ঢাকা ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪
English

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এবং আমাদের জাতীয় স্বার্থ

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৬ এএম
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এবং আমাদের জাতীয় স্বার্থ
মুন্সী ফয়েজ আহমদ

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে আমরা অনেক কিছুই নতুন করে ভাবার চেষ্টা করছি। এ জন্য অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, পররাষ্ট্রনীতিতেও নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতির আমূল পরিবর্তন করতে হবে, এমনটা ভাবা সমীচীন নয়। জাতীয় প্রয়োজনে, জাতীয় স্বার্থের সাধারণত পরিবর্তন হয়। প্রায়ই দেখা যায়, রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কূটনীতিতেও বড় রকমের পরিবর্তন হয়। এটা সঠিক নয়। আমাদের রাজনৈতিক একটা পরিবর্তন হয়েছে। তাই বলে পররাষ্ট্রনীতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে, এমনটি নয়। অনেকেই মনে করেন, আগে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ভারতের ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল ছিল।

 আমরা চেষ্টা করব তা কমাতে এবং সে ধরনের চিন্তাভাবনা হচ্ছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত আমাদের চারপাশ বেষ্টিত করে আছে। আমাদের পরস্পর নির্ভরশীলতা, তা পরস্পরের নিরাপত্তার জন্য। অন্যান্য ক্ষেত্র, যেমন- সামাজিক উন্নয়নে নির্ভরতা, সেটা কখনো কমে যাবে না। এ অবস্থার মধ্যেও চীনের সঙ্গে আমাদের গভীর সম্পর্ক। তার কারণ হলো আর্থসামাজিক উন্নয়ন অর্থাৎ আমাদের যে প্রয়োজনগুলো আছে, তা পূরণে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমরা ভূমিকা রাখছি। যদিও আমাদের মতামত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মেলে না। তার পরও তারা আমাদের বিভিন্ন জায়গায়, যেমন- মানবাধিকার অথবা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, উন্নয়ন, এসডিজি- সব ক্ষেত্রেই আমাদের অবস্থানগুলো প্রায়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে যায়। তার পরও তারা আমাদের গুরুত্ব দেয় বা তারা আমাদের কাজ করতে বাধা দেয় না। ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমরা বড় ধরনের সক্রিয়তা দেখাতে, একই সঙ্গে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হই। যেটা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক।

 পৃথিবীতে বড় ধরনের যেসব সংলাপ চলছে, সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়। আমাদের নিরাপত্তা, আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের ভূমিকা- এই তিনটি বিষয়ে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া জাপান, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া- সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এখন আপেক্ষিক গুরুত্বের কথা যদি বলি- কোন দেশ কোন বিষয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা মাথায় রাখতে হবে।

 ভারতের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্কটা ছিল, এখন সেখানে কিছুটা টানাপোড়েন চলছে। আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা বা ভারসাম্য বজায় রাখার ইঙ্গিত দিয়ে আসছেন। ভারতের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আমাদের ক্ষোভ আছে। তার পরও ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং বিশেষ করে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা দুজনের মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি, তারা দুজনই সঠিক জায়গায় আছেন। ভারতের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক থাকতে হবে এবং সেটার জন্য কাজ করতে হবে। অন্যদিকে ভারতকেও আমাদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। ভারতের যারা পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করেন, তারা দুই দেশের সম্পর্ককে ভালোভাবে রক্ষা করায় আগ্রহী। সুতরাং মূল বিষয়টিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। 

আমাদের অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। ডলারসংকট চলছে। বাজেট বাস্তবায়ন করতে অসুবিধা হচ্ছে। আমাদের আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন আছে। সেখানে  যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা নিজেরা সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারে এবং গুরুত্বপূর্ণ যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, যেমন- বিশ্বব্যাংক, আইএসএফ, এদেরও অনুপ্রাণিত করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আগে যা প্রত্যাশা করিনি, এখন আমরা তা করতে পারি। এটা ইতিবাচক দিক।

 যুক্তরাষ্ট্র আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিন ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে; ভারতীয়রাও ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় নানান কারণে। তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের যে স্তর তা আমাদের স্তরের চেয়ে অনেক আলাদা। আমাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য তারা যা দিতে পারে, সেটা গ্রহণ করা অনেক ক্ষেত্রেই ঠিক হবে না। কারণ তারা যা দিতে চায় তার বিনিময় হিসাব অনেক বেশি, যা আমাদের পক্ষে বহন করা কঠিন। আমরা আর্থিক সাহায্য চাইতে পারি। তবে তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু নিয়ে ব্যবহার করা আমাদের জন্য খুব সহজ নয়। সেখানে আমাদের বড় রকমের পরিবর্তন আসবে না। সে জন্য চীনের সঙ্গে আমাদের যে অবস্থানটা ছিল, অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনেও সেখানে তেমন কোনো টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়নি। 

আমরা যে ভূরাজনীতির কথা বলি, সেই কারণে কিছুটা দায় সৃষ্টি হতে পারে বা টানাপোড়েনও হতে পারে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চীনের থেকে যে জিনিসপত্র কিনি, তার বদলে চীন আমাদের কাছ থেকে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ আদায় করে না। তারা কোনো চাপ দেয় না। কোনো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সারা পৃথিবীতে তারা এভাবেই কাজ করে থাকে। একসময় তারা বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করত, তখন তারা কমিউনিজমকে বাইরে রপ্তানি করার চেষ্টা করত। এখন তারা এসব করে না। তারা কোনো দেশেরই অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা থেকে সাধারণত বিরত থাকে। ফলে বিভিন্ন সহযোগিতায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আমাদের দেশের সঙ্গেও তাই করে। এ জন্য তাদের সঙ্গে আমাদের তেমন টানাপোড়েন সৃষ্টি হবে না। 

আমাদের যদি বেশি মূল্য দিতে হয়, তাহলে আমাদের সরে আসা উচিত। কারণ স্বাভাবিকভাবে আমাদের অর্থসংকট আছে। ইচ্ছা করলেই যেকোনো জিনিস কিনতে পারি না। সে জন্য আমাদের সতর্কতার মধ্যে থাকতে হবে। আমাদের তিন দেশের সঙ্গে যে সম্পর্ক, ঘুরেফিরে সেখানেই থাকবে। এখন সাময়িকভাবে কিছুটা সমস্যা সৃষ্টি হলেও হতে পারে- যা স্বাভাবিক। আমরা যদি জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করি, এখানে কয়েকটি কথা খেয়াল করার দরকার আছে- আমাদের জাতিস্বার্থের প্রথম কথা ‘নিরাপত্তা’। নিরাপত্তার বিষয়ে যদিও ভারতের সঙ্গে কিছুটা টানাপোড়েন চলছে, তবু এমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না যে, আমাদের ভৌগোলিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে। আন্তর্জাতিক আইনকানুন যে রকম আছে, আমরা অনেক নিরাপদ বোধ করি। বিভিন্ন রকম সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু টানাপোড়েন সৃষ্টি হতে পারে। তার পরও আমরা শঙ্কাগ্রস্ত নই। আগে থেকেই আমরা আর্থসামাজিক উন্নয়নের ওপর জোর দিতে পারি। সে ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন হবে না।

বর্তমানে আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। প্রথম কাজ হলো অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তারা বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা। আমরা যদি দীর্ঘমেয়াদি অবস্থায় এগিয়ে যেতে পারি, তাহলে আমাদের সমস্যা তেমন থাকবে না। এখন আমরা আগের মতোই আর্থসামাজিক উন্নয়নের যে লক্ষ্যটি আছে তার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে পারব। সেই কারণে চীনের সঙ্গে সম্পর্কটা গুরুত্ব বেশি পায়। তার মানে এই নয় যে, ভারতের সঙ্গে গুরুত্ব কমে যাবে। তবে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা বৃদ্ধি করা জরুরি। ভারতের সঙ্গে আমাদের যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে, যেমন- টেকনোলজি ও খাদ্যপণ্য, সেগুলোও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। চীনের পরই ভারতের অবস্থান। যদিও চীন অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের সহায়ক শক্তি। তারাও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তারাই আমাদের রপ্তানির প্রধান গন্তব্য। আমরা যা কিছু উৎপাদন করি, বিশেষ করে মূল রপ্তানি দ্রব্য তৈরি পোশাক, যার বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে ইউরোপের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। 

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যাদের সক্ষমতা আছে, বিশেষ করে যে দেশগুলো থেকে সাহায্যের প্রয়োজন, সেখানেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরাট ভূমিকা আছে। মনে রাখতে হবে, একেক দেশ একেক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বর্তমান নেতা যারা আছেন, যারা দেশ চালাচ্ছেন, তারা অনেক বোঝেন। আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ। বাংলাদেশ অনেক দেশের তুলনায় কম শক্তিধর দেশ। সে জন্য সম্ভাবনার পাশাপাশি বিপদের আশঙ্কাও বেশি। ফলে ভুল করলে মাশুল দিতে হতে পারে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। সে জন্য আমরা যেন অতীতের ভুলগুলো এড়িয়ে চলতে পারি, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। 

লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত

বাশারের পতন: তুরস্ক, ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের বিজয়!

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:১৬ পিএম
বাশারের পতন: তুরস্ক, ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের বিজয়!
শ্লোমো বেন-অমি

সিরিয়ার আল-আসাদ রাজবংশের ৫৪ বছর পর পতন মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে বদলে দিয়েছে। ইসলামপন্থি হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) মিলিশিয়ার অতর্কিত আক্রমণ সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশ ও অন্য সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ রাশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার খবর আরেকটি যুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। সেই যুদ্ধ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। 

৭ অক্টোবর ২০২৩, গাজা সীমান্তবর্তী এলাকায় ইসরায়েলের বেসামরিক নাগরিকের ওপর হামাস যে হামলা চালিয়েছিল, তা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ভূমিকম্পের মতো ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। গাজায় হামাসকে নির্মূল করতে ইসরায়েল নির্মমভাবে আক্রমণ করে। ইসরায়েল লেবাননে হিজবুল্লাহর ওপর আক্রমণ করে মূলত ইরানের ‘প্রতিরোধের অক্ষ’কে ধ্বংস করেছে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য আন্তর্জাতিক শিপিংয়ে হুতি হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুতিদের ওপর আক্রমণ করে। 

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে, যখন আসাদ সরকার শান্তিপূর্ণ ‘আরব বসন্ত’ বিক্ষোভকে চূর্ণ করেছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের পর যুদ্ধটি অনেকাংশে কমে যায়, যখন রাশিয়া হস্তক্ষেপ করে। ইরান এবং হিজবুল্লাহর সহায়তায় সেই যুদ্ধটি আসাদের পক্ষে চলে যায়। ইরানের প্রক্সি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এবং ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার যুদ্ধের ক্ষমতা কিছুটা হ্রাস পাওয়ায় বিদ্রোহীরা সুযোগ নিয়েছে। তুরস্কের সহায়তায় বিদ্রোহীরা সহজেই বাশার সরকারের দুর্বল প্রতিরক্ষাকে পরাস্ত্র করে ফেলে। বাশার আল-আসাদের সেনাবাহিনী যুদ্ধ ছাড়াই আত্মসমর্পণ করে। ইরান ও রাশিয়ার পৃষ্ঠপোষকরা দ্রুত তাদের বাহিনী সরিয়ে নেয় এবং তাকে তার ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। 

সিরিয়ার সঙ্গে ইরানের জোট আরব বিশ্বে প্রধান শক্ত ঘাঁটি ছিল এবং এর অবসান আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যকে নতুন রূপ দেবে। মোহাম্মদ আলী আবতাহি, যিনি ছিলেন ইরানের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি বাশার পালানোর দুই দিন আগে বলেছিলেন, সিরিয়া সরকারের পতন মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি হবে। 

ইসরায়েল প্রভাবশালী শক্তি হয়ে উঠবে। হায়াত তাহরির আল-শাম নামটি আরবের দেশগুলোর দ্বীপ অঞ্চলসহ ভূমধ্যসাগরের পূর্ব অংশের মুক্তির জন্য দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এইচটিএস নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি নতুন ধরনের ইসলামপন্থি ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর ব্যর্থতা থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করেছেন বলে মনে হয়। এখন তিনি নিজেকে একজন বাস্তববাদী হিসেবে দেখেন, যিনি শুধু সিরিয়ার নিপীড়নমূলক শাসন থেকে মুক্তি আনতে চান।
 
তার এই নতুন বাস্তববাদের লক্ষণ হলো সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ গাজী আল-জালালিকে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর না করা পর্যন্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অনুমতি দেওয়ার জন্য জোলানিকে তার লোকদের নির্দেশ করতে হবে। আইএস সৈন্য ও কর্মকর্তাদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালাত। তার পরও আল-জোলানি একটি কট্টর ইসলামপন্থি সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তুরস্ক এইচটিএস-এর চরমপন্থাকে প্ররোচিত করতে পারে। অনেকে ধারণা করছেন, জোলানি তুরস্কের একজন অনুগত সৈনিক হতে পারেন। যাই হোক না কেন, আল-জোলানি শক্তিশালী রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হচ্ছেন। 

তাকে অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বী মিলিশিয়াদের সঙ্গে তুলনা করতে হবে, যারা বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য একত্রিত হয়েছিল। উত্তরে তুর্কি বাহিনীর আক্রমণের সময় পূর্ব সিরিয়ার আরও কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ নিতে ছুটে আসা কুর্দি বাহিনীকেও প্রতিরোধ করেছিল। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের কাছে সিরিয়ার কুর্দিরা তুরস্কের কুর্দিদের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহকে উৎসাহিত করার হুমকি দেয়।
২০১৯ সালে এরদোয়ান উত্তর সিরিয়ায় ৩০ কিলোমিটারজুড়ে একটি ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কুর্দি যোদ্ধাদের তুর্কি সীমান্ত থেকে দূরে ঠেলে দেওয়ার জন্য তিনি সেনাবাহিনী নিযুক্ত করেছিলেন। এমন এলাকা যেখানে কুর্দিরা একটি স্বায়ত্তশাসিত ছিটমহলকে নিজের দখলে নিয়ে গৃহযুদ্ধের জন্য সুযোগ খুঁজছিলেন। 

কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসন টিকে রাখার আকাঙ্ক্ষা এবং সীমান্ত এলাকা থেকে তাদের দূরে রাখার জন্য তুরস্কের মধ্যে সমঝোতা খুঁজে পেতে জোলানিকে এখন কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। এরদোয়ান কি কুর্দি আঞ্চলিক ক্ষমতা সহ্য করবেন, যা তিনি তুরস্কের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করেন? জোলানি কি তুরস্ককে কুর্দিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি দেবেন? যখন তিনি তাদের সঙ্গে শাসক জোট গঠন করার চেষ্টা করছেন এবং সিরিয়ার আঞ্চলিক সার্বভৌমত্বকে সমর্থন করতে যাচ্ছেন। সিরিয়ার কুর্দিদের সঙ্গে তার দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত সত্ত্বেও এরদোয়ান বাশারের পতনকে দুর্দান্ত অর্জন হিসেবে দেখেন। বিদ্রোহী বাহিনীর অগ্রযাত্রা অনুসরণ করে তিনি আনন্দিত হয়েছিলেন। সিরিয়ার এই অগ্রযাত্রা কোনো ঘটনা ছাড়াই চলতে থাকে। 

বছরের পর বছর এরদোয়ান এবং তার কাতার মিত্ররা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইসলামপন্থি দলগুলোকে সমর্থন করে আসছে। তিনি নিজেকে ইরানিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দেখেছিলেন যে, মুসলিম ভূমিতে ইসলামি গণতন্ত্রের কোন মডেলটি প্রাধান্য পাবে: শিয়া মৌলবাদী বা তুরস্কের মধ্যপন্থি কোনো রূপ। এখন তিনি বিশ্বাস করেন, তিনি দেশের সন্নিকটেই এমন একটি মডেলকে রূপ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। 

যদিও সিরিয়ার বিদ্রোহীদের এমন সাফল্যের পেছনে ইসরায়েলের হাত রয়েছে। সে জন্য ইসরায়েলকে ধন্যবাদ দেওয়ার অনেক কিছু রয়েছে। ইসরায়েল তার নতুন প্রতিবেশীদের সম্পর্কে কোনো ভুল ধারণা পোষণ করে না। আল-জোলানি সিরিয়ার গোলান মালভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন (তাই নাম জোলানি), ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ওই অঞ্চল দখল করেছিল। যার সংযুক্তি ও সার্বভৌমত্ব ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। 

দামেস্কে বিদ্রোহী অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েল সিরিয়ার সীমান্তে যুদ্ধ ইউনিট মোতায়েন করে। গোলান মালভূমিতে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ছড়িয়ে পড়া এবং সীমান্তে সিরিয়ার পাশের দ্রুজ এলাকায় আক্রমণ করা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল ইসরায়েল। ৭ অক্টোবরের রোমহর্ষক ঘটনা এখনো ইসরায়েলের মনে গেঁথে আছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ক্ষোভকে অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের অত্যাচারের পতন যদি ঘটতে পারে, কেন ইরানকেও পতনের চেষ্টা করা হবে না? নেতানিয়াহু প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপের বাইরে চলে যাওয়ার প্রলোভন রয়েছে। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, ১৯৭৪ সালের চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল ও সিরিয়ার মধ্যে যে বাহিনী বিচ্ছিন্নকরণ নিয়ন্ত্রিত ছিল তা ভেঙে গেছে। তিনি ইসরায়েলি সৈন্যদের হারমন পর্বতের সিরিয়ার অংশের নিয়ন্ত্রণ দখল করতে নির্দেশ দেন। সিরিয়ার সার্বভৌম ভূখণ্ডের বাফার জোন এবং এর আশপাশে প্রভাবশালী অবস্থান নেয়। 

এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্ররাও একইভাবে উদ্বিগ্ন। তারাও বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতায় থাকাটা পছন্দ করত, এই ভয়ে যে ইসলামপন্থি নিয়ন্ত্রিত সিরিয়া সন্ত্রাসবাদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠতে পারে। তাদের দৃষ্টিতে বাশার আল-আসাদ ইসলামপন্থি বিদ্রোহী নেতৃত্বাধীন সরকারের চেয়ে ভালো, যদিও এটি মধ্যপন্থি বলে দাবি করে।

বাশার আল-আসাদের পতন ঘটেছে। মধ্যপ্রাচ্য আবার নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যর পুনরুদ্ধারে সবার এগিয়ে আসা উচিত।

লেখক: ইসরায়েলের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:০৭ পিএম
খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি
সৈয়দ ফারুক হোসেন

দেশের ২ কোটি ৩৬ লাখ বা ২৬ শতাংশ মানুষ উচ্চমাত্রার খাদ্যসংকটে ভুগছেন। সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কাজনক এ চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত খাদ্যসংকটে থাকা মানুষগুলো তীব্র খাদ্য নিরাপত্তহীনতায় ভুগতে পারেন। তাদের মধ্যে মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ৩ লাখ রোহিঙ্গাও রয়েছে। এ অবস্থায় তীব্র খাদ্যসংকটে থাকা ১৬ লাখ মানুষের জন্য জরুরি খাদ্যসহায়তা প্রয়োজন।

 জাতিসংঘসহ বাংলাদেশে কাজ করা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর যৌথভাবে পরিচালিত ‘সমন্বিত খাদ্যনিরাপত্তার পর্যায় চিহ্নিতকরণ’ শীর্ষক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ৭ নভেম্বর প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। ২০ বছর ধরে এই জরিপ করা হচ্ছে। বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশে দুই বছর ধরে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে দেশের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষের ভৌগোলিক অবস্থানও চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব মানুষের বেশির ভাগ বাস করেন চট্টগ্রাম, রংপুর, খুলনা ও সিলেট বিভাগে। দেশের ৪০টি এলাকায় খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, ৩৩টি এলাকার মানুষ সংকটজনক অবস্থায় রয়েছেন। জরিপে দেখা গেছে, ১৬ লাখ ৪৭ হাজার মানুষের জরুরি খাদ্যসহায়তা দরকার। খাদ্য নিয়ে সংকটময় অবস্থায় আছেন ২ কোটি ১৯ লাখ ৩৩ হাজার মানুষ। আর ৩ কোটি ৩৪ লাখ ১১ হাজার মানুষ চাপে আছেন। শুধু ৩ কোটি ৩৯ লাখ মানুষ পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছেন।

দেশে খাদ্যপণ্যের দাম ও কৃষি-উপকরণের বিষয়টিকে বর্তমান সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। সরকার পণ্য সরবরাহ ও খাদ্য বণ্টনব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে না পারলে সামনের দিনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। বন্যা ও অন্যান্য দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার কৃষকদের জন্য খাদ্যসহায়তার পাশাপাশি আসন্ন বোরো-রবি মৌসুমে বিনামূল্যে কৃষি-উপকরণ সহায়তা দেওয়া দরকার। শুধু রিজার্ভের উন্নতি হলেই অর্থনীতির গতি ফিরে আসবে না। দেশের খাদ্যপণ্য সরবরাহব্যবস্থায় দ্রুত পরিবর্তনের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের দিয়ে ওই ঘাটতি পূরণের উদ্যোগ নিতে হবে।

 বাংলাদেশে গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সব ধরনের সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। বিশেষ করে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে। ওই অভ্যুত্থানের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নিয়েছে। অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে। নানা কারণে খাদ্যপণ্যের দাম তুলনামূলক বেশি বেড়েছে। ফলে সরকারকে সারা দেশে ন্যায্যমূল্যে খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এদিকে ২০২৪ সালের শুরুতে দেশের মানুষের আয় কমে গেছে এবং ব্যয় বেড়ে গেছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও সংঘাতের কারণে ওই সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে। আমদানি-রপ্তানি ও বাণিজ্য ব্যাহত হয়েছে। ফলে খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হয়েছে।

চলতি বছরের বন্যা ও খরার মতো দুর্যোগে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাদের বড় অংশই কৃষিজীবী। এদের আবার এক-চতুর্থাংশ কৃষি-মজুর। বন্যা, দুর্যোগ ও তাপপ্রবাহের কারণে তারা ঠিকমতো কাজ পাননি। কাজ পেলেও মজুরি পেয়েছেন কম। এই জনগোষ্ঠীর বড় অংশ শুধু কৃষি মজুরি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদের দৈনিক আয়ের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ খাদ্যের পেছনে ব্যয় হয়। ফলে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের খাদ্য গ্রহণ কমাতে হচ্ছে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যার কারণে ফসল, গবাদিপশু, মৎস্যসম্পদ এবং মজুত খাদ্যের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে।

 এতে খাদ্য উৎপাদন কমতে পারে এবং গৃহস্থের আয় কমে আসতে পারে। মহামারির প্রায় তিনটি বছর অতিবাহিত হলো! এরপর যুক্ত হলো ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাত। এ সংঘাতের কারণে এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বজুড়ে ৩ বিলিয়ন মানুষ এখনো স্বাস্থ্যকর খাবারের সামর্থ্য রাখে না। তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষির ওপর নির্ভর করে। এমতাবস্থায় একটি টেকসই বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য আমাদের সংহতি এবং সম্মিলিত পদক্ষেপের শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে, এমনটি মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যেখানে প্রত্যেকেরই পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারের নিয়মিত নিশ্চয়তা থাকবে। বাংলাদেশে ক্ষুধার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের জন্য সবচেয়ে কার্যকর ও অন্যতম বড় উদ্যোগ বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে কাজ করছে বর্তমান সরকার। কৃষি ও খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সরকারের কার্যকর উদ্যোগের মাধ্যমেই এই খাদ্যসংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। ২০৩০ সালে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ১৩ লাখ মানুষ ক্ষুধার ঝুঁকিতে থাকবে। 

বিশ্ব খাদ্যনিরাপত্তার মূল উদ্দেশ্য হলো ক্ষুধা, অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা, কৃষির উন্নতিতে মনোযোগ দেওয়া, কৃষিভিত্তিক উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়া, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা গ্রহণে উৎসাহ দান, গ্রামীণ জনগণ বিশেষ করে নারী ও পিছিয়ে পড়া মানুষের অবদানে উৎসাহ এবং প্রযুক্তির সমৃদ্ধিকে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। কৃষিকে কেন্দ্র করে বিশ্বের মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগান, দরিদ্র ও পুষ্টিহীনতা দূর করে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার নিতে হবে সবাইকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক সংকটে বেশি নিপতিত হয় পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী। একটি ভালো ভবিষ্যতের আশায় সবার জন্য খাদ্যনিরাপত্তা, শান্তি ও সমতাকে অগ্রাধিকার দিতে সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি খাত, একাডেমিয়া এবং সুশীল সমাজকে একত্রে কাজ করা দরকার।

খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় কাউকে পিছিয়ে না রাখার হাতিয়ার হিসেবে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে এগোতে হবে। তাদের আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে ফসলের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির দিকে বিশেষ মনোনিবেশ দরকার। কৃষিপ্রযুক্তি গ্রহণে কোন শ্রেণির কৃষক পেছনে আছে তা চিহ্নিত করে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ দরকার। এ ছাড়া সুবিধাভোগী শ্রেণি ব্যবধান কমাতে নীতিগুলো ডিজাইন করা, আসন্ন বৈশ্বিকসংকট ও খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি বিষয়ে প্রান্তিক কৃষকসহ সব সম্প্রদায়কে সতর্ক করা, প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক করা খুবই প্রয়োজন।

 অপরদিকে বিনিয়োগনীতিগুলোকে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে উপযোগী করে গড়ে তোলার পাশাপাশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করা, কৃষি-খাদ্যব্যবস্থায় সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; প্রান্তিক কৃষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান অত্যাবশ্যকীয়। টেকসইভাবে উৎপাদিত খাবার সরবরাহ করতে খাদ্যশৃঙ্খল ঠিক রাখা; খাদ্যের ক্ষয়ক্ষতি ও অপচয় রোধ করতে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও টেকসই প্যাকেজিং-ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে হবে। দরিদ্র এবং দুর্বল কৃষি পরিবারকে ফসল উৎপাদন করতে উন্নত বীজ, রোপণের উপকরণ, সার, বাগান করার সরঞ্জামসহ প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ চলমান রাখা; টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনার আলোকে কৃষক এবং পরিবেশের জন্য সবচেয়ে স্মার্ট সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন।

 পিছিয়ে পড়া কৃষক পরিবার যাতে ফসল ফলিয়ে আয় বাড়িয়ে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে পারে এবং কৃষক ব্যয়বহুল রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করে অর্থ সাশ্রয় করতে পারে, সে জন্য উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার। পিছিয়ে পড়া কৃষকদের বসতবাড়ির আঙিনায় বা তাদের ক্ষুদ্র জমিতে প্রদর্শনী প্লট স্থাপনে সহযোগিতা করা দরকার। বিভিন্ন শাকসবজি ও ফলের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার চালানো; চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল হিসেবে জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহারের সুফল পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারলে জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে দেশে একটি সহনশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই কৃষি-খাদ্যব্যবস্থার রূপান্তর ঘটাতে পারলে আগামীতে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে।

লেখক: সাবেক রেজিস্ট্রার, বিএসএফএমএসটিইউ
[email protected]

জবাবদিহির ব্যবস্থা করতে হবে

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:২২ পিএম
জবাবদিহির ব্যবস্থা করতে হবে
এ বি এম নাজমুস সাকিব

আয়নাঘর বা গোপন বন্দিশালার অস্তিত্ব থাকার বিষয়ে প্রথমবারের মতো কোনো বাহিনীপ্রধানের (র‌্যাব মহাপরিচালক) স্বীকার করার বিষয়টি প্রশংসা (‘অ্যাপ্রিশিয়েট’) করার মতো। আগে তো বাহিনীগুলোর দায়মুক্তি ও ভিন্ন যুক্তিগুলো ছিল খুবই অগ্রহণযোগ্য। যেমন- ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা বা ক্রসফায়ার নিয়ে র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য ছিল একই ধরনের। সেদিক থেকে গোপন বন্দিশালার অস্তিত্ব স্বীকার করার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার বিষয়গুলো ইতিবাচকভাবে মনে হচ্ছে।

কথিত আয়নাঘর বা গোপন বন্দিশালায় কাউকে আটকে রাখা বা গুম করার মতো বিষয়গুলো কোনো বাহিনীর কাঠামোতে থাকতে পারে না। এটা ছিলও না। রাজনৈতিক কারণে বা বাহিনীর কারও ব্যক্তিস্বার্থে এজাতীয় কাজ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে একটি কঠোর বার্তা থাকা প্রয়োজন, সেটা হলো কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অপরাধ করলে সে যেই হোক, তার শাস্তি হবেই। এই বার্তা যদি সমাজে বা রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা পায়, তাহলে এজাতীয় বেআইনি কাজ অনেকটাই কমে যাবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইনের রক্ষক, তারা আইন লঙ্ঘন করলে কঠোর শাস্তির বিধান থাকতে হবে। জবাবদিহি ও স্বচ্ছতাই নির্ধারণ করবে আগামী দিনের আইনশৃঙ্খলার সামগ্রিক বিষয়টি।

সহকারী অধ্যাপক, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাবি

প্রতিরোধে স্থায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৩ পিএম
প্রতিরোধে স্থায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে
ড. তৌহিদুল হক

‘আয়নাঘর’ বা গোপন বন্দিশালা গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যবস্থা। একটি রাষ্ট্রের মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে বিনা মামলায়, বিনা বিচারে কাউকে গোপন বন্দিশালায় দীর্ঘদিন ধরে আটকে রাখার এই প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক মতবিরোধ বা কারও বিরুদ্ধে কথা বললেই তুলে নিয়ে গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখা, নির্যাতন করার ঘটনাগুলো কোনো সভ্য দেশে ঘটতে পারে না। এজাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে স্থায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

আয়নাঘর নিয়ে আমরা যা দেখলাম বা জানলাম, তাতে এ বিষয়ে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত হওয়া জরুরি। তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

ভবিষ্যতে কেউ যাতে এই ধরনের অপকর্ম ঘটানোর চিন্তাও না করে, সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা রাখা দরকার। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার যেমন স্বচ্ছতা লাগবে, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহি ও শুভচিন্তা থাকতে হবে। কেননা, রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গিয়ে বাহিনীর একশ্রেণির কর্মকর্তাদের নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে থাকে। 

ক্ষমতায় থাকলে সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা দেখা যায় না। ভিন্নমত বা সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কথা বললেই তাকে আটক, হয়রানি, গুম বা আয়নাঘরের মতো গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখার সংস্কৃতি থেকে দেশের নাগরিকদের স্থায়ী মুক্তি জরুরি। এ জন্য দায়িত্বশীলদের সমন্বিত ব্যবস্থা ও মানসিকতা ধারণ করতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে মানুষের স্বাভাবিক মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং সহযোগী অধ্যাপক, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাবি

এমন ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি চাই না

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১২ পিএম
আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৪ পিএম
এমন ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি চাই না
নূর খান লিটন

আমরা কাজ করতে গিয়ে গোপন কারাগার (আয়নাঘর) দেখেছি। দেখেছি গোপন সেল। একবার ভাবুন, সোয়া তিন ফুট জায়গার মধ্যে কাউকে বন্দি রাখা হয়েছে। সেখানে এক ফুট দূরত্বে পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা। বলতে গেলে, মাত্র তিন ফুট জায়গার মধ্যে একজন মানুষকে বন্দি রাখা হয় মাসের পর মাস, বছরে পর বছর। এটা কতটা পীড়াদায়ক, কতটা অমানবিক! এমন ঘটনার যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে বিষয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে গুম কমিশনে কাজ করার সুবাদে অনেক কিছু জানা গেছে। একজন মানুষ যখন গুম অবস্থায় ছিলেন, তখন তিনি জানতেন না কতদিন তিনি বন্দি থাকবেন। তাকে সেই দিন গণনা করতে হয়েছে সকালের নাশতা বা খিচুড়ির হিসাব কষে। বন্দিদের অনেকে হিসাব করার জন্য দেয়ালে প্রতিটি দিন একটি একটি করে আঁচড় বা চিহ্ন এঁকে রাখতেন। সেখানে গিয়ে আমরা দেখেছি কোনো কোনো দেয়ালে এ রকম আঁচড় বা দাগ। কোথাও ১৮০টি, কোথাও ২২৫টি- এ রকম বিভিন্ন সংখ্যা আমরা পেয়েছি। কেউ কেউ দেয়ালে মোবাইল নাম্বারও লিখেছেন। নানা কথাও লেখা ছিল। এসব আলামত থেকে আমরা গুমের শিকার হওয়া মানুষদের তথ্য জানার চেষ্টা করেছি।

গত ৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে আমরা যে পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছি, এটা ধরে রাখতে হবে। কোনোভাবেই ওই জাতীয় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ।

গুমসংক্রান্ত কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী

'), descriptionParas[2].nextSibling); } if (descriptionParas.length > 6 && bannerData[arrayKeyTwo] != null) { if (bannerData[arrayKeyTwo].type == 'image') { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertImageAd(bannerData[arrayKeyTwo].url, ('./uploads/ad/' + bannerData[arrayKeyTwo].file)), descriptionParas[5].nextSibling); } else { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertDfpCodeAd(bannerData[arrayKeyTwo].custom_code), descriptionParas[5].nextSibling); } } if (descriptionParas.length > 9 && bannerData[arrayKeyThree] != null) { if (bannerData[arrayKeyThree].type == 'image') { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertImageAd(bannerData[arrayKeyThree].url, ('./uploads/ad/' + bannerData[arrayKeyThree].file)), descriptionParas[8].nextSibling); } else { descriptionParas[0].parentNode.insertBefore(insertDfpCodeAd(bannerData[arrayKeyThree].custom_code), descriptionParas[8].nextSibling); } } });