১৫ বছরের স্বৈরাচারী ও কর্তৃত্ববাদী শাসনে অর্থনীতি পরিচালিত হওয়ার পর তরুণদের নেতৃত্ব এবং জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা এসেছে। এমন পরিবর্তনের সম্ভাবনা এর আগেও এসেছিল ১৯৭২ এবং ১৯৯০ সালে। রাজনৈতিক দলের বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণার কারণে সেই দুটি সুযোগের কোনোটিই কাজে লাগানো যায়নি।
এবার কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসেনি। তাই প্রত্যাশার পাশাপাশি আমরা আগের সময়ের ব্যর্থতাকে স্মরণ করি। এখন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানি। কিন্তু এই সরকারের প্রাথমিক দায়িত্বগুলোও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। এই সরকার একটি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। এই সরকারের পেছনে জনগণের সমর্থন রয়েছে। বড় পরিবর্তনের জন্য এই সরকারের তাই অনেক দায়িত্ব রয়েছে। এই সরকার আগামী এক বা দুই মাসে কী করতে পারে তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করছি।
গত ১৫ বছরে ব্যাপক দুর্নীতি, অসংলগ্ন চুক্তি, ব্যাংক ডাকাতি, ঋণখেলাপি এবং মেগা প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে। এই সরকারের প্রথম যে কাজটি করা উচিত তা হলো এসব বিষয়ে সব তথ্য প্রকাশ করা। অন্তর্বর্তী সরকার এখন ক্ষমতায় রয়েছে, তাই তাদের উচিত সবকিছুতে স্বচ্ছতা নিয়ে আসা।
জুলাই-আগস্টের কয়েক সপ্তাহে আমরা যে হত্যাকাণ্ড ও দমন-পীড়ন প্রত্যক্ষ করেছি তার তদন্ত খুব দ্রুত যথাযথভাবে করে দায়ী ব্যক্তি ও সংস্থাগুলোকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করা উচিত। বাংলাদেশে এ ধরনের গণহত্যা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
বিগত সরকারের আমলে নেওয়া বিপুল পরিমাণ ঋণ বিশ্লেষণ করা উচিত। বাংলাদেশে এত উচ্চমাত্রার বৈদেশিক ঋণ এর আগে কখনো ছিল না। সব চুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্তদের শনাক্ত করা ও বড় চুক্তিগুলোর বিশদ বিবরণ অবশ্যই জনসমক্ষে আনতে হবে।
বাংলাদেশের জনগণ এসব ব্যয়বহুল চুক্তি সম্পর্কে কিছুই জানে না। অথচ জনগণকেই এই ঋণ শোধ করতে হবে। এমনভাবে কাজ করা দরকার যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের চুক্তির বিবরণ লুকানো সম্ভব না হয়। কোনো ঋণ নেওয়া বা চুক্তি করা হলে তা অবশ্যই সর্বজনীনভাবে প্রকাশ করা উচিত। কারণ জনগণকেই ঋণ পরিশোধের ভার বহন করতে হয়।
অনেক মেগা প্রকল্প রয়েছে, যেগুলোকে গত এক দশকে সরকারের অর্জন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তবু সেগুলোর অনেকই এখন বিপর্যয়কর, অনির্ভরযোগ্য ও ঝুঁকিপ্রবণ, যা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এই মেগা প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করা এই সরকারের দায়িত্ব। উদাহরণস্বরূপ রামপাল প্রকল্প সুন্দরবন ধ্বংস করার ঝুঁকি বহন করছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষাকারী আমাদের একমাত্র বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। কেন এই প্রকল্প ক্ষতিকর এবং হুমকিস্বরূপ তা নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা ও বিশ্লেষণ হয়েছে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে। এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে এক দশক ধরে জনগণ আন্দোলন করেছে। একটি নির্দিষ্ট প্রকল্পের বিরুদ্ধে পরিবেশ সুরক্ষার জন্য দীর্ঘতম আন্দোলন হয়েছে এবং সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ সমর্থন করেছে।
রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র আমাদের অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি। বন এবং নদীবেষ্টিত এমন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এর মতো আর কোনো পারমাণবিক কেন্দ্র বিশ্বের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ ধরনের পারমাণবিক প্ল্যান্টের ঝুঁকি যদি কখনো বাস্তবে পরিণত হয়, তাহলে কোটি কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। এমনকি এ ধরনের একটি প্রকল্পের পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও দেশকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে।
তাই রামপাল, রূপপুর, বাঁশখালীর মতো প্রকল্পগুলো বাতিল করতেই হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এই প্রকল্প বাতিলের জন্য কাগজপত্র ও আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে। এখন সবার মনে একটা প্রশ্ন জাগতে পারে, ‘যেহেতু আমরা ইতোমধ্যেই এই প্রকল্পগুলোর জন্য ঋণ নিয়েছি এবং অনেক টাকা খরচ করেছি, তাহলে এটা কি বড় আর্থিক ক্ষতি হবে না?’ যে ঋণ জনগণের স্বার্থবিরোধী, সেই ঋণ পরিশোধের দায় জনগণের ওপর বর্তায় না। এই আইন বা কনভেনশন ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিকভাবে বিদ্যমান এবং সরকার এটি ব্যবহার করতে পারে।
এমনকি যদি আমরা সেই ছাড় নাও পাই, তার পরও যদি আমাদের এই ঋণ পরিশোধ করতেই হয়, তবু আমি বলব, এই প্রকল্পগুলো চালু রাখার চেয়ে বাতিল করা অনেক বেশি উপকারী হবে।
জ্বালানি খাত বাংলাদেশে ব্যাপক দুর্নীতির ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এই সেক্টরে বড় আকারের ক্ষতি করার জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান লাখ লাখ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কিছু বেসরকারি কোম্পানি।
বাংলাদেশে সামিট, বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, ইউনাইটেডের মতো বহু প্রতিষ্ঠান এই দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থাপনা থেকে লাভবান হয়েছে। ভারতের এনটিপিসি এবং আদানি ও আম্বানি, রাশিয়ার রোসাটম ও গাজপ্রম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন ও কনোকো ফিলিপস এবং চীনের চায়না পাওয়ারের মতো প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য ও ক্ষতিকর প্রকল্প থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করা আবশ্যক।
গত দেড় দশক ধরে সম্পূর্ণরূপে বিদেশি পরামর্শদাতাদের তৈরি মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত চলছে। আমাদের এটি প্রত্যাখ্যান করতে হবে। যেসব প্রকল্প পরিবেশগত বিপর্যয়, প্রকৃতির জন্য ধ্বংসাত্মক, আমদানিমুখী এবং বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত, সেগুলো বাতিল করতে হবে।
পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ, দুর্নীতিমুক্ত নীতি ও প্রকল্প গ্রহণ খুবই সম্ভব। এতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম কমবে এবং পরিবেশগত হুমকি দূর হবে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধানে সক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে জোর দিয়ে আমরা এটি অর্জন করতে পারি। অন্তর্বর্তী সরকারকে এই যাত্রা শুরু করতে হবে।
সর্বজনের অধিকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, যা অবহেলিত হয়েছে। প্রধান ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে: সর্বজন শিক্ষা, সর্বজন স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং গণপরিবহন। এসব খাত প্রান্তিক হয়ে পড়েছে। অত্যন্ত কম বাজেট এবং উচ্চ অনিয়ম শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে অনেক দিন ধরেই প্রকট হয়ে আছে। সরকার বিশ্বব্যাংকের এমন নব্য উদারনীতি অনুসরণ করে যা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাকে মুনাফা সর্বাধিক করার জন্য বেসরকারি খাতের দিকে ঠেলে দেয়।
গণপরিবহন কিছু অপরাধকারী মাস্টারমাইন্ডের হাতে নিয়ন্ত্রিত। ২০১৮ সালের শিক্ষার্থীদের সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনের চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। এই সরকারকে অবশ্যই এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য কাজ করতে হবে এবং বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য একটি ভিত্তি স্থাপন করতে হবে, যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশ সম্ভব।
সংবিধান সংস্কারের আলোচনা শুরু করতে হবে। এটা কীভাবে অত্যন্ত বৈষম্যমূলক, স্বৈরাচারী এবং জনবিরোধী হয়ে উঠেছে, তা চিহ্নিত করতে হবে। কীভাবে জনগণের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর এক হাতে এত ক্ষমতা কেন? সংবিধানে লিঙ্গ, শ্রেণি, জাতিগত, ধর্মীয়সহ সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য থাকার পরও একই সংবিধানে বিপরীত ধারা থাকার কারণে এই প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করা সম্ভব হয়নি।
সর্বজনের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পাশাপাশি ভিআইপি সংস্কৃতি সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করতে হবে। সরকারি অফিসগুলো সর্বজনের জন্য সহজ ও মসৃণ হওয়া উচিত। এ ছাড়া সরকারি দপ্তরের সব কাজের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা থাকতে হবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ