দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে উন্নয়নের নামে নির্বিচারে একধরনের লুণ্ঠন করা হয়েছে। দুর্নীতি, লুণ্ঠন, আত্মসাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা ও লুণ্ঠনকারীকে সুরক্ষা দেওয়াসহ পছন্দমাফিক বিনিয়োগকারী ও ঠিকাদারকে বাছাই করা হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে এই কাজ করার সঙ্গে যারাই জড়িত ছিলেন, তারা সবাই অপরাধী। প্রতিযোগিতাবিহীন বিনিয়োগে যাকে খুশি, যখন খুশি, যত খুশি তত ব্যয়ে নিঃশর্তে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কথিত উন্নয়ন চলেছে। আজ ১৫-১৬ বছর পর এসে আমরা ঠিক আগের মতোই বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের সংকট দেখছি। বরং সংকট নানা দিক দিয়ে নানাভাবে আরও তীব্র ও ঘনীভূত হয়েছে। এর কারণ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিবিড়ভাবে জড়িত। মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট এখন চরম আকার ধারণ করেছে। লুণ্ঠনের অর্থ জোগানোর কারণে এমনটি হয়েছে। সরকার যদি জ্বালানিসংকট দূর করার জন্য তা ব্যয় করত, অর্থাৎ জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রকৃত উন্নয়নে সেই অর্থ ব্যয় হলে আজ দেশের এই অবস্থা হতো না। দেশজুড়ে লোডশেডিং থাকত না। দেশে মূল্যস্ফীতি হতো না এবং দেনার দায়ে দেশকে এ খাতে নাজুক অবস্থায় পড়তে হতো না। এসব সৃষ্টির মাধ্যমে সে সময়ের ক্ষমতাসীনরাই লাভবান হয়েছেন। এমনকি তারা নিজেরাও এর অংশ বলতেই হবে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে পরিকল্পনামাফিক সংস্কার করতে হবে। সম্প্রতি কিছু করণীয় প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে ‘সংস্কার কমিশন’ গঠনের কথা বলা হয়েছে। কমিশন সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়ন করবে। সে ক্ষেত্রে প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে দেখা যাবে, লুণ্ঠনের কারণে বিদ্যুৎ ও জালানি খাতে যে ব্যাপক ঘাটতি তৈরি হয়ে আছে, মূল্যবৃদ্ধি করেও সমন্বয় করা যায়নি, সেই ঘাটতি দ্রুত কমে আসবে। বিগত সরকার জ্বালানি খাতে যে গভীর সংকট তৈরি করে গেছে, রাতারাতি তা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য সময় দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে কর্মপরিকল্পনার আওতায় ভোক্তাদের অন্তর্ভুক্তিতে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন শুরু হলে দ্রুত এর সুফল দৃশ্যমান হবে। লুণ্ঠনমূলক ব্যয় হ্রাস পাবে। মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা প্রশমিত হবে। সে ক্ষেত্রে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে এবং ক্রমান্বয়ে তা হ্রাস পাবে।
বিদ্যুৎ ও জালানি খাতে রূপান্তর ঘটাতে তিনটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। প্রথমত, নীতিগত কৌশল গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, অপচয় কমানোর কৌশল নিতে হবে। তৃতীয়ত, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অতিরিক্ত ব্যয় কমানো উচিত। অতিরিক্ত ব্যয় বৃদ্ধির দ্বারা যথেচ্ছ লুণ্ঠন করা হয়। জ্বালানি খাতকে রাজস্ব আহরণের বিশেষ খাত বলে মনে করা হতো। এ খাতকে এক দিকে লাভজনক করার অভিপ্রায়ে যত বেশি মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, তত বেশি সরকারের লাভ হয়েছে। সরকার ট্যাক্স-ভ্যাট পেয়েছে ও সরকারি কোম্পানি থেকে মুনাফার ভাগ নিয়েছে। এখন বর্তমান সরকারকে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, রাষ্ট্র এ খাতকে রাজস্ব বা মুনাফা আহরণের খাত হিসেবে দেখবে না। বিদ্যুৎ বা জ্বালানি খাত মুনাফা ও রাজস্ব আহরণের খাত হওয়ায় যত মূল্যহার বাড়ে, সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা ও রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বাড়ে। ফলে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতাও বৃদ্ধি পায়। সরকারের ভূমিকায় তাতে উসকানি জোগায়। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে এখানেই বিপত্তি। মুনাফাবিহীন কার্যক্রম ও সরকারের রাজস্ব আহরণ নিয়ন্ত্রণে থাকলে মূল্যবৃদ্ধিও নিয়ন্ত্রণে থাকে। বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার প্রায় ট্যাক্স-ভ্যাট কমায়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ক্ষেত্রে তা কখনো হয়নি; যা লুণ্ঠন সুরক্ষার শামিল।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আমাদের চাহিদা বেড়েছে বটে। সে ক্ষেত্রে দেশে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ হয়নি। সে জন্য বিদেশ থেকে আমাদের আমদানি করতে হয়। তেল আমদানি বৃদ্ধি না করে নিজস্ব গ্যাসের মজুত ও উত্তোলন বৃদ্ধির পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে এলএনজি আমদানি বৃদ্ধিতে অগ্রসর হলে জ্বালানি সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। জনগণকে মূল্যবৃদ্ধি ও চরম জ্বালানিসংকটের অভিঘাতের শিকার হতে হবে না। বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে।
অথচ আমাদের মতো দরিদ্র দেশে সরকার নিজস্ব গ্যাসের মজুত বৃদ্ধি না করে জ্বালানি তেল ও এলএনজি আমদানি বাড়ায়। এতে জনগণের জীবন রক্ষার মতো মৌলিক অধিকার বিপন্ন হয়। নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের বিকল্প নেই। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদন ব্যয় ন্যায্য ও যৌক্তিক নয়। উৎপাদন ব্যয় লুণ্ঠনমূলক এবং গড়ে ১৩-১৪ টাকা। এই উৎপাদন ব্যয় জরুরি বিবেচ্য বিষয়। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমাতে না পারলে তা আর্থিক ঘাটতি বৃদ্ধিতে অন্যতম নিয়ামক হবে। সৌরবিদ্যুতের সুফল ভোক্তা পাবে না। মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাতের শিকার হবে। বিদ্যুৎ আমদানি বাজার তৈরিতে সহায়ক হবে। পরিবেশ সুরক্ষিত হবে। ছাদ এবং অব্যবহৃত জমি ব্যবহার করে ৫০ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। তাতে ৪ টাকার মতো খরচ পড়ে। প্রতিযোগিতামূলক বিনিয়োগে উৎপাদন হলে ৬-৭ টাকা বিক্রয় মূল্যহারে এ বিদ্যুৎ বাজার উন্নয়ন সম্ভব। তেমনটা হলে সৌরবিদ্যুৎকে খুব ভালো বিকল্প বলতে হবে। পারমাণবিক বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও দামের বিষয়টি আগে আলোচনায় আসা দরকার। যে সৌরবিদ্যুৎ ৪ টাকায় উৎপাদন করা যায়, তা ১২-১৩ টাকা মূল্যহারে কেনা হচ্ছে। যে কয়লা বিদ্যুৎ পুরোনো মেশিনসহ নানা সীমাবদ্ধতায় ১০ টাকা ব্যয় হারে উৎপাদন হয়, সেই বিদ্যুৎ আমদানি করা কয়লায় উৎপাদন হয় ১৪ টাকারও বেশি ব্যয় হারে। পারমাণবিক বিদ্যুতের দাম যদি আমদানি বিদ্যুতের মতো বেশি হয়, তাহলে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এ বিদ্যুতের ভূমিকা কী হবে? বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় তথা বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে তা কতটা ভূমিকা রাখবে? এমন সব প্রশ্নের মীমাংসার ওপর নির্ভর করছে এই বিদ্যুতের ওপর কতটা নির্ভর করা যায়।
অন্তর্বর্তী সরকারকে খাদ্যনিরাপত্তার মতোই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বস্তুত খাদ্যনিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্যই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়ন বাণিজ্যিক খাত হিসেবে নয়, কৃষি খাতের মতো সেবা খাত হিসেবে হতে হবে। এই বিবেচনায় ক্যাবের প্রস্তাবিত সংস্কার প্রস্তাবের আলোকে যদি সরকার জ্বালানি রূপান্তর বিবেচনায় নেয়, তাহলে মূল্যবৃদ্ধি ব্যতীত ঘাটতি সমন্বয় হবে এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে বলে আমরা আশাবাদী।
লেখক: জ্বালানি উপদেষ্টা, ক্যাব