এই যে আমাদের রাষ্ট্র জনগণের স্বার্থ দেখে না; স্বার্থ দেখে কতিপয়ের। এ রাষ্ট্র জনমতের তোয়াক্কা করে না। জবাবদিহির দায়ভার গ্রহণ করে না। যে অন্যায়গুলো ঘটেছে, সেগুলো জনগণের জন্য বড় রকমের সমস্যা, কিন্তু রাষ্ট্রের জন্য নয়। রাষ্ট্র এগুলোকে তার নিজের জন্য কোনো হুমকি বলে মনে করে না।
দেখা যায় যে বড় বড় অপরাধীর শাস্তি হয় না, যে জন্য অপরাধের মাত্রা বাড়তেই থাকে। অনুসন্ধান করলে জানা যাবে যে, অনেক অপরাধ সরকারি লোকদের হয় আশ্রয়ে নয়তো প্রশ্রয়ে ঘটে। সরকারি বলতে রাজনীতিক ও বিভিন্ন ধরনের আমলাতন্ত্রের সদস্য- উভয়কেই বুঝতে হবে। শাসক শ্রেণি জনগণের সম্মতি নিয়ে দেশ শাসন করে না। ভোটের তামাশায় তারা জোরজবরদস্তির ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়।
যখন ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে, তখনো জনগণের স্বার্থ দেখবে এমন লোকেরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় না; ভোটে জেতে তারাই, যাদের টাকা আছে। টাকাওয়ালারা নির্বাচনে টাকা খরচ করে, জেতে এবং জিতে আরও বেশি ধনী হয়। তা ছাড়া এমন ঘটনাও তো ঘটে যে, ভোটার আসে না, ভোট দেয় না, তবু কথিত জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে যান এবং দম্ভের সঙ্গে দেশ শাসন করেন। সরকার যে টিকে থাকে সেটা জনসমর্থনের দরুন নয়, ক্ষমতার জোরে ও দাপটে।
বর্তমানে শাসক শ্রেণির জন্য জনসমর্থনের চেয়েও বিদেশি শক্তির সমর্থন অধিক জরুরি হয়ে উঠেছে। মোট কথা, রাষ্ট্রের দায়িত্ব দাঁড়িয়েছে শাসক শ্রেণির স্বার্থকে নিরাপত্তা দেওয়া। নিরাপত্তা বিধানের জন্য আইনকানুন, সরকারি-বেসরকারি বাহিনী- সবকিছুই মজুত রয়েছে। আমাদের এই রাষ্ট্রকে তাই বুর্জোয়া অর্থেও গণতান্ত্রিক বলা যাবে না।
বুদ্ধিজীবীরা কথা বলেন ঠিকই, বলতে হয়, নইলে তারা বুদ্ধিজীবী কেন, কিন্তু তাদের অধিকাংশই কথা বলেন লাইন ধরে। একদল থাকেন সরকারের পক্ষে, কথা বলেন ইনিয়ে বিনিয়ে, সরকারের মুখ চেয়ে। এরা হয়তো ইতোমধ্যেই সুবিধা পেয়েছেন, নয়তো পাবেন বলে আশা করছেন।
সরকারের বিরুদ্ধে যারা বলেন তারাও আশাবাদী; আশা রাখেন যে, এখন পাচ্ছেন না ঠিকই, কিন্তু আগামীতে সুদিন আসবে এবং তখন সুবিধা পাবেন। তবে তাদের কথায় তেমন জোর থাকে না। প্রথমত, গণমাধ্যম তাদের তেমন একটা পাত্তা দেয় না, কেননা গণমাধ্যমের মালিকরা সরকারের বিরুদ্ধে যেতে চান না, ভয় পান। দ্বিতীয়ত, সরকার নিজেও বিরুদ্ধ মত পছন্দ করে না, বিরোধীদের কণ্ঠ রোধ করতে পারলে খুশি হয়।
দুই দলের কোনো দলই জনজীবনের গভীরে যেসব সমস্যা রয়েছে, যেগুলো রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, সেগুলোর দিকে যেতে চায়নি। দৃশ্যমান সমস্যাগুলো যে গভীর এক অসুখেরই প্রকাশ এবং সে অসুখের নাম যে বিদ্যমান পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও আদর্শের দৌরাত্ম্য, সেটা তারা মানতে চান না। মানলে তাদের খুবই অসুবিধা।
তারা চান ব্যবস্থাটাকে যেমন আছে তেমনি রেখে দিয়ে নিজেদের যা প্রাপ্য সেটা বুঝে নিতে। সুবিধা ভাগাভাগির লড়াইটাকে তারা মতাদর্শিক লড়াইয়ের আবরণ দিয়ে ঢেকে রাখতে চান; রাখেনও। কিন্তু যতই লুকোচুরি খেলুন, তারা যে জনগণের পক্ষের শক্তি নন, এ সত্য মিথ্যা হয়ে যায় না।
তা ছাড়া এটাও তো মানতে হবে যে, গভীর ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার চর্চা আমাদের দেশে উৎসাহ পায় না। এখানে মতাদর্শিক বিতর্ক নেই। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নেই। জাতীয় সংসদ আত্মসন্তুষ্ট দম্ভোক্তি, চাটুকারিতা ও অনুপস্থিত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে সর্বক্ষণ মুখরিত থাকে। গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন ও ছবি যত পাওয়া যায়, চিন্তাসমৃদ্ধ রচনা তার শতভাগের এক ভাগও পাওয়া যায় না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের কদর নেই। শিক্ষাক্ষেত্রে তথাকথিত বিস্ফোরণ চিন্তার মানের ও জ্ঞান প্রকাশের ভাষাগত দক্ষতার বৃদ্ধি ঘটিয়েছে, এমনটা বলা যাচ্ছে না, বরং উল্টোটাই ঘটেছে বলে সন্দেহ।
দলীয় আনুগত্যের বাইরে যে বুদ্ধিজীবীরা রয়েছেন, যারা মনে করেন রাষ্ট্র ও সমাজকে গণতান্ত্রিক করতে না পারলে মানুষের মুক্তি আসবে না, তাদের সংখ্যা অল্প। যারা আছেন তারাও সুসংগঠিত নন, পরস্পর বিচ্ছিন্ন এবং তাদের বক্তব্য প্রচার পায় না। সরকার তাদের অপছন্দ করে; গণমাধ্যম তাদের অবাঞ্ছিত বলে জানে।
রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ অবশ্যই আছে। থাকতেই হবে। রাষ্ট্রের যা কিছু ক্ষমতা, আয় উপার্জন, সে তো সাধারণ মানুষের কারণেই। তবে সম্পর্কটা একপক্ষীয়, দ্বিপক্ষীয় নয়। রাষ্ট্র হুকুম দেয়, জনগণ শোনে, শুনতে বাধ্য হয়। জনগণ যা বলতে চায় রাষ্ট্র তা শোনে না। রাষ্ট্র শাসন করে, জনগণ শাসিত হয়। রাষ্ট্র তার সিদ্ধান্তগুলো বিনা বিচারে ও নির্দ্বিধায় জনণের ওপর চাপিয়ে দেয়; জনগণের কিছু বলার থাকে না, তারা শুধু দেখে এবং সহ্য করে।
রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। আইন প্রণয়ন বিভাগে সত্যিকার জনপ্রতিনিধি বলতে প্রায় কেউই থাকে না। ওদিকে বিচার বিভাগ জনগণের বড় অংশের জন্য অনেকটা নিষিদ্ধই হয়ে রয়েছে। আদালতে যেতে হলে টাকা লাগে, গেলে ন্যায়বিচার কতটা পাওয়া যাবে এবং কবে পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে গভীর সংশয় রয়েই যায়। মামলা করে নিঃস্ব হওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল নয়।
রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ তাই মোটেই দ্বিপক্ষীয় নয়, একপক্ষীয় বটে। দুই পক্ষের যোগাযোগের একটি কার্যকর মাধ্যম হতে পারে গণমাধ্যম। গণমাধ্যম পারে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ক্ষোভ-বিক্ষোভকে তুলে ধরতে; পারে কিছু পরিমাণে হলেও রাষ্ট্রকে জবাবদিহির জায়গায় নিয়ে আসতে। কেবল যে পারে তা নয়, পারাটা উচিতও বটে।
কিন্তু আমাদের দেশে গণমাধ্যম সে কাজটা করে না। সরকারের অর্জন, সরকারি ও সরকারপক্ষীয় লোকদের বক্তৃতা-বিবৃতি প্রচার করাটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে গণমাধ্যমের প্রধান দায়িত্ব। এর কারণ মালিকরা সবাই সব সময়ে সরকারপন্থি। এই পক্ষপাত মতাদর্শিক অনুপ্রেরণায় নয়, স্বার্থের টানে।
দেশে বেকার সমস্যা ক্রমাগত ভয়ংকর হয়ে উঠছে। জনজীবনে নিরাপত্তার অভাব বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে মেয়েরা দুঃসহ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অন্য সমস্যা তো বটেই, জনদুর্ভোগের এই দুটি বড় বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছ থেকে যে সরবতা প্রত্যাশিত তা পাওয়া যাচ্ছে না।
দুর্বলকে রক্ষা করা এবং দুর্জনকে দমন করা একটি আদর্শের কথা। এমন আদর্শ রাষ্ট্র পাওয়া কঠিন, এখন তো পাওয়া যাচ্ছেই না।
আমাদের রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ দুর্বলরা রয়েছে দুর্জনদের কর্তৃত্বাধীন। রাষ্ট্র ধনীদের ইচ্ছায় চলে। ধনীরা উৎপাদনের সূত্রে ধনী হয়নি। উৎপাদন যা করার করে মেহনতি মানুষ। ধনীদের অধিকাংশই ধনী হয়েছে প্রতারণা ও লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে। এরা দুর্বল নয়, এরা দুর্জন। এদের পক্ষে দুর্জন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই দুর্জনদের কারণেই দুর্বলরা দুর্বল থাকে এবং অসহায় বোধ করে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো সহজ উপায় নেই।
উত্তরণের জন্য আমরা দীর্ঘকাল সংগ্রাম করেছি, কিন্তু সফল হইনি। সফল না হওয়ার কারণ হচ্ছে আমাদের দেশে কোনো সামাজিক বিপ্লব ঘটেনি। ওপর কাঠামোয় পরিবর্তন এসেছে, উন্নতিও হয়েছে, কিন্তু সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেনি। শাসক-শাসিতের সম্পর্কটা রাজা ও প্রজার যে সম্পর্ক সে রকমেরই রয়ে গেছে।
রাষ্ট্রের নাম বদলেছে, আয়তনে পরিবর্তন ঘটেছে, পুরোনো শাসকদের জায়গায় নতুন শাসক এসেছে, কিন্তু শাসক-শাসিতের সম্পর্কে মৌলিক রদবদল ঘটেনি। ধনীরা গরিবদের জ্বালাতন করে। এ ঘটনা আগেও ছিল, এখনো আছে। ধনবৈষম্য আগের তুলনায় কমে তো নয়ই, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন না আসার কারণ সমাজে বিপ্লব না ঘটা। উত্তরণের জন্য সমাজ পরিবর্তনের অব্যাহত সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এ ব্যাপারে আপসের কোনো সুযোগ দেখি না।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়