ঢাকা ২৩ আশ্বিন ১৪৩১, মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪

হত্যা মামলার বিচার এবং সাম্প্রতিক প্রেক্ষিত

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:১৬ এএম
আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:২৩ এএম
হত্যা মামলার বিচার এবং সাম্প্রতিক প্রেক্ষিত
মাসুদ আহমেদ

সরকার পতনের পরপরই শুরু হয়েছে গণহত্যার জন্য দায়ী সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, পুলিশ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একাদিক্রমে হত্যার অপরাধে ফৌজদারি মামলা দায়ের। যদিও ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের গণহত্যা এখনো স্বীকৃত হয়নি। ঢাকা মহানগরসহ আরও ছয়টি স্থানে এ পর্যন্ত ৪১০টি মামলা হয়েছে। ডেপুটি কমিশনারের বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছে। এসবে আসামি ও সাক্ষীর সংখ্যা মোট ৬০ হাজার। 

এই মানুষগুলোর বিরুদ্ধে প্রাথমিক চার্জশিট দিতে প্রয়োজন হবে তাদের নাম, বাবা ও মায়ের নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা, অপরাধের ধরন, সিআরপিসির প্রযোজ্য ধারা, সাক্ষীদের নাম ও ঠিকানা, সাক্ষ্য, আলামত ও অকুস্থলের বর্ণনা। এ ছাড়া লাগবে ভিডিও ক্লিপ, এফআইআর, নিহতের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন, লাশ শনাক্তকারীর স্বাক্ষর, ধ্বংসকৃত সরকারি সম্পত্তির চিত্র এবং বিমাকারীর প্রতিবেদন ইত্যাদি। 

একেকজন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে এর একেকটি মামলায় শুধু এই বিষয়গুলো প্রথমে হাতে লিখে এবং পরে টাইপ করে চার্জশিটের ছকে পেশ করতে কমপক্ষে প্রায় দুই বছর সময় লাগবে। তার পর তার ওপরস্থ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সার্কেল এএসপি, অতিরিক্ত এসপি ও এসপির সঙ্গে এবং কখনো কখনো সিনিয়র কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এগুলো যাচাই-বাছাই শেষ করে আদালতে পাঠাতে আরও তিন মাস করে সময় লাগবে। এগুলো হচ্ছে সেই সব মামলাসংক্রান্ত, যেগুলোর চার্জশিট সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপার অনুমোদন করে আদালতে পাঠাতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। 

আরেক শ্রেণির মামলা এর মধ্যেই পাওয়া যাবে, যেগুলোর চার্জশিট প্রণয়নে জেলা জজ আদালতে শুনানি সম্পন্ন করতে হবে। এই মামলাগুলো যেহেতু হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তি ধ্বংসসংক্রান্ত এবং এগুলো দায়ের হচ্ছে ঝড়ের গতিতে, সেহেতু এগুলোর বিচার করার জন্য প্রবল জনচাপ এবং ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক দলের প্রবল চাপ থাকবে দ্রুত সম্পন্ন করার লক্ষ্যে। বাংলাদেশে বিচারকের সংখ্যা ২ হাজার ১০০ জনের মতো। বিচারাধীন এবং অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা প্রায় ৪২ লাখ। নতুন দায়েরকৃত মামলার দ্রুত বিচার দাবি করা মানেই পুরোনো মামলার বাদীদের প্রতি অন্যায় করা। 

কারণ এতে ‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং আগে আসলে আগে পাবেন’- সাধারণ ন্যায়বিচারের ভিত্তির চরম লঙ্ঘন। দ্রুত বিচার মানেই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিচারকরা আগের মামলার শুনানি স্থগিত করে এই ৪১০টি মামলার বিরতিহীন শুনানি গ্রহণ ও বিচারকাজ সম্পন্ন করা; যেমন সাম্প্রতিকালে নোয়াখালীর মাদ্রাসা মামলায় নুসরাত হত্যাকাণ্ডে এবং চট্টগ্রামে ওসি প্রদীপের মামলায় আদালত একাদিক্রমে শুনানি ও বিচারকার্য সম্পন্ন করে রায় দিয়েছিলেন। 

ধরা গেল, সেই বেদম বিচারকাজ আরম্ভ হলো। তখন এই মামলাগুলো যাদের কলমের ভেতর দিয়ে আগাতে থাকবে, তাদের মানসিকতা এবং অবস্থানের ওপর বিচারের মান ও গতি নির্ভর করবে। যেমন প্রধান উপদেষ্টা প্রথমেই বলেছেন, ৫ আগস্ট পর্যন্ত যে প্রাণহানি, সম্পদহানি এবং নৈরাজ্য হয়েছে তার জন্য আন্দোলনকারী ছাত্রদের দায়ী করা যায় না, দায়ী করা যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে। বাস্তব হলো এই যে, আন্দোলনকারীদের হাতে ৪২ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। সরকারি গাড়ি ও মেট্রোরেলের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। তাহলে এই দুটি বিষয়ে ছাত্রদের বিরুদ্ধে কি মামলা বা শাস্তি হবে না? 

কারণ তারা তো নির্দোষ বলে সরকারপ্রধান উল্লেখ করেছেন, কিন্তু কোনো ইনডেমনিটি জারি করা হয়নি। সরকারি সম্পত্তি না হয় রেহাই পেল, কারণ সেগুলো অপ্রাণীবাচক। কিন্তু ৪২ জন পুলিশের মারা যাওয়ার মামলা থেকে রেহাই দেবে কে? সন্তর্পণে পুলিশ বা নিহতদের স্বজন বাদী হয়ে মামলাগুলো করবেন, তা নিশ্চিত। তাতে মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এদের সহকর্মীরা এবং সমর্থকরা পুলিশের নানা স্তরে কর্মরত। 

চার্জশিট প্রণয়ন এবং আদালতে অনুমদিত হওয়ার স্তর পর্যন্ত এরা চার্জশিটের উপজীব্যকে তাদের মনমতো না হলে কৌশলে তা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবেন। তেমনি রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি সহানুভূতিশীল গোয়েন্দা ও পুলিশ সদস্যরাও মামলার চার্জশিটের উপজীব্য নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবেন। প্রধান রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র সমন্বয়করা সরকার পতনের প্রথম দিন থেকেই বলে আসছেন যে, জেলা, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে বিচারকদের অধিকাংশ আওয়ামী প্রেতাত্মায় ভরপুর। 

এই বিশ্বাসে প্রথম কয়েক দিন বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ স্তর থেকে ম্যাজিস্ট্রেট স্তর পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে বরখাস্ত এবং পদত্যাগ করানো হয়েছে। কিন্তু একজন জেলা জজ বা উচ্চতর আদালতের বিচারকের শূন্যস্থান কোনো বিপ্লবের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব নয়। কারণ এই না যে, এই সার্ভিসে প্রয়োজনের অতিরিক্ত এমনকি ৫০ জন বিচারক রিজার্ভ রাখা হয়। একজন বিচারক তৈরি করতে দীর্ঘ সময় লাগে।

ফলে এই শূন্যস্থান পূরণ করে দ্রুত বিচার করা অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব হবে। অন্যদিকে আবার আগের আমলের মতো শাসন বিভাগ যদি বিচারকদের মামলার রায়ের ব্যাপারে তাদের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন, তা হলে সেই সংস্কৃতি আগের আমলের মতোই নিচু হবে। বিচার কোনো তড়িঘড়ির বিষয় নয়। জেলা জজ পর্যায়ে যে রায়ই হোক, পরবর্তী দুটি স্তরে আপিল নিষ্পত্তিতে কী রকম সময় লাগে, তা স্মরণ করতে তিনটি মামলার উদাহরণই যথেষ্ট। 

প্রথমত, শাজনীন খুনের মামলায় বিচার শেষ হতে ১৮ বছর; দ্বিতীয়ত, আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় ১২ বছর; তৃতীয়ত, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার বিচার হতে ৮ বছর লেগেছিল। এই সর্বশেষ মামলাটি এখন ডেথ রেফারেন্স হিসেবে ৫ বছর ধরে উচ্চতর আদালতে বিবেচনাধীন আছে। অপরদিকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে সংঘটিত খুনের মামলার বিচার ও রায় কার্যকর হতে ৩৫ বছর সময় লেগেছে। এর মধ্যে ৬ বছর সংক্ষুব্ধ পরিবারের সদস্যরা ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও। আবার বিডিআর হত্যাকাণ্ড মামলায় বিচার আরম্ভ হওয়ার পর সাড়ে ১৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। রায় এখনো অনিশ্চিত। 

পুলিশের সাবেক আইজি মামুন পলাতক ও কমিশনার আসাদুজ্জামান গ্রেপ্তার। তারাসহ ওই বিভাগের যারা সাবেক সরকারের অবৈধ সুবিধা ভোগ করেছেন এবং তাদের আমলে অধস্তন পুলিশ কর্মচারী নিয়োগ করেছেন, তাদের প্রভাব এই বিশাল বাহিনীতে অনেকাংশেই অক্ষুণ্ন রয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সগিরা মোর্শেদ হত্যাকাণ্ড হাইকোর্টের একটি স্থান থেকে অযৌক্তিকভাবে আগত এক নির্দেশে মামলাটির বিচারকাজ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখা হয়। 

তারা সমাজের খুব প্রভাবশালী লোক ছিলেন না। তার পরও ক্ষমতার রশিতে এভাবে প্রভাব বিস্তার করা এই সমাজেই সম্ভব। মামলাটি শেয হতে ৩৮ বছর লেগেছে। সাম্প্রতিক মামলাগুলোর বাদী, আসামি ও সাক্ষীর মধ্যে মৃত ব্যক্তি, শিশু, বিদেশে অবস্থানরত এবং একেবারেই অসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কারণ তাড়াহুড়ো। আমরা আত্মরক্ষায় সমর্থ একটা জাতি। ফলে প্রসিকিউশনের দক্ষতা আমাদের সামান্য। সরকারি মামলায় বিবাদীর উকিল যতটা দক্ষতা দেখান, সরকারি উকিল ততটা দক্ষতা তো দেখানই না বরং অনেক সময় নীরব থাকেন। ফলে আসামি খালাস পেয়ে যান। 

এই মামলাগুলোর ক্ষেত্রেও কোর্ট দারোগা, পেশকার, পিপি, জিপি এবং আদালতের অন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বৃহৎ অংশ অভিযোগ প্রমাণের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা নেবেন বলে মনে হয় না। অভিযুক্তরা অত্যন্ত শক্তিশালী, বিখ্যাত, প্রভাবশালী এবং ব্যয়বহুল আইনজীবী নিয়োগ করবেন। তাদের সামনে অখ্যাত সরকারি উকিলরা দুর্বলতার পরিচয় দেবেন। কাঁচাভাবে মামলা দায়েরের ফলে তা বৃদ্ধি পাবে। মুন সিনেমার পাকিস্তানি মালিক বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে ৩২ বছর মামলা লড়ে ওই সম্পত্তির মালিকানা ফিরে পান। 

১৯৭২ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর দালালদের মামলায় বিবাদীদের সমর্থন করেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী। এমনিতেও মৌলিকভাবে ব্রিটিশ আইন অপরাধীর পক্ষে থাকে। বাদীর উকিল অত্যন্ত মেধাবী, সৎ ও প্রভাবশালী না হলে অভিযোগ প্রমাণ করা প্রায় ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। এ দেশে নারী নির্যাতনসংক্রান্ত মামলার শতকরা ৯৫ ভাগ অভিযুক্ত বেকসুর খালাস পেয়েছেন। এসব বাস্তবতা বিবেচনায় অত্যন্ত সম্পদশালী এবং প্রভাবশালী এই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আনীত মামলাগুলো খুব দক্ষতার সঙ্গে দায়ের এবং চার্জশিট প্রণয়ন না করলে তাদের শাস্তির আওতায় আনা যাবে বলে মনে হয় না। 

মামলাগুলোতে অনেকেই হুকুমের আসামি, অনেক সাক্ষী বিদেশ চলে গেছেন, অনেকেই মৃত ও আহত, অনেকে সময়ের পরিসরে এই বিষয়ে আর আগ্রহী থাকবেন না। অনেক ক্ষেত্রে বিচারকও রাজনৈতিক কারণে অভিযুক্তের প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন, কেউ কেউ আবার বোধ করবেন বিব্রত। এমতাবস্থায় সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ও দক্ষ আইনজীবীর পরামর্শ ছাড়া মামলাগুলো দায়ের করা বিচারপ্রার্থীর জন্য আশাপ্রদ হবে না। ব্রিটিশদের প্রণীত ফৌজদারি আইন অক্ষুণ্ন আছে। তা একান্ত নৈর্ব্যত্তিক। সেগুলোর অন্তর্নিহিত লক্ষ্যের সঙ্গে পূর্ণ সামঞ্জস্য রেখে মামলাগুলো দায়ের করা উত্তম হবে। 

লেখক: সাহিত্যিক 
[email protected]

দেশপ্রেমের বন্যা বইবে এমনটা আশা করা যাবে না

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৫৩ এএম
দেশপ্রেমের বন্যা বইবে এমনটা আশা করা যাবে না
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

এটা সবাই বলতে চাইবে যে একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদাররা হেরে গিয়েছিল ঠিকই; কিন্তু তারপর আমরা নিজেরা কেবলই হেরে যাচ্ছি। অভিজ্ঞতা থেকেই বলা। বক্তব্যটা ভেতর থেকে উঠে আসে, বড় দুঃখে। কিন্তু কার কাছে হারলাম? কেই-বা হারল?
না, পাকিস্তানিদের কাছে নয়। ওই গৌরব তাদের একেবারেই প্রাপ্য নয়। হার হয়েছে সেই শক্তির কাছে, যার অধীনে পাকিস্তানিরা নিজেরাও ছিল এবং রয়েছে এখনো। এই প্রভুটির নাম পুঁজিবাদ। পরাজয় ঘটেছে তার কাছেই।

আশা ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওই প্রভুরও পতন ঘটবে। ঘোড়া পড়ে গেলে ঘোড়সওয়ারও পড়ে যাবে। কিন্তু তা কি হয়? এই সওয়ারটি অনেক বেশি শক্তি রাখে। তার ক্ষমতা বিশ্বব্যাপী ন্যস্ত; সে কেন পড়ে যাবে খামোখা? একটা ঘোড়া গেছে অন্য ঘোড়া সহজেই পেয়ে যাবে। বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রটি এই পুঁজিবাদের নতুন ঘোড়া বটে। সওয়ারটি দাবড়ে বেড়াচ্ছে। আর ওই যে আমাদের আশা তার ভিত্তিটাইবা কী ছিল?

ভিত্তি ছিল জনগণের আত্মত্যাগ। তারা এমনভাবে লড়েছে, এত অধিক মূল্য দিয়েছে এবং এতটা ঐক্যবদ্ধ ছিল যে, ভরসা ছিল যে পুঁজিবাদের পতন ঘটবে এবং বাংলাদেশের মানুষ কেবল স্বাধীন নয়, প্রকৃত প্রস্তাবেই মুক্ত হবে; কিন্তু কেবল আত্মত্যাগ তো ওই রকমের পরাক্রমশীল শক্তির, নাম যার পুঁজিবাদ, তার পতন ঘটে না। সাময়িকভাবে পিছু হটলে অনতিবিলম্বে সে ফিরে আসে। আমরা তো বুঝতেই পারছি যে আমাদের ক্ষেত্রেও ঠিক ওই ঘটনাই ঘটেছে। পুঁজিবাদ ফিরে এসেছে। কেবল ফেরত আসেনি, আগের চেয়ে বেশি নৃশংস হয়ে এসেছে, যেন তাকে বিরক্ত করার দরুন ক্ষিপ্ত সে, শাস্তি দেবে। 

বাংলাদেশ একটি নতুন রাষ্ট্র বটে। কিন্তু কতটা নতুন? নামে নতুন, ভূখণ্ডে নতুন; কিন্তু স্বভাব-চরিত্রে? না, স্বভাব-চরিত্রে সে এতটুকু বদলায়নি। পুরাতন রাষ্ট্রের মতোই রয়ে গেছে, আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী। হ্যাঁ, শাসক বদলেছে। পুরাতন শাসকদের জায়গায় নতুন শাসক এসেছে; কিন্তু তারা রাষ্ট্রকে বদলাবে, এই রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করবে, ভেঙে দেবে এর আমলাতান্ত্রিক কাঠামো, ঘটাবে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, প্রতিষ্ঠা করবে মানুষে মানুষে অধিকার ও সুযোগের সাম্য- এসব কেন আশা করব আমরা? আশা অবশ্য করেছিলাম ওই আত্মত্যাগের কারণেই। কিন্তু জনগণের আত্মত্যাগের কী মূল্য আছে এই নিপীড়নকারী শাসক শ্রেণি এবং তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী আমাদের এই নতুন রাষ্ট্রের কাছে? 

কে হারল এই প্রশ্নের জবাবও এই বাস্তবতার ভেতরই পাওয়া যাবে। হেরে গেছে জনগণ। হেরেছে এই জন্য যে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন নেই, নেতৃত্বের রয়েছে অভাব, অভাব ঘটেছে রাজনৈতিক শক্তির। একাত্তরের পর থেকে যে নেতৃত্বকে আমরা পেয়েছি তারা হারেনি, তারা আত্মসমর্পণ করেছে। হারতে হলে লড়তে হয়। রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তারা তো পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি। প্রশ্নই ওঠে না লড়াইয়ের। তারা উদগ্রীব ছিল আত্মসমর্পণে। সেটাই তারা করেছে। আত্মসমর্পণের পর এখন চলছে তোয়াজ করার পালা। এখানে তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। জনতার জয় পদপৃষ্ট হচ্ছে বিজয় উদ্ধৃত পুঁজিবাদ ও পুঁজিবাদীদের দাপটের নিচে। এই বিজয়টা যেমন স্থানীয়, তেমনি আন্তর্জাতিক; পুঁজিবাদ একটি বিশ্বব্যাপী ব্যবস্থা বটে। একাত্তরে এ দেশের মানুষের জীবনে যে দুর্ভোগ নেমে এসেছিল সেটা ছিল অপরিমেয়; কিন্তু যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যে গৌরব তারা অর্জন করেছিল তাও ছিল অতুলনীয়। ষোলই ডিসেম্বর বাঙালি জাতির ইতিহাসে গৌরবের অতি উজ্জ্বল মুহূর্ত। কিন্তু তার পরে?

তার পরের ইতিহাস উত্থানের থাকেনি, পরিণত হয়েছে পতনের। আমরা নামছি। কেবলই নামছি। এই নিম্নধাবমানতা নানা ক্ষেত্রে ঘটছে। সবচেয়ে ক্ষতিকরভাবে ঘটেছে মূল্যবোধের ক্ষেত্রে। খুব জরুরি যে মূল্যবোধ সেটি হচ্ছে দেশপ্রেম। এই দেশপ্রেমেরই চূড়ান্ত প্রকাশ আমরা দেখেছি একাত্তরে; আজ তার অভাব দেখছি পদে পদে। দেশপ্রেমের একটা বড় প্রকাশ ঘটেছিল, ১৯০৫ সালে, বঙ্গভঙ্গ রদ করার সংগ্রামে। কিন্তু সেটা ঘটেছিল সীমিত আকারে; সীমাবদ্ধ ছিল মধ্যবিত্তর মধ্যে, যে মধ্যবিত্ত সেদিন ছিল মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্বারা গঠিত। 

বঙ্গভঙ্গকে প্রতিরোধ করার আন্দোলনে প্রবল দেশপ্রেমের জোয়ার এসেছিল। প্লাবন দেখা দিয়েছিল জাতীয়তাবাদের। মানুষ কারাভোগ করেছে, প্রাণও দিয়েছে। কিন্তু নেতৃত্বের মারাত্মক রকমের ভ্রান্ত পদক্ষেপের দরুন ওই জাতীয়তাবাদ চলে গেল ধর্মীয় পুনর্জাগরণের অন্ধ পথে। 

হিসাব করলে সেদিন দেখা যেত বাঙালিদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা মোটেই অল্প ছিল না। আসলে তারাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। হিন্দু জাতীয়তাবাদের জোয়ার মুসলমানদের সঙ্গে নিতে পারল না। বরং দেখা দিল সাম্প্রদায়িক বিভাজন। পরিণতিতে দাঙ্গা বাধল এবং সাতচল্লিশে দেশ গেল ভাগ হয়ে। সবটাই ঘটল নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে। 

একাত্তরে দাঙ্গা হয়নি, যুদ্ধ হয়েছে। বাঙালি বিভক্ত হয়নি, ঐক্যবদ্ধ ছিল। এ যেন সাতচল্লিশের সেই ভুলের সংশোধন। এবারে দেশভাগের প্রশ্ন নেই, এবারের প্রশ্নটা রাষ্ট্রকে ভাঙার। রাষ্ট্র ভাঙল। এল স্বাধীনতা। কিন্তু তারপরে? তারপরে দেশপ্রেমের পতন ঘটেছে। কিন্তু কেন? এবারও দায়িত্ব নেতৃত্বেরই। না, যত দোষ নন্দ ঘোষের নয়, পতনের জন্য নেতারাই দায়ী। দোষ তাদেরই। তারা লড়াইয়ে যেতে চায়নি। যুদ্ধ নয়, তারা চেয়েছিল স্বায়ত্তশাসন, যার অর্থ তাদের জন্য অবাধ স্বাধীনতা; অন্যকিছুর নয়, লুণ্ঠনের। তাদের আন্তরিক দীক্ষা ছিল পুঁজিবাদে। সেই দীক্ষাটাকে যুদ্ধের সময়ে প্রকাশ না করলেও বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচিত করেছে। উন্মোচনেরও দরকার হয়নি, আপনাআপনি বের হয়ে পড়েছে। দেশপ্রেম ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে পুঁজিবাদের দাপটে। যুদ্ধপরবর্তী পুঁজিবাদীরা লড়াই করেছে নিজেদের মধ্যে, ক্ষমতার (অর্থাৎ লুণ্ঠনের অধিকারের) ভাগাভাগি নিয়ে। পাকিস্তানিদের সঙ্গেও তাদের লড়াইটা ছিল ওই ভাগাভাগি নিয়েই। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই সাঙ্গ করা যাবে বলে ভরসা করেছিল।
 
জনগণের লক্ষ্যটা ছিল ভিন্ন। তারা ক্ষমতার ভাগ পাবে এটা আশা করেনি; ওই লোভে যে উত্তেজিত হয়েছে তাও নয়। তাদের আশাটা ছিল মুক্তির। স্বায়ত্তশাসনের নয়, ক্ষমতার হস্তান্তরেরও নয়, তাদের জন্য স্বপ্নটা ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির। তারা আশা করেছে এমন একটি সমাজ ও রাষ্ট্র পাবে, যেখানে মানুষে মানুষে সম্পদ, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ইত্যাদি নিয়ে বৈষম্য থাকবে না; কেউ কারও শত্রু হবে না, সবাই হবে সবার মিত্র। বলাবাহুল্য, জনগণ এই মুক্তি পায়নি।
 
পুঁজিপন্থিরা কিন্তু স্বাধীনতা পেয়ে গেল। তারা আরও ধনী হলো। তাদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পেল অবিশ্বাস্য গতিতে। তাদের সংখ্যাও যে খুব সীমিত রইল তা নয়, বেশ বেড়ে গেল। কিন্তু জনগণের সংখ্যার তুলনায় তারা অবশ্যই অল্প। তবে তাদের দাপট অসম্ভব প্রবল। বাংলাদেশ এখন সেই দাপটে থরথর করে কাঁপে। 

জনগণ দেখল নতুন রাষ্ট্রের চেহারা আগের রাষ্ট্রের চেয়ে ভয়ংকর। এ রাষ্ট্র শাসকশ্রেণির অধীনস্থ তো বটেই, কিন্তু রীতিমতো সন্ত্রাসীও বৈকি। সাতচল্লিশের পরে বহু মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছিল, এবারও হলো; নিজের দেশের মধ্যেই তারা গৃহহীন, আশ্রয়হীন। তাদের দেশ নেই, দেশ চলে গেছে অন্যদের হাতে, যাদের হৃদয় ও মস্তিষ্কে দেশের জন্য কোনো স্থান অবশিষ্ট নেই। বাংলাদেশে এখন দেশপ্রেমিক বলতে শ্রমজীবী মানুষকেই বোঝায়। এই মানুষেরাই উৎপাদন করে। দেশকে এরাই টিকিয়ে রেখেছে এবং দেশের বাইরে এদের জন্য কোথাও কোনো স্থান নেই। যতই গৃহহারা হোক, এই মানুষেরাই গৃহী এবং দেশপ্রেমিক। 

আর উদ্বাস্তু হচ্ছে তারা, যাদের ধন-সম্পত্তি অনেক। বস্তুত যার বিত্তবেসাত যত অধিক, সে-ই তত বড় উদ্বাস্তু, আমাদের এই বাংলাদেশে। এদের আদর্শ এ দেশ নয়, আদর্শ হচ্ছে পুঁজিবাদী বিশ্ব। মানুষের জন্য সবচেয়ে মূল্যবান বিনিয়োগ হচ্ছে সন্তান-সন্ততি; সেই বিনিয়োগ এরা দেশে করে না, করে বিদেশে। সন্তানেরা বিদেশে যায় পড়ালেখার অজুহাতে, গিয়ে আর আসে না, এলেও আগমনটা বিদেশির মতোই, অবস্থানও সেই প্রকারেরই। ধনীদের জন্য বাংলাদেশ এখন এক প্রকারের জমিদারি। জমিদারদের তবু সরকারি তহবিলে খাজনা দিতে হতো, এরা সেটাও দেয় না। 

পুঁজিবাদের দাসানুদাস এই শাসকশ্রেণিই দেশপ্রেমের অবনতির জন্য দায়ী। তারাই হচ্ছে দৃষ্টান্ত। তারা তাদের আদর্শকে জনগণের ভেতর ছড়িয়ে দিয়েছে। মানুষকে যতভাবে পারা যায় উদ্বুদ্ধ করছে আত্মস্বার্থ-সর্বস্ব ও ভোগবাদী হতে। উসকানি দিচ্ছে সবকিছু ভুলে কেবল নিজের কথা ভাবতে। মানুষকে নিয়ে এসেছে বাজারে। সর্বোপরি সর্বক্ষণ ব্যস্ত রাখছে জীবিকার সন্ধানে। যাতে অন্য কিছু ভাবার সময় না হয়, বিশেষ করে শাসকশ্রেণির অত্যাচার যেন চোখের বাইরে থাকে। 

বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি দুটি কাজ খুব দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে, একটি বেকার সৃষ্টি, অন্যটি মাদ্রাসা শিক্ষার বিস্তার। দুটোই দেশপ্রেমের বিকাশের পথে মস্ত বড় অন্তরায়। এ দেশের ধনীরাই হচ্ছে শাসক এবং তারা বিনিয়োগ করে না, লুণ্ঠন করে। তাদের লুণ্ঠন তৎপরতায় বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়। জনগণের আয় এরা ব্যাংকের মাধ্যমে কিছুটা, কিছুটা নানাবিধ প্রতারণার ভেতর দিয়ে আত্মসাৎ করে ফেলে। ফলে কর্মসংস্থান বাড়ে না। লোক বাড়ছে, কাজ বাড়ছে না; অথচ করার মতো কাজের কোনো অবধি থাকার কথা নয়, আমাদের মতো অনগ্রসর দেশের। সরকার আসে-যায়, কিন্তু কোনো সরকারকেই দেখা যায় না কাজ সৃষ্টির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হতে। পুঁজিবাদ এমনিতেই শ্রমিকবিরোধী, শ্রমঘন উৎপাদনকে যে ঘৃণা করে, তার পক্ষপাত প্রযুক্তিঘন উৎপাদনের প্রতি। বাংলাদেশি পুঁজিবাদ উৎপাদনে বিশ্বাসই করে না, তার নির্ভরতা লুণ্ঠন ও ব্যবসায়। বলাবাহুল্য, ব্যবসা জিনিসটাও লুণ্ঠন ভিন্ন অন্য কিছু নয়। 

যে মানুষটি বেকার তার তো কোনো দেশপ্রেম থাকার কথা নয়। দেশ তো তাকে কিছুই দিচ্ছে না, বিড়ম্বনা ভিন্ন। তার সার্বক্ষণিক চিন্তা নিজেকে নিয়ে। বেকার মানুষের মতো আত্মপ্রেমিক সংসারে সত্যি বিরল। বেকারে যখন দেশ ছেয়ে যাচ্ছে, দেশে তখন দেশপ্রেমের বন্যা বইবে- এমনটা আশা করা মোটেই যুক্তিসম্মত নয়। 

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

গাজা যুদ্ধের এক বছরে মধ্যপ্রাচ্যে চারটি পর্যবেক্ষণ

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৪৭ এএম
গাজা যুদ্ধের এক বছরে মধ্যপ্রাচ্যে চারটি পর্যবেক্ষণ

৭ অক্টোবর এক বছর পূর্ণ হলো। এটা নিশ্চিত যে, মধ্যপ্রাচ্য আগের মতো আর ফিরে আসবে না। পরিবর্তনশীল অঞ্চলের কণ্ঠস্বর হিসেবে আমরা এই দিনে এই ভয়ংকর বছরটিকে চিহ্নিত করে এই যুগান্তকারী ঘটনাগুলোর অর্থ কী তা নথিভুক্ত করা এবং বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি।

প্রথম পর্যবেক্ষণ হলো- মধ্যপ্রাচ্যে হামাস, হিজবুল্লাহ এবং ইরানের অন্য প্রক্সিগুলোর বাস্তবের চেয়ে অনেক বেশি দুর্ভোগ হতে পারে। কারণ বিখ্যাত রাজনৈতিক ভাষ্যকার এবং সিএনএন উপস্থাপক ফরিদ জাকারিয়া আমাদের টকশোয় এক সাক্ষাৎকারে আরব নিউজকে বলেন: ‘ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং।’ এটি সত্যিই অসাধারণ। প্রথমত, ইসরায়েলি গোয়েন্দারা হিজবুল্লাহকে কতটা পরাস্ত্র করতে সক্ষম হয়েছিল তা লক্ষ্য করলেই সব কিছু বোঝা যায়। জাকারিয়া বলেন, ইসরালের সৈন্যরা বিস্ফোরিত পেজার বোম, অস্ত্র ও গোলাবারুদের অবস্থান এবং হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরাল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে স্পস্ট ধারণা পেয়েছিল। আমি মনে করি, হিজবুল্লাহ এবং ইরানকে যেভাবে দেখছি তাতে আমরা তাদের ১০ ফুট লম্বা হিসেবে চিত্রিত করেছি। প্রকৃতপক্ষে তারা ছিল ৫ ফুট লম্বা। 

সিএনএন নিউজে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের এক সাক্ষাৎকারে জাকারিয়া উল্লেখ করেছেন, ইরানের ‘সামর্থ্য ছিল না’ ইসরায়েলের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িত হওয়ার। শুধু হিজবুল্লাহর ওপর নির্ভর করে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়াটা নির্বুদ্ধিতা হতো। তিনি বলেন, ইসরায়েল যা করছে তার নিন্দা জানাতে আমাদের ইসলামিক দেশগুলোর একটি বৈঠক ডাকা উচিত। এটি বিশেষ কোনো প্রাণঘাতী প্রতিক্রিয়া নয়, যা আপনি কল্পনা করতে পারবেন না। সবাইকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একমত হয়ে আগিয়ে যেতে হবে। বলা হচ্ছে, হামাস এবং হিজবুল্লাহ নিজেরাই এটি উপলব্ধি করতে পারেনি যে, এমন হামলা হতে পারে। ইসরায়েল এমন হামলা চালিয়েছে, যাতে লেবানন এবং ফিলিস্তিনজুড়ে ব্যাপক ধ্বংস এবং অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটে।

দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণ হলো- জাতিসংঘের ব্যর্থতা। আমরা যেমন আমাদের গল্পে উল্লেখ করেছি, অনেক পশ্চিমা দেশের নিঃশর্ত সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন নিরাপত্তা পরিষদের অভ্যন্তরীণ বিভাজনকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে এবং এর কাজ করার ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে।

এমনকি জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস; যাকে ইসরায়েল একজন ব্যক্তিত্বহীন মানুষ বলে ঘোষণা করেছে। সাধারণ পরিষদের এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেছেন যে, ‘আমাদের (জাতিসংঘের) কোনো প্রকৃত ক্ষমতা নেই। জাতিসংঘের যে সংস্থাটি কিছু ক্ষমতার অধিকারী তা হলো নিরাপত্তা পরিষদ এবং সেই সংস্থাটিও পঙ্গু হয়ে গেছে।’

এটা অকল্পনীয় যে, ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের এমন দায়মুক্তি থাকতে পারে, যেখানে ৪৩ হাজারের বেশি লোককে হত্যা, প্রায় ২ লাখ লোককে আহত করেছে। লেবানন ও ফিলিস্তিনজুড়ে প্রায় ৩ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যুদ্ধবিরতিতে ভেটো দেওয়া হয়েছে। কিছু পশ্চিমা মিত্র যারা দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার সম্পর্কে আমাদের কাছে প্রচার করেছে, অথচ তারাই আবার ইসরায়েলকে সশস্ত্র করছে। 
তৃতীয় পর্যবেক্ষণ- যা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তা হলো আপনি একটি বদ্ধমুষ্টির চেয়ে একটি খোলা তালু দিয়ে অনেক বেশি জিততে পারেন।

সৌদি আরব তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে ফিলিস্তিনের জন্য স্বীকৃতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। সৌদি আরবের প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৪০টিরও বেশি রাষ্ট্রের ফিলিস্তিনের জন্য স্বীকৃতি অর্জন করেছে। 
চতুর্থত, এটি বারবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। যুদ্ধ যত বেশি সময় ধরে চলতে থাকে, ততই বেশি বিস্তৃত হয়। যেমনটি লেবাননের সংগ্রামের কথা বলা হয়েছে। বিশ্ব তার শ্বাস ধরে রেখেছে। ইরানের ওপর বিশ্ব তাকিয়ে আছে কখন ইসরায়েলের প্রতিশোধ নেবে। উপসংহারে বলতে হয়, সহিংসতা সহিংসতার জন্ম দেয় এবং দোষারোপের খেলা বিশ্বে কখনই শেষ হবে না।

সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহানের সাম্প্রতিক ‘ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস’-এর কলামে লিখেছেন, ইসরায়েলের নিরাপত্তার একমাত্র গ্যারান্টি হলো দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান। যাই হোক, ইসরায়েলের ভেতরে পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্বাচনে কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবে তার ওপর তাদের অনেক কিছুই নির্ভর করছে। যৌক্তিকতার বিষয়টি কোনোভাবেই পরিষ্কার হচ্ছে না। একীভূত করা ও সমৃদ্ধ এবং আরও শান্তিপূর্ণ অঞ্চল তৈরির জন্য সৌদি আরবের ভালো দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। অন্যদিকে চরমপন্থিদের অনুমতি দেওয়া মোটেই ঠিক নয়। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার বা জঙ্গিগোষ্ঠী বিশ্বে এই ধরনের কাজ করতে পারে না। বিশ্ব ভিন্ন ফল আশা করে যা শান্তিপূর্ণ।

লেখক: এডিটর-ইন-চিফ, আরব নিউজ 
আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

আওয়ামী লীগ এখন সাধু সাজছে: ড. মাহবুব উল্লাহ

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৪৩ এএম
আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১৯ পিএম
আওয়ামী লীগ এখন সাধু সাজছে: ড. মাহবুব উল্লাহ
ড. মাহবুব উল্লাহ

আওয়ামী লীগের এখনকার বিপজ্জনক পরিস্থিতি এড়ানোর সুযোগ ২০০৯ সালে ছিল। কিন্তু তারা যে রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করেছে, সেটি রিকনসিলিয়েশনের বয়ান নয়। সেই বয়ান জাতিকে চরমভাবে দ্বিধা-বিভক্ত করে একটি অংশকে চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। এটি ছিল তাদের লাইন। যে কারণে তারা বক্তৃতা দিত যে এই দেশে শুধু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকেরা রাজনীতি করবে; আর কেউ করতে পারবে না এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কারা সেই বিচারের ভারও তাদের ওপরে; অর্থাৎ তারা যাকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি মনে করবে শুধু তারাই রাজনীতি করবে।

এ জন্য তারা প্রায় ১৬ বছর ধরে ফ্যাসিস্ট কায়দায় নির্যাতন করেছে। মানুষকে গুম-খুন করেছে। আয়নাঘরে পাঠিয়েছে। সবই করেছে। এগুলো বলে শেষ করা যাবে না। এখন জনগণ তাদের উচ্ছেদ করেছে। উচ্ছেদ করার পর এখন তারা সাধু সাজার চেষ্টা করছে; যে আমরা ভালো মানুষ হয়ে গেছি। এমন পরিস্থিতিতে তাদের কথায় সবকিছু হবে না।

ফলে রিকনসিলিয়েশন বা রাজনৈতিক মীমাংসা দরকার, তবে আওয়ামী লীগ যে অন্যায় অপকর্ম করেছে, অত্যাচার-নির্যাতন, খুন-খারাপি করেছে, মানুষ মেরেছে এগুলোর সম্পূর্ণ বিচার ও শাস্তির পর রিকনসিলিয়েশনের কথা আসতে পারে। 

আওয়ামী লীগ নিজেরাই নিজেদের নিশ্চিহ্ন করেছে। পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবিকে তারা ব্যবহার করেছে। সেনাবাহিনীকেও তারা ব্যবহার করতে চেয়েছিল। তারা কী করেনি। জিয়াউর রহমানকে তারা পাকিস্তানের দালাল বলেছে। আইএসআইয়ের এজেন্ট বলেছে। এগুলো কি রিকনসিলিয়েশনের কথা নাকি?

সুপ্রিম কোর্টের অধীনে আনতে হবে

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৪৫ এএম
আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:২০ পিএম
সুপ্রিম কোর্টের অধীনে আনতে হবে
বিচারপতি এম এ মতিন

বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের জন্য আমাদের সুপ্রিম কোর্টের একটা জাজমেন্ট আছে। মাসদার হোসেনের মামলায় যে জাজমেন্ট হয়েছে সেটা কোনো সরকার পুরোপুরি বাস্তবায়ন করেনি। এটা অবশ্যই করতে হবে।

দ্বিতীয়ত হচ্ছে, আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৬ক, এটাকে পরিবর্তন করতে হবে। আগের, অর্থাৎ ১৯৭২ সালের সংবিধানে যেভাবে ছিল সেভাবেই নিতে হবে। অর্থাৎ জুডিশিয়ারি মাস্ট বি আন্ডার দি ফুল কন্ট্রোল অব দি সুপ্রিম কোর্ট। এটা কোনোভাবেই নির্বাহী বিভাগের হাতে রাখা যাবে না।

এ ছাড়া বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে একটা আইন করা দরকার। আমাদের সংবিধানে আইন করার প্রভিশন আছে। সংবিধানে আইন করার কথা বলা হলেও আইন করা হয়নি। এটা কেউই করেননি। আইন না হওয়ার কারণে আমাদের একটা জাজমেন্ট দিতে হয়েছে। সেই জাজমেন্টে আমাদের একটা গাইডলাইন দিতে হয়েছে। সেই গাইডলাইনও মানা হয়নি। এ জন্য অবশ্যই আইন করতে হবে।

বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে ইভ্যালুয়েশন কী হবে, না হবে, সে জন্য আইনটা খুবই জরুরি। পাশাপাশি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে পৃথক সচিবালয় থাকতে হবে। 

আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

ভ্যান্স ও ওয়ালজ বিতর্ক: মার্কিন  পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন বার্তা

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:২৭ পিএম
ভ্যান্স ও ওয়ালজ বিতর্ক: মার্কিন 
পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন বার্তা
ড. আমাল মুদাল্লালি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পাঁচ সপ্তাহ আগে আমেরিকান ভোটাররা দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দুটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পারছেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রিপাবলিকান জেডি ভ্যান্স এবং ডেমোক্র্যাট টিম ওয়ালজের কাছ থেকে নতুন নাগরিকদের জন্য ‘মধ্য-পশ্চিমা’ ধারণার কথা শুনেছেন। কিন্তু তাদের ৯০ মিনিটের বিতর্কে যা অনুপস্থিত ছিল সেটাই ছিল পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে তাদের মূল দৃষ্টিভঙ্গি। 

বিতর্কটি ইসরায়েলের ওপর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার বিষয়ে একটি প্রশ্ন নিয়ে শুরু হয়েছিল, যা নিউইয়র্ক সিটিতে দুই ব্যক্তি মুখোমুখি হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে ঘটেছিল। দুই প্রার্থী যে বিষয়গুলো নিয়ে কোনো উত্তর দেননি, তা-ই ছিল পররাষ্ট্রনীতির মূল এজেন্ডা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংঘাত ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। আফগানিস্তান এবং মিত্র বা ন্যাটো সম্পর্কেও কোনো প্রশ্ন নেই। ‘আঞ্চলিক রাজনীতি’- এই কথাটি তাদের বিতর্কের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। কারণ প্রার্থীরা অভিবাসন থেকে শুরু করে অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসেবা, প্রজনন অধিকার, জলবায়ু, অস্ত্র সহিংসতা এবং আমেরিকার গণতন্ত্রের মতো বিষয়গুলো নিয়ে বিরোধিতা করেছিলেন।

সিবিএস নিউজের মডারেটর বিতর্কের সূত্র ধরে এই প্রশ্নটি করেন যে, তারা কি ইরানের ওপর ইসরায়েলের ‘অগ্রিম হামলা’ সমর্থন করেন? যদিও তারা কেউই এ ব্যাপারে কোনো উত্তর দেননি। অথচ তাদের আন্তর্জাতিক নীতিতে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখা গেছে। ডেমোক্র্যাটদের ‘স্থির পরিস্থিতি’ বনাম রিপাবলিকাদের ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’র বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়েছে। 
ওয়ালজ ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণের কথা মনে করিয়ে দিয়ে শুরু করেছিলেন এবং বলেছিলেন, ইসরায়েলের আত্মরক্ষা করার ক্ষমতা তাদের জন্য মৌলিক ছিল। তাদের জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা মৌলিক দায়িত্ব এবং গাজায় মানবিক সংকটের অবসান ঘটানো দরকার।
 
ইসরায়েল ও ইরানের প্রক্সির সম্প্রসারণ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্থির নেতৃত্ব’কে মৌলিক হিসেবে দেখেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের অংশীদার হিসেবে যেভাবে কাজ করেছে তা একটা বড় উদাহরণ। তিনি বলেছিলেন, কমলা হ্যারিস স্থির নেতৃত্বের প্রস্তাব দেবেন। যখন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইটগুলোকে ‘মানসম্পন্ন কূটনীতি’ হিসেবে ব্যবহার করেন, তখন কমলা হ্যারিস ট্রাম্পকে জোটবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে ‘পরিবর্তনশীল’ বলে অভিযুক্ত করেছেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘আমরা আমাদের বাহিনী এবং আমাদের মিত্রবাহিনীকে রক্ষা করব।’

ভ্যান্স সরাসরি উত্তর এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ইসরায়েলের ওপর নির্ভর করে, তারা তাদের দেশকে সুরক্ষিত রাখতে কী করা দরকার। মিত্রদেরকে আমাদের সমর্থন করা উচিত তাদের শত্রুদের মোকাবিলার জন্য। তিনি আরও যুক্তি দিয়েছেন যে, ট্রাম্প বিশ্বকে আরও সুরক্ষিত করেছেন এবং বিশ্বে স্থিতিশীলতা এনেছেন। তিনি কার্যকর প্রতিরোধ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এটি করেছেন। সব কিছুই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় মানুষ খুব ভয় পাচ্ছে। ইরান, যারা এই হামলা চালিয়েছে নিশ্চয়ই তারা পুরস্কত হয়েছেন। ভ্যান্স আরও বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকার করেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনেকে ভয় পায়। শক্তির মাধ্যমে শান্তি স্থাপন করা প্রয়োজন। 

রিপাবলিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জেডি ভ্যান্স ট্রাম্পের নীতির প্রতিরক্ষা করেছিলেন, যেমনটি তিনি গত মাসে করেছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির বিরুদ্ধে। তিনি দ্য নিউইয়র্ক ম্যাগাজিনকে বলেছিলেন, ট্রাম্প ‘সত্যিই জানেন না কীভাবে যুদ্ধ বন্ধ করতে হয়’ এবং ভ্যান্স তাকে খুব ‘গোড়া’ বলে অভিহিত করেছেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন খুব দরকার। নভেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হলে ইউক্রেনে অব্যাহত মার্কিন সহায়তা প্রদানের জন্য ট্রাম্পের প্রয়োজন হবে।

এটি ছদ্মবেশে একটি আশীর্বাদ হতে পারে যে, বিতর্কের সময় ইউক্রেনের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। কারণ জেলেনস্কি ডেমোক্র্যাটিক গভর্নর জোশ শাপিরোর সঙ্গে পেনসিলভানিয়ায় একটি গোলাবারুদ কারখানা পরিদর্শন করেন। ভ্যান্স বলেন, আরেকটি গুরুতর রাজনৈতিক ভুল হয়েছে যখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হাজির হয়েছিলেন আমেরিকার নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করা এবং পক্ষ বেছে নিতে।

ভ্যান্সের প্রতিক্রিয়া পেনসিলভানিয়ায় একটি বক্তৃতায় উঠে এসেছিল। পেনসিলভানিয়া এমন একটি সমালোচনামূলক সুইং স্টেট, যেখানে প্রতিটি দল জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে একটু উচ্চ স্বরে বলেছেন, ‘তিনি এই দেশের গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের প্রচার করতে এসেছেন। আমরা ইউক্রেনে ২০০ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছি। আপনি কি জানেন- জেলেনস্কি যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসেন তখন তিনি কী করেছেন? তিনি শুধু পেনসিলভানিয়ার মানুষ এবং অন্য সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে যান।’ 
বিতর্কটি এমন এক সময়ে এসেছিল যখন মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘর্ষ দিন দিন বাড়ছে।

 ইউক্রেনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক নজর বা মিডিয়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ওয়ালজ দাবি করেছেন যে, জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন পারমাণবিক চুক্তি থেকে ট্রাম্পের প্রত্যাহারের কারণে ইরান এখন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। তিনি বলেছিলেন, ট্রাম্প এই অবস্থা টেনে নিয়ে এসেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের গোঁড়ামি নেতৃত্বের কারণে ইরান আগের তুলনায় পারমাণবিক অস্ত্র হামলার দিকে যাচ্ছে। 

তবে বিতর্কের সবচেয়ে মর্মান্তিক পয়েন্টটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করার সময়ে এসেছিল। রিপাবলিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ভেবেছিলেন, ট্রাম্প ২০২০ সালের নির্বাচনে হেরেছেন কিনা। ভ্যান্স আগে জোর দিয়েছিলেন যে, তিনি ২০২০ সালের নির্বাচনের ফল গ্রহণ করবেন না। তিনি বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যা বলেছেন তাতে অনেক সমস্যা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, পাবলিক স্কোয়ারে শান্তিপূর্ণভাবে এই বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক করা উচিত। আমি যা বলেছি, ডোনাল্ড ট্রাম্পও তাই বলেছেন। তিনি মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, যখন জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, তখন ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউস ছেড়ে দিয়েছিলেন। 

ওয়ালজ তার প্রতিপক্ষের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- ‘তিনি (ট্রাম্প) কি ২০২০ সালের নির্বাচনে হেরেছেন?’ প্রশ্নটির উত্তর সুন্দরভাবে এড়িয়ে গিয়ে ভ্যান্স বলেছিলেন, ‘টিম ওয়ালজ, আমি ভবিষ্যতের দিকে মনোনিবেশ করছি’। ওয়ালজ জবাব দিলেন- ‘এটি একটি জঘন্য উত্তর।’ তিনি সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আমেরিকান ভোটারদের উদ্দেশে বলেছিলেন- ‘আমি মনে করি আপনি সত্যিই পছন্দের জায়গায় সেরা… কে সেই গণতন্ত্রকে সম্মান করবে এবং কে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সম্মান করবে।’

ভাইস প্রেসিডেন্টরা সাধারণত মার্কিন নির্বাচনি দৌড়ের গতিপথ পরিবর্তন করেন না। তারা দেশীয় বা আন্তর্জাতিক নীতির ক্ষেত্রে সব সময় এক থাকেন। এই বিতর্কটিতে বিতর্কিত কোনো বিষয় নিয়ে এক সুচ পরিমাণও নড়েনি। দর্শকদের কাছ থেকে সিএনএন জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ১ শতাংশ বলেছেন যে, বিতর্কের ফলে তারা তাদের মন পরিবর্তন করেছেন। তবে বিতর্কটি এখনো ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের ভোটারের দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু পরিবর্তন আনতে পারে। ভ্যান্স খুব কম সুবিধা নিয়ে বিতর্কে আসেন। বিতর্কের সময় তিনি নিজের একটি নতুন এবং সরল সংস্করণের প্রস্তাব করেছিলেন। বিতর্কটি ছিল সুশীল সমাজ ও মূল বিষয়বস্তুর ওপর। উভয়েই একে অপরকে আক্রমণ করার চেয়ে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের বেশি আক্রমণ করেছিলেন।

নিউইয়র্ক টাইমস সম্পাদকীয় বোর্ডের সদস্য বিনইয়ামিন অ্যাপেলবামের মতে, ওয়ালজ ভ্যান্সকে ‘অদ্ভুত’ বলে অভিহিত করেননি, যেমনটি তিনি প্রচারণার সময় করেছিলেন। অন্যদিকে ভ্যান্স ‘ট্রাম্পবাদকে নম্র, শান্ত এবং সুসঙ্গত করে তুলেছিলেন’। এটি সিএনএন প্রতিফলিত হয়েছিল যে, ভ্যান্সের অনুকূলতা বেড়েছে। বিতর্কের আগে ৩০ শতাংশ ছিল এবং পরে ৪১ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে তার প্রতিকূলতা এখনো ৪৪ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে, ওয়ালজ তার অনুকূলতা ৪৬ শতাংশ থেকে ৫৯ শতাংশে উন্নীত করেছেন। কিন্তু যারা জরিপ করেছেন তাদের বেশির ভাগই বলেছেন, বিতর্কের সময় ভ্যান্স ভালো করেছেন।
 
যদিও ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা প্রচারের সময় পররাষ্ট্রনীতিতে তেমন কোনো পরিবর্তন করেন না। তবে তারা তাদের প্রার্থীদের একে অপরের বদনাম করতে পারেন। এই বিতর্কে উভয় প্রার্থীই একটি বড় দুর্ঘটনা এড়িয়ে গেছেন, বিশেষ করে পররাষ্ট্রনীতিতে। তারা বিশ্বকে একটি নিরপেক্ষ বার্তাও দিয়েছেন।

লেখক: জাতিসংঘে লেবাননের সাবেক রাষ্ট্রদূত
আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল