অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর বলা হচ্ছিল যে, দেশের অভ্যন্তরের চাহিদা পূরণ করে এ বছর আর ভারতে ইলিশ মাছ রপ্তানি করা হবে না। কিন্তু পরবর্তীকালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা বলে ভারতে ইলিশ মাছ রপ্তানি করা হচ্ছে অনেকটা তাদের অনুরোধক্রমে। এই নির্দেশনার ফলে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন মাছের পাইকারি বাজারে ইলিশ
মাছের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে খুচরা বাজারে।...
নদীমাতৃক দক্ষিণাঞ্চল। প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চল রুপালি ইলিশের জন্য বিখ্যাত। পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা, বরগুনা- এসব জেলার আশপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কীর্তনখোলা, আরিয়াল খাঁ, বলেশ্বর, তেঁতুলিয়া, আন্ধারমানিক, কালাবদর, মেঘনা ইত্যাদি নদী আর কুয়াকাটাসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে বলতে গেলে সারা বছরই কমবেশি ইলিশ মাছের দেখা মেলে। আর সে জন্যই এই অঞ্চলের উপকূলবর্তী হাজার হাজার জেলে পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হয় প্রধানত ইলিশ ধরা আর বেচাকেনা করে। বছরের পর বছর বংশানুক্রমিক তারা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে-পরে কোনোরকমে এভাবে জীবন কাটিয়েছে, এখনো কাটাচ্ছে।
দুই যুগ আগেও বরিশালের পোর্ট রোডের পাইকারি ইলিশের আড়তের ভেতরে-বাইরে দুপুর থেকে বিকেলের মধ্যে বিভিন্ন নদনদী ও সাগর থেকে ধরে আনা ইলিশের স্তূপ দেখা যেত।
সন্ধ্যার আগে আগে ছোট-বড় ট্রাকে করে বরফে ঢেকে সেই মাছের বেশির ভাগ চলে যেত দেশের বিভিন্ন স্থানে, প্রধানত উত্তরবঙ্গে। কিছু রপ্তানির মাধ্যমে বেনাপোল বন্দর দিয়ে চলে যেত কলকাতায়।
তার পরও কোনো কোনো দিন মাছ থেকে যেত, তার থেকে কিছু লবণ মাখিয়ে বিক্রির চেষ্টা হতো, দামের কথা আর নাই বা বললাম। তার পর যা থাকত মাটিচাপা দিয়ে নষ্ট করে ফেলা হতো। কারণ ওই মাছ আর পরের দিন চলত না। এসব যারা না দেখেছে, এখন তাদের এসব কথা বিশ্বাস করা কঠিন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু তখন বাস্তব সত্য ছিল এটাই।
তার পর নদীর স্রোতের মতো চলে গেছে অনেক সময়। তারই সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে অনেক কিছু। শহরাঞ্চল থেকে গ্রামীণ পরিবেশ উধাও হয়ে গেছে। বড় বড় রাস্তা হয়েছে, তার দুই পাশে এখন আর ছোট-বড় পাকা ঘরবাড়ির অভাব নেই। লক্ষ করলে দেশজুড়ে দেখা যাবে একই চিত্র। পাশাপাশি জ্যামিতিক হারে বেড়েছে মানুষ। বেড়ে যাওয়া মানুষের বসবাসের জন্য কত যে জলাশয় রূপান্তরিত হয়েছে বাসস্থানে, তার কি কোনো ঠিক-ঠিকানা আছে?
সবকিছু সামাল দিতে সরকারি আইনেরও
অদল-বদল হয়েছে। আজকে সেই রুপালি ইলিশ নিয়ে প্রায় কাড়াকাড়ি চলে। এমনভাবে দাম বেড়েছে, যাতে করে ইলিশ মাছ চলে গেছে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
এবারে এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। প্রথমত, এবারে অন্যবারের তুলনায় জেলেদের জালে কম মাছ ধরা পড়ছে। দ্বিতীয়ত, হঠাৎ করে কয়েকদিন আগে দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৪৯টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতি কেজি ১০ ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশি প্রায় ১২০০ টাকা হিসেবে সর্বমোট ২৪২০ টন ইলিশ মাছ ভারতে রপ্তানির জন্য অনুমোদন দিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, আগামী ১২ অক্টোবরের মধ্যে এই মাছ রপ্তানি করতে হবে। কারণ নিয়মমাফিক ১৩ অক্টোবর থেকে ইলিশ ধরা, বাজারজাত করা এবং সব ধরনের ক্রয়বিক্রয় বন্ধ হয়ে যাবে কিছুদিনের জন্য।
এবারে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর বলা হচ্ছিল যে, দেশের অভ্যন্তরের চাহিদা পূরণ করে এ বছর আর ভারতে ইলিশ মাছ রপ্তানি করা হবে না। কিন্তু পরবর্তীকালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা বলে ভারতে ইলিশ মাছ রপ্তানি করা হচ্ছে অনেকটা তাদের অনুরোধক্রমে।
এই নির্দেশনার ফলে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন মাছের পাইকারি বাজারে ইলিশ মাছের দাম মণপ্রতি ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা বেড়ে গেছে। লাগামহীনভাবে বেড়েছে খুচরা বাজারে।
এদিকে দেশের বিভিন্ন নদনদীতে ইলিশ মাছের প্রজনন ও উৎপাদন বাড়াতে এবং ১০ ইঞ্চি লম্বা ছোট ইলিশ, যাকে আমরা ‘জাটকা ইলিশ’ বলি রক্ষার্থে, নদী থেকে আহরণ, পরিবহন ও বেচাকেনা করা আগে থেকেই কিছুদিনের জন্য আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিবছরই এই নিয়ম পালন করা হয়। বলা হয়, এই আইন অথবা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে গুনতে হবে জরিমানা, যেতে হবে জেলে।
বলা বাহুল্য, এই নিষেধাজ্ঞার সময়টাতেই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় গরিব জেলেদের। মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নেওয়া অর্থ পরিশোধের বিষয়টি তখন তাদের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দেখা দেয়। যদিও এই সময় জেলেদের জীবিকা নির্বাহের জন্য সরকারি কিছু অনুদান দেওয়া হয়, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি এই আইন নানাভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে অর্থ ও প্রভাবশালী ব্যক্তি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং মৎস্য ব্যবসায়ীদের কৌশলের কারণে।
তার ফলে এখন চলমান নিষেধাজ্ঞার সময়ও ক্ষমতাবানদের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন জেলার ছোট-বড় মাছের বাজারে জটকা কেনাবেচা হয়, বলা যায় তা অবাধেই চলতে থাকে। যদিও মাঝে মাঝে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা অবৈধভাবে ‘জাটকা’ ধরা ও বেচাকেনা বন্ধে অভিযান চালান এবং উদ্ধারকৃত জাটকা ও কারেন্ট জাল জব্দ করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন। ক্ষেত্রবিশেষে ৫-১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা কখনো কখনো তার সঙ্গে যোগ করা হয় আট-দশ দিনের জেল। তাতেই জাটকা ধরা, পরিবহন ও ক্রয়বিক্রয় একেবারে বন্ধ হয়ে যায়, সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
তাই অভিজ্ঞজনরা কখনো কখনো এ ধরনের অভিযান চালানোকে মূলত ‘লোক দেখানো’ বলে মনে করেন। কারণ বছরের পর বছর এ ধরনের অভিযান চলতেই থাকে। কঠোরভাবে কোনো আইনকানুন মানা হয় না, তেমনভাবে কারোর কোনো শাস্তিও হয় না। তাছাড়া জব্দকৃত বিপুল পরিমাণ জাটকা ধরার কারেন্ট জাল পুড়িয়ে ফেলা হলেও কখনো এর উৎপাদন বন্ধের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না।
ইলিশ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী এবং জেলেদের অভিমত, বর্তমানে জাটকা ইলিশের বিচরণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে প্রধানত চাঁদপুর, বরিশাল এবং ভোলা, মেহেন্দিগঞ্জ ও শরীয়তপুরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মেঘনা এবং তার শাখা নদীগুলো।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বিগত ৮-১০ বছর আগের চাইতে এখন নানা কারণে ইলিশ মাছের উৎপাদন বেড়েছে। অবশ্য প্রতিবছর তেমনটা দেখা যায় না। কোনো কোনো বছর তুলনামূলকভাবে ইলিশ উৎপাদনে ঘাটতিও দেখা দেয়। যে কারণে গরিব জেলেদের দাদনের টাকা ফেরত দিতে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।
সাধারণত, প্রজননকালীন বেশির ভাগ সময় মেঘনা, বলেশ্বর, তেঁতুলিয়া, কালাবদর ইত্যাদি নদী মা ইলিশের বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হয় মিঠা পানির কারণে। ডিম ছাড়ার পর পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জন্ম লাভ করে ১ সেন্টিমিটার পর্যন্ত আকারের ইলিশ, যা অন্তত তিন মাস পর্যন্ত মা ইলিশের সঙ্গেই বিভিন্ন নদনদীতে বিচরণ করে এবং এই সময়ের মধ্যে আকারে ১২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বড় হয়। এ জন্য এই সময় ইলিশ ধরা, বহন ও বেচাকেনা নিষিদ্ধ করা হয়।
বরিশাল অঞ্চলে বিভিন্ন নদীতে প্রচুর ছোট ইলিশ অর্থাৎ জাটকা ইলিশের দেখা মেলে। আর সে কারণেই আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এই সময়ে ইলিশ নিধন বন্ধে তৎপর থাকেন।
তার পরও দেখা গেছে, প্রতিবছর মেঘনা নদী থেকেই অসংখ্য জেলে শত শত মণ জাটকা আহরণ করে বিভিন্ন নির্ধারিত পয়েন্টের মাধ্যমে বাজারজাত করে থাকে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, মহাজন ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের ছত্রছায়ায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্থানীয় প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য কমে গেলে ইলিশের উৎপাদন এবং সরবরাহ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
লেখক: খবরের কাগজের বরিশাল বিভাগীয় উপদেষ্টা
[email protected]