ঢাকা ২৭ কার্তিক ১৪৩১, মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪

সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির সরকার ও নির্বাচন কল্পনা নয়, বাস্তবতার নিরিখে প্রস্তাবনা

প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২৪, ১১:৩৭ এএম
আপডেট: ১৬ আগস্ট ২০২৪, ০৪:০৫ পিএম
সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির সরকার ও নির্বাচন কল্পনা নয়, বাস্তবতার নিরিখে প্রস্তাবনা
কাজী হাবিবুল আউয়াল

ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের পর থেকে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ফেডারেল সরকার ব্যবস্থায় কেন্দ্র ও বাংলাসহ সব প্রদেশ বা রাজ্য পর্যায়ে আইনসভার সাধারণ নির্বাচন দৃশ্যমানভাবে সূচিত হয়েছিল। নির্বাচন উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করা। 

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের যে পদ্ধতি কয়েক শতাব্দী যাবৎ অনুসৃত হয়ে আসছে, ইরেজিতে যাকে বলা হয় First Past The Post (FPTP)। এর সঠিক বাংলা নেই। ঘোড়দৗড়ের পদ্ধতি থেকে কথনটি এসেছে। এই পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে কোনো একটি নির্বাচনি কেন্দ্রে একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকলে প্রদত্ত ভোটের মধ্যে যিনি সর্বাধিক ভোট পাবেন তিনি নির্বাচিত ঘোষিত হবেন। আধুনিক গণতন্ত্রে এটিই ছিল দীর্ঘ অনুসৃত পদ্ধতি। 

বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে নির্বাচনের এই পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়েছে। পরিবর্তিত এমন একটি পদ্ধতির নাম হচ্ছে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি। ইংরেজিতে যাকে Proportional Representation (PR) System বলা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যক্তি-প্রার্থীদের মধ্যে হয় না। নির্বাচন হয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। 

মনে করুন, বিদ্যমান পদ্ধতিতে বাংলাদেশে ৩০০টি আসনে ১৫০০-১৭০০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। পিআর পদ্ধতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে নিবন্ধিত কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে। ৩০০টি নির্বাচনি কেন্দ্র থাকবে না। বাংলাদেশ হবে একটি একক নির্বাচনি কেন্দ্র। নির্বাচনে যে দল মোট প্রদত্ত ভোটের মধ্যে যত শতাংশ ভোট পাবেন সেই অনুপাতে সংসদে আসন লাভ করবেন। 

যেমন ‘ক’ দল মোট প্রদত্ত ভোটের ৫০% ভোট পেলে আসন পাবে ৫০×৩ =১৫০টি, ‘খ’ দল ৪০% ভোট পেলে আসন পাবে ৪০×৩ =১২০টি, ‘গ’ দল ৫% ভোট পেলে আসন পাবে ৫×৩ =১৫টি এবং ‘ঘ’ দল ৫% ভোট পেলে আসন পাবে ৫×৩ =১৫টি। এভাবে সংসদের ৩০০টি আসন পূরণ হবে। এটিই হচ্ছে পিআর পদ্ধতির সাধারণ ফর্মুলা। কোনো একটি দল যদি দশমিক ৩৪% ভোট পেয়ে থাকে, তা হলে তার আসন হবে মাত্র ১টি। ১৮৯৯ সালে বেলজিয়াম এই পদ্ধতি প্রথম প্রবর্তন করে। অধুনা বিশ্বের প্রায় ১০০টির অধিক দেশ কোনো না কোনো ধরনের PR পদ্ধতি অনুসরণ করছে।

বলা আবশ্যক, আদি FPTP পদ্ধতিতে নির্বাচনি এলাকায় এবং কেন্দ্রে ভোট অনুষ্ঠানে যেকোনো পন্থায় নির্বাচিত হওয়ার চেষ্টা বা অপচেষ্টায় যে ধরনের বিভিন্ন অপকর্ম, সহিংসতা ইত্যাদির চর্চা হতো PR পদ্ধতি তা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়ে থাকবে। 

PR পদ্ধতির অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে, এখানে নির্বাচনি অনিয়ম, অপকর্ম, সহিংসতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়ে থাকে। নির্বাচনি কর্মকর্তারা, পুলিশ বা প্রশাসনকে অবৈধ অর্থ দিয়ে পক্ষাশ্রিত করা সম্ভব হয় না। একই প্রার্থীর একাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ থাকে না। কোনো প্রার্থীর মৃত্যুজনিত কারণে উপনির্বাচনের প্রয়োজন হয় না। 

নারীদের সংরক্ষিত আসনে ভিন্নভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান আবশ্যক হবে না। নমিনেশন দাখিল কেন্দ্রীয়ভাবে হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় একটি রাজনৈতিক দল ২২% ভোট পেয়ে এবং অবশিষ্ট ৭৮% ভোটারের সমর্থন ব্যতিরেকে সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করতে পারে। PR পদ্ধতিতে এটি কখনোই সম্ভব হবে না। 

বিদ্যমান পদ্ধতিতে ৬০% ভোটারের সমর্থন ব্যতিরেকে কেবল ৪০% ভোটারের সমর্থনেই ৩০০টি আসন পূরণ সম্ভব। PR পদ্ধতিতে ১০০% ভোটারের সমর্থনে সরকার গঠিত হোক বা না হোক, ১০০% ভোটারের সমর্থনেই সংসদ পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত হবে। অর্থাৎ প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে ১০০% ভোটার, সংখ্যা যদি ৮ কোটিও হয়, তাদের সবাই সংসদের অভ্যন্তরে প্রতিনিধিত্বপ্রাপ্ত হবেন। 

PR পদ্ধতিতে নির্বাচনি ব্যয় অনেক হ্রাস পাবে। এই পদ্ধতিতে নারীদের জন্য অমর্যাদাকর লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যমূলক ৫০/৬০টি আসন ভিন্নভাবে সংরক্ষিত রাখার প্রয়োজন হবে না। যদি মনে করা হয়, ৩০০টি আসনের মধ্যেই নারীদের জন্য অনূর্ধ্ব ৬০টি আসন ব্যবস্থিত থাকবে, তা হলে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে আইন দ্বারা বাধ্য করা যাবে যে নির্বাচন কমিশনের কাছে দলের পক্ষে দাখিল করা তালিকায় প্রতি ১০ জনের প্রথম ২ জন বা শেষ ২ জন নারী হবেন। 

তা হলে সে দলের পক্ষে নারী প্রার্থী হবেন ৩০০ জনের মধ্যে ৬০ জন। ১৯৭২ সালের ৭.৫০ কোটি মানুষের বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৮ কোটি মানুষ। এমন বিবেচনায় সংসদের আসনসংখ্যা ৩৫০-৪০০-তে বর্ধিত করা যেতে পারে।

PR পদ্ধতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আগ্রহী রাজনৈতিক দল প্রার্থীদের তালিকা ওপেন লিস্ট বা ক্লোজড লিস্ট আকারে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করতে পারে। ওপেন লিস্টে ভোটার সাধারণ এবং দলের সদস্যরা আগেই জেনে যাবেন দলের প্রার্থী কারা। এর ভালো-মন্দ উভয় দিকই আছে। জনগণের জন্য ভালো, তারা প্রার্থীদের গুণাগুণ আগাম বিশ্লেষণ করে দলের সক্ষমতা নির্ধারণ করতে পারবেন। 

মন্দ দিক হলো, দলের অভ্যন্তরে এতে অনাকাঙ্ক্ষিত কোন্দল-রেষারেষি হতে পারে। ক্লোজড লিস্টের সুবিধা হচ্ছে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার আগে দলের প্রার্থী কারা ছিলেন তা গোপন থাকবে। ফলে দলের ভেতর সম্ভাব্য কোন্দল বা রেষারেষি পরিহার করা সম্ভব হবে। নির্বাচন সহজ, শান্তিপূর্ণ ও অবাধ হবে। 

PR পদ্ধতিতে অনেক সময় কোনো দলের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ (১৫০টির অধিক) আসন লাভ করে এককভাবে সরকার গঠন করা সম্ভব না-ও হতে পারে। এটি খুব কঠিন জটিল বিষয় নয়। প্রয়োজনে কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করতে হবে। 

কোয়ালিশন সরকার গঠন সম্ভব না হলে তাৎক্ষণিক সংসদ ভেঙে না দিয়ে সর্বোচ্চসংখ্যক আসনপ্রাপ্ত দলকে অবিলম্বে সরকার গঠনের অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে। এতে শূন্যতার তাৎক্ষণিক সংকট পরিহার করা যাবে। সংখ্যালঘু দল কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে না পারলে ২-৩ বছর পর একই পদ্ধতিতে আবার সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। 

সরকার গঠন এবং আইন পাস বা বিভিন্ন অনিবার্য উদ্দেশ্যে সংখ্যালঘু দলকে Legal Fiction-এর মাধ্যমে ধারণাভিত্তিকভাবে (Deemed) ১৫১টি আসন প্রাপ্ত মর্মে সাময়িকভাবে গণ্য করা যেতে পারে। সাময়িক এমন ব্যবস্থা সংবিধান বা যথোপযুক্ত আইনি বিধান দ্বারা করা যেতে পারে। 

স্বাধীন ভারতে বিগত ৭৫ বছরে কোনো সামরিক শাসন বা গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতন হয়নি। গণতন্ত্রের চর্চা ছিল নিরবচ্ছিন্ন। স্বাধীন পাকিস্তান অতঃপর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবাধ চর্চা মূলত কখনোই হয়নি। ১৯৭৪-এ বাকশাল, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, ৭ নভেম্বর বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব হয়েছে। সংবিধান অকার্যকর হয়েছে। 

১৯৮১ সালে আবারও সামরিক অভ্যুত্থানে গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হলো। ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতন হয়েছিল। সংবিধান অকার্যকর হয়েছিল। ১৯৯৬-এর গণ-অভ্যুত্থানেও অসাংবিধানিক পদ্ধতিতেই সরকার পতন হয়েছিল। পুনর্বার নির্বাচন হয়েছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসাংবিধানিক অবস্থানকে পরবর্তী সময় অনুমোদন করে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হয়েছিল। 

দুটি নির্বাচন সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অধিক স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। ২০০৭ সালে আবারও গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতন হয়েছিল। কথিত সেনাসমর্থিত বেসামরিক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। একটি নির্বাচন ছাড়া কাজের কাজ আর কিছুই করতে পারেনি। 

আসলে দুর্ভেদ্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছাড়া জনপ্রত্যাশিত অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন কঠিন। ইতিহাস তাই বলে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান হবে। স্বৈরাচারের পতন হবে। পৌরাণিক ফিনিক্স পাখির মতো ভস্ম থেকে সে আবার উঠে আসবে। আমার কথা নয়। জনৈক ব্রিটিশ মনীষী বলেছিলেন, Greatest lesson of history is that people do not learn from history. 

অনেকেই বলছেন, নির্বাচনব্যবস্থাকে আমূল ঢেলে সাজাতে হবে, সংস্কার করতে হবে। আমার অভিমতে প্রথমে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা বন্দোবস্তে মৌলিক পরিবর্তন ও সংস্কার প্রয়োজন হবে। তাহলে নির্বাচনব্যবস্থা সেই আদলে অনিবার্যভাবেই পরিবর্তিত হবে। Proportional Representation (PR) System কার্যত নির্বাচন পদ্ধতি নয়। 

এটি পার্লামেন্ট বা সংসদে আসন বণ্টনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিত্বকে সর্বজনীন করার লক্ষ্যে উদ্ভাবিত একটি উন্নততর পদ্ধতি। PR পদ্ধতি প্রবর্তিত হলে নির্বাচন পদ্ধতি সেই ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে শুধরে নিয়ে অনুসরণ করবে। বলা প্রয়োজন, জনঘন বাংলাদেশের জনগণের সমজাতীয়তা বা সমরূপতা (homogeneity) দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনে PR পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য অত্যন্ত অনুকূল। 

বর্তমান FPTP পদ্ধতির নির্বাচনে ভোটেকন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেওয়া, ব্যালট বাক্সে ব্যালট জোর কর প্রবিষ্ট করা, কালোটাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার হয়ে থাকে। নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতালাভের মাধ্যমে বিপুল অর্থসম্পদ উপার্জনের মনস্তত্ত্ব এ ক্ষেত্রে প্রার্থীদের মধ্যে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে। 

দলীয় সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে পুলিশ ও প্রশাসনকে দিয়ে নির্বাচন প্রভাবিত করার চেষ্টা হয়ে থাকে। এ কারণেই রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতেই একদা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। মূলত সরকার সরাসরি না করলেও সরকারদলীয় প্রার্থীরা স্থানীয়ভাবে প্রবল শক্তিধর হয়ে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এটি বাস্তবতা। 

এটি দীর্ঘ অপচর্চার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক অপশক্তির অর্জিত এক ধরনের প্রতিষ্ঠিত নষ্ট ঐতিহ্য। নির্বাচনে এমন অপচর্চা শুধু বাংলাদেশেই নয়। দেশে দেশে হচ্ছে। সম্প্রতি কেনিয়া, ভেনেজুয়েলাসহ আফ্রিকার আরও কয়েকটি দেশে নির্বাচন-উত্তর অবিশ্বাস, অনাস্থা, বিক্ষোভ, সহিংসতা দেখা গেছে। বাংলাদেশে অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত কার্যকর সংস্কার ও পরিবর্তন অনিবার্যভাবে প্রয়োজন। 

লেখক: প্রধান নির্বাচন কমিশনার 
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন

বাংলাদেশের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি কী হবে

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৯ পিএম
বাংলাদেশের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি কী হবে
মুন্সি ফয়েজ আহমদ

যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি নতুন নির্বাচন সম্পন্ন হলো। এই নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি আগেও প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পুনরায় তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি অন্যদের থেকে অপেক্ষাকৃত একটু আলাদা। সে কারণে অনেক ক্ষেত্রেই তিনি ব্যতিক্রম কিছু করে ফেলতে পারেন বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক।

 অনেকেই এ বিষয়ে বলার চেষ্টা করেছেন যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক সম্পৃক্ততা কিছুটা কমিয়ে আনতে পারেন। গতবার যখন তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখন ন্যাটোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা কমিয়ে এনেছিলেন। ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ বহুভাবে কমানো হয়েছিল। ন্যাটো সদস্যদেশগুলো আবারও সেই অবস্থায় চলে যেতে পারে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, তিনি যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ হয়নি। যেসব যুদ্ধ চলমান ছিল সেখান থেকে সরে আসার জন্য, অর্থাৎ যুদ্ধ থামানোর 
জন্য তিনি সচেষ্ট ছিলেন। এবারও সে রকম হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

বাংলাদেশ বা যুক্তরাষ্ট্র অথবা অন্য যেকোনো দেশ, সবাই জাতীয় স্বার্থেই পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে থাকে। জাতীয় স্বার্থ বলতে প্রত্যেকেই নিজ দেশের স্বার্থকে গুরুত্বসহকারে দেখে। তবে ব্যক্তিবিশেষে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতপার্থক্য থাকতে পারে। সেই পার্থক্যগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সূক্ষ্ম বা মোটা দাগের হয়ে থাকে। পররাষ্ট্র বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু নীতিমালা আছে। তারা সেই নীতিমালাগুলোই মোটামুটিভাবে অনুসরণ করে থাকে। ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান- উভয় দলই দেশের ভেতরে, অর্থাৎ জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাট হোক বা রিপাবলিকান হোক, সম্পর্কগুলো বেশি পরিবর্তন হয় না। 

আমরা পেছন থেকে দেখে সামনের দিকে কী হবে সেই চিন্তা করি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথার মধ্যেও এটি ছিল যে, যুদ্ধ তিনি পছন্দ করেন না। সে জন্য মনে করা হচ্ছে, যেখানে যেখানে যুদ্ধ আছে বিশেষ করে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, সেটার ওপরে বড় ধরনের প্রভাব আসতে পারে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভালো সম্পর্ক আছে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার জন্য সুবিধাজনক হয়, সেভাবে চেষ্টা করতে পারেন এবং সেটা হওয়া সম্ভব। আরেকটা বিষয় অনেকে মনে করার চেষ্টা করেন, যেমন- এবারের নির্বাচনে বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানরা অনেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। তারা আশা করেছেন যে, তিনি হয়তোবা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি রক্ষার জন্য চেষ্টা করবেন। 

যেখানে তার বেশি কিছু করার আছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ ইসরায়েলের স্বার্থ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক কী হবে- এই বিষয়ে অনেকে বলার চেষ্টা করেছেন। সেখানেও বড় রকমের কোনো পার্থক্য হবে না। তবে পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক বিস্তারণে উনি গুটিয়ে থাকা প্রকৃতির মানুষ। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ দেখানো অথবা বাংলাদেশকে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারগুলো কমে যাবে। এখন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের যেভাবে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করার চেষ্টা করছে, সেই চেষ্টাটা একটু কমে আসতে পারে। তবে পররাষ্ট্রনীতির ধরন পাল্টাবে না।

 বিশেষ করে আমাদের অনেক বেশি সচেষ্ট হতে হবে। অনেক বেশি প্রো-অ্যাকটিভ হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কটুকু বজায় রাখার জন্য আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে। বিশেষ করে বাণিজ্যিক সুবিধাসহ অন্য যেসব সুবিধা আমরা পেয়ে আসছিলাম, সেদিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। অর্থনৈতিক যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলো কী করে কাটিয়ে ওঠা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য সহযোগিতার ক্ষেত্রে আমাদের অনেক বেশি কাঠখড় পোড়াতে হবে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে ডেমোক্র্যাটের মতো রিপাবলিকানরা এত বেশি ব্যস্ত থাকে না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চীনের সঙ্গে  সম্পর্ক কেমন হবে। আগামী দিনেও এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলবৎ থাকবে বলে মনে হয়। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ। সামরিক শক্তির দিক থেকেও দেশটি সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। কাজেই চীন সবদিক থেকেই বৈশ্বিকভাবে তার প্রভাব বাড়িয়ে চলছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার আগের শাসনামলে চীনের বিরুদ্ধে প্রথম শুল্কারোপ করেন। বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সেই শুল্ক বজায় রাখেন। এসব কিছুর উদ্দেশ্য হচ্ছে চীনকে এক রকম কোণঠাসা করে রাখা।  

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ট্রাম্প জয়ী হয়েছেন। এর ওপর নির্ভর করবে চীনের সঙ্গে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কমবে নাকি বাড়বে। বলা বাহুল্য, এর প্রতিক্রিয়া পৃথিবীজুড়েই ছড়িয়ে পড়বে। এটি মনে করার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ আছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশেষ করে ভিন্ন ভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসন বিদ্যমান পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করবেন না। বরং বিদ্যমান নীতি গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। তবে তিনি দেখাতে চেষ্টা করবেন যে, পররাষ্ট্রনীতিতে তিনি কিছু করছেন। চীনের বিরুদ্ধে নানা রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করে সম্ভবত তিনি তাদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করবেন। 

যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে চীনের বিরুদ্ধে সহজে প্রভাবিত করা যায়। বিশেষ করে প্রযুক্তিগত সহযোগিতার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসতে পারে। একই সঙ্গে ইউক্রেনের প্রতি চাপ বৃদ্ধি হতে পারে। তবে ট্রাম্প বরাবরই বলছেন যে, তিনি যুদ্ধনীতির বিরুদ্ধে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার ক্ষেত্রে এটা কাজে লাগবে। 

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বলা যায়, তেমন কোনো পরিবর্তন না হলেও কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন হতে পারে। সেটা বাংলাদেশিদের জন্য ইতিবাচক হবে কি না, সেটাই বিবেচ্য। যেমন- অভিবাসীদের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি সংকুচিত হতে পারে। দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে যে রকম চিন্তাভাবনা লক্ষ করা যায়, ট্রাম্প প্রশাসন সেখানে সম্পূর্ণ নীতি অনুসরণ করতে নাও পারে। কাজেই বাংলাদেশের মানুষের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ঘিরে অতি উৎসাহের মাত্রাটা ধীরে ধীরে কমে আসবে বলে মনে হয়।

লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত

ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় বিশ্বরাজনীতিতে নতুন চমক

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৫ পিএম
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় বিশ্বরাজনীতিতে নতুন চমক
রায়হান আহমেদ তপাদার

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জয়ের জন্য ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোটের দরকার হলেও তার অন্তত ২৭৯টি ভোট নিশ্চিত হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিসের পক্ষে ২২৩টি ভোট। সুতরাং সিনেটের নিয়ন্ত্রণ রিপাবলিকানদের হাতে যাচ্ছে এবারের নির্বাচনে। মার্কিন আইনসভার উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ- পূর্বাভাস বলছে উভয় ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে রিপাবলিকান পার্টি। তাই ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমেরিকা আমাদের একটি অভূতপূর্ব এবং শক্তিশালী ম্যান্ডেট দিয়েছে।’ বিজয়ের পর ভাষণকালে ইলন মাস্ককে তিনি ‘স্টার’ বলে অভিহিত করেছেন।

 ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কিছু ক্ষেত্রে বেশ নজর থাকবে। একটা হলো ইউক্রেন যুদ্ধ কীভাবে থামানো যায় এবং রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক কী দাঁড়ায়। ট্রাম্প নির্বাচনকালে অনেকবার বলেছেন, তিনি ক্ষমতায় থাকলে এ অবস্থা কোনোভাবে ঘটত না। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপের ওপর তার বিশেষ নজর থাকবে। কারণ, ইউরোপের কনজারভেটিভ পার্টিগুলো বিভিন্ন জায়গায় জিতে যাচ্ছে। তা ছাড়া অনেক দেশ যুদ্ধের ব্যাপারে নতুন করে চিন্তা করছে। সুতরাং ইউক্রেনের ব্যাপারে একটা নজর থাকবেই। দ্বিতীয় নজর থাকবে ফিলিস্তিনে, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। এখানে কোনো নতুনত্ব আনা যায় কি না, তা নিয়েও ট্রাম্প গুরুত্ব দেবেন। তবে এই মুহূর্তে বলা মুশকিল, সেখানে কোনো ধরনের পরিবর্তন আসবে কি না। কোনো দল যদি ইসরায়েলের ব্যাপারে নতুনত্ব আনতে পারে তাহলে তা হতে পারে রিপাবলিকান পার্টি। তবে দলের মধ্যে এখনো কিছু অস্থিতিশীলতা রয়ে গেছে। তাই পরিবর্তন আনা খুব কঠিন।

বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এবার অনেকের আগ্রহ থাকবে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের ব্যাপারে ট্রাম্পের আমেরিকা কী সিদ্ধান্ত নেয়। মনে হয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চীনের ব্যাপারেও তার নজর থাকবে। চীন, রাশিয়া ও ভারত মিলে ইতোমধ্যে একটি কাঠামো তৈরি করে ফেলেছে। সেই জায়গায় ট্রাম্পের বাড়তি একটা চেষ্টা থাকবে যেন ভারতকে আরও কাছে টানতে পারেন। আর বাংলাদেশের ব্যাপারে বলা যায়, ইতোমধ্যে রিপাবলিকান পার্টি নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে, যদিও তারা বড় রকমের কোনো সহযোগিতা করতে পারবে না। বরং এখানে নির্বাচিত সরকার যাতে তাড়াতাড়ি হয়, সেটা দেখার ব্যাপারে আরও বাড়তি কথাবার্তা বলতে পারে। যেহেতু ভারত তথা মোদির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হওয়ার বড় সম্ভাবনা রয়েছে, তার একটা প্রভাব বাংলাদেশের ওপরেও থাকবে। তবে ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের এই সম্পর্ক বাংলাদেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, তা এখনই নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। সে জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে। 

সম্প্রতি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি টুইট করেছেন। এ ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অব্যাহত মনোযোগ দেখা গেছে। যেমন- শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় থাকাবস্থায় ট্রাম্পের সভায় প্রিয়া সাহার মন্তব্য ঘিরে সংখ্যালঘুদের অধিকারের কথা উঠেছিল। তখন বলা হয়েছিল, এটা বিএনপি-জামায়াত লবি করছে। সুতরাং ডোনাল্ড ট্রাম্প যেমন হাসিনা সরকারের আমলে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কথা বলেছিলেন, এবারও তিনি একই কথা বলেছেন। এবার বলার মধ্যে কোনো রাজনৈতিক কারণ থাকতেও পারে, যদিও তিনি নিয়মিতভাবে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে নজর রাখেন। এটা বলা যায়, এ ব্যাপারে তিনি এখনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেননি। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা যাতে ঝামেলায় না পড়ে, সেদিকে আমেরিকা আরও বড় আকারে সব সময় একটা চাপ রাখবেই। সেটা যে সরকারই থাকুক না কেন। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নানা সম্পর্ক রয়েছে। যেমন- অর্থনৈতিক, কৌশলগত, ভূরাজনৈতিক ইত্যাদি।

সুতরাং বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ইস্যু যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে দেখবে, সেটিও ভারতের সঙ্গে কিছুটা যুক্ত। তবে আমাদের ওপর তার কী প্রভাব পড়বে এখনো বলা কঠিন। মনে হচ্ছে, খুব একটা পরিবর্তন হওয়ার কথা নয়। এ বিষয়ে আমেরিকা একই ধরনের কথা বলে থাকে। রোহিঙ্গা নির্যাতনের ব্যাপারে ডেমোক্র্যাটদের পক্ষ থেকে গণহত্যা বলা হয়েছিল এবং বার্মা অ্যাক্ট নামে একটি বিলও পাস করা হয়েছিল। আবার তারা রোহিঙ্গা অ্যাক্টও নিয়ে এসেছে। তবে ট্রাম্পের আমলে পরিস্থিতি কী হবে, তা দেখার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। ভাটা পড়তে পারে, আবার উল্টোও হতে পারে। কিন্তু এটা অনেকটা নির্ভর করে ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কী দাঁড়াচ্ছে তার ওপর।

 বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অভিবাসন-প্রক্রিয়া। সেখানে মূল সমস্যা আসে  দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। এসব অঞ্চল থেকে অবৈধভাবে লোক মার্কিন সীমান্ত অতিক্রম করে। যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসী ছাড়া কোনোভাবে চলতে পারার কথা নয়। কারণ তার নতুন লোকবল দরকার পড়বে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেটি আইনি পদ্ধতিতে করতে চায়। সমস্যা হলো, লাতিন আমেরিকা থেকে যেভাবে লোকজন আসে, তাতে সেখানে হিস্পানিক সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এমনকি অনেক জায়গায় যত লোক ইংরেজি বলে, তার চেয়ে বেশি লোক স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে। এর মূল কারণ হলো, লাতিন আমেরিকা থেকে আসা লোকসংখ্যা। বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে অভিবাসনের হার এত কম যে, এ ব্যাপারে কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। সেটা তেমন গুরুত্ব বহন করে না। মূলত তার সমস্যা হিস্পানিক জনসংখ্যা নিয়ে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র শক্ত একটা অবস্থান নেবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বৈধ অভিবাসন নিয়ে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেবে বলে ধারণা করা যায়। কারণ এ হার অত্যন্ত কম। বাংলাদেশে এখন অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। তারা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখার কৌশলের বাইরে যেতে পারবে বলে মনে হয় না।

এ অবস্থায় ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন, তাহলে বাংলাদেশ কোয়াডে যুক্ত থাকল কি থাকল না, সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের খুব বেশি নজর থাকবে না। সুতরাং বাংলাদেশকে অবস্থান ঠিক রাখতে হলে নিজেদেরই চিন্তাভাবনা করতে হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পর রাশিয়ার মতো চীনের তরফ থেকেও আনুষ্ঠানিক কোনো অভিনন্দনবার্তা পাঠানোর খবর পাওয়া যায়নি। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং জানিয়েছেন, মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত এবং ট্রাম্পকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করার পর চীনও নিয়ম অনুযায়ী প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো পালন করবে। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবারও নির্বাচিত হওয়ায় চীনের সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।

 নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই ট্রাম্পকে নিয়ে চীনা নাগরিকদের মধ্যে বাড়তি একটা আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছিল। অনেকেই তাকে পছন্দ করেন এবং প্রায়শই ‘কমরেড ট্রাম্প’ নামে ডেকে থাকেন। তবে চীনের যেসব ব্যবসায়ী যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করেন, তাদের মধ্যে বেশ উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে। এর কারণ নির্বাচনি প্রচারণায় ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় গিয়ে বিদেশি পণ্যের ওপর কর বাড়াবেন। ওদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পর বিভিন্ন দেশের নেতারা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানালেও এখনো সে ধরনের কোনো বার্তা দিতে দেখা যায়নি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে। পুতিন আদৌ আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানাবেন কি না, সেটি এখনো নিশ্চিত নয় বলে জানিয়েছেন রুশ কর্মকর্তারা। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ট্রাম্প তার নির্বাচনি প্রচারের সময় ইউক্রেন যুদ্ধের ইতি টানার বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। তবে বাস্তবে তার কথার প্রতিফলন কতটুকু দেখা যাবে, সেটি সময়ই বলে দেবে।

আগামী ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে সিনেটে আনুষ্ঠানিকভাবে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট গণনা করা হবে। সেই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট ও নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিস। ভোট গণনা শেষে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম ঘোষণা করবেন। ২০২০ সালে সিনেটের সেই ভোট গণনার সময়েই উত্তেজিত জনতা ক্যাপিটল হিলে হামলা করেছিল। সেই অনুষ্ঠানে ভোট গণনা পাঠ করছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। এরপর ২০ জানুয়ারি নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। একই সময় জো বাইডেন হোয়াইট হাউস ছেড়ে যাবেন। ওই শপথ নেওয়ার আগ পর্যন্ত সময়কে বলা হয় ‘রূপান্তরকালীন সময়’। ওই সময়ের মধ্যে নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের বাছাই করেন এবং পরিকল্পনা তৈরি করবেন। 

২০২৪ সালের নির্বাচন তার ভাগ্যের চাকাকে এমনভাবে ঘোরাচ্ছে, যা হয় তার ভঙ্গুর বন্ধনকে সহজেই ছিন্ন করতে পারে অথবা সংগ্রাম ও অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পথে চালিত করতে পারে। অনেকের মতে, সামনের দিনগুলো একটি নতুন বন্দোবস্তের সূচনা ঘটাতে পারে, যেখানে প্রতিটি অঞ্চলের শক্তিকে সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখা হবে। অন্যদের কাছে এটি তাদের প্রিয় সবার জন্য ধ্বংসের পরিখা, রক্ত দিয়ে অর্জিত এবং প্রাচীন ও পবিত্র মাটিতে দাঁড়িয়ে কথিত শপথ দ্বারা আবদ্ধ একটি ইউনিয়নের সমাপ্তি। সেখানে শান্তি বা যুদ্ধ যা-ই বিরাজ করুক না কেন, আসন্ন যুগ এমন সব হিসাব-নিকাশের প্রতিশ্রুতি দেয়, যা নিশ্চিতভাবে যেকোনো বিজয়ীর তরবারি যেমনটা করে তেমনভাবে এ ভূখণ্ডকে রূপান্তর করবে। যা-ই হোক, এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, পরবর্তী চার বছর ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দেশ ও যুদ্ধ আক্রান্ত বিশ্ব পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেন।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক 
[email protected]

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সাহসী পদক্ষেপ জরুরি

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫৪ এএম
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সাহসী পদক্ষেপ জরুরি
বান কি-মুন

জলবায়ুসংকটের কারণে কৃষি খাত ব্যাপক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় এবং সেটা মোকাবিলা করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি জাতিসংঘের মহাসচিব থাকাকালে জলবায়ু মোকাবিলায় আমার নেতৃত্বের ভূমিকা অনেক বড় ছিল। কপ-২৯ সম্মেলনে আমি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করি। কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট অনুদান ও প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। জলবায়ুসহনশীল ফসল, টেকসই চাষাবাদ অনুশীলন, উন্নত পানি ও মাটি ব্যবস্থাপনার কৌশল বিকাশের জন্য কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ অপরিহার্য। কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে সহায়তা শুধু উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং স্থিতিস্থাপকতা বাড়াবে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও স্থিতিশীল ও নিরাপদ বিশ্ব খাদ্যব্যবস্থায় অবদান রাখবে।...

এবারের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৯) হতে যাচ্ছে আজারবাইজানের বাকুতে। বিশ্ব নেতারা এবারের সম্মেলনে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় নতুন করে অর্থায়ন লক্ষ্য নির্ধারণ করতে যাচ্ছেন। বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোকে তাদের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে এবং জলবায়ুসংকটের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হবে। আবহাওয়ার বৈরী প্রভাব এবং কীভাবে তা মোকাবিলা করা যায়- সেটাই এবারের আলোচ্য বিষয় হবে। আমরা উত্তর আফ্রিকা, মেক্সিকো, ভারত 
এবং সৌদি আরবজুড়ে মারাত্মক তাপপ্রবাহ 
উপলব্ধি করেছি। দক্ষিণ আফ্রিকাজুড়েও অনেক খরা পড়েছে, যা ইতিহাসে রেকর্ড। ব্রাজিলের জলাভূমিতে ভয়ানক দাবানল দেখেছি। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড ভঙ্গকারী হারিকেন ঝড় হয়েছে। জলবায়ু কোনো সীমানা জানে না এবং কাউকে রেহাই দেয় না। 

এবারের সম্মেলন জলবায়ুসংকটের প্রথম সারিতে থাকা দুর্বল দেশগুলোকে রক্ষায় বিশ্ব নেতাদের কাছে বড় চাপ সৃষ্টি করবে। উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিশেষ করে আফ্রিকায় জলবায়ু প্রভাবের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার খরচ অনেক বেশি। আফ্রিকান দেশগুলো জলবায়ুর চরম প্রভাবের কারণে তাদের জিডিপির ৫ শতাংশ হারাচ্ছে। কোনো কোনো দেশ তাদের জাতীয় বাজেটের ৯ শতাংশ পর্যন্ত বরাদ্দ করেছে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব কাটিয়ে উঠতে। 
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা অনুমান করছে, দক্ষিণ আফ্রিকার সাহারায় জলবায়ু বিপর্যয়ের মুখোমুখি যেসব সম্প্রদায় রয়েছে তাদের রক্ষা করতে আগামী দশকে বার্ষিক ৩০-৫০ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হবে। জলবায়ুসংকট মোকাবিলা না করে আমরা দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূর করতে পারব না। জলবায়ু সংকটের সমাধান না করলে সমৃদ্ধ ও স্থিতিস্থাপক বিশ্ব সম্প্রদায় গড়ে তুলতে পারব না।

জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় আর্থিক ব্যয়ের মাত্রা দিন দিন অনেক বাড়ছে। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অনুসারে ২০২১ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রায় ৮৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার সহযোগিতা করা হয়েছিল। তবুও বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়ন অনুপাতিকহারে দিন দিন কমে যাচ্ছে। জলবায়ু অর্থায়নের প্রায় ৯০ শতাংশ জলবায়ুসংকটের প্রভাবগুলো মেটানোর জন্য খরচ হয়। সংকট কাটিয়ে দেশগুলোর স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করতে বহির্বিশ্বের সহযোগিতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ বিশ্বের সামনে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য যারা ইতোমধ্যেই ঋণের বোঝা বহন করে পঙ্গু হয়েছে। আমি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে জলবায়ুর বৈরিতা প্রশমন এবং সংকট কাটিয়ে ওঠার আর্থিক সহযোগিতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য আহ্বান জানাই। জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় উভয়ই ক্ষত্রেই পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত হোক। 

আর্থিক ভারসাম্য মানে চ্যালেঞ্জের স্কেল ভেদে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলার জন্য অনুদানভিত্তিক পাবলিক ফাইন্যান্স বাড়ানো। এটি অবশ্যই কপ-২৯-এ আলোচনা করা নতুন যৌথ পরিমাপকৃত লক্ষ্যের (NCQG) মূল উপাদান হতে হবে, যেখানে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় সমন্বয় তহবিলের অর্থ পৃথক এবং সমান অগ্রাধিকার হিসেবে স্বীকৃত হতে হবে। সমন্বয় তহবিল সম্প্রসারণ ইতোমধ্যে জলবায়ুসংকটে বিধ্বংসী প্রভাবের সম্মুখীন হওয়া দেশগুলোকে রক্ষা করতে সম্পদের ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করেছে। 

কপ-২৯ সম্মেলনে সমন্বয় অর্থায়নের ওপর বেশি জোর দিতে অবশ্যই সাহসী ও রূপান্তরমূলক হতে হবে। কপ-২৯ সম্মেলনে সমন্বয় অর্থ তহবিলের আলোচনার জন্য আয়ারল্যান্ড এবং কোস্টারিকা থেকে দুজন মন্ত্রীকে প্রেসিডেন্সির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা এই সম্মেলন চলাকালীন পরামর্শ এবং দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় নেতৃত্ব দেবেন। এটি নিউ কালেক্টিভ কোয়ান্টিফাইড গোল (NCQG) আলোচনার মধ্যে সমন্বয় তহবিলের গুরুত্ব দেওয়াটা ইতিবাচক হবে। 

কপ-২৯ সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের অবশ্যই পাবলিক অ্যাডাপ্টেশন ফাইন্যান্স বাড়ানোর জন্য উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এটিকে ক্ষয়ক্ষতি থেকে আলাদাভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে। এই অঙ্গীকারগুলো অবশ্যই উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে করতে হবে। সবচেয়ে দুর্বলদের জন্য আবেদন প্রক্রিয়া সরল করাসহ আরও ভালো সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু এটি করার মাধ্যমে আমরা সমন্বয় তহবিলের ব্যবধানকে সংকুচিত করা এবং অর্থ সংগ্রহে বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জনের কাছাকাছি যাওয়ার আশা করতে পারি। 
জলবায়ুসংকটের কারণে কৃষি খাত ব্যাপক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় এবং সেটা মোকাবিলা করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি জাতিসংঘের মহাসচিব থাকাকালে জলবায়ু মোকাবিলায় আমার নেতৃত্বের ভূমিকা অনেক বড় ছিল।

 কপ-২৯ সম্মেলনে আমি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করি। কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট অনুদান ও প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। জলবায়ুসহনশীল ফসল, টেকসই চাষাবাদ অনুশীলন, উন্নত পানি ও মাটি ব্যবস্থাপনার কৌশল বিকাশের জন্য কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ অপরিহার্য। কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে সহায়তা শুধু উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং স্থিতিস্থাপকতা বাড়াবে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও স্থিতিশীল ও নিরাপদ বিশ্ব খাদ্যব্যবস্থায় অবদান রাখবে।

কপ-২৯ সম্মেলনে জলবায়ু নেতৃত্বের জন্য নতুন যুগের জন্য বড় সুযোগ রয়েছে। জলবায়ু সম্মেলনে যারা নেতা আছেন আমি তাদের সাহসী প্রতিশ্রুতি উপস্থাপন করার আহ্বান করছি, যা চ্যালেঞ্জের মাত্রাকে প্রতিফলিত করে। জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় অর্থ প্রক্রিয়াগুলোকে সরলীকরণ করা, দুর্বল দেশগুলোর জন্য অর্থায়নের সুবিধা বৃদ্ধি করা ও অর্থ সমন্বয় করা এবং ক্ষয়ক্ষতির সমান অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা নিশ্চিত করা।
এখন বিশ্ব নেতাদের বিশ্ব নেতৃত্ব দেখানোর সময়। প্রশ্ন থেকে যায়- আমরা কি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে উঠতে পারব?

লেখক: জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব
দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন ও কপ-২৯

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৮ এএম
বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন ও কপ-২৯

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ বৈশ্বিকভাবে সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশ বিশ্বের জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় যথাক্রমে সপ্তম ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে, যা বাংলাদেশের ব-দ্বীপ অঞ্চলের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সব কিছু সরকার ও ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কোনোমতেই তা ভালো হবে না। বাস্তবে দেখা যায়, জীবাশ্ম জ্বালানির ভবিষ্যৎ নিয়ে এ বিশ্ব এখন দ্বিধাবিভক্ত। একদিকে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর বাণিজ্যিক স্বার্থ আর অন্যদিকে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জোট অ্যালায়েন্স অব স্মল আইল্যান্ডের (এওএসআইএস) জলবায়ুর ঝুঁকি থেকে বেঁচে থাকার লড়াই।...

আজারবাইজানের বাকুতে শুরু হয়েছে কপ-২৯ জলবায়ু সম্মেলন (১১-২২ নভেম্বর)। জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন ও প্রশমন কৌশলগুলো ন্যায়সঙ্গত হতে হবে এবং সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে প্রাধান্য দিতে হবে। আন্তর্জাতিক অর্থায়নসংকট মোকাবিলায় যে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল তা বাড়াতে হবে। উন্নত দেশগুলোর অর্থ সাহায্য কিছু আর্থিক সমস্যার সমাধান করলেও এর দ্বারা প্রকৃত জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে না। বাংলাদেশ বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার বিষয়ে দৃঢ় অবস্থানে থাকবে সব সময়। অভিযোজন পদক্ষেপের ওপর গুরুত্বারোপ এবং তরুণদেরও এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে। 

এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরা এবং উচ্চাভিলাষী প্রশমন উদ্যোগ নিয়ে কথা বলতে হবে। কপ-২৯ সম্মেলনে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। কপ-২৯ সম্মেলনে জোরালো অ্যাডভোকেসির প্রয়োজন রয়েছে, যাতে বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনায় বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর কণ্ঠস্বর শোনা যায়। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং সহনশীলতা গঠনে বাংলাদেশ উদাহরণ সৃষ্টি করবে। 
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ বৈশ্বিকভাবে সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশ বিশ্বের জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় যথাক্রমে সপ্তম ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে, যা বাংলাদেশের ব-দ্বীপ অঞ্চলের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। 

পৃথিবীর উষ্ণতম বছর ছিল ২০২৩ সাল। বছরটি উষ্ণতার দিক থেকে আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। এতে বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস সত্য প্রমাণ করে নিশ্চিত হওয়া গেল ২০২৩ ছিল এ গ্রহের এ যাবৎকালের উষ্ণতম বছর। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়ে আরও বলেছেন, পৃথিবীর এ অবস্থা মানুষেরই সৃষ্টি। এ গ্রহ গরম হয়ে ওঠার পেছনে জীবাশ্ম জ্বালানির বহুল ব্যবহারই দায়ী। তাই আর সময়ক্ষেপণ নয়, দ্রুত নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথে আমাদের হাঁটতে হবে। তা না হলে বর্তমান পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

এর ফলে ইতোমধ্যেই বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং ভূমিক্ষয়জনিত ঝুঁকির মাধ্যমে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর বরাবর উপকূলীয় তটরেখার ৭১০ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকাজুড়ে বসবাসরত প্রায় ১ কোটি পরিবারের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ও পরিষেবায় প্রবেশ ও অন্তর্ভুক্তি পরস্থিতি খুব সংকটে রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ৬৯ শতাংশ উপকূলীয় উপজেলায় সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারগুলো গুরুতর ঝুঁকিতে পড়েছে, যা বাংলাদেশের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ৩, ৪, ৭, ৮ ও ১৩ নম্বর সূচক অর্জনকে বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ফেলছে। 

বাংলাদেশের কৃষিতথ্য সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দেশে ধানের উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। ধান চাষের ক্ষেত্রে ১৮-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন হয়। শীতের সময় তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রির অনেক নিচে নেমে যায় এবং গরমের সময় ৩৫ ডিগ্রির ওপরে উঠে যায়। এতে ধানের পরাগায়নে অনেক সমস্যা হয় এবং উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলে বরফ গলার কারণে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষিজমির মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। লবণাক্ততার তীব্রতায় আবাদি জমি হয়ে পড়ছে অনাবাদি, ফলন কমছে ক্রমাগত। এতে করে উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে দিন দিন। মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (এসআরডিআই) এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, শুধু লবণাক্ততার কারণেই প্রতিবছর উপকূলীয় জেলাগুলো ৩০ লাখ টনেরও বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে।

কৃষিজমির লবণাক্ততা বাড়তে থাকলে কৃষি থেকে আয় বছরে ২১ শতাংশ কমে যাবে এবং উপকূলীয় অঞ্চলের অর্ধেকের বেশি কৃষিজমি উৎপাদনবঞ্চিত হবে। ফলে, বিপুলসংখ্যক অধিবাসী বাস্তুচ্যুত হবে। প্রধান খাদ্যশস্য ধান ছাড়াও বাংলাদেশের অন্য শস্য যেমন- পাট, গম, ভুট্টা, মটর, ছোলা উৎপাদনও ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে; যার প্রধান কারণ শিলাবৃষ্টি, ঝড়, আকস্মিক বন্যা, খরা পরিস্থিতি প্রভৃতি। ফলে, উপকূলীয় মানুষের মাথাপিছু আয় হ্রাস পাচ্ছে, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-পুষ্টির ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন শুধু কৃষিই নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতির সব খাত সংকটে পড়েছে। যেমন- দেশে প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার হেক্টর পুকুর, ৫ হাজার ৪৮৮ হেক্টর বাঁওড় এবং ১১ কোটি  হেক্টর চিংড়ি ঘেরে মাছ চাষ হয়। এ ছাড়া ৪৪ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর মুক্ত জলাশয়, যেমন- নদী, হাওর, বিল, খালে প্রায় ২৫০ প্রজাতির মাছ বাস করে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর বিভিন্ন পরিবর্তনের প্রভাবে এই মৎস্য উৎপাদনও হুমকির মুখে পড়েছে। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে পানি গরম হয়ে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। এতে মাছের পোনা উৎপাদন অনেকাংশে হ্রাস পায়। এ কারণে মৎস্য খাত থেকে আয় কমে যাচ্ছে, যা প্রভাব পড়ছে মৎস্যজীবীদের ওপর, যাদের জীবিকা মূলত মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বর্তমান সময়ে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেওয়ায় মানুষ তাদের সব হারিয়ে সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ছে, যাদের পুনর্বাসন করতে সরকারকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে, বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি অনেক মানুষ কাজের সন্ধানে নিজ এলাকা ছেড়ে বড় শহরে বিশেষ করে ঢাকায় পাড়ি জমাচ্ছে এবং বাধ্য হয়ে অপরিকল্পিতভাবে বিকাশমান শিল্পকারখানা ও শ্রম ব্যবস্থায় জড়িত হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাব মতে, বাংলাদেশের উৎপাদন খাত তাপমাত্রাজনিত অস্বস্তি বা হিট স্ট্রেসের কারণে বর্তমানে ২ দশমিক ৫৯ শতাংশ কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে, যা ২০৩০ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। যদি পোশাক কারখানাগুলো তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য ভবিষ্যতে এয়ার কন্ডিশনের ওপর বেশি নির্ভর করে, তাহলে তা বাংলাদেশের গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন আরও বাড়িয়ে দেবে, যেখানে আবার আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত প্রায় পুরোপুরি জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর। 

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ক্লাইমেট সার্ভিসের তথ্যমতে, জীবাশ্ম জ্বালানির বহুল ব্যবহার শুরুর দীর্ঘ সময়ের গড় উষ্ণতা বাড়ার তুলনায় গত বছর পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৪৮ ডিগ্রি। গেল বছরের জুলাই মাস থেকে প্রতিদিনই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ার রেকর্ড সৃষ্টি হয়। অথচ বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এখন সত্যিই ব্যর্থতার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছেছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে তাই দরকার গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের রাশ শক্ত হাতে টেনে ধরা। কিন্তু কাজটি করা সম্ভব হয়নি বলে গত বছরটি বিশ্বের উষ্ণতম বছরে পরিণত হয়।

 এটি বিশ্ববাসীর জন্য আসলেই দুশ্চিন্তার কারণ। ইউরোপভিত্তিক জলবায়ুবিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সারভিসের (সিথ্রিএস) এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়, শিল্পপূর্ব অক্টোবর মাসের গড় তাপমাত্রার চেয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস ছিল অনেক বেশি উষ্ণ। এর তাপমাত্রা ছিল ১ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কোপারনিকাস সারভিসের উপপ্রধান সামান্তা বারগেসের মতে, ২০২৩ সালের ছয়টি মাস এবং দুটি মৌসুম উষ্ণতার বেলায় নতুন রেকর্ড গড়ে। তাই ২০২৩ সাল হলো স্মরণকালের উষ্ণতম বছর। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জোরদার হয় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রেখে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার দাবি।

সব কিছু সরকার ও ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কোনোমতেই তা ভালো হবে না। ব্যক্তিপর্যায়ে বেশি করে শাকসবজি, ফলমূল, শস্য, লেবু, বাদাম ও বীজ এবং কম মাংস এবং দুগ্ধজাত খাবার খেলেও পরিবেশগত প্রভাব কমিয়ে আনতে উল্লেখযোগ্যভাবে ভূমিকা রাখা যায়; উদ্ভিদভিত্তিক খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে কম গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করা যায় এবং কম শক্তি, জমি এবং জলের প্রয়োজন হয়। এমনকি ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে যদি বিদেশে অনুষ্ঠিত সভা সেমিনারগুলো সম্পন্ন করা যায়, তাহলে বিপুল জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো উড়োজাহাজে ওড়া এড়ানো যায়। এ রকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাজারো ব্যক্তিপ্রচেষ্টা মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে পারে।

বাস্তবে দেখা যায়, জীবাশ্ম জ্বালানির ভবিষ্যৎ নিয়ে এ বিশ্ব এখন দ্বিধাবিভক্ত। একদিকে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর বাণিজ্যিক স্বার্থ আর অন্যদিকে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জোট অ্যালায়েন্স অব স্মল আইল্যান্ডের (এওএসআইএস) জলবায়ুর ঝুঁকি থেকে বেঁচে থাকার লড়াই। কপ-২৮ সম্মেলনের শেষ দিকেও তার লক্ষণ পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ঘড়ির কাঁটা ধরে ঝুলতে থাকা এ বিভেদ রীতিমতো বড় হয়ে উঠেছিল। নানামুখী চাপ ছিল ঠিকই, তার পরও জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের শেষ দিকে বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে যায়। 

কপ-২৮ সম্মেলন চলাকালীন আরও একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ‘জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধের দাবির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।’ এ মন্তব্যের পর তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। শেষে পিছু হটে এসে তিনি বলতে বাধ্য হন, ‘জলবায়ুবিষয়ক বিজ্ঞানের প্রতি তার শ্রদ্ধা আছে। এমন একটা বিরূপ অবস্থা জিইয়ে থাকার পরও ২৮ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলন কপের (কনফারেন্স অব পার্টিস) ২৮-এর সদস্য দেশগুলো (১৯৮ দেশ) একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে তারা পর্যায়ক্রমে সরে আসবে। ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ুর চুক্তির পর শেষ অবধি দুবাই জলবায়ু চুক্তিও সফল হয়।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ

বিশেষ সাক্ষাৎকার: নুরুল হক নুর সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নিয়ে  জাতীয় সরকার হতে পারে

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:১৮ পিএম
সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নিয়ে 
জাতীয় সরকার হতে পারে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সর্বশেষ ভিপি নুরুল হক নুর। মানুষের কাছে তিনি ভিপি নুর নামে পরিচিত। পটুয়াখালীর প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে উঠে আসা নুর ধাপে ধাপে নিজেকে তৈরি করে এখন রাজনীতির আলোচিত মুখ। আন্দোলন করতে গিয়ে বারবার হামলা-মামলা, জেল-জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। প্রতিবাদ-আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত করতে না পেরে ভিপি নুরকে একাধিকবার অর্থবিত্তের প্রলোভন দেখিয়েছিলেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালীরা। তার পরেও তাকে লক্ষ্য থেকে টলানো যায়নি। ভিপি নুরের দৃঢ় মনোবল এবং চেষ্টার ফলে দানা বাঁধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেই আন্দোলন থেকেই পতন হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের। এসেছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। 

এই সরকারের কাছে প্রত্যাশা কী? আন্দোলনের সময় দিনগুলো কেমন ছিল, সেসব নিয়ে কথা বলেছেন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। তিনি বলেন, এই সরকারের কোনো পলিটিক্যাল বেজ নেই। পলিটিক্যাল পার্টিগুলো যদি সরকারের বিপক্ষে চলে যায় তাহলে সরকার এক মাসও টিকতে পারবে না। এ জন্য আমরা বলেছিলাম সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাদের প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সরকার করতে পারে। তাহলে সবার প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সবাই সরকারকে সাপোর্ট দিতে বাধ্য। তাহলে হয়তো সরকার সুন্দরভাবে সফলভাবে কাজগুলো এগিয়ে নিতে পারবে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের সিটি এডিটর আবদুল্লাহ আল মামুন


শেখ হাসিনা যেভাবে বিভিন্নজনকে পয়সা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কিনে নিয়েছে, আমাদেরও বিভিন্ন সময় সে অফার করেছিল। আমরা বিক্রি হইনি। আমরা এ জন্য এখনো পরিষ্কারভাবে বলি, শেখ হাসিনার মতো এত শক্তিশালী দানবীয় সরকারের কাছে মাথা নত করিনি। কাজেই কারও কাছে মাথা বিক্রি করে রাজনীতি করব না। কারও কাছে নত হয়ে এমপি-মন্ত্রী হওয়ার জন্য রাজনীতি করব না। স্ট্রেট-ফরোয়ার্ড রাজনীতি করে যাব। দেশ ও জাতির পক্ষে আমাদের অবস্থান থাকবে। কে পছন্দ করল না করল, কে খুশি হলো, অখুশি হলো- বিন্দুমাত্র আমরা তা চিন্তাভাবনা করি না।...

খবরের কাগজ: আপনি কি মনে করেন আওয়ামী লীগের পতনের জন্য আপনার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য? 
নুরুল হক নুর: আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না যে, এটা আমার একক কৃতিত্ব বা একক  কন্ট্রিবিউশন ছিল। আমরা একটা টিমওয়ার্ক করেছিলাম। বড় টিম ছিল। এ টিমের অনেকে হয়তো আমার মতো পরিচিতি পাননি বা মিডিয়ায় পরিচিত মুখ নন। তাদের অনেক কন্ট্রিবিউশন আছে। আমাদের একজন ছাত্রনেতা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বদ্যিালয়ের ছাত্র। কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছিলেন এবং গুম হয়েছেন। আমাদের সঙ্গে অনেক ছাত্রনেতা, ছাত্র অধিকার পরিষদের প্রোগ্রাম করতে গিয়ে পা ভেঙেছে, চোখ হারিয়েছে। তারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে। তাদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ রকম বড় একটা কমিউনিটি আমার সঙ্গে ছিল এবং এখনো আছে। তাদের মুখপাত্র হিসেবে আমি সামনে ছিলাম।

 ফলে আমাকে আপনারা দেখছেন। কিন্তু আমরা যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছি, যে কাজগুলো করেছি, সেখানে সবার কন্ট্রিবিউশন ছিল। তরুণদের এই প্ল্যাটফর্ম ছাত্র অধিকার পরিষদ ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ থেকে তৈরি হয়েছে এবং ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে রাজনৈতিক দল গণ অধিকার পরিষদের জন্ম হয়েছে। গণ অধিকার পরিষদ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। 

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যাদের দেখেন, তারা ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকেই তৈরি হয়েছে। ছাত্র অধিকার পরিষদ তৈরি না হলে এই বিপ্লবী চেতনা এবং এভাবে এই সময়ে তারা বিদ্রোহ করত না। হয়তো অন্য কেউ করত আগে বা পরে। আমরা ২০১৮ সালের পর সারা বাংলাদেশের তরুণদের সম্পৃক্ত করেছি। তাদের সাহস, প্রতিক্রিয়া, প্রতিবাদ, দেশের প্রশ্নে আপসহীন ভাবনা আর ট্রিগার করেছে ছাত্র অধিকার পরিষদের সঙ্গে গণ অধিকার পরিষদ। এখানে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তির অবদান ছিল, কন্ট্রিবিউশন ছিল। তবে এটা সবাইকে স্বীকার করতে হবে কো-অর্ডিনেশনের ক্ষেত্রে গণ অধিকার পরিষদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল।
খবরের কাগজ: জেলখানায় নিয়ে যাওয়া বা কোর্টে হাজিরার সময় আপনাকে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখেছি। আন্দোলন করতে গিয়ে আপনাকে কি পুলিশের নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে?

নুরুল হক নুর: মাঝে মাঝে ভাবি, আমি তো একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছি। জেলহাজত পর্যন্ত যেতে হয়েছে। একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়ে থানা বা ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পেয়েছি। আবার একবার দুই দফায় ১২ দিন রিমান্ডে ছিলাম। সেখানে গরু-ছাগল জবাই করার মতো ঝুলিয়ে পিটিয়েছে পুলিশ, 
টর্চার করেছে। 

খবরের কাগজ: এ বিষয়ে আরও বিস্তারিতভাবে আপনার অভিজ্ঞতা বলুন। 
নুরুল হক নুর: অভিজ্ঞতা বলতে দেখা যায়, নাশতা খেলাম, তারপর দুপুরে টর্চার শুরু হলো। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গল্প শুনেছিলাম- অল্প বয়সী মেয়েদের পাকিস্তানি আর্মি অফিসাররা পালাক্রমে ধর্ষণ করত। একজন যেত বা একটা টিম যেত, পরে আর একটা টিম যেত বা আরেকজন যেত। কোনো একজন মা নাকি বলেছিলেন যে, ‘বাবারা তোমরা আসো একটু আস্তে আস্তে বা একটু সময় নিয়ে আসো। আমার মেয়েটা অনেক ছোট।’ আমার ক্ষেত্রে সে রকমই অভিজ্ঞতা যে, বিকেলে এক টিম এসেই জিজ্ঞাসাবাদ। জিজ্ঞাসাবাদ মানে চোখ বাঁধা, হাত বাঁধা। গরু যে হাল চাষ করে, ধরেন পেছনে একটা লাঠি থাকে, লাঠির মাথায় লোহার একটা সুচ থাকে। হাঁপিয়ে গেলে গুঁতা দিলে গরু আবার হাঁটা শুরু করে। কথা নেই, দেখা যায় পেছন থেকে একটা বাড়ি (আঘাত) পড়ে গেছে। কিংবা দেখা যায়, বসতে দিয়েছে একটা চেয়ারে- সেখানে আবার ইলেকট্রিক সেটআপ কারেন্টের শক দেওয়ার। মানে এ ধরনের নির্যাতন ছিল। এটা সব সময়ই হয়েছে। এক বেলা ডাকলে এক বেলা, দুই বেলা ডাকলে দুই বেলা, তিন বেলা ডাকলে তিন বেলা নির্যাতন করেছে। এ ধরনের নির্যাতন তাদের পৈশাচিক আনন্দের একটা জায়গা ছিল। আমার ক্ষেত্রে বিশেষ করে ছাত্রলীগ থেকে যারা ইয়াং পুলিশ অফিসার ছিল, ওদের বড় ধরনের ক্ষোভ ছিল। তাদের একজন আরেকজনকে বলছে- স্যার ও কত বড় বেয়াদব, ও প্রধানমন্ত্রীর নামের আগে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ বলে না। কেন আমি শেখ হাসিনার নামের আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলি না, সে জন্য পুলিশ অফিসার ক্ষুব্ধ। কেন শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে আমি জাতির পিতা বলি না, তা নিয়ে ক্ষুব্ধ।
শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল কায়েম করেছিলেন, সেটা নিয়ে কেন আমি সমালোচনা করেছি? শেখ মুজিবুর রহমানের কি অবদান কম- এগুলো আমি কেন বলি? মানে পারসোনাল ক্ষোভ। যারা একেবারে আদর্শিকভাবে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, এটা তাদের একটা ক্ষোভের জায়গা ছিল। নির্যাতন-নিপীড়নের সব কথা বলাও যায় না। আমি মাঝে মাঝে ভেবেছি আসলে বাস্তবতাটা কত কঠিন। মাঝে মাঝে আমি দেখেছি- অন্য দলের সিনিয়র নেতাদের মেরে রক্তাক্ত করে ফেলেছে। কিন্তু রিমান্ডে যাওয়ার সময় সাদা পাঞ্জাবি, নতুন জামা-কাপড় পরে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় কর্মীদের হাত নেড়ে আশ্বস্ত করতে চেয়েছে যে, এভরিথিং ইজ ওকে। বাট, দেখা যাচ্ছে, তার হাতটা ওঠাতেও কষ্ট হচ্ছে। কারণ মেরে বা পিটিয়ে ফুলিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সে যেহেতু লিডার, তার কর্মীরা যাতে মনোবল 
না হারায়, আতঙ্কিত না হয়, এ জন্য নির্যাতনের 
কথা বলেননি।

আমার সঙ্গে যারাই ছিলেন- এই যে বিএনপির উত্তরের আহ্বায়ক ছিলেন সাইফুল ইসলাম নীরব ভাই। ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ভাই। দক্ষিণের মজনু ভাই। বিএনপির আরও সিনিয়র লিডার, এমপিরা। একটা লোককেও বাদ রাখেনি ঝোলানো থেকে, নির্যাতন থেকে, নিপীড়ন থেকে। তারা বয়স, সিনিয়রিটি নানা কারণে হয়তোবা মুখ খোলেননি। আমার ক্ষেত্রে মনে হয়েছে, আমি যদি এটা সহ্য করে যাই চুপ চুপ। তাহলে এটা চলতেই থাকবে। এটা বন্ধ করা দরকার। আমি পুলিশের প্রিজন ভ্যান থেকে বলেছিলাম, ডিবি কার্যালয়- আই ওয়াজ ট্রিটেড লাইক আ ফুটবল। সো এটা হচ্ছে অত্যাচার-নির্যাতন। দেখেছেন মনে হয়, আঘাতের চিহ্ন কোর্টে আমি টি-শার্ট খুলে দেখিয়েছিলাম। কারণ এখানে আমার হিরোগিরির কিছু নেই। আমার ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছে, এটা দেশবাসী জানুক। দেশের 
মানুষ জানুক। 

খবরের কাগজ: মানুষ জানতে চায় আসলে নির্যাতনটা কীভাবে হয়েছে এবং পুলিশ কীভাবে নির্যাতন করে? 
নুরুল হক নুর: শেখ হাসিনার আমলেই পুলিশের রিমান্ডে যে রাজনীতিবিদরা টর্চারের শিকার হয়েছেন, অত্যাচারের শিকার হয়েছেন এমনটা নয়। এর আগেও যারা ছিলেন, এমন ঘটনা ঘটেছে হয়তো। তবে এতটা প্রকট আকারে হয়নি। রাজনীতিবিদদের প্রতি একটা সম্মান ছিল। শেখ হাসিনা তো সব রীতিনীতি ভেঙে তছনছ করে দিয়েছেন। শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ইনস্ট্রাকশন ছিল বিরোধীদলীয় নেতাদের ‘ঝুলাইয়া, পিটাইয়া, মাইরা’ ভিডিও তাদের পাঠাতে। পুলিশ বলেছে, ভাই আমাদের কিছু করার নেই, এই ভিডিও পাঠাতে হবে হোম মিনিস্টারের কাছে। বোঝেন তাহলে কতটা বর্বর, পৈশাচিক নির্যাতনের চিত্র। 

খবরের কাগজ: সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাই ঝোলানোটা কেমন ছিল? আপনার হাত ধরে, পা ধরে কীভাবে ঝুলিয়েছিল?
নুরুল হক নুর: হাতে তো হ্যান্ডকাফ পরা। হ্যান্ডকাফের ওপরে আই থিঙ্ক রিঙের মতো সিস্টেম। হ্যান্ডকাফ খুলে দুটি আঙুল দুটি রিঙের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেয়। পা-টা ফাঁসির আসামির মতো একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে মাটি থেকে ওপরে ঝুলিয়ে দেয়। মাটি থেকে তক্তা বা কাঠের একটা কাঠামো থাকে। যখন পেটানো শুরু করে, পা থেকে ওপর পর্যন্ত ওটা একটু সরিয়ে দেয়। অটোমেটিক্যালি আপনি মুভ করতে থাকবেন। ওদের তো একটা ট্রেনিং আছে, আসলে কোথায় কীভাবে মারতে হয়। 
এমন হয়েছে, অনেক মানুষ তো বলতেও পারে না, দেখাতেও পারে না। তার পরই দেখা যায়, চেয়ারে বসতে দিয়েছে- নিচে ইলেকট্রিক শকের ব্যবস্থা রাখা আছে, বসলেই শক করে। ইভেন আমরা তো কিছুটা পরিচিত ফেস ছিলাম ন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনালে, ফলে আমাদের সঙ্গে অসভ্যতা অতটা করতে পারেনি।

এমনও হয়েছে ছাত্রদল, যুবদল বা শিবিরের ছেলেদের উলঙ্গ করে নির্যাতন করেছে। বালতির মধ্যে পানি রেখে ইলেকট্রিক লাইন দিয়ে সেখানে প্রসাব করতে বাধ্য করেছে। এ কারণে তারা কারেন্টের শক খেয়েছে। পুলিশ ওই চিত্র তাদের সিনিয়দের দেখায়, যাতে তারা ভয়ে-আতঙ্কে যা বলাতে চায় তা যেন বলে দেয়।
আমার কাছে স্বীকারোক্তি চেয়েছিল যে, বিটিভিতে আপনারা আগুন দিয়েছেন। মিরপুরের মেট্রোরেলে আগুন দিয়েছেন। তারেক রহমান নির্দেশ এবং টাকা-পয়সা দিয়েছে। এটা বললে তাহলে আর অন্য মামলায় জড়াবে না। আমি স্বীকারোক্তি দিইনি। বলেছি, তোমাদের এত সংস্থা- ডিজিএফআই, এনএসআই, এসবি আছে। তাদের কাছে খবর নাও এগুলো (আগুন)-কে দিয়েছে। এগুলো (আগুন) সরকার দিয়েছে। সাবোট্যাজ করেছে আন্দোলনে। আমি কেন স্বীকারোক্তি দেব? ফলে আরও টর্চার করেছে, হুমকি দিয়েছে সব মামলায় জড়াবে। দেখেছেন তো, গত ১৫ বছর মামলার তো একটা উৎসব ছিল। প্রতিযোগিতা ছিল কোন পুলিশ সদস্য বিএনপি, জামায়াত, গণ অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীদের নামে কত মামলা দিতে পারে। কত মিথ্যা মামলা সাজাতে পারে? মরা মানুষ হতো মামলার আসামি। যার হাত নেই, সেও বোমা ছুড়ে মারার মামলার আসামি হয়েছে- এ ধরনের চিত্র তো দেখেছি।

খবরের কাগজ: আপনাকে কখনো প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল সরকারের সঙ্গে মিলে যান?
নুরুল হক নুর: এটা তো শুরু থেকেই ছিল। শেখ হাসিনার গত দেড় দশকে ধারাবাহিকভাবে লড়াই, সংগ্রাম চালিয়ে গেছে কে? একমাত্র ২০১৮ সালের আন্দোলনের পর থেকে আমার টিমের সহযোগিতা, আমার সহযোদ্ধা ও সহকর্মীদের সমর্থনে সাহস নিয়ে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে গেছি। শেখ হাসিনার জন্য আমরা বড় একটা থ্রেট ছিলাম। শেখ হাসিনা যেভাবে বিভিন্নজনকে পয়সা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কিনে নিয়েছে, আমাদেরও বিভিন্ন সময় সে অফার করেছিল। আমরা বিক্রি হইনি। আমরা এ জন্য এখনো পরিষ্কারভাবে বলি, শেখ হাসিনার মতো এত শক্তিশালী দানবীয় সরকারের কাছে মাথা নত করিনি। কাজেই কারও কাছে মাথা বিক্রি করে রাজনীতি করব না। কারও কাছে নত হয়ে এমপি-মন্ত্রী হওয়ার জন্য রাজনীতি করব না। স্ট্রেট-ফরোয়ার্ড রাজনীতি করে যাব। দেশ ও জাতির পক্ষে আমাদের অবস্থান থাকবে। কে পছন্দ করল না করল, কে খুশি হলো, অখুশি হলো- বিন্দুমাত্র আমরা তা চিন্তাভাবনা করি না। আমাদের পরিষ্কার কথা হলো- রাজনীতিগতভাবে ৫০ বছর দেশে যা চলেছে, যেভাবে চলেছে সেই পথে আগামীর বাংলাদেশ চলবে না। সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হলে নিউ লিডারশিপ প্রয়োজন এবং জেন জি (নিউ জেনারেশন) সেটা প্রমাণ করেছে। একজিস্ট লিডারশিপের বাইরে তারা নিজ নিজ জায়গা থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, উত্তরা, রামপুরা- কী ধরনের এই প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ ছিল? এখানে কে লিড দিয়েছে, কে লিডার ছিল? কেউ ছিল না। সম্মিলিতভাবে তারা নেতৃত্ব দিয়েছিল। আমার বিশ্বাস, ‘দিস ইস আই টাইম পলিটিক্স’-এ একটু চেঞ্জ আনা এবং সেই লক্ষ্যেই গণ অধিকার পরিষদ কাজ করছে। আমরা আশাবাদী এবং দেশের মানুষকে বলব, আপনারা সচেতন হন। সঠিক মানুষকে রাজনীতিতে সাপোর্ট দিন। সঠিক মানুষের নেতৃত্বে থাকুন। একটা পরিবর্তন করতে হবে। একটা জাতির ভাগ্যে এ রকম সুযোগ বারবার আসে না। ৫৩ বছরে আমরা একবার পেয়েছি, একটা গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছি। এখন আমাদের দরকার একটা জাতীয় ঐক্যের সরকার। এই সরকারের মাধ্যমে আমরা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কাঠামোর পরিবর্তন বা বিলোপের চিন্তাভাবনা করছি। জাতীয় ঐক্যের সরকারের মাধ্যমে পরিবর্তন করে একটা 
নতুন কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে। যে কারণে 
নতুন সংবিধানের একটা দাবি উঠছে। আমরা সেই দাবির পক্ষে। 

খবরের কাগজ: আপনি কি মনে করেন গণ-আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে যে সরকার এসেছে, তারা আপনাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ঠিকঠাক কাজ করছে?
নুরুল হক নুর: একটা সরকারকে মূল্যায়ন করার জন্য দু-তিন মাস পর্যাপ্ত সময় না। শেখ হাসিনা গত ১৫ বছরে রাষ্ট্রকে একটা ব্যক্তির ওপরে ডিপেন্ডেবল করেছিলেন। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো একটা ব্যক্তির আঙুলের হ্যালনে চলত। এ রকম একটা ভঙ্গুর রাষ্ট্রব্যবস্থায় হঠাৎ করে সরকার পরিবর্তন হলো। নতুন এসেই তারা এই সেটআপ পরিবর্তন করতে পারবে না। এই সরকারের আন্তরিকতা আছে। সরকারের ভালো লোক আছে। তারা ভালো কিছু করতে চায়। তবে রাজনৈতিক সহযোগিতা ছাড়া তারা ভালো কিছু করতে পারবে না, সফল হবে না। সে জন্য আমরা শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তাদের বারবার পরামর্শ দিয়েছি- যে আন্দোলনকারী স্টেক হোল্ডারদের নিয়ে এই সরকারকে একটা জাতীয় সরকারের রূপ দেওয়া, একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত তারা থাকবে এবং একটা রোডম্যাপ প্রকাশ করা। তাদের কাজের ধরন মানুষের সামনে উপস্থাপন করা। মানুষ রাষ্ট্র সংস্কার চাচ্ছে। প্রশাসনের সংস্কার চাচ্ছে। গভর্মেন্ট সার্ভিসের সংস্কার চাচ্ছে। রাজনীতি সংস্কার চাচ্ছে। এ জন্য একটু সময় লাগবে। সে জন্য আমরা বলছি, বছর দুয়েক সময় প্রয়োজন হবে। এখন রাজনৈতিক দলগুলো যদি সরকারকে সেই সময়টা না দেয় তাহলে সরকার থাকতে পারবে না। কারণ এই সরকারের কোনো পলিটিক্যাল বেজ নেই। পলিটিক্যাল পার্টিগুলো যদি সরকারের অ্যাগেইনেস্টে চলে যায়। তাহলে সরকার এক মাসও টিকতে পারবে না। এ জন্য আমরা বলেছিলাম, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাদের প্রতিনিধি নিয়ে যদি জাতীয় সরকার করতে পারে। তাহলে সবার প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সবাই সরকারকে সাপোর্ট দিতে বাধ্য। তাহলে হয়তো সরকার সুন্দরভাবে, সফলভাবে কাজগুলো এগিয়ে নিতে পারবে।

খবরের কাগজ: সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় সরকার হওয়ার কোনো সুযোগ আছে বলে আপনি মনে করেন?
নুরুল হক নুর: আমি মনে করি অবশ্যই নতুন নতুন ক্রাইসিস তৈরি হচ্ছে। মাঝখানে দেখেছেন না রাষ্ট্রপতি নিয়ে রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-জনতার মধ্যে কী ধরনের একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে? এখন কেউ বলছে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন। কেউ বলছে ডাবল চেম্বার বা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট নির্বাচন। কেউ বলছে বিদ্যমান সিস্টেমে। এই যে জটিলতাগুলো বা নানা ধরনের মতামত তৈরি হচ্ছে- দিন শেষে এর তো একটা কালেক্টিভ ওপেনিয়ন প্রয়োজন। একটা সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি ইউনিটি বা আলাপ-আলোচনা না থাকে, সরকারের সঙ্গে যদি রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝাপড়া না থাকে তাহলে এটা সম্ভব নয়। এ জন্য আমরা বলছি, এখনো সুযোগ আছে। ২১ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের কাঠামো দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব নয়। এটাকে আরও বাড়ানো দরকার। একুশের জায়গায় যদি ৩১ হয় সরকারের লস আছে? আপনার লস আছে, আমার লস আছে? নেই তো। তাহলে এখানে আট-দশটা রাজনৈতিক দল থেকে আট-দশজন রাজনৈতিক নেতা নেওয়া যেতেই পারে। তাহলে তাদের সাপোর্টটা সরকারের প্রতি থাকবে। তখন সরকার স্মুথলি কাজ করতে পারবে।
 
খবরের কাগজ: বিএনপি কি আপনার এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত?
নুরুল হক নুর: আমি জানি না বিএনপির অবস্থানটা কী? কারণ বিএনপিকে আমরা এ বিষয়ে কখনো জিজ্ঞেস করিনি। বিএনপির সঙ্গে আমাদের অত্যন্ত ভালো বোঝাপড়া আছে। আমরা বিএনপিকে কখনো বলিনি। সরকারে যারা আছে তাদের বলেছি। পাবলিকলি অনেকবার বলেছি। বিএনপি তো বলছে, তারেক রহমান জাতীয় সরকার করবেন। 
খবরের কাগজ: বিএনপি আপনাকে নির্বাচনি এলাকায় নির্বিঘ্নে কাজ করার জন্য সহযোগিতা করছে। নির্বাচনের সময় রিলেশনটা কেমন থাকবে? একসঙ্গে নির্বাচন করবেন? 

নুরুল হক নুর: আওয়ামী ফ্যাসিবাদ পতনের এক দফা দাবিতে একসঙ্গে যে আন্দোলন করেছিলাম, সেই ইউনিটি ধরে রাখা বিএনপির জন্য জরুরি। বিএনপি একটা বড় রাজনৈতিক দল। সরকার গঠন করলে তারাই বেনিফিটেড হবে। ছোট দলগুলোকে নিয়ে যদি বিএনপি একটা জাতীয় সরকার গঠন করতে পারে সেটা দেশ-বিদেশে পরিচিতি পাবে। 
আমাদের পরিষ্কার কথা যে, হাসিনা সরকারের কাছে মাথা বিক্রি করে আমরা রাজনীতি করিনি। আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে কিংবা নতজানু হয়ে গণ অধিকার পরিষদ কিংবা পরিষদের নেতারা রাজনীতি করবে না। যেখানে আমাদের মূল্যায়ন হবে, আমাদের মর্যাদা থাকবে চিন্তাভাবনা করে সেখানে আমরা এগোব।
খবরের কাগজ: ধন্যবাদ।
নুরুল হক নুর: আপনাকেও ধন্যবাদ।