২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে জো বাইডেনের প্রার্থিতা প্রত্যাহার এবং ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস মনোনয়ন পাওয়ার পর কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে এসেছে। কমলা হ্যারিসের পররাষ্ট্রনীতি বাইডেনের নীতি থেকে কি দূরে সরে যাবে?
বাইডেন আমাদের প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও পররাষ্ট্রনীতিতে বিজ্ঞ প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেছিলেন। তিনি সিনেটের আন্তর্জাতিক বিষয়-সম্পর্কিত কমিটির দীর্ঘদিনের সদস্য ছিলেন। তিনি কয়েক দশক ধরে জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন। তার পর বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক উদ্যোগের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কমলা হ্যারিসের পররাষ্ট্রনীতি-সম্পর্কিত জ্ঞান, প্রসিকিউটর, স্টেট অ্যাটর্নি জেনারেল, প্রথম মেয়াদের সিনেটর- সবকিছু মিলে তুলনামূলকভাবে বিরল অবস্থানে রয়েছেন।
কিন্তু ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার চার বছর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিকে ভালো অবস্থানে রয়েছে, যা খুব কম ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকানের আছে। তিনি প্রতিদিন সকালে প্রেসিডেন্টের ব্রিফ পেয়েছেন। রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে বাইডেনের বেশির ভাগ বৈঠকে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন।
জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তিনি প্রেসিডেন্টের রুমে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ২০টির অধিক দেশে ভ্রমণ করেছেন, ১৫০-এর বেশি বিদেশি নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সসহ অনেক প্রধান প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।
করোনা মহামারি, আফগানিস্তান থেকে যুদ্ধ প্রত্যাহার, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ, চীনের মতো বড় শক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতা তীব্র হওয়া, সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ এবং অসংখ্য ছোট ছোট সংকটের মধ্য দিয়ে মার্কিন মিত্র ও অংশীদাররা তাকে একটি স্থির ও সক্ষম হাতিয়ার হিসেবে দেখছে। কমলা হ্যারিসকে যারা কয়েক দশক ধরে চেনেন ও পছন্দ করেন, তারা অবশ্যই তাকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে অনেক বেশি সক্ষম ও নির্ভরযোগ্য প্রার্থী বলে মনে করেন।
তার বিশ্বদর্শন ও নীতিগুলো কি বাইডেনের নীতির সঙ্গে তুলনা করা যায়? তাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। জো বাইডেনের বয়স ৮১। ফলে যুদ্ধ করার মতো তার সেই বয়স ও মানসিকতা নেই। তার বিশ্বদর্শনে পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। তিনি ‘আমেরিকান ব্যতিক্রমবাদে’ দৃঢ় বিশ্বাসী।
তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে সাদা ও কালোর মতো করে দেখেন। তিনি গণতন্ত্র এবং স্বৈরাচারের মধ্যে সংগ্রাম দেখছেন। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব সময় ভালোর পক্ষে এক বড় শক্তি। তিনি রাজনীতিতে ‘মহা মানুষ’ তত্ত্বে বিশ্বাসী যারা বিশ্বাস করেন যে, তার মতো রাষ্ট্রনায়করা ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করে এবং ইচ্ছাশক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ঘটনার গতিপথ পরিবর্তন করতে পারেন।
অন্যদিকে ৫৯ বছর বয়সী কমলা হ্যারিস স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বেড়ে ওঠেন। যেখানে আমেরিকান আধিপত্যের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল দেশে এবং বিদেশে তার আদর্শকে সমুন্নত রাখা। একজন প্রসিকিউটর হিসেবে তার ইচ্ছা হলো দেশের বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিকভাবে না করা।
আইনের শাসন এবং আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে বিচার করা। যেসব দেশ গণতান্ত্রিক নয়, তাদের সঙ্গে আমেরিকার যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। আমেরিকার নিজেদেরও গণতান্ত্রিক সমস্যা রয়েছে। তিনি জো বাইডেনের ‘গণতন্ত্র বনাম স্বৈরাচার’ কাঠামোকে কপট ও অবাস্তব বলে মনে করেন।
যদিও কমলা হ্যারিস বাইডেনের সঙ্গে একমত যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সার্বিক মঙ্গলের পথে থাকে এবং বড় শক্তি। তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি নিয়ে সব সময় সতর্ক এবং একতরফা হস্তক্ষেপের ওপর বহুপক্ষীয় পদ্ধতির পক্ষে থাকেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, উদাহরণের মাধ্যমে নেতৃত্ব দেওয়া হলো আমেরিকার পক্ষে আরও বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং বহুমুখী বিশ্বে ক্ষমতা প্রয়োগের সবচেয়ে কার্যকর উপায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছে। তার পরও আধিপত্য বিস্তারে তাদের ক্ষমতা, ইচ্ছা এবং বৈধতার অভাব রয়েছে।
বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে এমন বৈপরীত্য হলে নীতিতেও কিছুটা পরিবর্তন আসে। ধারাবাহিকতা হলো চীনের প্রতিদিনের কাজ। গত মাসের শেষের দিকে একটি বৈঠকে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে স্পষ্টভাবে আশ্বস্ত করেছেন।
বাইডেন এবং হ্যারিস যেখানেই সহযোগিতা সম্ভব, সেখানে চীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে একমত। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা-সম্পর্কিত বিষয়ে মিত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষপাতী। তাদের মধ্যে নীতিতে কোনো পার্থক্য নেই, শুধু কৌশলের ক্ষেত্রে তাদের পার্থক্য থাকতে পারে।
ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিস আমেরিকার ইন্দো-প্যাসিফিক সম্পর্ককে খর্ব করার জন্য যথেষ্ট প্রচেষ্টা করেছেন। এশিয়ায় চারবার ভ্রমণ করেছেন এবং ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়রের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করেছেন। তার প্রশাসন একতরফা পদক্ষেপের (যেমন- শুল্ক, নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা) চেয়ে জোট গঠনকে অগ্রাধিকার দেবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের গল্পটা একটু ভিন্ন। হ্যারিস এবং বাইডেন ইউক্রেনকে সমর্থন করলেও তাদের মধ্যে ভিন্নতা আছে। হ্যারিস এই দ্বন্দ্বটিকে আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন, রাশিয়াকে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘনের ওপর জোর দিয়েছিলেন। বাইডেন এটিকে নৈতিক দৃষ্টিতে দেখেন।
তিনি এটিকে গণতন্ত্র এবং স্বৈরাচারের মধ্যে দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখছেন। এই অন্তর্নিহিত পার্থক্য পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নীতির ভিন্নতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। যদিও কমলা হ্যারিস দ্বিপক্ষীয় যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নেবেন। তবে তিনি বাইডেনের চেয়ে একটু ব্যতিক্রমী, কারণ তার সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুটি বাইডেন এবং তার ভাইস প্রেসিডেন্টের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক নীতিবিভাজনকে নির্দেশ করে। কমলা হ্যারিস গাজা ও পশ্চিম তীরে আন্তর্জাতিক আইনকে ইসরায়েলের লঙ্ঘনের বিষয়টিকে অমানবিক হিসেবে দেখছেন। তিনি জো বাইডেনের চেয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে বেশি সমর্থন করেন। জো বাইডেন নামমাত্রভাবে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে ছিলেন। তবে তিনি ইসরায়েলের ডানপন্থি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রতি খুব বেশি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
যদিও হ্যারিস ইসরায়েলকে আমেরিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি দেবে এবং তার আত্মরক্ষার ক্ষমতা নিশ্চিত করবে, তিনি আইনের শাসন বজায় রাখার জন্য তার সরকারের ওপর আরও চাপ প্রয়োগ করবেন। ‘বিশেষ সম্পর্কের’ ক্ষেত্রে অতীতের প্রশাসন থেকে তিনি ভিন্নভাবে প্রতিনিধিত্ব করবেন। এ জন্য মার্কিন নীতি তার বেশির ভাগ মিত্রদের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হবে।
নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, কমলা হ্যারিসের আগামীতে বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা অনেক বাড়ছে। তার অনন্য বিশ্বদর্শন আন্তর্জাতিক মঞ্চে নেতৃত্বে স্বতন্ত্র রূপলাভ করা তীব্র সম্ভাবনা রয়েছে।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, ইউরেশিয়া গ্রুপ ও জিজিরো মিডিয়া এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সম্পর্কিত জাতিসংঘের উপদেষ্টা কমিটির নির্বাহী সদস্য।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল