কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম বিতর্ক আমেরিকার জনগণের কাছে দিকনির্দেশনার এক বিশেষ মুহূর্ত। তাদের বক্তব্যকে পর্যায়ক্রমে বিশ্লেষণ করেছেন কয়েকজন লেখক। তাদের মধ্যে মোস্তফা বায়োমি, যিনি গার্ডিয়ানের একজন আমেরিকার কলামিস্ট; লাটোশা ব্রাউন হলেন ব্ল্যাক ভোটার ম্যাটারের সহ-প্রতিষ্ঠা এবং লয়েড গ্রিন নিউইয়র্কের একজন অ্যাটর্নি, যিনি ১৯৯০ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত মার্কিন বিচার বিভাগে নিযুক্ত ছিলেন।...
ট্রাম্প পুরোটা নড়বড়ে: মোস্তফা বায়োমি
বিতর্কের পুরো সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প একবারও কমলা হ্যারিসের নাম উচ্চারণ করেননি, যা চরম অসম্মানের লক্ষণ। তিনি যা করেছিলেন তা হলো হ্যারিসকে চুপ করে রাখার চেষ্টা। ‘আমি এখন কথা বলছি’- এমন কথা বলে হ্যারিসকে দমানোর চেষ্টা করেন। তিনি নির্লজ্জের মতো বলেন যে, ‘প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হ্যারিসকে ঘৃণা করেন। বাইডেন তাকে সহ্য করতে পারেন না’। কমলা হ্যারিস তার এই হাস্যকর কথা শুনে আত্মবিশ্বাস নিয়ে হেসে উঠলেন।
ট্রাম্প তার নিজের বিবৃতিতে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন যে, তিনি ২০২০ সালের নির্বাচনে প্রথমে একজন মদ্যপায়ী উন্মাদের কাছে হেরেছিলেন। আমেরিকানদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার দীর্ঘ একটি পরিকল্পনা আছে।’ গত ৬ জানুয়ারিতে ক্যাপিটলে তার ওপর আক্রমণের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন।
তিনি প্রতিক্রিয়ায় জানান, তারা আমাকে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ দিতে পারত। ট্রাম্প চাপে পড়ে নড়বড়ে অবস্থা। তিনি তার অতীত কর্মের জন্য কোনো দায়বদ্ধতা নিতে চাননি। এর পরিবর্তে তিনি তার নির্বাচনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্ভাবনী বক্তব্য ছুড়ে দেন।
কমলা হারিসের চেহারায় জয়ী ভাব। তিনি যেন এক চমক নিয়ে বেরিয়ে এলেন, তার ওপর ট্রাম্পের আক্রমণগুলোকে নির্দেশ করলেন। এমন একটি যুক্তি উপস্থাপন করলেন যে, ভবিষ্যৎ সুযোগের ওপর নির্ভর করে, ভয়ের ওপর নয়। তিনি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ট্রাম্পকে বললেন, আপনি এমন এক ব্যক্তি যিনি সমস্যার সমাধান না করে সমস্যা সৃষ্টি করেন।
কমলা হ্যারিসের নীতিগত অবস্থান স্পষ্টতই গণতান্ত্রিক ধারার দিকে রয়েছে। তিনি সীমান্তে টহলরত কর্মীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে অভিবাসীরা ঢুকতে না পারে। তিনি গর্ভপাতের অধিকারকে রক্ষা করার ব্যাপারে সম্মত। তিনি ফিলিস্তিনিদের জন্য কোনো নীতি পরিবর্তনের প্রস্তাব দেননি।
বরং তিনি যুদ্ধবিরতির জন্য আহ্বান করেছেন। বিতর্কে কমলা হ্যারিস জয়ী হন। তার পারফরম্যান্স এবং আইডিয়াগুলো ব্যতিক্রম। তবে তার এই ধারণাগুলো উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা করা ও পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
শক্ত হাত বনাম বেপরোয়া আবেগপ্রবণতা: লাটোশা ব্রাউন
এই বিতর্কটি আমেরিকান জনগণের জন্য একটি বিশেষ মুহূর্ত ছিল। কারণ কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে সম্পূর্ণ বিপরীত মতপ্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছিল। শুরু থেকেই কমলা হ্যারিস সুন্দরভাবে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তার নেতৃত্বে ভদ্রতা, প্রস্তুতি এবং দেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেছেন।
তিনি কেবল ট্রাম্পের সঙ্গে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দেননি, তিনি নিজেকে আমেরিকান জনসাধারণের কাছে একজন শক্তিশালী ও যোগ্য নেতা হিসেবে পুনরায় পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। যিনি দেশের কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে কাজ করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত।
বিপরীতে ট্রাম্প শৃঙ্খলাহীন এবং অপ্রতিরোধ্য দেখালেন। বিশৃঙ্খল নেতৃত্বের জন্য তিনি অনুস্মারক হিসেবে থাকবেন। তার পারফরম্যান্স প্রস্তুতির অভাব এবং সমালোচনামূলক বিষয়ে চিন্তাভাবনা করার অক্ষমতাকে তুলে ধরে। হ্যারিস যখন উত্থান এবং ক্ষমতায়নের চেষ্টা করেছিলেন, ট্রাম্প তখন বিভাজনমূলক বক্তব্যের আশ্রয় নিয়েছিলেন। ট্রাম্প মানুষকে নিরাময়ের পরিবর্তে একটি জাতিকে আরও বিচ্ছিন্ন করেছেন।
আমেরিকান জনগণ একটি শক্ত হাত এবং বেপরোয়া আবেগের মধ্যে পার্থক্য প্রত্যক্ষ করেছেন। ট্রাম্প বলেন, আমেরিকানদের পছন্দ পরিষ্কার নয়। তিনি বলেন, তার কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও বিশেষ একটি পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি নেতৃত্ব দিয়ে নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করে এগিয়ে নিয়ে যতে চান। অন্যদিকে হ্যারিস বলেছেন, আমরা পেছনে ফিরে যাচ্ছি না।
হ্যারিস বিতর্কে জয়ী: লয়েড গ্রিন
এই বিতর্কে জয়ী হন কমলা হ্যারিস। বক্তৃতার বেশির ভাগ সময়ই কথা বলেছেন ট্রাম্প। কিন্তু তাতে তার কোনো উপকার হয়নি।
অভিবাসন ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে হ্যারিসকে আক্রমণ করেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি হ্যারিসকে মার্কসবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং তার সমাবেশের আকার নিয়ে বড়াই করেন।
তিনি হাঙ্গেরির ভিক্টর অরবানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন এবং অভিবাসীদের ফিডোর দিকে ঝুঁকে পড়ার জন্য দোষারোপ করেন। এখানে যারা বসবাস করছে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
হ্যারিস ট্রাম্পকে গর্ভপাতের অধিকার এবং গণতন্ত্র লঙ্ঘনের জন্য দোষারোপ করেন। তিনি কোভিডের সময় চীনের ভূমিকা নিয়ে নিন্দা করেছিলেন। কারণ ট্রাম্প চীনের প্রেসিডেন্ট শিকে কোভিডের সময় কিছু খারাপ উদ্যোগ নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। কমলা হ্যারিস বলেন, ‘যখন আমরা জানতে পারব যে, কোভিডের উৎস সম্পর্কে সঠিক তথ্য না দেওয়া বা স্বচ্ছতা না থাকার জন্য শি দায়ী ছিলেন, তখন আমরা অনুতপ্ত হব।’
কমলা হ্যারিস তখন প্রসিকিউটর হিসেবে ছিলেন। তখন ট্রাম্প আত্মহননে ভুগছিলেন। তিনি তাকে ৬ জানুয়ারির কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তখন ট্রাম্প বারবার তরুণদের বলছিলেন যে, ‘ফিরে দাঁড়ান এবং আমার পাশে দাঁড়ান।’
নির্বাচন অত্যাসন্ন। ট্রাম্প ও হ্যারিসকে পেনসিলভানিয়ায় খুবই প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। কারণ মিশিগান ও উইসকনসিনে ডেমোক্র্যাটরা কিছুটা পিছিয়ে রয়েছেন। সম্মেলনের পর উত্তেজনা হ্রাস পেয়েছে। ট্রাম্পের জীবনে এটাই সবচেয়ে বড় চেষ্টা। তাদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রটা এখন যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনের মাত্র দুই মাসেরও কম বাকি। কিন্তু দলের রাজনীতি দীর্ঘকালের।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জুনের বিতর্কের পারফরম্যান্স এতটাই বিপর্যয়কর ছিল যে, দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতার প্রতিযোগিতায় তিনি হেরে যান এবং তার জায়গায় কমলা হ্যারিসকে বসানো হয়।
কমলা হ্যারিসের প্রতিভা সুপ্ত ছিল। হ্যারিস তার শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিয়েছেন, যখন তিনি ট্রাম্পকে অভিজাত হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যিনি সাধারণ আমেরিকানদের কথা কখনো চিন্তা করেন না। এমনকি হ্যারিসের বংশ-পরিচয় নিয়ে কথা বলেছেন। ট্রাম্প শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে নীতি অনুসরণ করেছেন।
ট্রাম্পের ২০১৬ সালের ‘পপুলিজম সংস্করণ’ আমেরিকানদের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। তার ২০২৪ নির্বাচনি ইশতেহার কিছুটা অপ্রকাশিত। আগামী নির্বাচন, অভিবাসন, গর্ভপাত আইনসহ অগণিত মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছেন ট্রাম্প।
ফলে ট্রাম্পের আগামী নির্বাচনে নিরাপদে অবস্থান করাটা কঠিন হবে। আমেরিকায় হ্যারিস তার উদ্বিগ্নতা ও ন্যায্য ক্ষোভের কথা বলতে চান না। হ্যারিস নিজেকে হিলারি ক্লিনটনের মতো নিজেকে উচ্চ অবস্থানে রাখতে চান।
লেখক: সভাপতি, দ্য নেশন ও প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, জ্যাকবিন এবং দ্য সোশ্যালিস্ট মেনিফেস্টো: দ্য কেস ফর রেডিক্যাল পলিটিক্স ইন এন এরা অব এক্সট্রিম ইনক্যালিটিসের লেখক।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল