তানজিম আহমদ সোহেল তাজ। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বিরাগভাজন হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তার পরের ঘটনার কিছু প্রকাশ্যে এসেছে। কিছু রয়ে গেছে অন্তরালে। কিন্তু কেন তিনি ইস্তফা দিয়েছিলেন? খবরের কাগজের কাছে সেসব ঘটনা উন্মোচন করেছেন সোহেল তাজ নিজেই। তিনি বলেছেন, অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা, অন্যায়গুলো মেনে নিয়ে জি হুজুর বলে থাকার মানুষ না তিনি। চূড়ান্ত প্রতিবাদ হিসেবে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জানিয়ে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদপুত্র সোহেল তাজ বলেন, ‘পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতে নিজে জমা দিয়েছি। পরের দিন আমাকে জোর করে যমুনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।’ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের সিটি এডিটর আবদুল্লাহ আল মামুন।
খবরের কাগজ: এটা কি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন?
সোহেল তাজ: তারা (মন্ত্রণালয়ের সচিবরা) নির্দেশ নেন শুধু একজনের। একজন প্রতিমন্ত্রী বা মন্ত্রী দেখেন তার ইনস্ট্রাকশন ফলো করা হচ্ছে না। আরেকটা বিষয় আমাকে নাড়া দিয়েছিল, সেটা হলো বিডিআর হত্যাযজ্ঞ। এ বিষয়ে অনেকে আমাকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেছিল। আমি সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম। সেখান থেকে দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি। প্রধানমন্ত্রী কেন তার সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছেন সেটা আমি বলতে পারব না। কেন তিনি রাজনৈতিক সমাধানে গেলেন, সেটা তিনি বলতে পারবেন।
খবরের কাগজ: আপনি কি কখনো জানার চেষ্টা করেছিলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে…
সোহেল তাজ: আমি একটা টার্গেট নিয়ে এসেছিলাম যে, এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে। এসে আমি হতাশ হলাম কেন জানেন? এর সম্পূর্ণ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলো একজন কো-অর্ডিনেটরকে। তার মানে আমাদের হাত থেকে সবকিছু সরিয়ে ফেলা হলো। সব ফাইলপত্র ও দায়িত্ব দেওয়া হলো বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল ফারুক খানকে এবং আমাদের কাছ থেকে কিছু জানার চেষ্টাও করা হয়নি।
খবরের কাগজ: আমরা সে সময় জেনেছিলাম শেখ ফজলুল করিম সেলিমের সঙ্গে আপনার একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল?
সোহেল তাজ: এটা সম্পূর্ণ ভুল। এটা বলা হয়েছে আসল কারণ পদত্যাগকে ‘ডিফ্লেক্ট’ করার জন্য। যারা প্রিভিয়াস সরকারে দুর্নীতি করেছেন, তাদের বিদেশ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। যারা সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ সেই তালিকাতে ছিলেন বিএনপির ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। রাতে আমাকে এসবি প্রধান ফোন করে বলেন তিনি (টুকু) যাচ্ছেন, আমি বললাম তিনি কি তালিকায় আছেন? বলেন, জি আছেন। আমি বললাম আপনাদের যেটা করার সেটা করতে হবে। এই বিষয়টা মনে হয় তিনি (শেখ ফজলুল করিম সেলিম) জানতে পেরেছিলেন। এটা নিয়ে তার সঙ্গে আমার কোনো দ্বন্দ্ব মতবিরোধ হয়নি।
খবরের কাগজ: তার অর্থ শেখ সেলিম আপনাকে তার বেয়াই ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে কিছু বলেননি?
সোহেল তাজ: না।
খবরের কাগজ: গুজব ছিল আপনি তাকে (ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু) বিদেশ যেতে দেননি।
সোহেল তাজ: এই গুজবটা ছড়িয়েছিল একটা গোষ্ঠী। যারা চেয়েছিল আমার পদত্যাগের আসল কারণগুলো ঢাকা দিয়ে একটা ফলস কারণ দাঁড় করাতে।
খবরের কাগজ: শেখ সেলিম আপনাকে ফোন করেছিলেন?
সোহেল তাজ: আমাকে ফোন করে থাকলে মনে থাকত।
খবরের কাগজ: একবার আপনি আমাকে বলেছিলেন তিনি (শেখ সেলিম) আপনাকে ফোন করে রিকোয়েস্ট করেছিলেন তাকে (ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু) যেন ছেড়ে দেওয়া হয়।
সোহেল তাজ: আমি এসবি প্রধানকে বলেছিলাম নিয়মের মধ্যে যেটা আছে, তালিকা যদি থাকে তাহলে নিয়মের মধ্যে থেকে যেটা করার সেটাই করবেন।
খবরের কাগজ: আপনি তো ওই রাতেই পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলেন?
সোহেল তাজ: না।
খবরের কাগজ: কিন্তু আমরা জেনেছিলাম যে প্রধানমন্ত্রী আপনার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে ফেরত দিয়েছিলেন?
সোহেল তাজ: না, এখানে আরেকটা ঘটনা আছে। আমি ৩১ মে পদত্যাগপত্র দিয়েছিলাম। আমি অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা, অন্যায়গুলো মেনে নিয়ে জি হুজুর বলে থাকার মানুষ না। চূড়ান্ত প্রতিবাদ হিসেবে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতে নিজে জমা দিয়েছি। পরের দিন আমাকে জোর করে যমুনায় নিয়ে যাওয়া হলো। প্রধানমন্ত্রী কথা বলবেন, তাই যমুনায় আমাকে নিয়ে গেলেন।
খবরের কাগজ: পরের দিন কোন সময়ে?
সোহেল তাজ: রাত ৮টায়।
খবরের কাগজ: তার মানে সারা দিন পার করে?
সোহেল তাজ: আমাকে যমুনায় নিয়ে যাওয়া হয়। যমুনায় নিয়ে যাওয়ার পর দেখি সবাই বসে আছেন।
খবরের কাগজ: আপনাকে কীভাবে নিয়ে যাওয়া হয়? ডেকে নিয়ে যায়?
সোহেল তাজ: সৈয়দ আশরাফ ভাই এসে বললেন নেত্রী কথা বলবেন। আমি যেতে চাইনি। বলেছি পদত্যাগপত্র দিয়েছি, আমি যাব না। আমি তাকে অসম্মান করতে চাইনি। এ অবস্থায় আমাকে সৈয়দ আশরাফ বললেন, সোহেল চলো চলো। আশরাফ ভাইয়ের কথায় রাজি হলাম। আমি ভাবলাম তিনি হয়তো আমাকে বলবেন, জিজ্ঞেস করবেন, কেন তুমি পদত্যাগটা করছ? হয়তো আমার থেকে জানতে চাইবেন এবং অ্যাড্রেস করবেন ইস্যুগুলো। আমি গেলাম এবং দেখলাম সাজেদা চৌধুরী, শামসুল হক টুকু, আশরাফ ভাই, ফিজার সাহেব। সবাই বসে আছেন, খোশগল্প করছেন। পাঁচ মিনিট চলে গেল, দশ মিনিট চলে গেল, আমি বসে আছি তারা খোশগল্প করছেন। তখন আমার রিয়েলাইজেশন হলো এটা আমাকে বোঝাবার কিছু না। এটা হচ্ছে জনগণকে একটা মেসেজ দেওয়া- সোহেলকে ম্যানেজ করা হয়েছে এবং সবকিছু ঠিকঠাক। তখন একপর্যায়ে আমি বলে বসলাম আমাকে কি ডেকেছেন আলাপ শোনার জন্য নাকি আমাকে আপনারা বোঝাবেন?
খবরের কাগজ: তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না?
সোহেল তাজ: হ্যাঁ, আমি প্রধানমন্ত্রীকেই বললাম- আমাকে ডেকেছেন কথা বলার জন্য না আপনাদের আলাপ শোনার জন্য। ১৫ মিনিট হয়ে গেছে!
খবরের কাগজ: তিনি কি কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না?
সোহেল তাজ: নাথিং। তারা শুধু আলাপ করছেন আর আমি বসে আছি। প্রধানমন্ত্রী বললেন তুমি এটা কি করছ? আমি বললাম, আমি তো আপনাকে বলেছি আমি পদত্যাগ করেছি। আমি থাকব না। তখন প্রধানমন্ত্রী বললেন- তুমি পদত্যাগ করলে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে এবং তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন।
খবরের কাগজ: কী বললেন ক্ষিপ্ত হয়ে?
সোহেল তাজ: সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি সোচ্চার হচ্ছে। তখন আমি তাকে বললাম আমরা যে নির্বাচনি ইশতেহার দিয়েছিলাম, আমাদের বাংলাদেশকে পুনর্গঠন করার কথা ছিল। আমরা যদি সঠিক পথে কাজটা করতাম, তাহলে চেয়ারের নিচে ডানে-বামে আমাদের ষড়যন্ত্র খোঁজা লাগত না। আমরা এখন ভাবছি সব জায়গায় ষড়যন্ত্র। আমরা সঠিক পথটা বেছে নিইনি। তখন সাজেদা চৌধুরী বললেন, এই তুমি এভাবে কথা বলছ কেন? ১৫ আগস্ট এর পরে আমরা তাকে… তখন আমি সাজেদা চৌধুরীকে বলেছিলাম, দেখুন, আপনাদের কারণেই দলের এ অবস্থা। কারণ সঠিক কথাটা আপনারা বলার সাহস রাখেন না। তিনি যা শুনতে চেয়েছেন আপনারা তাই বলেছেন। আমি বলেছি আপনাদের যদি আমাকে কিছু বলার না থাকে চলে যাচ্ছি। পদত্যাগপত্র আমি গতকাল দিয়েছি।
খবরের কাগজ: যমুনায় গিয়েই দিয়েছিলেন?
সোহেল তাজ: হ্যাঁ, তারপর আমি চলে গেলাম। তারপরও রিকোয়েস্ট করা হলো। পরবর্তী সময়ে দেখেছি যে, আমাকে নানাভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলাম আমেরিকা চলে যাব। তার তিন-চার দিন পরে আমেরিকা গিয়ে তাকে ফোন করেছি। একটা কথা বলি- আমাকে জোর করে রাখা হয়েছিল তিন দিন।
খবরের কাগজ: এখানে কি কোনো এজেন্সির ভূমিকা ছিল?
সোহেল তাজ: এ রকম একটা প্রেশার সিচুয়েশনে..
খবরের কাগজ: সে সময় আমি যখন আপনার সঙ্গে দেখা করতে যমুনায় যাই আপনি বলেছিলেন...
সোহেল তাজ: দেখেন আমার বক্তব্যটা খুব সিম্পল ছিল এই যে, দিন বদলের সনদের ওয়াদাগুলো যদি বাস্তবায়ন করতাম, যদি নির্বাচন কমিশনকে একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে পারতাম, প্রশাসনকে দলীয়মুক্ত করতে পারতাম, পুলিশ বাহিনীকে কার্যকর জনবান্ধব করে গড়ে তুলতে পারতাম, তাহলে পরবর্তী নির্বাচনে মানুষ আপনাকে ভোট দিয়ে নিয়ে আসত। আপনার তো ভয় পাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু আপনি সেই পথে গেলেন না। আমি সেই কথাটাই বলেছিলাম। বলেছিলাম আমরা তো একই কাজ করছি, যেটা বিএনপি জামায়াত করেছে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত।
খবরের কাগজ: এই কথাগুলো আপনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন? এই যে দল নীতি আদর্শ থেকে সরে গেছে, আমি এগুলোকে মেনে নিতে পারছি না?
সোহেল তাজ: হ্যাঁ, আমি বলেছি।
খবরের কাগজ: আগে বলেছিলেন?
সোহেল তাজ: না, যখন আমাকে ডাকল সাজেদা চৌধুরী, আশরাফ ভাইসহ।
খবরের কাগজ: তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী বলেছিলেন?
সোহেল তাজ: তিনি কোনো কথা বলেননি। তার মুখ একদম ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল, আমি তখন উঠে চলে এসেছি।
খবরের কাগজ: আপনি তিন দিন পর চলে গিয়েছিলেন স্ত্রী-সন্তানদের কাছে। সে সময় আপনি আমাকে একটা ইন্টারভিউয়ে বলেছিলেন- খেলোয়াড় বদলেছে কিন্তু খেলা একই আছে। আপনি বলেছিলেন যে আওয়ামী লীগের ভেতরে চিত্র এক রকম। বাইরে চিত্র আরেক রকম। আপনি বলেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনাকে ফোন করেছিলেন এবং বলেছিলেন দলীয় পদ দেওয়ার জন্য, পূর্ণমন্ত্রী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে পরিষ্কার করে যদি বলতেন।
সোহেল তাজ: আমি বাংলাদেশ থেকে কোনোমতে বের হয়ে আমেরিকায় গিয়ে তাকে (শেখ হাসিনা) ফোন দিয়েছি। রিকোয়েস্ট করেছি আমাকে দয়া করে ছেড়ে দেন। আমি পদত্যাগপত্র আপনাকে দিয়েছি ৩১ মে। আমি থাকতে চাই না। তিনি আমাকে বললেন থাকো।
এটা হাস্যকর শোনাবে আমি বলতে চাচ্ছি না। পাঁচ মিনিট ধরে আমি বলছি আমাকে ছেড়ে দেন, তিনি বলছেন, তোমাকে ছাড়ব না। তারপর তিনি গান গেয়েছেন, আমি হতভম্ব হয়ে যাই।
খবরের কাগজ: কী গান গেয়েছেন?
সোহেল তাজ: আমি তোমাকে ছাড়ব না, আমি কাউকে ছাড়ি না, আমি তোমাকে ছাড়ব না। এভাবে সুর করে ২-৪ মিনিট গান গাইলেন। ফোনে শুনে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী এভাবে গান গাইবেন! কিন্তু এটা আমার কাছে ‘নট আ ম্যাটার অব জোকস’। আমার মনে পড়েছিল ৩১ তারিখের চেহারা। এগুলো যদি আপনি মিলিয়ে দেখেন ইট ওয়াজ আ বিগ থ্রেট। তার আগে তিনি বলেছিলেন, তোমার কী লাগবে? তুমি আসো সেক্রেটারির একটা পদ খোলা আছে। মন্ত্রিত্বের অফার করা হয়েছে। কী লাগবে বারবার বলা হয়েছে। আমি বলেছি আমাকে ছেড়ে দেন। তখন তিনি ওই গানটা গাইলেন। আমার মনে আছে আমি প্রতি উত্তরে তাকে বলেছিলাম- দেখেন আপনাকে যা বলার আমি বলে দিয়েছি, আপনি আপনারটা করুন আর আমি এখন যা করার সেটা করব।
খবরের কাগজ: তার মানে আপনি সবকিছু বলে দেওয়ার জন্য…
সোহেল তাজ: আমি মিন করেছি বেরিয়ে আসার জন্য, যা করা দরকার তাই করব। কারণ তিনি তো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন আমাকে ছাড়বেন না। আমি তাকে চ্যালেঞ্জ দিলাম আমি বের হব। এই শুরু হলো খেলা। আমার শেষ খেলাটা খেললাম।
খবরের কাগজ: কী খেললেন?
সোহেল তাজ: সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করলাম। আমার প্যাডে সাইন করে স্পিকার বরাবর পাঠিয়ে দিলাম। স্পিকারকে ফোন করে বললাম হামিদ কাকু এই যে আমার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছি, এটা আমার স্বাক্ষর করা। তিনি প্রেসকে বললেন, এটা কে দিয়েছে না দিয়েছে আমি তো জানি না। কারণ তাকে বলা হয়েছে এটা গ্রহণ না করতে। তিনি অজুহাত দিলেন সশরীরে থাকতে হবে। তখন আমি নিজে চলে এলাম এবং পদত্যাগপত্র দিলাম। প্রথমটা দিয়েছিলাম এপ্রিল মাসে, দ্বিতীয়টা দিলাম জুলাই মাসে। জুলাই মাসে পদত্যাগপত্র দিলে আবার আমাকে ডেকে পাঠালেন প্রধানমন্ত্রী। গণভবনে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন- তুমি এখন কী করবা? আমি বললাম, আমি তো পদত্যাগপত্র দিয়েছি। হ্যাঁ তুমি পদত্যাগপত্র দিয়ে এখানে এসেছ। আমি ভেবেছিলাম তুমি আগে আমার কাছে আসবা। আমি বললাম, আমি তো পদত্যাগপত্র দিয়েছি।
খবরের কাগজ: আপনি ওই সময় বলেছিলেন আর রাজনীতি করবেন না। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের আগে একটা আলোচনা ছিল আপনাকে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বা আপনার দলে কাজ করার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এই বিষয়টা কী ছিল?
সোহেল তাজ: কবে এটা?
খবরের কাগজ: সর্বশেষ আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে।
সোহেল তাজ: দেখেন আমি বারবার একটা কথা বলেছি আওয়ামী লীগে ছিলাম, আছি, থাকব। কিন্তু এই আওয়ামী লীগে না। এটা আমার আওয়ামী লীগ না। এটা কোনো আওয়ামী লীগ না। এটা হচ্ছে লুটেরা লীগ, এটা হচ্ছে খুনি লীগ, এটা হচ্ছে গুম লীগ, এটা হচ্ছে অব্যবস্থাপনা লীগ, দুর্নীতি লীগ। এটা সাধারণ মানুষ হত্যাকারী লীগ। এই আওয়ামী লীগের তো আমি হতে চাইনি।
খবরের কাগজ: কিন্তু আপনার বোন তো আওয়ামী লীগের টিকিটে একই আসন থেকে এমপি হয়েছেন।
সোহেল তাজ: আমার বোনকে রীতিমতো জোর করে নমিনেশন দেওয়া হয়। কারণ আমার পথটা যে বেকায়দায় ফেলেছিল সরকারকে, তাজউদ্দীন পরিবার থেকে পদত্যাগ করেছে, সেটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা। যে যাই বলুক না কেন, আমাদের জননেত্রী শেখ হাসিনার একটা গুণ আছে। তার সংস্পর্শে এলে কেন জানি সবাই নিজেকে হারিয়ে ফেলে। এটা অ্যামেইজিং ট্যালেন্ট কারিশমা বলে। আপনি তার সামনে গেলে একদম দুর্বল হয়ে যাবেন।
খবরের কাগজ: এখন আলোচনা হচ্ছে আপনি আওয়ামী লীগের হাল ধরবেন। আপনার মায়ের মতো। এই আলোচনার সত্যতা কতটুকু?
সোহেল তাজ: ছাত্র আন্দোলনের ঘটনাগুলো বিবেককে এমনভাবে নাড়া দিয়েছে যে, আমি বাধ্য হয়েছি প্রতিবাদ করতে। আমি আমার অবস্থান থেকে প্রতিবাদ করেছি। আমি ২৭ জুলাই ডিবি অফিসে গিয়েছি ছাত্র সমন্বয়কদের সেখানে আটকে রাখা হয়েছিল। আন্দোলন প্রত্যাহারের ফলস স্টেটমেন্ট যখন দেওয়া হলো, আমি আশ্চর্য হয়েছি যখন দেখলাম প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) মেট্রোরেলের সামনে গিয়ে কান্নাকাটি করছেন যে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অথচ শত শত প্রাণ আমরা হারিয়েছি। আমি মানুষের কাছে মেসেজটা দিতে চেয়েছিলাম। কারণ সাংঘাতিকভাবে মিডিয়াতে একই জিনিস রিপিট করা হচ্ছিল, মেট্রোরেলের ক্ষতি হয়েছে, অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। আমি আশ্চর্য হলাম যে মানুষ ভুলে যাচ্ছে মেট্রোরেল, পদ্মা ব্রিজ- এগুলো জনগণের টাকায় তৈরি হয়েছে। এগুলো আবার পরে গড়ে নিতে পারব। যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের তো আমরা ফিরে পাব না। তখন আমি এই মেসেজটা দিলাম- একটা প্রাণ হচ্ছে অমূল্য।
খবরের কাগজ: মেসেজটা কীভাবে দিয়েছিলেন?
সোহেল তাজ: আমি ডিবি অফিসে যখন গেলাম তখন সংবাদ মাধ্যম ছিল। সেই সংবাদ মাধ্যমে আমি জানালাম যে সমন্বয়করা সেফ কাস্টডিতে না। তারা গ্রেপ্তার অবস্থায় আছে, তারা গ্রেপ্তার অবস্থায় থাকা মানে আমি ইন্ডিকেট করলাম ‘স্টেটমেন্ট ইজ নট ভ্যালিড’। দ্বিতীয়ত হচ্ছে- ক্ষয়ক্ষতি কিছুই না, প্রাণ হচ্ছে অমূল্য। তৃতীয় মেসেজ নতুন প্রজন্ম তোমরাই পারবে, তোমাদের দেশ এটা, আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
খবরের কাগজ: এই যে এত ছাত্র-জনতা মারা গেছে, এটাকে গণহত্যা হিসেবে দাবি করছে বর্তমান সরকার এবং আন্দোলনকারী ছাত্ররা। আপনি মনে করেন কি না যে সেটা গণহত্যা হয়েছিল আর গণহত্যা হয়ে থাকলে আওয়ামী লীগের ক্ষমা চাওয়া উচিত?
সোহেল তাজ: দেখেন যে ঘটনাটা ঘটেছে এখানে হাজারের ওপরে মারা গেছে। মারা গেছে নিরীহ ছাত্র, পোশাক শ্রমিক, রিকশাচালক, সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশের ইতিহাসে কেন, গত ৫০ বছরে এশিয়ার ইতিহাসে নেই এ রকম জঘন্য হত্যাকাণ্ড। নির্বিচারে গুলি করা হয়েছে। পুলিশ গুলি করেছে, বিজিবি গুলি করেছে, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা গুলি করেছে, যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা গুলি করেছে। যারা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনতে হবে। গত ১৫ বছর যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, যারা টাকা পাচার করেছে বিদেশে তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে। যারা অনিয়ম করেছে, হত্যা, গুম, নির্যাতনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনতে হবে। সে আওয়ামী লীগার হোক আর না হোক। এই শুদ্ধি অপারেশন করার পর যদি কোনো আওয়ামী লীগার থাকে তাকে অনুশোচনা করতে হবে। আত্মসমালোচনা করতে হবে, আত্মোপলব্ধি করতে হবে।
খবরের কাগজ: এখন অনেকে অ্যারেস্ট হয়ে, অনেকে আত্মগোপনে আছেন। অনেকে পালিয়ে গেছেন। এই পরিস্থিতিতে আপনি কি মনে করেন আওয়ামী লীগ আবার ঘুরে দাঁড়াবে? ঘুরে দাঁড়ালে সেটা কতদিন লাগতে পারে?
সোহেল তাজ: আমি আশ্চর্য হয়েছি এই যে. আত্মোপলব্ধি, আত্মসমালোচনা, অনুশোচনা, এটা দেখছি না আওয়ামী লীগের ভেতর। এটা আমাকে খুব হতাশ করেছে। আমি মনে করি এখনো আওয়ামী লীগের ভেতরে ভালো মানুষ আছে।
খবরের কাগজ: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে। এই সরকারের কাছ থেকে আপনি কী আশা করছেন?
সোহেল তাজ: নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক একটা সমাজ- এটাই তারা চাচ্ছে। এটাও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল। এটা আমারও স্বপ্ন ছিল।
খবরের কাগজ: তার অর্থ আপনি আশাবাদী?
সোহেল তাজ: আমি আশাবাদী। কিন্তু কাজ করতে হবে। আমি জাস্ট ওয়ার্নিং দিয়ে রাখি, যারা হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে তারা প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই না এই আন্দোলনটা বৃথা যাক।
খবরের কাগজ: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
সোহেল তাজ: আপনাকেও ধন্যবাদ।