ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের পর থেকে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ফেডারেল সরকার ব্যবস্থায় কেন্দ্র ও বাংলাসহ সব প্রদেশ বা রাজ্য পর্যায়ে আইনসভার সাধারণ নির্বাচন দৃশ্যমানভাবে সূচিত হয়েছিল। নির্বাচন উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করা।
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের যে পদ্ধতি কয়েক শতাব্দী যাবৎ অনুসৃত হয়ে আসছে, ইরেজিতে যাকে বলা হয় First Past The Post (FPTP)। এর সঠিক বাংলা নেই। ঘোড়দৗড়ের পদ্ধতি থেকে কথনটি এসেছে। এই পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে কোনো একটি নির্বাচনি কেন্দ্রে একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকলে প্রদত্ত ভোটের মধ্যে যিনি সর্বাধিক ভোট পাবেন তিনি নির্বাচিত ঘোষিত হবেন। আধুনিক গণতন্ত্রে এটিই ছিল দীর্ঘ অনুসৃত পদ্ধতি।
বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে নির্বাচনের এই পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়েছে। পরিবর্তিত এমন একটি পদ্ধতির নাম হচ্ছে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি। ইংরেজিতে যাকে Proportional Representation (PR) System বলা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যক্তি-প্রার্থীদের মধ্যে হয় না। নির্বাচন হয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে।
মনে করুন, বিদ্যমান পদ্ধতিতে বাংলাদেশে ৩০০টি আসনে ১৫০০-১৭০০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। পিআর পদ্ধতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে নিবন্ধিত কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে। ৩০০টি নির্বাচনি কেন্দ্র থাকবে না। বাংলাদেশ হবে একটি একক নির্বাচনি কেন্দ্র। নির্বাচনে যে দল মোট প্রদত্ত ভোটের মধ্যে যত শতাংশ ভোট পাবেন সেই অনুপাতে সংসদে আসন লাভ করবেন।
যেমন ‘ক’ দল মোট প্রদত্ত ভোটের ৫০% ভোট পেলে আসন পাবে ৫০×৩ =১৫০টি, ‘খ’ দল ৪০% ভোট পেলে আসন পাবে ৪০×৩ =১২০টি, ‘গ’ দল ৫% ভোট পেলে আসন পাবে ৫×৩ =১৫টি এবং ‘ঘ’ দল ৫% ভোট পেলে আসন পাবে ৫×৩ =১৫টি। এভাবে সংসদের ৩০০টি আসন পূরণ হবে। এটিই হচ্ছে পিআর পদ্ধতির সাধারণ ফর্মুলা। কোনো একটি দল যদি দশমিক ৩৪% ভোট পেয়ে থাকে, তা হলে তার আসন হবে মাত্র ১টি। ১৮৯৯ সালে বেলজিয়াম এই পদ্ধতি প্রথম প্রবর্তন করে। অধুনা বিশ্বের প্রায় ১০০টির অধিক দেশ কোনো না কোনো ধরনের PR পদ্ধতি অনুসরণ করছে।
বলা আবশ্যক, আদি FPTP পদ্ধতিতে নির্বাচনি এলাকায় এবং কেন্দ্রে ভোট অনুষ্ঠানে যেকোনো পন্থায় নির্বাচিত হওয়ার চেষ্টা বা অপচেষ্টায় যে ধরনের বিভিন্ন অপকর্ম, সহিংসতা ইত্যাদির চর্চা হতো PR পদ্ধতি তা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়ে থাকবে।
PR পদ্ধতির অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে, এখানে নির্বাচনি অনিয়ম, অপকর্ম, সহিংসতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়ে থাকে। নির্বাচনি কর্মকর্তারা, পুলিশ বা প্রশাসনকে অবৈধ অর্থ দিয়ে পক্ষাশ্রিত করা সম্ভব হয় না। একই প্রার্থীর একাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ থাকে না। কোনো প্রার্থীর মৃত্যুজনিত কারণে উপনির্বাচনের প্রয়োজন হয় না।
নারীদের সংরক্ষিত আসনে ভিন্নভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান আবশ্যক হবে না। নমিনেশন দাখিল কেন্দ্রীয়ভাবে হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় একটি রাজনৈতিক দল ২২% ভোট পেয়ে এবং অবশিষ্ট ৭৮% ভোটারের সমর্থন ব্যতিরেকে সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করতে পারে। PR পদ্ধতিতে এটি কখনোই সম্ভব হবে না।
বিদ্যমান পদ্ধতিতে ৬০% ভোটারের সমর্থন ব্যতিরেকে কেবল ৪০% ভোটারের সমর্থনেই ৩০০টি আসন পূরণ সম্ভব। PR পদ্ধতিতে ১০০% ভোটারের সমর্থনে সরকার গঠিত হোক বা না হোক, ১০০% ভোটারের সমর্থনেই সংসদ পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত হবে। অর্থাৎ প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে ১০০% ভোটার, সংখ্যা যদি ৮ কোটিও হয়, তাদের সবাই সংসদের অভ্যন্তরে প্রতিনিধিত্বপ্রাপ্ত হবেন।
PR পদ্ধতিতে নির্বাচনি ব্যয় অনেক হ্রাস পাবে। এই পদ্ধতিতে নারীদের জন্য অমর্যাদাকর লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যমূলক ৫০/৬০টি আসন ভিন্নভাবে সংরক্ষিত রাখার প্রয়োজন হবে না। যদি মনে করা হয়, ৩০০টি আসনের মধ্যেই নারীদের জন্য অনূর্ধ্ব ৬০টি আসন ব্যবস্থিত থাকবে, তা হলে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে আইন দ্বারা বাধ্য করা যাবে যে নির্বাচন কমিশনের কাছে দলের পক্ষে দাখিল করা তালিকায় প্রতি ১০ জনের প্রথম ২ জন বা শেষ ২ জন নারী হবেন।
তা হলে সে দলের পক্ষে নারী প্রার্থী হবেন ৩০০ জনের মধ্যে ৬০ জন। ১৯৭২ সালের ৭.৫০ কোটি মানুষের বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৮ কোটি মানুষ। এমন বিবেচনায় সংসদের আসনসংখ্যা ৩৫০-৪০০-তে বর্ধিত করা যেতে পারে।
PR পদ্ধতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আগ্রহী রাজনৈতিক দল প্রার্থীদের তালিকা ওপেন লিস্ট বা ক্লোজড লিস্ট আকারে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করতে পারে। ওপেন লিস্টে ভোটার সাধারণ এবং দলের সদস্যরা আগেই জেনে যাবেন দলের প্রার্থী কারা। এর ভালো-মন্দ উভয় দিকই আছে। জনগণের জন্য ভালো, তারা প্রার্থীদের গুণাগুণ আগাম বিশ্লেষণ করে দলের সক্ষমতা নির্ধারণ করতে পারবেন।
মন্দ দিক হলো, দলের অভ্যন্তরে এতে অনাকাঙ্ক্ষিত কোন্দল-রেষারেষি হতে পারে। ক্লোজড লিস্টের সুবিধা হচ্ছে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার আগে দলের প্রার্থী কারা ছিলেন তা গোপন থাকবে। ফলে দলের ভেতর সম্ভাব্য কোন্দল বা রেষারেষি পরিহার করা সম্ভব হবে। নির্বাচন সহজ, শান্তিপূর্ণ ও অবাধ হবে।
PR পদ্ধতিতে অনেক সময় কোনো দলের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ (১৫০টির অধিক) আসন লাভ করে এককভাবে সরকার গঠন করা সম্ভব না-ও হতে পারে। এটি খুব কঠিন জটিল বিষয় নয়। প্রয়োজনে কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করতে হবে।
কোয়ালিশন সরকার গঠন সম্ভব না হলে তাৎক্ষণিক সংসদ ভেঙে না দিয়ে সর্বোচ্চসংখ্যক আসনপ্রাপ্ত দলকে অবিলম্বে সরকার গঠনের অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে। এতে শূন্যতার তাৎক্ষণিক সংকট পরিহার করা যাবে। সংখ্যালঘু দল কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে না পারলে ২-৩ বছর পর একই পদ্ধতিতে আবার সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে।
সরকার গঠন এবং আইন পাস বা বিভিন্ন অনিবার্য উদ্দেশ্যে সংখ্যালঘু দলকে Legal Fiction-এর মাধ্যমে ধারণাভিত্তিকভাবে (Deemed) ১৫১টি আসন প্রাপ্ত মর্মে সাময়িকভাবে গণ্য করা যেতে পারে। সাময়িক এমন ব্যবস্থা সংবিধান বা যথোপযুক্ত আইনি বিধান দ্বারা করা যেতে পারে।
স্বাধীন ভারতে বিগত ৭৫ বছরে কোনো সামরিক শাসন বা গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতন হয়নি। গণতন্ত্রের চর্চা ছিল নিরবচ্ছিন্ন। স্বাধীন পাকিস্তান অতঃপর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবাধ চর্চা মূলত কখনোই হয়নি। ১৯৭৪-এ বাকশাল, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, ৭ নভেম্বর বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব হয়েছে। সংবিধান অকার্যকর হয়েছে।
১৯৮১ সালে আবারও সামরিক অভ্যুত্থানে গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হলো। ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতন হয়েছিল। সংবিধান অকার্যকর হয়েছিল। ১৯৯৬-এর গণ-অভ্যুত্থানেও অসাংবিধানিক পদ্ধতিতেই সরকার পতন হয়েছিল। পুনর্বার নির্বাচন হয়েছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসাংবিধানিক অবস্থানকে পরবর্তী সময় অনুমোদন করে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হয়েছিল।
দুটি নির্বাচন সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অধিক স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। ২০০৭ সালে আবারও গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতন হয়েছিল। কথিত সেনাসমর্থিত বেসামরিক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। একটি নির্বাচন ছাড়া কাজের কাজ আর কিছুই করতে পারেনি।
আসলে দুর্ভেদ্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছাড়া জনপ্রত্যাশিত অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন কঠিন। ইতিহাস তাই বলে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান হবে। স্বৈরাচারের পতন হবে। পৌরাণিক ফিনিক্স পাখির মতো ভস্ম থেকে সে আবার উঠে আসবে। আমার কথা নয়। জনৈক ব্রিটিশ মনীষী বলেছিলেন, Greatest lesson of history is that people do not learn from history.
অনেকেই বলছেন, নির্বাচনব্যবস্থাকে আমূল ঢেলে সাজাতে হবে, সংস্কার করতে হবে। আমার অভিমতে প্রথমে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা বন্দোবস্তে মৌলিক পরিবর্তন ও সংস্কার প্রয়োজন হবে। তাহলে নির্বাচনব্যবস্থা সেই আদলে অনিবার্যভাবেই পরিবর্তিত হবে। Proportional Representation (PR) System কার্যত নির্বাচন পদ্ধতি নয়।
এটি পার্লামেন্ট বা সংসদে আসন বণ্টনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিত্বকে সর্বজনীন করার লক্ষ্যে উদ্ভাবিত একটি উন্নততর পদ্ধতি। PR পদ্ধতি প্রবর্তিত হলে নির্বাচন পদ্ধতি সেই ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে শুধরে নিয়ে অনুসরণ করবে। বলা প্রয়োজন, জনঘন বাংলাদেশের জনগণের সমজাতীয়তা বা সমরূপতা (homogeneity) দেশের রাজনীতি ও নির্বাচনে PR পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য অত্যন্ত অনুকূল।
বর্তমান FPTP পদ্ধতির নির্বাচনে ভোটেকন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেওয়া, ব্যালট বাক্সে ব্যালট জোর কর প্রবিষ্ট করা, কালোটাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার হয়ে থাকে। নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতালাভের মাধ্যমে বিপুল অর্থসম্পদ উপার্জনের মনস্তত্ত্ব এ ক্ষেত্রে প্রার্থীদের মধ্যে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে।
দলীয় সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে পুলিশ ও প্রশাসনকে দিয়ে নির্বাচন প্রভাবিত করার চেষ্টা হয়ে থাকে। এ কারণেই রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতেই একদা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। মূলত সরকার সরাসরি না করলেও সরকারদলীয় প্রার্থীরা স্থানীয়ভাবে প্রবল শক্তিধর হয়ে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এটি বাস্তবতা।
এটি দীর্ঘ অপচর্চার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক অপশক্তির অর্জিত এক ধরনের প্রতিষ্ঠিত নষ্ট ঐতিহ্য। নির্বাচনে এমন অপচর্চা শুধু বাংলাদেশেই নয়। দেশে দেশে হচ্ছে। সম্প্রতি কেনিয়া, ভেনেজুয়েলাসহ আফ্রিকার আরও কয়েকটি দেশে নির্বাচন-উত্তর অবিশ্বাস, অনাস্থা, বিক্ষোভ, সহিংসতা দেখা গেছে। বাংলাদেশে অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত কার্যকর সংস্কার ও পরিবর্তন অনিবার্যভাবে প্রয়োজন।
লেখক: প্রধান নির্বাচন কমিশনার
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন