মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড় থেকে সরে আসার ছয় সপ্তাহের মধ্যে নতুন ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস আমেরিকান ভোটারদের কাছে নীতিগত বিষয়ে তার নিজস্ব মতামত প্রকাশ করার জন্য কিছু সময় পেয়েছেন। গাজা যুদ্ধ এবং ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কতটুকু সমর্থন আছে, তার অবস্থান প্রকাশ করেছেন।
জো বাইডেন প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আগে ডেমোক্র্যাটরা এবং কিছু স্বাধীনচেতা ভোটার ইসরায়েলের প্রতি প্রেসিডেন্টের নিঃশর্ত সমর্থনের কারণে তার বিরোধিতা করেছিলেন। এটা তার নির্বাচনি প্রচারে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। একটি আন্দোলন দেখিয়েছিল যে, ইসরায়েলের প্রতি জো বাইডেনের সমর্থন তার নির্বাচনের পথে বড় দায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ভোটাররা তাদের মূল্যবান ভোট উপযুক্ত কাজে লাগাতে চেয়েছেন। তারা ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করতে তাদের ভোট ব্যবহারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু মিশিগানের মতো গুরুত্বপূর্ণ সুইং স্টেটগুলোতে, যেখানে মাত্র কয়েকটি ভোট নির্বাচন নির্ধারণ করতে পারে, তারা প্রভাব অর্জন করেছে।
ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিস জটিল অবস্থানে রয়েছেন। কারণ তাকে অবশ্যই প্রার্থী হিসেবে তার নিজস্ব মতামত উপস্থাপন করার সময় বাইডেনের নীতির সঙ্গে কিছুটা থাকতে হবে। তিনি নির্বাচনে জয়ী হলে অবশ্যই ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরিবর্তনের পরামর্শ দেবেন। তিনি জো বাইডেনের নীতির প্রতি আনুগত্যে ও ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করবেন। তিনি ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রতি অঙ্গীকার প্রকাশ করেছেন এবং ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের জন্য আরও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
কমলা হ্যারিস যখন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনীত হন, তখন অনেক কর্মী ও ভোটার আশা করেছিলেন যে, তিনি মার্কিন নীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারেন। বিশেষ করে ইসরায়েলে অস্ত্র পাঠানো বন্ধে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। হ্যারিস ইতোমধ্যে চলতি বছরের শুরুতে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। তবে কর্মীরা অনুভব করেছিলেন যে, জো বাইডেন থেকে তার অবস্থানকে আলাদা করার জন্য তাকে আরও স্বতন্ত্র কিছু করতে হবে।
গত কয়েক সপ্তাহে কমলা হ্যারিস ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ সম্পর্কে তার মতামত স্পষ্ট করার কয়েকটি সুযোগ পেয়েছেন। একটি সুযোগ ছিল গণতান্ত্রিক জাতীয় সম্মেলন। কর্মীরা বর্ণনা করেছেন যে, হ্যারিস তার প্রচারণায় তাদের কথাই শুনছেন, যাদের জো বাইডেন ও তার দল উপেক্ষা করেছিল। হ্যারিস তার বক্তৃতার সময় গাজা যুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছেন এবং যুদ্ধবিরতি চুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কমলা হ্যারিস বলেন, ‘গত ১০ মাসে গাজায় যা ঘটেছে তা খুবই ধ্বংসাত্মক। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অনেক পর্যবেক্ষক অবাক হয়েছিলেন যে, হ্যারিস সরাসরি একটি বিতর্কিত বিষয় নিয়ে স্পষ্টভাবে কথা বলছেন। এই বিষয়টি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জনগণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গির লক্ষণ হিসেবে দেখেছেন।
গত ২৯ আগস্ট সিএনএনকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন কমলা হ্যারিস। সিএনএনের হোস্ট তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি ইসরায়েলের অস্ত্রের কিছু চালান আটকাবেন কি না? তখন কমলা এই প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। বরং তিনি কনভেনশনে বক্তৃতায় বলেন, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষার বিষয়টি তিনি দেখবেন।
তবে ইসরায়েল কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবে এটা তাদের বিষয়। প্রশ্ন হলো, ফিলিস্তিনের এত নিরপরাধ মানুষকে তারা কীভাবে হত্যা করল? তিনি গাজা যুদ্ধ বন্ধে একটি চুক্তির আহ্বান করেছেন। তিনি ‘দ্বি-রাষ্ট্র’ সমাধানের দিকে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যেখানে ইসরায়েল নিরাপদ থাকবে এবং ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মর্যাদা বজায় থাকবে।
কমলা হ্যারিসের মন্তব্যগুলো থেকে বোঝা যায়, তিনি ইসরায়েলের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থনের জায়গা থেকে দূরে সরে এসেছেন। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতাদের মধ্যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিয়েছেন। কয়েক বছর ধরে তরুণ আমেরিকান ভোটারদের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি দেখা যাচ্ছে।
গাজায় ধ্বংসের শেষ মুহূর্তে এসে কিছুটা পরিবর্তন ও আশা দেখা দিয়েছে। ডেমোক্র্যাটিক ভোটাররা মার্কিন নীতির পরিবর্তন চায়। সিবিএসের এক জরিপে দেখা গেছে, ৭৭ শতাংশ ডেমোক্র্যাট বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসরায়েলে অস্ত্র পাঠানোকে সমর্থন করেন না।
ভোটারদের মধ্যে এই বড় পরিবর্তনের বিষয়টি দলের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে পুরোপুরি পৌঁছায়নি। কারণ, এ ধরনের নেতারা বিশেষ করে বয়স্ক আমেরিকানদের ইসরায়েলপন্থি ঐকমত্য বজায় রাখার প্রতি আগ্রহ বেশি। অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারকরা এমন চিন্তা ধারণ করেন যে, ইসরায়েলের সমালোচনা করলে নির্বাচনে হারার আশঙ্কা থাকে। কমলা হ্যারিসের প্রচারাভিযানে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, গাজায় মার্কিন অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, যা গণহত্যার শামিল।
জো বাইডেন থেকে হ্যারিসের গাজা সম্পর্কে যে পরিবর্তন, তা উদ্বিগ্ন ভোটারদের ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থীকে ভোট দিতে উৎসাহিত করবে কি না, সেটাই মূল বিষয়। অনেকে এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। আমেরিকায় অনেক ভোটার আছেন যারা গাজা যুদ্ধের বিরোধিতা করেন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয় নিয়েও অনেকে উদ্বিগ্ন। তারা বিশ্বাস করেন, কমলা হ্যারিস ডোনাল্ড ট্রাম্প বা জো বাইডেনের চেয়ে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি আরও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নেবেন।
ফিলিস্তিনি, আরব এবং মুসলিম আমেরিকানরা যারা আছেন, তারা এমন কাউকে ভোট দেবেন না, যে কিনা ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করতে মার্কিন সম্পদ ব্যবহার করবে। এই ভোটারদের মধ্যে খুব কমই ট্রাম্পকে ভোট দেবেন। বরং তারা তৃতীয় পক্ষের প্রার্থীকে ভোট দেবেন বা হ্যারিসকে ভোট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত বেছে নেবেন।
ডেমোক্র্যাটরা ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন সমর্থনের বিষয়টি যেভাবে অনুমোদন করেছিলেন, কমলা হ্যারিস তা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছেন। তিনি এ বিষয়ে কর্মীদের সঙ্গে আপস করতে নারাজ। তিনি সেই সব ভোটারের সমর্থন পাওয়ার জন্য যথেষ্ট পদক্ষেপ নেননি। দুর্ভাগ্যবশত আগামী দিনে গাজা এবং পশ্চিম তীর রক্তাক্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইসরায়েলের জন্য ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন এবং ইসরায়েলের সামরিক পদক্ষেপ বন্ধে কমলা হ্যারিস শক্ত পথে হাঁটছেন এবং আরও কঠিন হবেন।
লেখক: আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও
সাবেক উপপরিচালক, অক্সফোর্ড অ্যানালিটিকা
আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল