন কংগ্রেসমুক্ত ভারত তৈরি করতে। তবু কংগ্রেস চাইছে মমতা ইন্ডিয়া জোটে থাকুন।
বর্তমানে সংসদে কংগ্রেসের সবচেয়ে বেশি আসন এবং তারা একটি সর্বভারতীয় দল, এ কথা মনে রাখতে হবে। তবু মমতার কংগ্রেসের প্রতি এলার্জি। ইতোমধ্যে দুটি আসনেই ৫ লাখ ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন রাহুল গান্ধী, কেরালার ওয়েনার্ডে ও তাদের পারিবারিক এলাকা রায়বেরিলিতে। ওয়েনার্ডের আসনটি তিনি ছেড়ে দেওয়ার পর উপনির্বাচনে প্রার্থী করা হবে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে। রাজনৈতিক মহল মনে করছে, এটি কংগ্রেসের অসাধারণ সিদ্ধান্ত। এর ফলে ভাইবোনের উদ্যোগে কংগ্রেস পুনরায় সম্পূর্ণভাবে ক্ষমতায় আসবে।
এসব সত্ত্বেও সোনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধী সাবেক স্বরাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরমকে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন মমতার সঙ্গে কথা বলতে। কথা হলেও মমতা কংগ্রেসের প্রতি তার যে এলার্জি, তার ইঙ্গিত দিয়ে দিয়েছেন। তবু এই বৈঠক যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক মহল। এই বৈঠকের ফলে দুই পক্ষের সম্পর্কের শীতলতাও কিছুটা গলেছে।
সুযোগের অপেক্ষায় না থেকে, প্রথমেই এনডিএ সরকারকে টলমলে করে দেওয়ার জন্য একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরামর্শ দেন মমতা। তবে কংগ্রেস নেতৃত্ব এটাও বুঝতে পারছেন যে, দুর্বল এনডিএ সরকারকে ধাক্কা দিতে হলে ইন্ডিয়া জোটের মধ্যে কোনো বিভেদ থাকা ঠিক নয়।
বরং নিজেদের মধ্যে ঐক্য জোরদার করা উচিত। শেষ পর্যন্ত মমতা মোহনের কথাই শুনবেন নাকি ইন্ডিয়া জোটে থাকবেন, সেটা জানার জন্য আমাদের আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। সংসদের অধিবেশন শুরু হলেও মোদিকে এবার কঠিন সংকটের মধ্যে পড়তে হবে। যদিও তিনি নিজের দলের সদস্যকে স্পিকার পদ দিয়েছেন, তার কথা অন্যান্য সদস্য কতটা মানবেন, সেটা সন্দেহের বিষয়।
যতটুকু ভারতের রাজনীতি দেখেছি, বুঝেছি ও রিপোর্টিং করেছি সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এবারে ভারতের সংসদে প্রচণ্ড ঝড় উঠবে। মমতাকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি কোন দিকে যাবেন- এনডিএ জোট নাকি ইন্ডিয়া জোট। কোনো এলার্জি দেখালে চলবে না, এটা কংগ্রেসসহ ইন্ডিয়া জোটের সবাই মনে করেন।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক