ঢাকা ১৯ আশ্বিন ১৪৩১, শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফেরা জরুরি

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:২৮ পিএম
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফেরা জরুরি
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

দীর্ঘদিন থেকে দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। মূলত গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পর প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদে থাকা শিক্ষকদের পদত্যাগের কারণে এমন সংকট তৈরি হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও একই অবস্থা। আমার বিভাগে একাডেমিক কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকেই একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যেই অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে একই প্রক্রিয়ায় একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। উল্লেখ্য, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েই একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করেছে।

আমি কয়েক দিন থেকে লক্ষ করছি, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা খুব উৎসাহ নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। যদিও এখনো সব শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে ক্লাসে পাইনি। কোনো কোনো শিক্ষার্থী তৎকালীন সরকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণে তারা এখনো ক্লাসে ফিরতে শঙ্কায় রয়েছে। বাকি সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাসে আসছে। একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হলেও সেশনজটের একটি বড় শঙ্কা তৈরি হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মনে একধরনের অস্থিরতা রয়েছে। 

এ পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হওয়ার পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। কয়েক বছর আগে করোনার কারণে সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় তখন তৈরি হওয়া সংকট এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য, আমার বিভাগে এমন একটি একাডেমিক ব্যাচ রয়েছে, যাদের স্বাভাবিক একাডেমিক কার্যক্রম চালু থাকলে এক বছর আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই ব্যাচ প্রায় দুই থেকে তিন বছরের সেশনজটে পড়ে আছে। বর্তমানে তারা একাডেমিক এমন একটি পর্যায়ে আছে যে, স্বাভাবিক একাডেমিক কার্যক্রম চালু থাকলে তাদের মাস্টার্স শেষ করতে আরও প্রায় দুই বছরের বেশি সময় লেগে যেতে পারে।

তা ছাড়া এই মুহূর্তে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা লক্ষ করেছি প্রতিনিয়ত আলটিমেটাম দিয়ে শিক্ষকদের পদত্যাগ এবং অপসারণে বাধ্য করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কঠোর বার্তা এবং প্রজ্ঞাপন থাকলেও সেটি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না। 

বিশেষ করে যেসব শিক্ষকের নামে নানা ধরনের অনৈতিক কিংবা আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে, তাদের সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখি চলছে। এ ধরনের বিষয়কে অনেকেই সাধুবাদ জানাচ্ছেন, আবার অনেকেই এসব পরিস্থিতিকে হয়রানিমূলক হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন। উল্লিখিত নানা ধরনের পরিস্থিতির কারণে একধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতিও ঘটেছে।

কিছু কিছু পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, ব্যক্তিগত রেষারেষির কারণে একজন শিক্ষক আরেকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক কাজে লিপ্ত রয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শুধু রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতা, ব্যক্তিগত রেষারেষি প্রভৃতি কারণেও অসংখ্য পদত্যাগের কিংবা চাকরি থেকে অপসারণের দাবি উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। 

তবে বেশ কিছু অভিযোগ এসেছে, যেগুলোর প্রাথমিক সত্যতা রয়েছে। আমি মনে করি, দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অর্থাৎ উপাচার্য নিয়োগ হলে ওই অভিযোগগুলো যথাযথভাবে তদন্ত সাপেক্ষে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে শিক্ষার পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। 

দীর্ঘদিন থেকেই বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগে দলীয়করণ লক্ষ করা গেছে। ফলে যেকোনো ধরনের নিয়োগ এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনাতেও দলীয়করণের প্রভাব বিদ্যমান ছিল। এমনকি এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর, ছাত্র উপদেষ্টা, প্রাধ্যক্ষ, বিভিন্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালকসহ এমন কোনো পদ নেই যে দলীয়করণের বাইরে রয়েছে। 

আর দলীয় লেজুড়বৃত্তির ফলে শিক্ষকরা যারা প্রশাসনের পদে গিয়েছেন, তারা তাদের মনমতো যা ইচ্ছা তাই করেছেন বা করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মতো অভিযোগ স্পষ্টভাবে থাকা সত্ত্বেও দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে ওই সব প্রশাসনিক পদধারী শিক্ষকরা কোনো শাস্তির আওতায় আসেননি। এখনো শঙ্কা রয়েছে যে, ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে পারবে কি না।  

লক্ষণীয় বিষয় হলো, সাম্প্রতিক অতীতে এবং বর্তমানে সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানাবিধ অনিয়ম, অন্যায়ের অভিযোগ প্রায়ই আমাদের সামনে আসছে। এমনকি বিভিন্ন ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন কিংবা অনিয়মের কথাও শোনা যাচ্ছে। এর আগেও এমন অনেক অভিযাগ ছিল, কিন্তু সেগুলো যথাযথভাবে আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এসব বিষয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। 

বিশেষ করে বহু প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থদের বিরুদ্ধে নানাবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আসা সত্ত্বেও বিভিন্ন অজুহাতে কিংবা দলীয় লেজুড়বৃত্তির বদৌলতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। মূলত এসব ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলে অনেকে সেটির বৈধতা পেয়ে গেছেন। 

বাংলাদেশে নিজের নীতি-নৈতিকতার অবস্থানের কারণে পদ থেকে সরে যাওয়ার নজির নেই বললেই চলে। এবারের উদ্ভূত পরিস্থিতিতেও আমরা সেটি লক্ষ করেছি। অনেকেই দলীয় লেজুড়বৃত্তির ঊর্ধ্বে উঠে এখন নিরপেক্ষ সেজে পদ ছাড়েননি। অথচ তারাই একসময় দলীয় লেজুড়বৃত্তি করেই ওই পদগুলোতে বসেছিলেন বা পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন। আলটিমেটাম নেই, এই অজুহাতে দলীয় নিরপেক্ষ সাজার চেষ্টা করে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক পদধারী কেউ কেউ। আবার জানা গেছে, আলটিমেটাম যাতে না আসে, সে জন্য সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে চলছেন তারা।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বেচ্ছায় পদ থেকে চলে যাওয়ার ঘটনা অনেক। কিন্তু আমাদের দেশে কোনো কোনো প্রশাসকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগসহ গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ বিষয়ে ব্যাপক প্রতিবাদ হলেও সংশ্লিষ্টদের কোনো কর্ণপাত লক্ষ করা যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন অবস্থা বিরাজ করার পেছনে আরও কিছু কারণ রয়েছে। 

তার মধ্যে বড় কারণ হলো উপাচার্য কিংবা উপ-উপাচার্য সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তি না হওয়া। সরকারের কাছে ধরনা দিয়ে অনেকেই উপাচার্য কিংবা উপ-উপাচার্য হওয়া। যে কারণে তারা সরকার, মন্ত্রণালয় কিংবা ইউজিসিকে শুরু থেকেই খুশি করার তোষামোদিতে ব্যস্ত থাকেন। আর এই খুশির বেড়াজাল সহজে কেউই ভাঙতে পারেন না।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হলো দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। এ ক্ষেত্রেও বিভিন্ন পর্যায়ে কতিপয় তথাকথিত তোষামোদকারী ব্যক্তির কর্মকাণ্ডে যথাযথ সুশাসন বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই সরকার যদি প্রকৃতপক্ষেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতেই চায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে এসে প্রশাসনিক পদগুলোতে নিয়োগ নিশ্চিত করা। বিষয়টি মোটেও সহজ নয়। তবে ধীরে ধীরে সেই পর্যায়ে যাওয়ার মাধ্যমে একটি দীর্ঘমেয়াদি টেকসই একাডেমিক পরিস্থিতির পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। 

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

রাহুলের ঘুরে দাঁড়ানো এবং ভারতীয় রাজনীতি

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১১:২৯ এএম
আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৫ পিএম
রাহুলের ঘুরে দাঁড়ানো এবং ভারতীয় রাজনীতি

রাহুল সম্পর্কে বিজেপি নেতাদের কটূক্তির বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গসহ সারা ভারতে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। তাদের বক্তব্য, রাহুল গান্ধী ‘জঙ্গি’ এই উক্তি প্রত্যাহার করে আরএসএস এবং বিজেপিকে ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা, বিজেপি গান্ধী-পরিবারমুক্ত ভারত তৈরির লক্ষ্যে অবিচল।...

ইন্দিরা-পৌত্র রাহুল গান্ধী কি সন্ত্রাসবাদী নাকি দেশদ্রোহী? সম্প্রতি ভারতের বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী আমেরিকার চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত হয়ে ছাত্রদের কাছে বক্তব্য রেখেছেন। তার বক্তৃতায় তিনি ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন। এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাহুলকে সন্ত্রাসবাদী বলে চিহ্নিত করেছেন। এমনকি তাকে গ্রেপ্তারের দাবিও জানিয়েছেন।


বিজেপি সাংসদ গিরিজাশংকর মুখ খোলার পর বিজেপির সব নেতা, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও বলছেন, গান্ধী-পরিবারমুক্ত ভারত তৈরি করাই তাদের লক্ষ্য। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই ঝাড়খণ্ড, হরিয়ানা ও কাশ্মীরে নির্বাচন। সেখানে নির্বাচনি প্রচারে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একই সুরে রাহুলকে আক্রমণ করেছেন।


গত জুনে দেশে লোকসভা নির্বাচনের পর এই প্রথম ঝাড়খণ্ড, হরিয়ানা ও কাশ্মীরে নির্বাচন হতে চলেছে। উল্লেখ্য, ৩৭০ ধারা বিলোপের পর, সব মিলিয়ে ১০ বছর পর কাশ্মীরে নির্বাচন হচ্ছে। রাহুল সম্পর্কে বিজেপি নেতাদের কটূক্তির বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গসহ সারা ভারতে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। তাদের বক্তব্য, রাহুল গান্ধী ‘জঙ্গি’, এই উক্তি প্রত্যাহার করে আরএসএস এবং বিজেপিকে ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা, বিজেপি গান্ধী-পরিবারমুক্ত ভারত তৈরির লক্ষ্যে অবিচল।


বৃহস্পতিবার ইংরেজি টিভি চ্যানেলের একটি কনক্লেভে মনমোহন মন্ত্রিসভার অর্থ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম এই কটূক্তির শুধু জবাবই দেননি, তার দীর্ঘ ৪৫ মিনিটের বক্তব্যে তিনি বলেছেন, বিজেপি চাইছে সংবিধান সংশোধন করে ‘এক দেশ, এক ভোট’ করতে। কিন্তু তারা সেটা হতে দেবেন না বুঝতে পেরেই, বিজেপি রাহুলজীকে গালাগালি করছেন। তার আরও অভিযোগ, ২০২৪-এর নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। না হলে তারাই সরকার গঠন করতেন। মানুষের জন্য রুটি-রুজি দিতে না পেরে বিরোধী নেতাকে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করা কোনো গণতন্ত্রে অথবা স্বাধীনতাত্তোর ভারতবর্ষে এর আগে কখনো দেখা যায়নি।


বিজেপির প্রাক্তন নেতা অটল বিহারি বাজপেয়িও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু তিনি কখনোই বিরোধীদের এভাবে আক্রমণ করেননি। মোদি ক্ষমতায় আসার পর তার একমাত্র কাজই হলো গান্ধী পরিবারকে রাজনীতির মূল স্রোত থেকে সরিয়ে দেওয়া। জম্মু কাশ্মীরের নির্বাচনি প্রচারে গিয়ে লোকসভার বিরোধী দলনেতা দাবি করেছেন, তারা এবং ন্যাশনাল কনফারেন্স জিতবে এবং কাশ্মীরে আবার ৩৭০ ধারা ফিরিয়ে আনবে।


কাশ্মীর থেকে যেসব খবর আসছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, লালকৃষ্ণ আদবানি যখন উপপ্রধানমন্ত্রী, তখন কাশ্মীর উপত্যকা থেকে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জম্মুতে স্থানান্তরিত করেছিলেন। জম্মুতে যেসব সাংবাদিক রয়েছেন, তাদের বক্তব্য, কাশ্মীরি পণ্ডিতরা এবার আর বিজেপির ওপরে ভরসা রাখতে পারছেন না। কারণ, তাদের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার একটাও পূরণ হয়নি।


ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তার বক্তব্যে তুলে ধরেছেন, কংগ্রেস এবং ন্যাশনাল কনফারেন্স (ফারুক আব্দুল্লার দল) সেখানে জোট বেঁধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। অর্থাৎ, কংগ্রেস ও ন্যাশনাল কনফারেন্স দুটোই আবার পরিবারতন্ত্র কায়েম করতে চাইছে। এই পরিবারতন্ত্র শেষ করাই হবে বিজেপির লক্ষ্য। সেই কর্মসূচি নিয়ে তারা যে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেছে, তা আর তারা লুকিয়ে রাখছে না। ছোট-বড় সব নেতাই এখন একই কথা বলছেন।


এই পরিবারতন্ত্র শেষ করার কথার জবাব দিয়েছেন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য তথা রাহুলের ছোট বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। তিনি বলেছেন, আমাদের পরিবার শহিদ পরিবার, সন্ত্রাসবাদীরা আমার ঠাকুরমা ইন্দিরা গান্ধীকে মেরেছে, আমার বাবা রাজীব গান্ধীকে মেরেছে, আমার কাকা সঞ্জয় গান্ধীকেও মেরেছে। এই হত্যালীলা তারা শুরু করেছিল জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকে প্রার্থনা সভায় গুলি করে মেরে।


দেশ গঠনের কাজে কংগ্রেসের কোনো বিকল্প নেই। স্বাধীনতাত্তোর ভারতে যা কিছু হয়েছে, সবই কংগ্রেস করেছে। সম্প্রতি আরএসএস নেতা সুব্রামানিয়াম স্বামী সাংবাদিক বৈঠক করে দাবি করেছেন, রাহুল গান্ধী ভারতের নাগরিক নন। তিনি আসলে ব্রিটিশ নাগরিক। আমার মনে আছে রাহুল কবে জন্মাল, ১৯৭০ সালের জুন মাসে ইন্দিরা গান্ধী তখন পশ্চিমবঙ্গে পুরুলিয়ায় নির্বাচনি প্রচারে ছিলেন। নির্বাচনি ভাষণ শেষ করে তিনি সার্কিট হাউসে ঢুকলেন, আমি ছাড়া আরও দুজন সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমাদের সামনে ইন্দিরা গান্ধী খবরটি পেয়ে উল্লাসে তিনি তার পরবর্তী বৈঠক বাতিল করে দিল্লি চলে যান। আমরা তখন তার কাছে মিষ্টি খেতে চেয়েছিলাম। ইন্দিরা চিৎকার করে বললেন, ‘আই এম নাউ অ গ্র্যান্ডমাদার’। এর পরই তিনি দিল্লির উদ্দেশে রওনা দেন। 


গত বছর ‘ভারত ন্যায় যাত্রা’ করে রাহুল গান্ধী গ্রামে-গঞ্জে ঘুরেছিলেন পুরো এক বছর। তখন তিনি নিজের চোখে দেখেছিলেন গ্রামের মানুষের অবর্ণনীয় দুরবস্থা ও বেকারত্ব। তাই তিনি গত লোকসভা নির্বাচন থেকে বিরোধী দলনেতা হওয়া পর্যন্ত দেশের মানুষের কাছে সেই দুর্দশার কথা তুলে ধরেছেন। সম্প্রতি আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সেসব কথা বলেছেন তিনি। তাই তিনি বিজেপির ভাষায় ‘টেরোরিস্ট’।


রাহুল তার বর্তমান নির্বাচনি প্রচারে গিয়ে বলেছেন, সংসদে প্রধানমন্ত্রী মোদি আমার সামনাসামনি বসেন। তার আর ৫৬ ইঞ্চি ছাতি নেই। তিনি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার একটাও রাখতে পারেননি। তাই মানুষ যখন প্রশ্ন করছে, তখন তার কোনো উত্তর দিতে না পেরে গান্ধী-পরিবারের ওপরে দোষ চাপাচ্ছেন। মানুষ তা বিশ্বাস করছে না। তারা চাকরি পাচ্ছে না, খাবার পাচ্ছে না। মনমোহন সিংয়ের আমলে আমরা ফুড সিকিউরিটি অ্যাক্ট চালু করেছিলাম। আর এখন তা প্রধানমন্ত্রী নিজের নামে চালাচ্ছেন। বিজেপি আরএসএস তথা সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি দল যতই অপপ্রচার করুক না কেন, তাতে বিজেপির লাভ হবে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক

ইলিশ নিয়ে যত তেলেসমাতি

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১১:২২ এএম
আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৬ পিএম
ইলিশ নিয়ে যত তেলেসমাতি

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর বলা হচ্ছিল যে, দেশের অভ্যন্তরের চাহিদা পূরণ করে এ বছর আর ভারতে ইলিশ মাছ রপ্তানি করা হবে না। কিন্তু পরবর্তীকালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা বলে ভারতে ইলিশ মাছ রপ্তানি করা হচ্ছে অনেকটা তাদের অনুরোধক্রমে। এই নির্দেশনার ফলে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন মাছের পাইকারি বাজারে ইলিশ 
মাছের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে খুচরা বাজারে।...

নদীমাতৃক দক্ষিণাঞ্চল। প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চল রুপালি ইলিশের জন্য বিখ্যাত। পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা, বরগুনা- এসব জেলার আশপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কীর্তনখোলা, আরিয়াল খাঁ, বলেশ্বর, তেঁতুলিয়া, আন্ধারমানিক, কালাবদর, মেঘনা ইত্যাদি নদী আর কুয়াকাটাসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে বলতে গেলে সারা বছরই কমবেশি ইলিশ মাছের দেখা মেলে। আর সে জন্যই এই অঞ্চলের উপকূলবর্তী হাজার হাজার জেলে পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হয় প্রধানত ইলিশ ধরা আর বেচাকেনা করে। বছরের পর বছর বংশানুক্রমিক তারা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে-পরে কোনোরকমে এভাবে জীবন কাটিয়েছে, এখনো কাটাচ্ছে। 


দুই যুগ আগেও বরিশালের পোর্ট রোডের পাইকারি ইলিশের আড়তের ভেতরে-বাইরে দুপুর থেকে বিকেলের মধ্যে বিভিন্ন নদনদী ও সাগর থেকে ধরে আনা ইলিশের স্তূপ দেখা যেত।
 সন্ধ্যার আগে আগে ছোট-বড়  ট্রাকে করে বরফে ঢেকে সেই মাছের বেশির ভাগ চলে যেত দেশের বিভিন্ন স্থানে, প্রধানত উত্তরবঙ্গে। কিছু রপ্তানির মাধ্যমে বেনাপোল বন্দর দিয়ে চলে যেত কলকাতায়। 


তার পরও কোনো কোনো দিন মাছ থেকে যেত, তার থেকে কিছু লবণ মাখিয়ে বিক্রির চেষ্টা হতো, দামের কথা আর নাই বা বললাম। তার পর যা থাকত মাটিচাপা দিয়ে নষ্ট করে ফেলা হতো। কারণ ওই মাছ আর পরের দিন চলত না। এসব যারা না দেখেছে, এখন তাদের এসব কথা বিশ্বাস করা কঠিন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু তখন বাস্তব সত্য ছিল এটাই।


তার পর নদীর স্রোতের মতো চলে গেছে অনেক সময়। তারই সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে অনেক কিছু। শহরাঞ্চল থেকে গ্রামীণ পরিবেশ উধাও হয়ে গেছে। বড় বড় রাস্তা হয়েছে, তার দুই পাশে এখন আর ছোট-বড় পাকা ঘরবাড়ির অভাব নেই। লক্ষ করলে দেশজুড়ে দেখা যাবে একই চিত্র। পাশাপাশি জ্যামিতিক হারে বেড়েছে মানুষ। বেড়ে যাওয়া মানুষের বসবাসের জন্য কত যে জলাশয় রূপান্তরিত হয়েছে বাসস্থানে, তার কি কোনো ঠিক-ঠিকানা আছে?
সবকিছু সামাল দিতে সরকারি আইনেরও 
অদল-বদল হয়েছে। আজকে সেই রুপালি ইলিশ নিয়ে প্রায় কাড়াকাড়ি চলে। এমনভাবে দাম বেড়েছে, যাতে করে ইলিশ মাছ চলে গেছে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।        
এবারে এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। প্রথমত, এবারে অন্যবারের তুলনায় জেলেদের জালে কম মাছ ধরা পড়ছে। দ্বিতীয়ত, হঠাৎ করে কয়েকদিন আগে দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৪৯টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতি কেজি ১০ ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশি প্রায় ১২০০ টাকা হিসেবে সর্বমোট ২৪২০ টন ইলিশ মাছ ভারতে রপ্তানির জন্য অনুমোদন দিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, আগামী ১২ অক্টোবরের মধ্যে এই মাছ রপ্তানি করতে হবে। কারণ নিয়মমাফিক ১৩ অক্টোবর থেকে ইলিশ ধরা, বাজারজাত করা এবং সব ধরনের ক্রয়বিক্রয় বন্ধ হয়ে যাবে কিছুদিনের জন্য। 


এবারে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর বলা হচ্ছিল যে, দেশের অভ্যন্তরের চাহিদা পূরণ করে এ বছর আর ভারতে ইলিশ মাছ রপ্তানি করা হবে না। কিন্তু পরবর্তীকালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা বলে ভারতে ইলিশ মাছ রপ্তানি করা হচ্ছে অনেকটা তাদের অনুরোধক্রমে। 


এই নির্দেশনার ফলে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন মাছের পাইকারি বাজারে ইলিশ মাছের দাম মণপ্রতি ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা বেড়ে গেছে। লাগামহীনভাবে বেড়েছে খুচরা বাজারে। 
এদিকে দেশের বিভিন্ন নদনদীতে ইলিশ মাছের প্রজনন ও উৎপাদন বাড়াতে এবং ১০ ইঞ্চি লম্বা ছোট ইলিশ, যাকে আমরা ‘জাটকা ইলিশ’ বলি রক্ষার্থে, নদী থেকে আহরণ, পরিবহন ও বেচাকেনা করা আগে থেকেই কিছুদিনের জন্য আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিবছরই এই নিয়ম পালন করা হয়। বলা হয়, এই আইন অথবা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে গুনতে হবে জরিমানা, যেতে হবে জেলে। 
বলা বাহুল্য, এই নিষেধাজ্ঞার সময়টাতেই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় গরিব জেলেদের। মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নেওয়া অর্থ পরিশোধের বিষয়টি তখন তাদের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দেখা দেয়। যদিও এই সময় জেলেদের জীবিকা নির্বাহের জন্য সরকারি কিছু অনুদান দেওয়া হয়, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। 
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি এই আইন নানাভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে অর্থ ও প্রভাবশালী ব্যক্তি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং মৎস্য ব্যবসায়ীদের কৌশলের কারণে। 


তার ফলে এখন চলমান নিষেধাজ্ঞার সময়ও ক্ষমতাবানদের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন জেলার ছোট-বড় মাছের বাজারে জটকা কেনাবেচা হয়, বলা যায় তা অবাধেই চলতে থাকে। যদিও মাঝে মাঝে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা অবৈধভাবে ‘জাটকা’ ধরা ও বেচাকেনা বন্ধে অভিযান চালান এবং উদ্ধারকৃত জাটকা ও কারেন্ট জাল জব্দ করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন। ক্ষেত্রবিশেষে ৫-১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা কখনো কখনো তার সঙ্গে যোগ করা হয় আট-দশ দিনের জেল। তাতেই জাটকা ধরা, পরিবহন ও ক্রয়বিক্রয় একেবারে বন্ধ হয়ে যায়, সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই।


তাই অভিজ্ঞজনরা কখনো কখনো এ ধরনের অভিযান চালানোকে মূলত ‘লোক দেখানো’ বলে মনে করেন। কারণ বছরের পর বছর এ ধরনের অভিযান চলতেই থাকে। কঠোরভাবে কোনো আইনকানুন মানা হয় না, তেমনভাবে কারোর কোনো শাস্তিও হয় না। তাছাড়া জব্দকৃত বিপুল পরিমাণ জাটকা ধরার কারেন্ট জাল পুড়িয়ে ফেলা হলেও কখনো এর উৎপাদন বন্ধের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না।


ইলিশ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী এবং জেলেদের অভিমত, বর্তমানে জাটকা ইলিশের বিচরণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে প্রধানত চাঁদপুর, বরিশাল এবং ভোলা, মেহেন্দিগঞ্জ ও শরীয়তপুরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মেঘনা এবং তার শাখা নদীগুলো। 


মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বিগত ৮-১০ বছর আগের চাইতে এখন নানা কারণে ইলিশ মাছের উৎপাদন বেড়েছে। অবশ্য প্রতিবছর তেমনটা দেখা যায় না। কোনো কোনো বছর তুলনামূলকভাবে ইলিশ উৎপাদনে ঘাটতিও দেখা দেয়। যে কারণে গরিব জেলেদের দাদনের টাকা ফেরত দিতে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। 


সাধারণত, প্রজননকালীন বেশির ভাগ সময় মেঘনা, বলেশ্বর, তেঁতুলিয়া, কালাবদর ইত্যাদি নদী মা ইলিশের বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হয় মিঠা পানির কারণে। ডিম ছাড়ার পর পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জন্ম লাভ করে ১ সেন্টিমিটার পর্যন্ত আকারের ইলিশ, যা অন্তত তিন মাস পর্যন্ত মা ইলিশের সঙ্গেই বিভিন্ন নদনদীতে বিচরণ করে এবং এই সময়ের মধ্যে আকারে ১২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বড় হয়। এ জন্য এই সময় ইলিশ ধরা, বহন ও বেচাকেনা নিষিদ্ধ করা হয়।


বরিশাল অঞ্চলে বিভিন্ন নদীতে প্রচুর ছোট ইলিশ অর্থাৎ জাটকা ইলিশের দেখা মেলে। আর সে কারণেই আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এই সময়ে ইলিশ নিধন বন্ধে তৎপর থাকেন।
তার পরও দেখা গেছে, প্রতিবছর মেঘনা নদী থেকেই অসংখ্য জেলে শত শত মণ জাটকা আহরণ করে বিভিন্ন নির্ধারিত পয়েন্টের মাধ্যমে বাজারজাত করে থাকে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, মহাজন ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের ছত্রছায়ায়। 


অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্থানীয় প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য কমে গেলে ইলিশের উৎপাদন এবং সরবরাহ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

লেখক: খবরের কাগজের বরিশাল বিভাগীয় উপদেষ্টা
[email protected]

রাজনৈতিক সংস্কারের রোডম্যাপ প্রয়োজন

প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১১:২৬ এএম
রাজনৈতিক সংস্কারের রোডম্যাপ প্রয়োজন
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

অন্তর্বর্তী সরকারের সদিচ্ছা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত সব রাজনৈতিক সংস্কার সাধনে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তার পরও আমাদের প্রত্যাশা ইতিবাচক। এ কথা সত্য যে, রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য একটি যৌক্তিক সময় প্রয়োজন। সেই সময় এবং ধৈর্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এবং দেশের জনগণের আছে কিনা, সেটি বলা মুশকিল। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, দু-একটি রাজনৈতিক দল ইতোমধ্যেই বারবার নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানাচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত সংস্কার শুধু ছাত্র-জনতার সমর্থন নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর স্পষ্ট সহযোগিতা ও সমর্থনের মধ্যদিয়ে এগিয়ে নেওয়া ছাড়া সম্ভব নয়। 

আমরা জানি, বাংলাদেশে একটি নির্ভরযোগ্য এবং জনআস্থাসম্পন্ন নির্বাচনি কাঠামো নেই। স্বাধীনতার পর থেকে সরকারি দলের অধীনে নির্বাচন করে কখনো বিরোধী দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে পারেনি। এ কারণে কখনোই রাজনৈতিক দলগুলো সরকারি দলের অধীনে নির্বাচনে যেতে চায় না। আমাদের অন্যতম প্রধান প্রত্যাশা হলো- আগামী দিনে নির্বাচনি কাঠামোর পরিবেশ যেন এমন হয়, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, সেই দলের অধীনে নির্বাচন হলেও তাদের (ক্ষমতাসীনদের) পরাজিত হওয়ার শঙ্কা থাকবে। তারা নিশ্চিত থাকবে না যে, তারাই আবার ক্ষমতায় আসবে। এমন কোনো পরিস্থিতি কিংবা শঙ্কা থাকা যাবে না যে, সরকারি দলের অধীনে বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নিতে ভয় পাবে। যেকোনো পরিস্থিতিতেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনি কাঠামো বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরি। সরকারের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম ফাউন্ডেশন হিসেবে এই প্রক্রিয়াকে সর্বাগ্রে বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। 

অন্যদিকে ভালো একটি নির্বাচনি কাঠামোর মধ্যদিয়ে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা যেন যথাযথ এবং ন্যায্য প্রক্রিয়ায় শাসন কাঠামো পরিচালনা করে, সে বিষয়ে একটি জবাবদিহিমূলক কাঠামো প্রস্তুত রাখা। এজন্য আমাদের প্রত্যাশা- একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরশাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে প্রয়োজনীয় কাঠামো তৈরি করা। সংসদ এবং সংসদের বাইরে নির্বাচনি প্রতিনিধিরা যেন একটি জবাবদিহির মধ্যে থাকে, তেমন একটি কাঠামো তৈরি করা জরুরি। সংসদ সদস্যদের সব আয়-ব্যয়ের হিসাব ওপেন-এক্সেস ইনফরমেইশন ডাটাবেইজের ভিত্তিতে হতে পারে। একজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগে এবং পরে কী অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা কিংবা আয়-ব্যয়ের কাঠামোতে থাকে তার একটি সুনির্দিষ্ট ডাটাবেইজ থাকবে। যেখানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের সেটি সহজেই পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ থাকবে।

বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) এমন একটি অবস্থায় নিয়ে যাওয়া দরকার, যাতে সরকারি দল কিংবা যেকোনো ব্যক্তিপর্যায়ে দুর্নীতিবাজ ভয়ে তটস্থ থাকে। দুদক চেয়ারম্যান এবং কমিশনারকে কে নিয়োগ দিচ্ছেন, কার পছন্দমতো হচ্ছেন, তার ওপর অনেকটা নির্ভর করে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারার বিষয়টি। তাছাড়া নৈতিক উন্নয়ন ছাড়া কোনো ব্যক্তিই চেয়ারম্যান কিংবা কমিশনার হলে নিরপেক্ষ এবং যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে না। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে এমন ব্যবস্থা তৈরি হওয়া দরকার যে, সরকারি দলের পছন্দে নয় বরং বিরোধী দল কিংবা সাধারণ জনগণের মতামতে বা পছন্দে দুদকের চেয়ারম্যান এবং কমিশনার নিয়োগের ব্যবস্থা রাখা। তাছাড়া সরকারি দল যতই নিরপেক্ষ ব্যক্তি পছন্দ করে দুদকের চেয়ারম্যান এবং কমিশনার নিয়োগ দিক না কেন, তাদের সফট কর্নার থাকতে পারে সরকারি দলের ব্যক্তিদের ওপর। এ জন্য দুদকের এমন একটি সংস্কার কাঠামো দেওয়া দরকার, যাতে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসার পর দুদক চেয়ারম্যান এবং কমিশনার একমাত্র তাদের মন মতোই যেন না হয়। 

আরও যে বিষয়টি অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন, সেটি হলো- বিচারব্যবস্থায় একটি গ্রহণযোগ্য কাঠামো প্রস্তুত করা। বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভয়াবহ জিনিস হচ্ছে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের বেলায় কোনো ধরনের যোগ্যতার মানদণ্ড ঠিক করা নেই। কেবল সরকারি দল যে নিয়োগ করবে এবং ওই লোকটা যে আইনজীবী হিসেবে ১০ বছর অথবা কোনো একটা অধস্তন আদালতে ১০ বছর চাকরি করেছে এটুকু শর্ত পূরণ করলেই আদালত তাকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেবেন। এ ক্ষেত্রে ওইসব বিচারকের দলীয় চরিত্র দেখে বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি সামনে আসতে পারে। এ জন্য এমন একটি কাঠামো প্রস্তুত রাখা দরকার, যাতে প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ থাকার পরই একটি সুনির্দিষ্ট যোগ্যতার মানদণ্ড, যা প্রতিযোগিতামূলক হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিচারব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশে অনেক ধরনের জবাবদিহি নিশ্চিত হয় না। বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা এবং স্বাধীনতার ওপর দেশের সুশাসনের অন্যান্য ইন্ডিকেটর যথাযথভাবে কাজ করতে পারে। 

আমরা সবাই জানি, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার উন্নতি এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে সমাজে অস্থিরতা তৈরি হয় এবং কোনো সংস্কারের কাজ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। কাজেই আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার উন্নতি এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেকোনো সংস্কারের অগ্রাধিকার নির্ণয়ে মৌলিক নীতি ও মানদণ্ড হওয়া উচিত। যে সংস্কারগুলো আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য সহায়ক, সেগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, অন্যদিকে যে সংস্কারগুলো আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে অবনতি বা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়, তা সংস্কারের বাইরে রাখা উচিত।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাষ্ট্র যে দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছে তার জন্য মূলত দায়ী সমাজের নেতৃত্বদানকারী রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, আমলা, পেশাজীবী, গণমাধ্যম ও ব্যবসায়ী শ্রেণি। সাধারণ মানুষ সহজ-সরল প্রকৃতির। তাই দেশের দুরবস্থার জন্য তারা মোটেও দায়ী নয়- এমন একটি ধারণা সমাজে রয়েছে। তবে একটি কথা প্রচলিত আছে, যার মর্মার্থ হলো, ‘যে দেশের জনগণ যেমন, রাষ্ট্র ঠিক তেমনই হয়ে থাকে।’ দেশের সম্পদ লুটের জন্য একজন দুর্বৃত্ত নেতা যেমন দায়ী, অজ্ঞতাবশত অথবা সামান্য টাকার লোভে ওই মানুষটিকে যে ভোট দিয়েছে সেও দায়ী। রাজনীতির অন্যতম প্রধান কাজ মানুষকে সক্রিয় নাগরিকে রূপান্তর করা। তাদের রাজনীতি-সচেতন এবং নাগরিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করা। একজন দুর্বৃত্তও যখন সমাজ সচেতন হয়ে ওঠে, তখন সে বুঝতে পারে যে, ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে সমাজের স্বার্থ রক্ষাই দীর্ঘমেয়াদে তার ও তার সন্তানদের অধিক লাভবান করবে। তখন সে-ও সমাজের পক্ষে কাজ করে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূল দায়িত্বই হলো জনগণের মাঝে সেরকম চিন্তার বিকাশ ঘটানো। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো যাতে আগ্রহী হয়- সেদিকটা পরিষ্কারভাবে কাঠামোগত অবস্থায় নেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে ভেবে দেখা দরকার।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ 
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি আগ্রাসন এবং পশ্চিমা বিশ্বের রহস্যজনক ভূমিকা

প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১১:২৪ এএম
আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১১:২৮ এএম
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি আগ্রাসন এবং পশ্চিমা বিশ্বের রহস্যজনক ভূমিকা
মালিহা লোধি

সব কিছুতেই বিপরীত কিছু লক্ষ্য করা যায়। গত সপ্তাহে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার বিদায়ী ভাষণে কীভাবে তিনি ইউক্রেন এবং এর জনগণকে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রক্ষা করেছিলেন, সে সম্পর্কে গর্বের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের কথা বলতে গিয়ে তিনি ভিন্ন নীতি প্রয়োগ করেছেন।

আগ্রাসন ও নিপীড়নের সম্মুখীন ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্দশার জন্য ইসরায়েলকে শিকার হিসেবে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। তিনি ইউক্রেনকে যুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করার জন্য বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, জাতিসংঘ সনদের ভিত্তিতে ন্যায্য এবং টেকসই শান্তি না হওয়া পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যদিকে তাকাবে না। মধ্যপ্রাচ্যে, জো  বাইডেন ‘৭ অক্টোবরের ভয়াবহতা’ এবং হামাসের হাতে বন্দি জিম্মিদের নিয়ে কথা বলেন। গাজায় ইসরায়েলের বছরব্যাপী চলমান যুদ্ধে নৃশংস হত্যা এবং ধ্বংস সম্পর্কে খুব কমই বলেছেন। ইসরায়েলের অগনিত লঙ্ঘন সত্ত্বেও জাতিসংঘের সনদকে আহ্বান করা হয়নি। জো বাইডেন গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন এবং এই অঞ্চলে পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে বলেছেন। কিন্তু কয়েক মাস ধরে তার প্রশাসন যে ভূমিকা পালন করেছে, তা দেখে এই কথাগুলো ভণিতা বলে মনে হয়। 

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে কয়েকবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিয়েছে। ইসরায়েলের নিরলস সশস্ত্র হামলায় তার প্রশাসন স্পষ্ট ভূমিকা রেখেছে। গত বছরে ওয়াশিংটন ইসরায়েলকে ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি অস্ত্র সরবরাহ করেছে এবং ‘ইসরায়েলকে রক্ষা’ করতে এই অঞ্চলে অতিরিক্ত সামরিক বাহিনী মোতায়েন করেছে। 

গত সপ্তাহে, ইসরায়েল মার্কিন সামরিক সহায়তায় অতিরিক্ত ৮.৭ বিলিয়ন ডলার সুরক্ষা পেয়েছে। গত ১১ মাসে, জো বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলের সামরিক আক্রমণ এবং বোমা হামলায় প্রায় ৪১ হাজারের বেশি বেসামরিক লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। তিনি হাসপাতাল এবং চিকিৎসাকর্মীদের ওপর বারবার ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করেননি। সরকারি মুখপাত্ররা প্রায়শই আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে বিবৃতি দিয়েছেন। 

এই অবস্থায় গাজায় নৃশংসতা, জাতিগত নির্মূল এবং সেখানে সাহায্যের অনুমতি দেওয়া, যুদ্ধবিরতির জন্য ইউএনএসসির আহ্বানকে অস্বীকার করার জন্য ইসরায়েলকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায়কেও লঙ্ঘন করেছে। ইসরায়েলকে শুধুমাত্র তার গণহত্যামূলক যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়নি, অধিকৃত পশ্চিম তীরে ধ্বংসযজ্ঞ, তৃতীয় দেশে হামাস ও হিজবুল্লাহ কমান্ডারদের হত্যা এবং লেবাননের ওপর আক্রমণ জোরদার করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। 

যখন ইসরায়েল লেবাননে বোমা হামলা চালায়, তখন ওয়াশিংটন এবং অনেক পশ্চিমা দেশ থেকে টুঁ শব্দটিও শোনা যায়নি। যদি অন্য কোনো দেশ এটা করত তাহলে পশ্চিমারা এটাকে সন্ত্রাসী হামলা বলে নিন্দা করত। ইসরায়েল পশ্চিম তীরজুড়ে মারাত্মক অভিযান চালিয়েছে, ফলে বহু বেসামরিক লোকের প্রাণহানি হয়েছে এবং অবকাঠামোর ব্যাপক ধ্বংস হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আঞ্চলিক যুদ্ধের বিপদ সম্পর্কে ওয়াশিংটনের সতর্কতা উপেক্ষা করেছেন। আমেরিকার নির্বাচনের সময় জো বাইডেন প্রশাসনের রাজনৈতিক বিবেচনাকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন। তিনি আরও গণনা করেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তেল আবিবকে সংযত করার জন্য অস্ত্র সরবরাহ স্থগিত করতে ইচ্ছুক নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের ‘নিঃশর্ত আত্মরক্ষার অধিকার’-এর প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে চলেছে। 
নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতি বা শান্তি চুক্তিতে কোনো আগ্রহ দেখাননি, কারণ তার রাজনৈতিকভাবে বেঁচে থাকা নির্ভর করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ওপর। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। একজন বিদ্বেষী নেতানিয়াহু তার ইউএনজিএ ভাষণে যুদ্ধবিরতির জন্য আন্তর্জাতিক আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

এদিকে জো বাইডেন প্রশাসনের কিছু সদস্য ইসরায়েলের অযৌক্তিক ‘পর্যায়ক্রম যুদ্ধ বাড়ানো’ যুক্তিকে গ্রহণ করেছেন। এটি সংঘাত বাড়ানোর একটি নতুন পর্যায়। এভাবেই ইসরায়েল লেবাননে একাধিক বিধ্বংসী বিমান হামলা চালায়। কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় এ বিমান হামলায় ৭০০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এই হামলা বিশ্বে বৃহত্তর বহুমুখী যুদ্ধের আশঙ্কাও সৃষ্টি করেছে; যা সমগ্র অঞ্চলকে গ্রাস করতে পারে। 
বিশেষ করে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যার পর তার মিত্র হিজবুল্লাহর ওপর ক্রমবর্ধমান চাপের কারণে ইরানের আরও সমালোচনা হবে। এখন পর্যন্ত ইরান সংযম ও ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান যুদ্ধে নামার জন্য ইসরায়েলের টোপ এড়িয়ে গেছেন।

তিনি ইরানের মাটিতে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াহকে ইসরায়েলের হত্যার প্রতিশোধমূলক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের সময় ইরানের প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান বলেছিলেন,  ইসরায়েল তার দেশকে একটি বৃহত্তর যুদ্ধে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, যা তার কখনো কোনো ইচ্ছা ছিল না। ইসরায়েল তার সৈন্যদের লেবাননে স্থল আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছিল, যদি তারা আবার রেড লাইন অতিক্রম করে হামলা করে তাহলে ইরান বড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। যদিও জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ফিলিস্তিনিদের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং গ্লোবাল সাউথের নেতাদের কাছ থেকে ইসরায়েলের তীব্র নিন্দা প্রকাশ করা হয়েছে। পশ্চিমা সরকারগুলোর অনুশীলন করা এই ধরনের ভণ্ডামি এবং দ্বৈত মানসিকতা বিশ্বকে আরও ভাবিয়ে তুলেছে। স্পেন, আয়ারল্যান্ড এবং নরওয়ের মতো পশ্চিমা দেশগুলো ছাড়া বাকি দেশগুলো ইসরায়েলের প্রতি তাদের অন্ধ সমর্থনে আন্তর্জাতিক আইন এবং মৌলিক মানবাধিকারের সম্পূর্ণ অবজ্ঞা দেখিয়েছে। তারা রাশিয়ার সামরিক পদক্ষেপ এবং ইউক্রেনে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর আক্রমণ করাকে তীব্র নিন্দা করেছে। কিন্তু গাজায় একই নীতি প্রয়োগ করতে অস্বীকার করেছে। গাজায় বেসামরিক লোকদের টার্গেট করা, শিশুদের হত্যা, হাসপাতালে বোমা ফেলা, লোকজনকে বাস্তুচ্যুত করা এবং জনসংখ্যাকে অনাহারে রাখার কোনো যৌক্তিকতা আছে কিনা, তা তারা কখনোই বলেনি। এর পরিবর্তে তারা ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রক্ষার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যে কারণে ইসরায়েল প্রতিটি আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়ম লঙ্ঘন, যুদ্ধাপরাধ, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বে আক্রমণ এবং একটি জাতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তো দূরের কথা, তারা শুধু তাদের শত্রুদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে যাচ্ছে এবং সময়ের সঙ্গে দখলদারির প্রতিরোধকে শক্তিশালী করে যাচ্ছে। 

আরব সরকারগুলো ইসরায়েলকে গণহত্যামূলক যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে কিছু করতে ব্যর্থ হয়ে নিজেদের গৌরব ক্ষুণ্ন হয়েছে। আরবদের নিন্দা করার মতো অনেক কিছুই আছে। কারণ, তাদের নিষ্ক্রিয়তা ইসরায়েলকে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে যেতে সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করেছে।

মধ্যপ্রাচ্য চরম বিপজ্জনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। ইসরায়েলের উত্তেজনা এই অঞ্চলটিকে পূর্ণ মাত্রার সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। সাহসী ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য এটি নির্যাতিত ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার সময়। কিন্তু অতীত কথা বলে, চ্যালেঞ্জ যাই হোক না কেন, তারা নিষ্ঠুর ও অন্যায়কে প্রতিহত করবেই।
 
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে সাবেক রাষ্ট্রদূত
ডন থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

সংস্কারের জন্য রোডম্যাপ থাকতে হবে

প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৪৪ এএম
সংস্কারের জন্য রোডম্যাপ থাকতে হবে
ড. মাহবুব উল্লাহ

দেশে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে কিছুদিন হলো। এই দায়িত্ব বিশাল, একই সঙ্গে খুব জটিল। বর্তমান সময়ে মানুষের মধ্যে নানারকম অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এর কারণ, একদিকে প্রত্যাশা অন্যদিকে প্রাপ্তি; এই দুইয়ের মধ্যে বিশাল ব্যবধান। অস্থিরতার এটা একটা বড় কারণ বলতে হবে। এ ছাড়া একটা বিশাল গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার পর আমরা দেখতে পাচ্ছি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সব ভেঙে পড়েছে। যেদিকেই তাকাই সেদিকেই একটা বিধ্বস্ত অবস্থা! বিশেষ করে ব্যাংক ও আর্থিক সংস্থাগুলো ভেঙে পড়েছে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবে মানুষের মনে এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে। সে অস্থিরতার প্রতিফলন ঘটছে সর্বত্র। পুরোনো সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নতুন সমাজ কাঠামো এখনো দৃশ্যমান হয়নি। আমরা কেবল অস্থির সময়গুলো অতিক্রম করছি। বাংলাদেশ আজকে একটি কঠিনতম সংকটের মধ্যে পড়েছে। এই সংকট থেকে আমাদের কীভাবে উত্তরণ হবে, তা দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দেখে নিরূপণ করা সম্ভব নয়। আমাদের নিজেদের পথনির্দেশিকা নিরূপণ করতে হবে। উত্তরণের সঠিক পথ খুঁজে বের করতে হবে। এই মুহূর্তে আমাদের লক্ষ্য খুব সীমিত এবং সেই লক্ষ্যটা হচ্ছে- আমরা সবাই একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চাই। যে বাংলাদেশে আমরা কথা বলতে পারব। মুক্তভাবে মত প্রকাশ করতে পারব। আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারব। এগুলো নিয়ে আমাদের মুক্তমত প্রকাশের পাশাপাশি চিন্তাভাবনা করতে হবে। শুধু চিন্তার মধ্যেই নিবিষ্ট থাকলে হবে না। আমাদের সেই পথ খুঁজে বের করে নিতে হবে এবং সেই মোতাবেক পথ চলতে হবে। আমাদের সেই পথ হচ্ছে সংগ্রামের পথ। আমাদের সেই পথ হচ্ছে আত্মদানের পথ। সেই পথ মানুষকে ভালোবাসার, দেশকে ভালোবাসারও পথ। আজকে আমাদের যে ব্যর্থতা, আমরা দেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলাম। সত্যিকার অর্থে শোষণমুক্ত দেশ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলাম। আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল হচ্ছে, আমরা আমাদের মতো করে আমাদের পথে এগিয়ে যেতে পারিনি। বাস্তব অবস্থার আলোকে আমাদের রাজনৈতিক কৌশল, রাজনৈতিক লক্ষ্য নির্মাণ করতে পারিনি। আমরা সবকিছু ধারণ করতে সক্ষম হতে পারিনি। আমরা আমাদের মূল আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকতে পারিনি। আমরা পরস্পর অনুগত থাকতে পারিনি। আমাদের মানসিকতায় ও কাজেকর্মে মতানৈক্যে পৌঁছাতে পারিনি। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এখন আমাদের সময় এসেছে ফিরে দেখার পাশাপাশি নিজেদের নতুন করে ফিরে পাওয়ার।

 
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজ হচ্ছে সংস্কার করা। সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ছয়টি কমিশন গঠিত হয়েছে। সংস্কার কমিশনে দায়িত্বপ্রাপ্তরা তাদের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, নানা ধরনের কমিশন গঠিত হয়েছে। তবে এবার যে কমিশন গঠিত হয়েছে এর পেছনে একটা বড় ধরনের প্রেক্ষাপট আছে। সেই প্রেক্ষাপটটি হলো এবারের জুলাইয়ের ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থান। ছাত্রদের সাধারণ কোটা আন্দোলন থেকে স্বৈরাচার সরকারের পতন। এতগুলো তাজা প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া এই গণ-অভ্যুত্থানকে আমাদের অন্তরে ধারণ করতে হবে। একই সঙ্গে সে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে সক্ষম হলে সরকার ও কমিশনের সদস্যরা ভালো কাজ করবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করেই তারা তাদের সুপারিশগুলো লিখবেন। সুপারিশগুলো যেন দেশের গণতন্ত্রের চাহিদা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের চাহিদা, মানবাধিকারের চাহিদা, সত্য ও ন্যায়নীতি পূরণের চাহিদাগুলোকে পূরণ করতে সক্ষম হয়, এটাই সাধারণ মানুষ আশা করে। কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত যারা আছেন তারা তাদের সুপারিশগুলো কীভাবে বাস্তবায়িত করবেন, সে বিষয়ে একটি রূপরেখা থাকতে হবে। বলাবাহুল্য, একটি বিশাল গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে কমিশনগুলো গঠিত হয়েছে। এ কমিশনের সদস্যরা এবং কমিশনপ্রধান যারা আছেন তারা মনে রাখবেন গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাকে নিজেদের ভিতরে ধারণ করতে। গণমানুষের যে আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা আছে, সেগুলোর আলোকে যদি তারা তাদের রিপোর্ট তৈরি করতে পারেন তাহলে সেটা একটা সফল রিপোর্ট হবে। অন্যথায় অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে কমিশনগুলো শুরু হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, তার কোনোটিই সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এবার সে ধরনের কিছু করার কোনো সুযোগ নেই বলেই মনে করা যায়। 


যেকোনো রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। রাষ্ট্র যদি সে দায়িত্ব পালন না করে, তখন রাষ্ট্রে নানারকম নৈরাজ্য তৈরি হয়। রাষ্ট্র নৈরাজ্যে ডুবে গেলে জনগণও আস্থা হারায়। দেশে বছরের পর বছর এহেন পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। জনগণের প্রতিনিধির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা আমাদের রক্তে, আমাদের ইতিহাসে রয়েছে। সেখান থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে গণতন্ত্র। আজ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দেশ অস্থির ও বৈরী অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে একটি অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনীর প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী। যদিও আমাদের সেনাবাহিনী অনুপযোগী সেনাবাহিনী নয়। আমাদের সেনাবাহিনী বিদেশে শান্তি মিশনে অংশ নিয়ে দেশের জন্য লাখ লাখ বিদেশি মুদ্রা জোগায়। এ ছাড়া দেশের ভেতরে তারা যে কর্মকাণ্ড করে তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। যেমন- দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বিভিন্ন সময়ে সব কিছুই আমাদের সেনাবাহিনীর প্রোডাক্টিভিটি বা উৎপাদনশীলতায় যুক্ত হয়। দেশে অস্থিতিশীল তথা অনভিপ্রেত পরিবেশ মোকাবিলায় তাদের কাজে লাগানো হয়। দেশের সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা সেনাবাহিনীর হাতে। আমরা আগামী দিনগুলোতে খুব একটা শান্তিতে থাকব বলে মনে হয় না। সে লক্ষ্যে  আমাদের মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। ভারতের উসকানিতে দেশে অনেক ধরনের অঘটন-দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের মানসিকভাবে এবং অন্যভাবেও প্রস্তুত থাকতে হবে। যেন দেশের নিরাপত্তা সুরক্ষিত রাখা সম্ভব হয়। আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশের পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে ভারত সরকার, ভারতের মিডিয়া ও ভারতের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি তা পছন্দ করছেন না। আমাদের দেশের ১৭ কোটি মানুষের অর্জনকে নস্যাৎ করার জন্য তারা বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা করছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত ‘র’ বাংলাদেশে ব্যর্থ হওয়ার পর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তিনজন জেনারেলকে। এর মধ্যে একটি সামরিক কনটেন্ট ইতোমধ্যে যুক্ত হয়ে গেছে। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন। সার্বিকভাবে সাধারণ মানুষের জন্য এটা নিঃসন্দেহে অশনি সংকেত। এ বিষয়ে সবাইকে দূরদর্শী ও সজাগ থাকতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক