বাংলাদেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ৮ আগস্ট, ২০২৪-এ শপথ গ্রহণ করে। এ সরকার পূর্ববর্তী তিন বা চারটি ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের ঐতিহ্যের অনুবর্তী হলেও প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের অন্তর্বর্তী সরকার, বিচারপতি হাবিবুর রহমান ও লতিফুর রহমানের দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানের বিধানবলে গঠিত এবং সংবিধান নির্ধারিত সময়ে তারা দায়িত্ব শেষ করেন।
বিরাজিত সরকার কাঠামোয় একটি স্থিতিশীল ব্যবস্থায় তারা কাজের সুযোগ পান। তুমুল একটি হিংসাশ্রয়ী আন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকার অকার্যকর হয়ে পড়লে ২০০৭-০৮-এ ভিন্ন প্রকৃতির একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের ভালো বিকল্প না পাওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই দলেরই দায় ছিল। বিএনপি বিচারপতির অবসরের বয়স বাড়ানোয় আওয়ামী লীগ সিরিয়ালে থাকা সর্বশেষ অবসরে যাওয়া বিচারপতি মাসুদকে মেনে নিতে অস্বীকার করে এবং বিএনপিও অন্য বিকল্প অনুসন্ধান না করে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে দায়িত্ব দিয়ে বসে। তার পরের ইতিহাস সবার জানা।
১/১১-এর সরকারের কাজকর্ম নিয়ে ২০০৯ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা গ্রহণকারী আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে নানা কটু মন্তব্য করলেও তারাই জাতীয় সংসদে দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সব কাজকর্ম ও পরিবর্তন সাপেক্ষে আইনকানুনের বৈধতা দান করে। কিছু ধারা পরিবর্তনের নমুনা, যেমন- উপজেলা পরিষদ আইনে ‘জাতীয় সংসদ সদস্যকে উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা করা ও পরিষদ উপদেষ্টার উপদেশ শুনবে’- এ জাতীয় ধারা সংয়োজন করা হয়।
যেটি ছিল পরিষদকে অকার্যকর করার একটি অন্যতম হাতিয়ার। আবার ‘স্থানীয় সরকার কমিশন’ আইনটি তারা রেকটিফাই করেননি। ফলে কমিশন অকার্যকর হয়ে পড়ে। দুই বছরের শাসনকালের সেই সরকার বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাসহ বেশুমার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির মামলা দায়ের করে। আওয়ামী লীগের সরকার গঠিত হওয়ার পর শেখ হাসিনাসহ সরকারি দলের সবার কয়েক হাজার মামলা প্রত্যাহার হয়ে যায়।
কিন্তু বেগম খালেদা জিয়াসহ বিরোধী দল বিএনপির সবার মামলা বহাল থাকে এবং দ্রুততার সঙ্গে বিচার ও শাস্তি-প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন ও কর্ম-প্রক্রিয়া আলোচনার আগে এ প্রাসঙ্গিক ইতিহাস অনেক কারণে মনে করার প্রযোজন রয়েছে। কারণ কোনো নতুন ঘটনা-দুর্ঘটনার মুখোমুখি হলে আমরা অবলীলাক্রমে অতীত ভুলে যাই বা ভুলে যাওয়ার ভান করি।
২০২৪-এর অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়ে আলোচনার প্রথম বিষয় হচ্ছে, এ সরকারের সঙ্গে পূর্ববর্তী চারটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্যে প্রেক্ষাপটগত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ও সমস্যার বিচারে পর্বতপ্রমাণ পার্থক্য রয়েছে। অনেক প্রশ্ন অনেকে ওঠাচ্ছেন, এ সরকার কবে যাবে? কিন্তু এ প্রশ্নগুলো যৌক্তিকভাবে ওঠাতে গেলে বেশি না হলেও অন্তত দুই বছর এ সরকারকে সময় দেওয়ার প্রশ্ন আসবে।
লাগলে হয়তো আরও বেশিও দিতে হতে পারে। সরকারের কাজ শুরুর আগে যদি কেউ বলতে শুরু করেন- আপনি কবে যাবেন, তা খুব অন্যায্য ও হঠকারিতা। ৮ আগস্ট ২০২৪-এ শপথ নেওয়ার পর মাত্র এক মাস গত হলো। যদি প্রশ্ন করা হয়, ছাত্র-জনতার এ অভ্যুত্থান না হলে আওয়ামী লীগ আরও কয় বছর ক্ষমতায় থাকত? কখন কবে নাগাদ নির্দলীয় সরকারের অধীনে রাজনৈতিক সমতলভূমিতে নির্বাচন পাওয়া যেত। তার সদুত্তর পাওয়া কঠিন।
সব ধরনের শূন্যতার মাঝে একটি ‘সরকার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু ‘শাসন’ এখনো প্রতিষ্ঠা পায়নি। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, শুধু একটি নির্বাচন করার জন্য এ সরকার গঠিত হয়নি। এ সরকারের ম্যান্ডেট অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। দেশে পরিপূর্ণ শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রের নানামুখী সংস্কার কর্মসূচির। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা পাওয়া গেছে। বিশেষত সংস্কার বিষয়ে কমিশন গঠন তার একটি স্পষ্ট ও বাস্তব পদক্ষেপ। সংস্কারের ক্ষেত্রেও সবকিছু অন্তর্বর্তী সরকার পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে তা হলফ করে বলা যায় না, না পারলেও একটি পথ রচনা করে দিয়ে যেতে পারবে।
এ সময়ের মধ্যে বিএনপিসহ দেশের সব রাজনৈতিক দল বা জোটকে একটি ভালো নির্বাচনের জন্য নিজেদের পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত করতে হবে। প্রতিটি দলের গঠনতন্ত্র ও সাংগঠনিক কাঠামোর গণতান্ত্রিক রূপান্তর এবং প্রত্যেক প্রার্থীর উচ্চ গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। প্রার্থীর শিক্ষা, নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা, অপরাধ, কালোটাকা, সভ্যতা-সংস্কৃতি, আচার-আচরণ ইত্যাদি নিয়ে সংবিধানে অনেক কিছুই সর্বজনীনতার খাতিরে অনুপস্থিত হলেও আরপিও, আচরণবিধি এবং হলফনামার আট তথ্যের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি মনোনয়নকে জনপ্রত্যাশার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যায়। এবার সে প্রচেষ্টা আন্তরিকভাবে করতে হবে।
স্বাভাবিক রাজনৈতিক কারণে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি, জামায়াত এবং গণতন্ত্রমনা অন্যান্য ডান, বাম ও মধ্যপন্থি দলগুলো আওয়ামী লীগের বিপর্যস্ত অবস্থার সুযোগ নেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তারা নিশ্চয়ই সেভাবে নিজেদের সাংগঠনিকভাবে প্রস্তুত করছেন। কিন্তু দেশ পরিচালনার নীতিনির্ধারণ ও যোগ্য নেতৃত্ব বাছাইয়ে তারা কতটুকু প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন, সেটি জাতি দেখতে চাইবে। সে জন্য এখন একটি স্বাধীন ও মুক্ত পরিবেশ তারা পাচ্ছেন। আশা করি, সে সুযোগ গ্রহণ করে তারা নিজেদের ভালোভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে সক্ষম হবেন এবং দল পুনর্গঠন করে নেবেন।
ইতোমধ্যে বিএনপি-জামায়াতসহ সব বাম দল ও মোর্চা সরকারের সঙ্গে সভা করে তাদের মতামত দিয়েছে, সে জন্য তাদের অভিনন্দন। এটিই জাতি আশা করছিল। এখানে জাতীয় পার্টি নিয়ে বড় একটি প্রশ্ন আছে। রাজনীতিতে সুবিধাবাদের জনবিরোধী ভূমিকাকে চিরতরে শেষ করার প্রচেষ্টা হিসেবেই জাতীয় পার্টির ভূমিকার বিষয়টি মনে রাখতে হবে। এ দলটি গত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বৈধতা দিয়েছে। সময়-সুযোগে বর্তমানে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগের অনুগ্রহের দায় শোধে এ ভদ্র ও শিষ্ট চেহারা ভবিষ্যতে পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে।
গোলাম মোহাম্মদ কাদের নির্বাচনের আগে ভারত গিয়ে সবকও নিয়েছিলেন। আবার তা জনসমক্ষে প্রকাশে অস্বীকারও করেছিলেন। এসব কুকাজের জন্য তারা কি জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন বা তাদের বর্তমান অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন বলে জানা নেই। আওয়ামী লীগ যদি ফ্যাসিস্ট ও গণহত্যাকারী দল হিসেবে চিহ্নিত হয়; জাতীয় পার্টিও তার অনুগত ও বিশ্বস্ত দোসর হিসেবে দোষী হবে।
দেশের মানুষ একটি স্বচ্ছ রাজনীতি ও সুষ্ঠু নির্বাচন, দলনিরপেক্ষ পেশাদার প্রশাসন, নীতিনৈতিকতার ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ও ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, সুদক্ষ অর্থব্যবস্থা তথা পেশাদার ও দায়িত্বশীল ব্যাংক, ব্যাংকার ও ব্যবস্থাপক দেখতে চায়। দেশের সব নাগরিক ও পেশাদার সংঘ-সমিতি একটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের রূপ নিয়েছিল, অনেকে সরকারের দায়িত্বশীল পদে বসে রাজনীতির স্লোগান ধরেছেন এবং দুহাতে দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় গড়েছেন, পাচার করেছেন, তাদের বিচার নিশ্চয়ই হবে।
ব্যবসা-বাণিজ্য বিকাশের স্বার্থে কাউকে ছাড় দিতে হবে- এ কথা যেন না বলা হয়। কোনো কোনো দল ও মহল বলতে শুরু করেছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, এমন কিছু যেন না করা হয়। অনেকে রপ্তানি করে তার জন্য প্রণোদনার অর্থ গ্রহণ করে; আবার রপ্তানির মাধ্যমে আয় করা অর্থ বিদেশে রেখে জালিয়াতি করেছেন। বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ নানা খাতে অন্যায্য মুনাফা, ব্যাংকের অর্থ ও নানা সংস্থার পদ-পদবি বাগিয়ে লুটপাট করেছেন, তাদের ছাড় ও ছেড়ে দেওয়া চলবে না।
সংবিধানের প্রজাতান্ত্রিক চরিত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। সে জন্য দ্বিকক্ষবিশিস্ট জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা একটি অন্যতম পদক্ষেপ হতে পারে। নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার, যেমন- ‘সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ ও অনুপস্থিত ভোটারদের জন্য ‘পোস্টাল ব্যালট’ চালুর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। শিকড় থেকে শিখর পর্যন্ত দায়িত্বশীল, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রশাসনের অধিকর্তাদের নিজ নিজ পেশাগত স্বাধীনতা নিশ্চিত থাকবে। তারা কখনো কোনো দলের আজ্ঞাবহ নয়, তারা হবেন প্রজাতন্ত্রের গর্বিত জনসেবক।
স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে গণতন্ত্রমুখী ধারায় পুনর্গঠিত করতে হবে। ‘দেশের মালিক দেশের জনগণ’- এ বোধ ও সংস্কৃতি হবে সরকারের মূল দর্শন এবং সরকার হবে স্মল ও স্মার্ট। এগুলো হলো এ সরকার থেকে গণপ্রত্যাশা। সবটা এ সরকার করতে পারবে তা নয়। এখানে এসব প্রত্যাশার দিকগুলো নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একটি পথরেখা তৈরি করবে এবং আগামীর নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে এগুলো নিয়ে বোঝাপড়ার বিষয় আছে। জাতি স্পষ্টভাবে সে রকম একটি বোঝাপড়া দেখতে চাইবে।
লেখক: অধ্যাপক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ
tofailahmed.info