বাইরে পৃথিবী অসুখে ভুগছে, দুই দেশের বেশ কিছু মানুষ আমাকে নিয়ে ভাবনায় উন্মাদপ্রায় হয়েছে। কিন্তু আমি তখন কী সুখে যে সময় কাটাচ্ছি, তা আমিই জানি। কাজটা হয়তো ঠিক করিনি।
বাংলাদেশে গেলে আমি ঢাকা ক্লাবে, হোটেলে বা গেস্ট হাউসে থেকেছি বেশির ভাগ সময়, কিন্তু কখনো কখনো দু-একটি পরিবারের সঙ্গেও থেকেছি। কারণ এই দীর্ঘকাল ধরে যাতায়াতের ফলে সেখানে আমার কিছু পুত্র-কন্যাও আমি পেয়েছি। হাসিব রহমান সেই রকম একটি অর্জিত পুত্র। তার বাবা মোহম্মদ হাবিবুর রহমানের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল, তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ, ‘শিক্ষাকোষ’ বলে একটি শিক্ষাবিষয়ক বিশ্বকোষ তিনি সম্পাদনা করেছিলেন।
কিন্তু হাসিব হলো কম্পিউটারে ভাষাপ্রযুক্তির বিশেষজ্ঞ, তার সঙ্গে অন্য সূত্রেও আমার বাংলা একাডেমিতে আলাপ হয়। তখন (২০১০-১২) আমরা ঢাকার বাংলা একাডেমিতে ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ তৈরি করছিলাম। সেই থেকে আমি হাবিব ভাইয়ের পরিবারের আত্মীয় হয়ে যাই। অত্যন্ত অমায়িক ও সজ্জন ওই মানুষটি কবছর আগে প্রয়াত হয়েছেন, কিন্তু ওদের ফ্ল্যাটে আমার আতিথ্য আর আনুষঙ্গিক আপ্যায়ন সব সময় উদ্যত থাকে। এর আগে বার দুয়েক আমার ওদের বাড়িতে থাকা হয়ে গেছে।
এবারে যারা আমাকে আমন্ত্রণ করেছিল, তারা হাসিবের কেউ নয়। প্রয়াত নাট্যকার সেলিম আল দীনের শ্যালক সেলিমের ৭৫ বছরের জন্মজয়ন্তী উৎসবের শুরুর অনুষ্ঠানটি আমাকে উদ্বোধন করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তার এক সহকারী হাসিবের পরিচিত, সে-ই হাসিবের ওখানে আমার থাকার ব্যবস্থা করে। হাসিবরা সানন্দে রাজি হয়, কাজেই আমারও দ্বিধার কোনো পরিসর ছিল না। হাসিবই আমাকে এয়ারপোর্টে নিতে আসে তার গাড়ি নিয়ে।
তার আগের দিন জাহাঙ্গীরনগর ও অন্যত্র গুলি চলেছে, ছাত্রদের মৃত্যু হয়েছে। পথে আমরা কোনো বাধা পাইনি। কিন্তু পথে দেখলাম দলে দলে ছাত্র হওয়ার বয়স পেরিয়ে গেছে এমন মানুষ (মূলত পুরুষ) মাথায় হেলমেট ও হাতে বাঁশের ডান্ডা নিয়ে চলেছে বা জমা হয়েছে। মনে হলো, ঝড়ের সংকেত। এর মধ্য দিয়ে আমরা হাসিবের ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠলাম এবং চার দিনের জন্য সেখানে এক চমৎকার বন্দিজীবন কাটালাম। বাইরে বাংলাদেশের গভীর গভীরতর অসুখ, আমার সম্বন্ধে দুই দেশেই প্রিয়জনদের বিপুল ও নিরুপায় উদ্বেগ। কিন্তু আমি অসাধারণ আপ্যায়ন ও চিন্তাহীনতা ভোগ করছি।
এর প্রধান কারণ সত্তরোর্ধ্ব হাসিবের মা। তিনি ক্যানসারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন একসময়, উঠে দাঁড়াতেও পারতেন না। পরে কিছুদিন মাটিতে কোমর হিঁচড়ে কোনো রকমে চলাফেরা করতেন, এখন একটু চলাফেরা করেন, কিছুটা টলোমলো পায়ে। কিন্তু রান্নাঘর তার নিজের বিপুল আগ্রহের জগৎ, তার দায়িত্ব অন্য কাউকে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন না। ব্যাপারটা রান্না থেকে শুরু হয় বললে ভুল হবে।
আমি ভোরবেলায় উঠে দেখি খাবার ঘরে ডাইনিং টেবিলের পাশে রেফ্রিজারেটরের সামনে তিনি সামনে সবজির বাজার চারপাশে ছড়িয়ে পা মেলে বসেছেন এবং জিনিসপত্রের কাটাকুটিতে লেগে গেছেন। অন্যদের তরকারি কাটা তার কিছুতেই মনমতো হয় না বলে অন্যরা, যেমন বিদুষী বউমা, হাসিবের স্ত্রী টুম্পাকে (এখন ফাদার দঁতিয়েনের গদ্যের ওপর এমফিল শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছে, সেই সঙ্গে একটি স্কুলে পড়াচ্ছে) ও রাঁধুনিকে ধারেকাছে আসতে দেন না।
তবে টুম্পাকে পরিবেশন করতে দেন, সে খাবার সময় টেবিলে বসে আমাকে এটা-ওটা এগিয়ে দেয়। আমার খাবার চাহিদা এই বয়সে বেশি নেই। আমি বলেছিলাম, ডাল তরকারি হবে, মাছ বা মাংসের একটা আইটেম হবে, দুটো নয়, আর বাংলাদেশের রন্ধনের গৌরব ভর্তা যা পারো খাওয়াবে। রাত্রে তো আমি সুপ আর ফল খাই, তার ব্যবস্থা রাখলেই হবে।
তা ওরা আমার কথা মেনেছে, ঢাকার আনুষ্ঠানিক নেমন্তন্নের মতো টেবিলে কুড়ি-পঁচিশটা আইটেম সাজিয়ে দেয়নি। কিন্তু প্রতিটি পরিবেশনায় কী মমতা ঢেলে দিয়েছে এই পরিবার, তা বলে বোঝানো যাবে না। সকালে ব্রেকফাস্ট বাংলাদেশের খুব পরিচিত প্লেট, দুটি রুটি, খুব অল্প ঘি মাখানো, আর সেই সঙ্গে একটা সবজি। সাধারণভাবে অন্যত্র, লাউ ইত্যাদি দিয়ে একটু নিশ্চরিত্র ধরনের হয় এবং প্রতিদিনই প্রায় একই থাকে।
কিন্তু হাসিবের মা রুটিটা নরম ও তুসতুসে হলো কি না, মুখে দিলে তা গলে যায় কি না, এ নিয়ে ভারি উৎকণ্ঠায় থাকেন এবং আমাকে প্রতিদিনই তাকে আশ্বস্ত করতে হতো। আর তরকারিও তিনি রোজ বদলে দিতেন, কোনো দিন কুমড়োর ছক্কা, কোনো দিন অন্য কিছু- ফলে ব্রেকফাস্ট আমার দিনের পরবর্তী ভোজনের একটা চমৎকার মহড়া হয়ে উঠত।
কিন্তু ব্রেকফাস্টের আগেও একট জিনিস ঘটত। হাসিবের দুটি মেয়ে- হিয়া আর হিমি। হিয়া আঠারো বছরে পা দিতে চলেছে, একটু আত্মমগ্ন স্বভাবের। ছোট মেয়েটির নাম হিমি, সে সবে দশ পেরিয়েছে। ভোরে আমার ঘুম ভেঙেছে কি ভাঙেনি, সে আমার ঘরের স্লাইডিং দরজায় টোকা দিয়ে খুলে, ভারি মিষ্টি গলায় জিজ্ঞেস করত, ঢাকাই ভাষার মিষ্টি সুর- ‘দাদা, চা কইরা আনুম?’ আমি তো প্রথম দিন চমকে গিয়েছিলাম, এইটুকু মেয়ে, সে বলে কী?
আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছে নাকি? একেবারেই না, ওই মেয়ে একটু অন্য রকম এ বাড়িতে। দুবোনই লেখাপড়ায় বেশ ভালো, কিন্তু সে আরও কম বয়স থেকে সবার ডাকখোঁজ নেয়, এটা-ওটা এগিয়ে দেয়, রান্নাবান্না সেবাযত্নেও হাত লাগায়। আমি এতটুকু মেয়ের এই বিশুদ্ধ মাতৃমূর্তি আর দেখিনি।
শুধু সকালে নয়, বিকেলেও ঘুম ভাঙার পর সে ওই মিষ্টি গলায় ‘দাদা, চা কইরা দিমু?’ বলে আমাকে জিজ্ঞেস করত এবং আমি বাধা দেওয়ার আগেই সে চমৎকার এক মগ লিকার চা আমার টেবিলে এনে রাখত, সঙ্গে বিস্কুট। আমি কৃতার্থ হয়ে যেতাম। ছেলেমেয়েদের সেবায় আমরা বুড়োরা অভ্যস্ত, আর নাতি-নাতনিদের আমরা বিশুদ্ধ মজার সঙ্গে হিসেবে ভাবি। কিন্তু আমার এই সেবানিপুণা নাতনিটি আমাকে একটা অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছে।
এখন তো কম খাই, কিন্তু খাবার যদি উৎকৃষ্ট হয়, তার প্রশংসা করতে ছাড়ব কেন? হাসিবের মা প্রতিদিন নতুন নতুন ভর্তা করতেন। একদিন করলেন কালোজিরার ভর্তা, একদিন কাঁঠালবিচির, আর একদিন হয়তো মিশ্রিত উপাদানের। ওই ভর্তা আর ডাল দিয়েই পুরো এক থালা ভাত শেষ করা যায়। হাসিব আবার বাজার খুঁজে নিয়ে আসত আমার ছেলেবেলার সব মাছ।
সেই কবে গ্রামে খেয়েছি ‘রিঠা’ মাছ, একদিন তাই নিয়ে এল, আমার শৈশব স্মৃতি উসকে দিয়ে। একদিন আনল তেলাপিয়া, যা অনেক দিন খাই না, কিন্তু প্রথম যখন উঠেছিল বাজারে, সমাদর করে খেতাম। আমার প্রয়াত স্ত্রী চমৎকার রান্না করতেন ওই মাছটি। হাসিবের মায়েরও রান্নার হাত অপূর্ব, প্রতিটিতেই যেন একটি ম্যাজিক জুড়ে যেত।
বাইরে পৃথিবী অসুখে ভুগছে, দুই দেশের বেশ কিছু মানুষ আমাকে নিয়ে ভাবনায় উন্মাদপ্রায় হয়েছে। কিন্তু আমি তখন কী সুখে যে সময় কাটাচ্ছি, তা আমিই জানি। কাজটা হয়তো ঠিক করিনি।
লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়