জেন জেড প্রজন্ম, যারা সাধারণত ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে, বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিতে পরিণত হচ্ছে। প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়ন, সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে তারা বেড়ে উঠেছে।
ফলে তারা তাদের পূর্বসূরিদের থেকে আলাদা চিন্তাধারা ও আচরণধারাসম্পন্ন। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ এবং ভোক্তা বাজারে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথে তাদের প্রভাব আরও বেশি করে প্রতিফলিত হবে। জেন জেড প্রজন্মের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো তাদের ডিজিটাল দক্ষতা। ইন্টারনেটের যুগে বেড়ে ওঠা এই প্রজন্ম স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে অভ্যস্ত। তাদের এই প্রযুক্তিগত পারদর্শিতা বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম।
প্রজন্ম জেডের ডিজিটাল প্রযুক্তি গ্রহণের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং খুচরা বিক্রিসহ সব ক্ষেত্রে ডিজিটাল বিপ্লব ঘটছে। এই প্রজন্মের ডিজিটাল পেমেন্ট এবং অনলাইন শপিংয়ের প্রতি আগ্রহ বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের সামনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। প্রযুক্তি দক্ষতার কারণে জেন জেড প্রজন্ম উদীয়মান গিগ অর্থনীতিতে অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। প্রচলিত চাকরির বাজারের কঠিন নিয়মের পরিবর্তে গিগ অর্থনীতি তাদের স্বাধীনতা ও নমনীয়তার স্বাদ দিয়েছে।
বাংলাদেশের যুবকদের বেকারত্বের হার উদ্বেগজনক হলেও গিগ অর্থনীতি তাদের জন্য আয়ের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। ফ্রিল্যান্সিং, রিমোট ওয়ার্ক এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে তরুণরা তাদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে বাড়ি থেকেই আয় করার সুযোগ পাচ্ছে। এই নতুন কর্মসংস্থান পদ্ধতি শ্রমবাজারে বিপ্লব ঘটিয়েছে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আয় বিতরণ এবং সামাজিক নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে গভীর প্রভাব ফেলছে।
জেন জেড প্রজন্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তাদের উদ্যোক্তা মনোভাব। তারা অনেকেই নিজস্ব ব্যবসা শুরু করতে বা স্টার্টআপে যোগ দিতে আগ্রহী। এই উদ্যোক্তা মনোভাবের পেছনে স্বাধীনভাবে কাজ করার আকাঙ্ক্ষা এবং প্রচলিত চাকরি বাজারের সীমাবদ্ধতার প্রভাব লক্ষ করা যায়।
বাংলাদেশের এসএমই খাতে প্রজন্ম জেডের উদ্যোক্তাদের আগমন অর্থনীতিকে আরও বৈচিত্র্যময় ও উদ্ভাবনী করে তুলতে পারে। যদি তাদের যথাযথভাবে অর্থায়ন, পরামর্শ এবং অবকাঠামোগত সহায়তা দেওয়া হয়, তা হলে তারা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
জেন জেড প্রজন্ম তাদের পূর্বসূরিদের থেকে ভিন্ন মূল্যবোধ ও অগ্রাধিকার নিয়ে গড়ে উঠেছে। সামাজিক ও পরিবেশগত দায়িত্ববোধের প্রতি তাদের গভীর আগ্রহ তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। জলবায়ু পরিবর্তন, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং নৈতিক ভোগের মতো বিষয়গুলো তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফলে তারা এমন ব্যবসা ও ব্র্যান্ডকে সমর্থন করে, যাদের মূল্যবোধ তাদের নিজস্ব মূল্যবোধের সঙ্গে মিলে যায়।
বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকার অনেক তরুণ-তরুণী মানসম্পন্ন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাবে ভুগছে। এর ফলে তারা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। জেন জেড প্রজন্মের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে ডিজিটাল দক্ষতা, সমালোচনামূলক চিন্তা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতার উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করা জরুরি। এই দক্ষতাগুলো অর্জন করলে বাংলাদেশের তরুণরা বৈশ্বিক কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হবে এবং দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির ব্যাপক পরিবর্তনে জেন জেড প্রজন্মের জনসংখ্যাগত বৈশিষ্ট্যের গুরুত্ব অপরিসীম। তরুণ ও বর্ধনশীল এই জনগোষ্ঠী দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী এবং ভোক্তা বাজারের একটি বড় অংশ গঠন করে। যদি এই জনগোষ্ঠীর যোগ্যতা ও উদ্যোগকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয়, তা হলে দেশ টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে। যদি আমরা জেন জেড প্রজন্মের সম্ভাবনাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে তুলে ধরতে চাই, তা হলে তাদের সামনে দাঁড়ানো বেকারত্ব, অধিকারহীনতা এবং সামাজিক বৈষম্যের মতো সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
তাদের জন্য মানসম্মত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা, সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন নিশ্চিত করা এবং সামাজিক সেবায় সহজ প্রবেশাধিকার দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। শুধু তাই নয়, একটি সমৃদ্ধ এবং সবার জন্য সমান অধিকারসম্পন্ন একটি সমাজ গড়তে হলে এই তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও জরুরি।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির ওপর জেন জেড প্রজন্মের রাজনৈতিক সচেতনতা ও সক্রিয়তার গভীর প্রভাব পড়তে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহার এবং তথ্যের সহজলভ্যতা এই প্রজন্মকে রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে আগের চেয়ে বেশি সচেতন করে তুলেছে। ফলে তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে এবং তাদের মতামত প্রকাশ করছে।
সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের মতো সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে জেন জেড প্রজন্মের সক্রিয় অংশগ্রহণ তাদের পরিবর্তন ও জবাবদিহির প্রতি গভীর আগ্রহের পরিচয় দেয়। এই প্রজন্ম যখন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আরও প্রভাবশালী হবে, তাদের স্বচ্ছতা, সুশাসন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবি ব্যবসায়িক পরিবেশকে আরও সুস্থ করে তুলবে এবং টেকসই উন্নয়নকে উৎসাহিত করবে।
বিশ্বায়নের প্রভাবে জেন জেড প্রজন্মের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ গভীরভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। একটি আন্তর্জাতিকভাবে সংযুক্ত পৃথিবীতে বেড়ে ওঠা এই প্রজন্ম বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি, ধারণা এবং বাজারের সঙ্গে পরিচিত। ফলে তারা বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে বিশ্বব্যাপী শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং উদ্যোক্তা কার্যকলাপের সুযোগ খুঁজতে আগ্রহী।
তরুণ বাংলাদেশিরা তাদের নতুন চিন্তাধারা ও বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতা দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণসঞ্চার করছে। তাদের এই উদ্যমী মনোভাব উদ্ভাবন ও প্রতিযোগিতাকে আরও জোরদার করছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রতিযোগিতা, বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। তবে এই একীকরণের পাশাপাশি নানা ধরনের চ্যালেঞ্জও সামনে আসছে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির টেকসই বৃদ্ধির জন্য প্রজন্ম জেডের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোভিড-১৯ মহামারি স্পষ্ট করেছে যে জনস্বাস্থ্য একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ভিত্তি। তরুণদের মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা একটি দক্ষ ও উৎপাদনশীল কর্মশক্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। মহামারি-পরবর্তী সময়ে শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার না হলেও এই সমস্যাগুলোর সমাধান না করা হলে প্রজন্ম জেডের অর্থনৈতিক সাফল্য বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিতে জেন জেড প্রজন্মের অবদান অপরিহার্য হবে। তাদের শক্তিশালী ডিজিটাল দক্ষতা, উদ্যোক্তার মনোভাব এবং সামাজিক-পরিবেশগত দায়বদ্ধতার কারণে তারা বিভিন্ন খাতে নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে। এই প্রজন্মের তরুণরা তাদের দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
পরিশেষে জেন জেড প্রজন্মের সম্পূর্ণ সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে তাদের সামনে দাঁড়ানো বেকারত্ব, বৈষম্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অসমতাসহ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা জরুরি। এই প্রজন্মের উন্নয়ন ও কল্যাণে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ তাদের তরুণ জনগোষ্ঠীর সৃজনশীলতা ও উদ্যমকে কাজে লাগিয়ে একটি টেকসই এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারবে।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]