দীর্ঘদিন থেকে দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। মূলত গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পর প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদে থাকা শিক্ষকদের পদত্যাগের কারণে এমন সংকট তৈরি হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও একই অবস্থা। আমার বিভাগে একাডেমিক কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকেই একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যেই অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে একই প্রক্রিয়ায় একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। উল্লেখ্য, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েই একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করেছে।
আমি কয়েক দিন থেকে লক্ষ করছি, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা খুব উৎসাহ নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। যদিও এখনো সব শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে ক্লাসে পাইনি। কোনো কোনো শিক্ষার্থী তৎকালীন সরকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণে তারা এখনো ক্লাসে ফিরতে শঙ্কায় রয়েছে। বাকি সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাসে আসছে। একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হলেও সেশনজটের একটি বড় শঙ্কা তৈরি হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মনে একধরনের অস্থিরতা রয়েছে।
এ পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হওয়ার পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। কয়েক বছর আগে করোনার কারণে সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় তখন তৈরি হওয়া সংকট এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য, আমার বিভাগে এমন একটি একাডেমিক ব্যাচ রয়েছে, যাদের স্বাভাবিক একাডেমিক কার্যক্রম চালু থাকলে এক বছর আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই ব্যাচ প্রায় দুই থেকে তিন বছরের সেশনজটে পড়ে আছে। বর্তমানে তারা একাডেমিক এমন একটি পর্যায়ে আছে যে, স্বাভাবিক একাডেমিক কার্যক্রম চালু থাকলে তাদের মাস্টার্স শেষ করতে আরও প্রায় দুই বছরের বেশি সময় লেগে যেতে পারে।
তা ছাড়া এই মুহূর্তে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা লক্ষ করেছি প্রতিনিয়ত আলটিমেটাম দিয়ে শিক্ষকদের পদত্যাগ এবং অপসারণে বাধ্য করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কঠোর বার্তা এবং প্রজ্ঞাপন থাকলেও সেটি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না।
বিশেষ করে যেসব শিক্ষকের নামে নানা ধরনের অনৈতিক কিংবা আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে, তাদের সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখি চলছে। এ ধরনের বিষয়কে অনেকেই সাধুবাদ জানাচ্ছেন, আবার অনেকেই এসব পরিস্থিতিকে হয়রানিমূলক হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন। উল্লিখিত নানা ধরনের পরিস্থিতির কারণে একধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতিও ঘটেছে।
কিছু কিছু পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, ব্যক্তিগত রেষারেষির কারণে একজন শিক্ষক আরেকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক কাজে লিপ্ত রয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শুধু রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতা, ব্যক্তিগত রেষারেষি প্রভৃতি কারণেও অসংখ্য পদত্যাগের কিংবা চাকরি থেকে অপসারণের দাবি উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
তবে বেশ কিছু অভিযোগ এসেছে, যেগুলোর প্রাথমিক সত্যতা রয়েছে। আমি মনে করি, দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অর্থাৎ উপাচার্য নিয়োগ হলে ওই অভিযোগগুলো যথাযথভাবে তদন্ত সাপেক্ষে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে শিক্ষার পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
দীর্ঘদিন থেকেই বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগে দলীয়করণ লক্ষ করা গেছে। ফলে যেকোনো ধরনের নিয়োগ এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনাতেও দলীয়করণের প্রভাব বিদ্যমান ছিল। এমনকি এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর, ছাত্র উপদেষ্টা, প্রাধ্যক্ষ, বিভিন্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালকসহ এমন কোনো পদ নেই যে দলীয়করণের বাইরে রয়েছে।
আর দলীয় লেজুড়বৃত্তির ফলে শিক্ষকরা যারা প্রশাসনের পদে গিয়েছেন, তারা তাদের মনমতো যা ইচ্ছা তাই করেছেন বা করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মতো অভিযোগ স্পষ্টভাবে থাকা সত্ত্বেও দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে ওই সব প্রশাসনিক পদধারী শিক্ষকরা কোনো শাস্তির আওতায় আসেননি। এখনো শঙ্কা রয়েছে যে, ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে পারবে কি না।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, সাম্প্রতিক অতীতে এবং বর্তমানে সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানাবিধ অনিয়ম, অন্যায়ের অভিযোগ প্রায়ই আমাদের সামনে আসছে। এমনকি বিভিন্ন ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন কিংবা অনিয়মের কথাও শোনা যাচ্ছে। এর আগেও এমন অনেক অভিযাগ ছিল, কিন্তু সেগুলো যথাযথভাবে আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এসব বিষয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
বিশেষ করে বহু প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থদের বিরুদ্ধে নানাবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আসা সত্ত্বেও বিভিন্ন অজুহাতে কিংবা দলীয় লেজুড়বৃত্তির বদৌলতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। মূলত এসব ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলে অনেকে সেটির বৈধতা পেয়ে গেছেন।
বাংলাদেশে নিজের নীতি-নৈতিকতার অবস্থানের কারণে পদ থেকে সরে যাওয়ার নজির নেই বললেই চলে। এবারের উদ্ভূত পরিস্থিতিতেও আমরা সেটি লক্ষ করেছি। অনেকেই দলীয় লেজুড়বৃত্তির ঊর্ধ্বে উঠে এখন নিরপেক্ষ সেজে পদ ছাড়েননি। অথচ তারাই একসময় দলীয় লেজুড়বৃত্তি করেই ওই পদগুলোতে বসেছিলেন বা পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন। আলটিমেটাম নেই, এই অজুহাতে দলীয় নিরপেক্ষ সাজার চেষ্টা করে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক পদধারী কেউ কেউ। আবার জানা গেছে, আলটিমেটাম যাতে না আসে, সে জন্য সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে চলছেন তারা।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বেচ্ছায় পদ থেকে চলে যাওয়ার ঘটনা অনেক। কিন্তু আমাদের দেশে কোনো কোনো প্রশাসকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগসহ গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ বিষয়ে ব্যাপক প্রতিবাদ হলেও সংশ্লিষ্টদের কোনো কর্ণপাত লক্ষ করা যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন অবস্থা বিরাজ করার পেছনে আরও কিছু কারণ রয়েছে।
তার মধ্যে বড় কারণ হলো উপাচার্য কিংবা উপ-উপাচার্য সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তি না হওয়া। সরকারের কাছে ধরনা দিয়ে অনেকেই উপাচার্য কিংবা উপ-উপাচার্য হওয়া। যে কারণে তারা সরকার, মন্ত্রণালয় কিংবা ইউজিসিকে শুরু থেকেই খুশি করার তোষামোদিতে ব্যস্ত থাকেন। আর এই খুশির বেড়াজাল সহজে কেউই ভাঙতে পারেন না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হলো দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। এ ক্ষেত্রেও বিভিন্ন পর্যায়ে কতিপয় তথাকথিত তোষামোদকারী ব্যক্তির কর্মকাণ্ডে যথাযথ সুশাসন বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই সরকার যদি প্রকৃতপক্ষেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতেই চায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে এসে প্রশাসনিক পদগুলোতে নিয়োগ নিশ্চিত করা। বিষয়টি মোটেও সহজ নয়। তবে ধীরে ধীরে সেই পর্যায়ে যাওয়ার মাধ্যমে একটি দীর্ঘমেয়াদি টেকসই একাডেমিক পরিস্থিতির পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]