বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে আমরা অনেক কিছুই নতুন করে ভাবার চেষ্টা করছি। এ জন্য অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, পররাষ্ট্রনীতিতেও নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতির আমূল পরিবর্তন করতে হবে, এমনটা ভাবা সমীচীন নয়। জাতীয় প্রয়োজনে, জাতীয় স্বার্থের সাধারণত পরিবর্তন হয়। প্রায়ই দেখা যায়, রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কূটনীতিতেও বড় রকমের পরিবর্তন হয়। এটা সঠিক নয়। আমাদের রাজনৈতিক একটা পরিবর্তন হয়েছে। তাই বলে পররাষ্ট্রনীতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে, এমনটি নয়। অনেকেই মনে করেন, আগে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ভারতের ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল ছিল।
আমরা চেষ্টা করব তা কমাতে এবং সে ধরনের চিন্তাভাবনা হচ্ছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত আমাদের চারপাশ বেষ্টিত করে আছে। আমাদের পরস্পর নির্ভরশীলতা, তা পরস্পরের নিরাপত্তার জন্য। অন্যান্য ক্ষেত্র, যেমন- সামাজিক উন্নয়নে নির্ভরতা, সেটা কখনো কমে যাবে না। এ অবস্থার মধ্যেও চীনের সঙ্গে আমাদের গভীর সম্পর্ক। তার কারণ হলো আর্থসামাজিক উন্নয়ন অর্থাৎ আমাদের যে প্রয়োজনগুলো আছে, তা পূরণে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমরা ভূমিকা রাখছি। যদিও আমাদের মতামত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মেলে না। তার পরও তারা আমাদের বিভিন্ন জায়গায়, যেমন- মানবাধিকার অথবা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, উন্নয়ন, এসডিজি- সব ক্ষেত্রেই আমাদের অবস্থানগুলো প্রায়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে যায়। তার পরও তারা আমাদের গুরুত্ব দেয় বা তারা আমাদের কাজ করতে বাধা দেয় না। ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমরা বড় ধরনের সক্রিয়তা দেখাতে, একই সঙ্গে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হই। যেটা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক।
পৃথিবীতে বড় ধরনের যেসব সংলাপ চলছে, সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়। আমাদের নিরাপত্তা, আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের ভূমিকা- এই তিনটি বিষয়ে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া জাপান, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া- সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এখন আপেক্ষিক গুরুত্বের কথা যদি বলি- কোন দেশ কোন বিষয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা মাথায় রাখতে হবে।
ভারতের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্কটা ছিল, এখন সেখানে কিছুটা টানাপোড়েন চলছে। আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা বা ভারসাম্য বজায় রাখার ইঙ্গিত দিয়ে আসছেন। ভারতের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আমাদের ক্ষোভ আছে। তার পরও ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং বিশেষ করে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা দুজনের মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি, তারা দুজনই সঠিক জায়গায় আছেন। ভারতের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক থাকতে হবে এবং সেটার জন্য কাজ করতে হবে। অন্যদিকে ভারতকেও আমাদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। ভারতের যারা পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করেন, তারা দুই দেশের সম্পর্ককে ভালোভাবে রক্ষা করায় আগ্রহী। সুতরাং মূল বিষয়টিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না।
আমাদের অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। ডলারসংকট চলছে। বাজেট বাস্তবায়ন করতে অসুবিধা হচ্ছে। আমাদের আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন আছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা নিজেরা সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারে এবং গুরুত্বপূর্ণ যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, যেমন- বিশ্বব্যাংক, আইএসএফ, এদেরও অনুপ্রাণিত করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আগে যা প্রত্যাশা করিনি, এখন আমরা তা করতে পারি। এটা ইতিবাচক দিক।
যুক্তরাষ্ট্র আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিন ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে; ভারতীয়রাও ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় নানান কারণে। তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের যে স্তর তা আমাদের স্তরের চেয়ে অনেক আলাদা। আমাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য তারা যা দিতে পারে, সেটা গ্রহণ করা অনেক ক্ষেত্রেই ঠিক হবে না। কারণ তারা যা দিতে চায় তার বিনিময় হিসাব অনেক বেশি, যা আমাদের পক্ষে বহন করা কঠিন। আমরা আর্থিক সাহায্য চাইতে পারি। তবে তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু নিয়ে ব্যবহার করা আমাদের জন্য খুব সহজ নয়। সেখানে আমাদের বড় রকমের পরিবর্তন আসবে না। সে জন্য চীনের সঙ্গে আমাদের যে অবস্থানটা ছিল, অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনেও সেখানে তেমন কোনো টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়নি।
আমরা যে ভূরাজনীতির কথা বলি, সেই কারণে কিছুটা দায় সৃষ্টি হতে পারে বা টানাপোড়েনও হতে পারে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চীনের থেকে যে জিনিসপত্র কিনি, তার বদলে চীন আমাদের কাছ থেকে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ আদায় করে না। তারা কোনো চাপ দেয় না। কোনো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সারা পৃথিবীতে তারা এভাবেই কাজ করে থাকে। একসময় তারা বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করত, তখন তারা কমিউনিজমকে বাইরে রপ্তানি করার চেষ্টা করত। এখন তারা এসব করে না। তারা কোনো দেশেরই অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা থেকে সাধারণত বিরত থাকে। ফলে বিভিন্ন সহযোগিতায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আমাদের দেশের সঙ্গেও তাই করে। এ জন্য তাদের সঙ্গে আমাদের তেমন টানাপোড়েন সৃষ্টি হবে না।
আমাদের যদি বেশি মূল্য দিতে হয়, তাহলে আমাদের সরে আসা উচিত। কারণ স্বাভাবিকভাবে আমাদের অর্থসংকট আছে। ইচ্ছা করলেই যেকোনো জিনিস কিনতে পারি না। সে জন্য আমাদের সতর্কতার মধ্যে থাকতে হবে। আমাদের তিন দেশের সঙ্গে যে সম্পর্ক, ঘুরেফিরে সেখানেই থাকবে। এখন সাময়িকভাবে কিছুটা সমস্যা সৃষ্টি হলেও হতে পারে- যা স্বাভাবিক। আমরা যদি জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করি, এখানে কয়েকটি কথা খেয়াল করার দরকার আছে- আমাদের জাতিস্বার্থের প্রথম কথা ‘নিরাপত্তা’। নিরাপত্তার বিষয়ে যদিও ভারতের সঙ্গে কিছুটা টানাপোড়েন চলছে, তবু এমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না যে, আমাদের ভৌগোলিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে। আন্তর্জাতিক আইনকানুন যে রকম আছে, আমরা অনেক নিরাপদ বোধ করি। বিভিন্ন রকম সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু টানাপোড়েন সৃষ্টি হতে পারে। তার পরও আমরা শঙ্কাগ্রস্ত নই। আগে থেকেই আমরা আর্থসামাজিক উন্নয়নের ওপর জোর দিতে পারি। সে ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন হবে না।
বর্তমানে আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। প্রথম কাজ হলো অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তারা বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা। আমরা যদি দীর্ঘমেয়াদি অবস্থায় এগিয়ে যেতে পারি, তাহলে আমাদের সমস্যা তেমন থাকবে না। এখন আমরা আগের মতোই আর্থসামাজিক উন্নয়নের যে লক্ষ্যটি আছে তার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে পারব। সেই কারণে চীনের সঙ্গে সম্পর্কটা গুরুত্ব বেশি পায়। তার মানে এই নয় যে, ভারতের সঙ্গে গুরুত্ব কমে যাবে। তবে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা বৃদ্ধি করা জরুরি। ভারতের সঙ্গে আমাদের যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে, যেমন- টেকনোলজি ও খাদ্যপণ্য, সেগুলোও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। চীনের পরই ভারতের অবস্থান। যদিও চীন অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের সহায়ক শক্তি। তারাও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তারাই আমাদের রপ্তানির প্রধান গন্তব্য। আমরা যা কিছু উৎপাদন করি, বিশেষ করে মূল রপ্তানি দ্রব্য তৈরি পোশাক, যার বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে ইউরোপের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যাদের সক্ষমতা আছে, বিশেষ করে যে দেশগুলো থেকে সাহায্যের প্রয়োজন, সেখানেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরাট ভূমিকা আছে। মনে রাখতে হবে, একেক দেশ একেক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বর্তমান নেতা যারা আছেন, যারা দেশ চালাচ্ছেন, তারা অনেক বোঝেন। আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ। বাংলাদেশ অনেক দেশের তুলনায় কম শক্তিধর দেশ। সে জন্য সম্ভাবনার পাশাপাশি বিপদের আশঙ্কাও বেশি। ফলে ভুল করলে মাশুল দিতে হতে পারে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। সে জন্য আমরা যেন অতীতের ভুলগুলো এড়িয়ে চলতে পারি, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।
লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত