যে নদী এক বা একাধিক দেশের রাজনৈতিক সীমান্ত অতিক্রম করে তাকে আন্তসীমান্ত নদী বা অভিন্ন নদী বা ইংরেজিতে ট্রান্সবাউন্ডারি রিভার বলে অভিহিত করা হয়। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ২৬৩টি আন্তসীমান্ত নদী সক্রিয় রয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দুটি দেশের সঙ্গে ছোট-বড় মিলিয়ে আন্তসীমান্ত নদ-নদী রয়েছে ৫৭টি। সরকারিভাবে বাংলাদেশ-ভারত এবং বাংলাদেশ-মায়ানমার আন্তসীমান্ত নদীর সংখ্যা যথাক্রমে ৫৪টি ও ৩টি।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রিভারাইন পিপল-এর ২০২৩ সালের এক গবেষণায় আরও ৬৯টি বাংলাদেশ-ভারত অস্বীকৃত আন্তসীমান্ত নদীর সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমানায় স্বীকৃত ৫৪টি নদীর মধ্যে ৬টি বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করেছে এবং তার মধ্যে ৩টি নদী আবার ভারত হয়ে পুনরায় বাংলাদেশে ঢুকেছে। বাকি ৪৮টি নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে ৩৬টি নদীর ওপর ভারত মোট ৫৪টি ব্যারাজ এবং ড্যাম তৈরি করেছে মূলত জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, নদীর নাব্য বজায় রাখা এবং সেচ ও পানি মজুত রাখার জন্য। তবে যে উদ্দেশ্যেই হোক না কেন, যেকোনো নদীতে বাঁধ বা ব্যারাজ বসানোর অর্থই হলো ভাটি অঞ্চলে পানির প্রাকৃতিক ও যথাযথ প্রবাহে বিঘ্ন ঘটানো। সে জন্য আন্তসীমান্ত নদ-নদীতে বাঁধ বা কোনো প্রতিবন্ধকতা নির্মাণের জন্য কিছু আন্তর্জাতিক আইন আছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ভারত বাংলাদেশের বিষয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই আইনগুলোর যথাযথ তোয়াক্কা করছে না। অভিন্ন নদীতে পানির প্রবাহ নিয়ে সংকট শুধু ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ঘটছে এমন নয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেও একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এই দুটি দেশ ১৯৬০ সালে সিন্ধু নদীর পানিবণ্টন চুক্তি সই করেছিল। কিন্তু তার পরও দেশ দুটি প্রায়ই একে অপরকে চুক্তি লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করেছে। কোশি ও মহাকালী নদী নিয়ে ভারত ও নেপালের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। বর্ষা ঋতুতে যখন উপমহাদেশে ভারী বৃষ্টিপাত হয়, তখন এ-জাতীয় সমস্যা প্রায়ই দেখা দেয়। নিজ দেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বাঁধ নির্মাণ করেছে চীন। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত। ভারতে মোট বাঁধের সংখ্যা সাড়ে ৫ হাজার এবং এখানে আরও সাড়ে ৪০০ বড় বাঁধ নির্মাণাধীন। গঙ্গা নদীর অববাহিকাজুড়ে ভারতের বাঁধ আছে ১৮০টির বেশি।
উত্তর-পূর্ব ভারতের সেভেন সিস্টার্স এলাকায় বয়ে যাওয়া অভিন্ন নদীতে ভারতের প্রায় ৩০টি বাঁধ, ড্যাম ও পানির সংরক্ষণাগার রয়েছে। সিকিমের পর্বতশৃঙ্গ থেকে উৎপন্ন, ভারত ও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের লাইফ লাইন বলে খ্যাত তিস্তা নদীর ওপর ১০টির বেশি বাঁধ-ব্যারাজ ও জলাধার নির্মাণ করেছে ভারত, প্রক্রিয়াধীন আছে আরও ৫টি বাঁধের। তবে বাংলাদেশের জন্য অভিশাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আন্তসীমান্ত নদীতে নির্মিত ভারতের বিশেষ ৩টি বাঁধ।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত ফারাক্কা বাঁধ গঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত, যা প্রায় ৭ হাজার ৩৫০ ফুট লম্বা এবং প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় বানানো হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে চালু হওয়া এই বাঁধটিতে মোট ১০৯টি গেট রয়েছে এবং ফারাক্কা সুপার তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় পানি এই বাঁধ থেকেই সরবরাহ করা হয়। এই বাঁধ তৈরির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল কলকাতা বন্দরের কাছে হুগলি নদীতে জমা পড়া পলি ধুয়ে পরিষ্কার করা এবং গঙ্গার শাখা নদী প্রায়মৃত ভাগীরথীকে পুনরায় গঙ্গার পানিতে জীবন্ত করে তোলা।
তৎকালীন বিভিন্ন সমীক্ষায় বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে, গঙ্গার মতো বিশাল নদীর গতি বাঁধ দিয়ে বিঘ্নিত করলে নদীর উজান এবং ভাটি উভয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে বিনষ্ট হতে পারে। বাংলাদেশের সীমানা থেকে ৬০ কিলোমিটার উজানে ১৯৯৮ সালে গজলডোবা বাঁধ স্থাপিত হয়েছিল তিস্তা নদীর ভারতীয় অংশে। এই বাঁধের ৫৪টি গেট দিয়ে তিস্তার মূল প্রবাহ থেকে পানি বিভিন্ন খাতে মূলত তিস্তা-মহানন্দা খালে প্রবাহিত করা হয়। প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা-মহানন্দা খালের মাধ্যমে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার ও মালদহ জেলায় সেচের পানি সরবরাহ করা হয়, কিন্তু বাংলাদেশে বহমান তিস্তা থাকে পানিশূন্য। ত্রিপুরা রাজ্যের ডম্বুর হ্রদ থেকে উৎপন্ন আন্তসীমান্ত নদী গোমতীর ওপর ১৯৭০-এর দশকে নির্মিত ডম্বুর বাঁধটি বাংলাদেশ থেকে ১২০ কিলোমিটার উজানে অবস্থিত, যা একটি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে স্থাপন করা হয়েছিল। এই বাঁধটি সম্পূর্ণভাবে খোলা হয়েছিল ১৯৮৪, ১৯৯৩ ও ২০২৪ সালে।
বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা গঙ্গা তথা পদ্মানির্ভর এবং গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকার প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ এই নদীর সেবা পেয়ে আসছে। এই নদী প্রায় ৭০০ কিলোমিটার উপকূল বরাবর জীবজাগতিক বৈশিষ্ট্য বজায় রাখে। শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কার মাধ্যমে গঙ্গার পানি অপসারণের ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মরূকরণ শুরু হয়েছে, প্রমত্তা পদ্মা শুকিয়ে এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে, নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে, বর্ষায় দেশের উত্তরাঞ্চলে তীব্র বন্যা দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশকে কৃষি, মৎস্য, বনজ, শিল্প, নৌপরিবহন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, যার পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমস্থল আরিচা ঘাটে আগের তুলনায় বর্তমান মৎস্য উৎপাদন মাত্র ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ভারতের সিকিম থেকে উৎপন্ন তিস্তা, পশ্চিমবঙ্গ হয়ে রংপুর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্র নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে, যা বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী। তিস্তার অববাহিকা আনুমানিক ১২ হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানায় তিস্তার ওপর নির্ভরশীল প্রায় ২ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা। তিস্তা বাংলাদেশের প্রধান ফসল বোরো ধান চাষের জন্য পানির প্রাথমিক উৎস এবং মোট ফসলি জমির প্রায় ১৪ শতাংশের সেচ প্রদান করে। তিস্তা ব্যারাজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প। এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত জেলা ৬টি ও এর আওতাভুক্ত এলাকা সাড়ে ৭ লাখ হেক্টর। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণের আগে বাংলাদেশের ডালিয়া সীমান্তে তিস্তার বার্ষিক গড় পানিপ্রবাহ ছিল প্রায় ৬ হাজার ৭০০ কিউসেক যা, গজলডোবা ব্যারাজ চালু হওয়ার পর কমে ২ হাজার কিউসেকে দাঁড়ায়। শুষ্ক মৌসুমে সর্বনিম্ন পানিপ্রবাহ ১ হাজার ৫০০ থেকে ৩০০ কিউসেকে নেমে আসে। তিস্তা অববাহিকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গত এক দশকে প্রায় ১০ মিটার নিচে নেমে গেছে। কৃষকদের সেচের খরচ অনেক গুণ বেড়েছে এবং কৃষিব্যবস্থাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। তিস্তায় পানি ঘাটতির কারণে প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদনের ক্ষতি হচ্ছে। এটা দেশের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৯ শতাংশের সমান।
এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের চাল উৎপাদন প্রায় ৮ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১৪ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। দেশের উত্তরবঙ্গের খাল-বিল, পুকুর, জলাশয় শুকিয়ে যাচ্ছে, যার সঙ্গে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানি না থাকার সম্পর্ক রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে পুরো উত্তরবঙ্গের পরিবেশগত ভারসাম্য বিনষ্ট হতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল হয়ে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত প্লাবিত সাম্প্রতিক বন্যার প্রক্ষাপটে অনেকে দাবি করছেন, ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত গোমতী নদীর ওপর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ধলাইতে অবস্থিত ডম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে। যদিও সেখানে পাহাড়ি অঞ্চলে সৃষ্ট ডাকাতিয়া নদীর পানি বৃদ্ধিও গোমতীর পাশাপাশি নদী প্লাবনে ভূমিকা রেখেছে। গত ২৬ আগস্ট ফারাক্কা ব্যারাজের ১০৯টি গেট খুলে দিয়ে ফিডার ক্যানেলে ৪০ হাজার কিউসেক ও ডাউন স্ট্রিমে ১১ লাখ কিউসেক পানি ছাড়া হয়েছে। এতে নদীতে প্রচণ্ড ঢেউ এবং ভাঙন দেখা দিয়েছে। ফারাক্কা ব্যারাজ এলাকায় পানি বিপৎসীমার ৭৭ দশমিক ৩৪ মিটার ওপর দিয়ে বইতে থাকায় বাধ্য হয়ে গেট খুলতে হয়েছে বলে ভারত জানিয়েছে।
এশিয়ার বৃহত্তম ১০টি নদীর উৎস বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ওয়াটার টাওয়ার হিসেবে খ্যাত হিন্দুকুশ হিমালয় অঞ্চলে, যা বাংলাদেশের অনেকটা উজানের উচ্চধারায় অবস্থিত। অধুনা বাংলাদেশে প্রবাহিত মোট নদীর সংখ্যা ১ হাজার ৮টি বলে প্রকাশ করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এসব নদী দিয়ে প্রবাহিত উজানের দেশগুলোর পানি নিম্নে ধাবিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে নেমে যাবে, এটাই চিরন্তন প্রক্রিয়া। দেশের অভ্যন্তরে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির প্রবেশ ঠেকানো এবং সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান টিকিয়ে রাখতেও এই নিম্নধারার পানির প্রবাহ বজায় রাখা জরুরি। গবেষণায় দেখা গেছে, উজান থেকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে নেমে যাওয়া পানির ৫৬ শতাংশ ভারতের ও ৪৪ শতাংশ বাংলাদেশের অভ্যন্তরের। তাই প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতকেও উপলব্ধি করতে হবে যে, উজানে নির্মিত তাদের বাঁধগুলো পানির ন্যায্য অধিকার থেকে বাংলাদেশকে যেমন বঞ্চিত করছে, তেমনি অকালবন্যায় প্লাবিত করছে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, যার কারণে নষ্ট হচ্ছে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ, বাড়াচ্ছে জনদুর্ভোগ।
সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থানে থাকায় ভারত বাংলাদেশের দক্ষিণে বা ভাটিতে নেই, তবু ভারতের পানি আগ্রাসন বা অসম পানিবণ্টন বাংলাদেশের জন্য ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। অভিন্ন নদীগুলোর পানি সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাস, আস্থা, সম্প্রীতি এবং সহযোগিতার ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত ও গভীরতর করতে পারে। প্রতিবেশী দুটি দেশের মধ্যে সহযোগিতার নতুন নতুন ক্ষেত্র যেমন বন্যানিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ সংরক্ষণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ নানাবিধ উপকারী প্রকল্প গ্রহণে সহায়ক হতে পারে এবং বর্তমানের পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আগামীতে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধিতে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
[email protected]