ঢাকা ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪
English

ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় বিশ্বরাজনীতিতে নতুন চমক

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৫ পিএম
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় বিশ্বরাজনীতিতে নতুন চমক
রায়হান আহমেদ তপাদার

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জয়ের জন্য ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোটের দরকার হলেও তার অন্তত ২৭৯টি ভোট নিশ্চিত হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিসের পক্ষে ২২৩টি ভোট। সুতরাং সিনেটের নিয়ন্ত্রণ রিপাবলিকানদের হাতে যাচ্ছে এবারের নির্বাচনে। মার্কিন আইনসভার উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ- পূর্বাভাস বলছে উভয় ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে রিপাবলিকান পার্টি। তাই ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমেরিকা আমাদের একটি অভূতপূর্ব এবং শক্তিশালী ম্যান্ডেট দিয়েছে।’ বিজয়ের পর ভাষণকালে ইলন মাস্ককে তিনি ‘স্টার’ বলে অভিহিত করেছেন।

 ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কিছু ক্ষেত্রে বেশ নজর থাকবে। একটা হলো ইউক্রেন যুদ্ধ কীভাবে থামানো যায় এবং রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক কী দাঁড়ায়। ট্রাম্প নির্বাচনকালে অনেকবার বলেছেন, তিনি ক্ষমতায় থাকলে এ অবস্থা কোনোভাবে ঘটত না। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপের ওপর তার বিশেষ নজর থাকবে। কারণ, ইউরোপের কনজারভেটিভ পার্টিগুলো বিভিন্ন জায়গায় জিতে যাচ্ছে। তা ছাড়া অনেক দেশ যুদ্ধের ব্যাপারে নতুন করে চিন্তা করছে। সুতরাং ইউক্রেনের ব্যাপারে একটা নজর থাকবেই। দ্বিতীয় নজর থাকবে ফিলিস্তিনে, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। এখানে কোনো নতুনত্ব আনা যায় কি না, তা নিয়েও ট্রাম্প গুরুত্ব দেবেন। তবে এই মুহূর্তে বলা মুশকিল, সেখানে কোনো ধরনের পরিবর্তন আসবে কি না। কোনো দল যদি ইসরায়েলের ব্যাপারে নতুনত্ব আনতে পারে তাহলে তা হতে পারে রিপাবলিকান পার্টি। তবে দলের মধ্যে এখনো কিছু অস্থিতিশীলতা রয়ে গেছে। তাই পরিবর্তন আনা খুব কঠিন।

বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এবার অনেকের আগ্রহ থাকবে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের ব্যাপারে ট্রাম্পের আমেরিকা কী সিদ্ধান্ত নেয়। মনে হয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চীনের ব্যাপারেও তার নজর থাকবে। চীন, রাশিয়া ও ভারত মিলে ইতোমধ্যে একটি কাঠামো তৈরি করে ফেলেছে। সেই জায়গায় ট্রাম্পের বাড়তি একটা চেষ্টা থাকবে যেন ভারতকে আরও কাছে টানতে পারেন। আর বাংলাদেশের ব্যাপারে বলা যায়, ইতোমধ্যে রিপাবলিকান পার্টি নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে, যদিও তারা বড় রকমের কোনো সহযোগিতা করতে পারবে না। বরং এখানে নির্বাচিত সরকার যাতে তাড়াতাড়ি হয়, সেটা দেখার ব্যাপারে আরও বাড়তি কথাবার্তা বলতে পারে। যেহেতু ভারত তথা মোদির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হওয়ার বড় সম্ভাবনা রয়েছে, তার একটা প্রভাব বাংলাদেশের ওপরেও থাকবে। তবে ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের এই সম্পর্ক বাংলাদেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, তা এখনই নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। সে জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে। 

সম্প্রতি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি টুইট করেছেন। এ ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অব্যাহত মনোযোগ দেখা গেছে। যেমন- শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় থাকাবস্থায় ট্রাম্পের সভায় প্রিয়া সাহার মন্তব্য ঘিরে সংখ্যালঘুদের অধিকারের কথা উঠেছিল। তখন বলা হয়েছিল, এটা বিএনপি-জামায়াত লবি করছে। সুতরাং ডোনাল্ড ট্রাম্প যেমন হাসিনা সরকারের আমলে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কথা বলেছিলেন, এবারও তিনি একই কথা বলেছেন। এবার বলার মধ্যে কোনো রাজনৈতিক কারণ থাকতেও পারে, যদিও তিনি নিয়মিতভাবে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে নজর রাখেন। এটা বলা যায়, এ ব্যাপারে তিনি এখনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেননি। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা যাতে ঝামেলায় না পড়ে, সেদিকে আমেরিকা আরও বড় আকারে সব সময় একটা চাপ রাখবেই। সেটা যে সরকারই থাকুক না কেন। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নানা সম্পর্ক রয়েছে। যেমন- অর্থনৈতিক, কৌশলগত, ভূরাজনৈতিক ইত্যাদি।

সুতরাং বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ইস্যু যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে দেখবে, সেটিও ভারতের সঙ্গে কিছুটা যুক্ত। তবে আমাদের ওপর তার কী প্রভাব পড়বে এখনো বলা কঠিন। মনে হচ্ছে, খুব একটা পরিবর্তন হওয়ার কথা নয়। এ বিষয়ে আমেরিকা একই ধরনের কথা বলে থাকে। রোহিঙ্গা নির্যাতনের ব্যাপারে ডেমোক্র্যাটদের পক্ষ থেকে গণহত্যা বলা হয়েছিল এবং বার্মা অ্যাক্ট নামে একটি বিলও পাস করা হয়েছিল। আবার তারা রোহিঙ্গা অ্যাক্টও নিয়ে এসেছে। তবে ট্রাম্পের আমলে পরিস্থিতি কী হবে, তা দেখার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। ভাটা পড়তে পারে, আবার উল্টোও হতে পারে। কিন্তু এটা অনেকটা নির্ভর করে ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কী দাঁড়াচ্ছে তার ওপর।

 বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অভিবাসন-প্রক্রিয়া। সেখানে মূল সমস্যা আসে  দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। এসব অঞ্চল থেকে অবৈধভাবে লোক মার্কিন সীমান্ত অতিক্রম করে। যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসী ছাড়া কোনোভাবে চলতে পারার কথা নয়। কারণ তার নতুন লোকবল দরকার পড়বে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সেটি আইনি পদ্ধতিতে করতে চায়। সমস্যা হলো, লাতিন আমেরিকা থেকে যেভাবে লোকজন আসে, তাতে সেখানে হিস্পানিক সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এমনকি অনেক জায়গায় যত লোক ইংরেজি বলে, তার চেয়ে বেশি লোক স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে। এর মূল কারণ হলো, লাতিন আমেরিকা থেকে আসা লোকসংখ্যা। বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে অভিবাসনের হার এত কম যে, এ ব্যাপারে কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। সেটা তেমন গুরুত্ব বহন করে না। মূলত তার সমস্যা হিস্পানিক জনসংখ্যা নিয়ে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র শক্ত একটা অবস্থান নেবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বৈধ অভিবাসন নিয়ে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেবে বলে ধারণা করা যায়। কারণ এ হার অত্যন্ত কম। বাংলাদেশে এখন অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। তারা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখার কৌশলের বাইরে যেতে পারবে বলে মনে হয় না।

এ অবস্থায় ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন, তাহলে বাংলাদেশ কোয়াডে যুক্ত থাকল কি থাকল না, সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের খুব বেশি নজর থাকবে না। সুতরাং বাংলাদেশকে অবস্থান ঠিক রাখতে হলে নিজেদেরই চিন্তাভাবনা করতে হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পর রাশিয়ার মতো চীনের তরফ থেকেও আনুষ্ঠানিক কোনো অভিনন্দনবার্তা পাঠানোর খবর পাওয়া যায়নি। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং জানিয়েছেন, মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত এবং ট্রাম্পকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করার পর চীনও নিয়ম অনুযায়ী প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো পালন করবে। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবারও নির্বাচিত হওয়ায় চীনের সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।

 নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই ট্রাম্পকে নিয়ে চীনা নাগরিকদের মধ্যে বাড়তি একটা আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছিল। অনেকেই তাকে পছন্দ করেন এবং প্রায়শই ‘কমরেড ট্রাম্প’ নামে ডেকে থাকেন। তবে চীনের যেসব ব্যবসায়ী যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করেন, তাদের মধ্যে বেশ উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে। এর কারণ নির্বাচনি প্রচারণায় ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় গিয়ে বিদেশি পণ্যের ওপর কর বাড়াবেন। ওদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পর বিভিন্ন দেশের নেতারা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানালেও এখনো সে ধরনের কোনো বার্তা দিতে দেখা যায়নি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে। পুতিন আদৌ আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানাবেন কি না, সেটি এখনো নিশ্চিত নয় বলে জানিয়েছেন রুশ কর্মকর্তারা। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ট্রাম্প তার নির্বাচনি প্রচারের সময় ইউক্রেন যুদ্ধের ইতি টানার বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। তবে বাস্তবে তার কথার প্রতিফলন কতটুকু দেখা যাবে, সেটি সময়ই বলে দেবে।

আগামী ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে সিনেটে আনুষ্ঠানিকভাবে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট গণনা করা হবে। সেই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট ও নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিস। ভোট গণনা শেষে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম ঘোষণা করবেন। ২০২০ সালে সিনেটের সেই ভোট গণনার সময়েই উত্তেজিত জনতা ক্যাপিটল হিলে হামলা করেছিল। সেই অনুষ্ঠানে ভোট গণনা পাঠ করছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। এরপর ২০ জানুয়ারি নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। একই সময় জো বাইডেন হোয়াইট হাউস ছেড়ে যাবেন। ওই শপথ নেওয়ার আগ পর্যন্ত সময়কে বলা হয় ‘রূপান্তরকালীন সময়’। ওই সময়ের মধ্যে নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের বাছাই করেন এবং পরিকল্পনা তৈরি করবেন। 

২০২৪ সালের নির্বাচন তার ভাগ্যের চাকাকে এমনভাবে ঘোরাচ্ছে, যা হয় তার ভঙ্গুর বন্ধনকে সহজেই ছিন্ন করতে পারে অথবা সংগ্রাম ও অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পথে চালিত করতে পারে। অনেকের মতে, সামনের দিনগুলো একটি নতুন বন্দোবস্তের সূচনা ঘটাতে পারে, যেখানে প্রতিটি অঞ্চলের শক্তিকে সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখা হবে। অন্যদের কাছে এটি তাদের প্রিয় সবার জন্য ধ্বংসের পরিখা, রক্ত দিয়ে অর্জিত এবং প্রাচীন ও পবিত্র মাটিতে দাঁড়িয়ে কথিত শপথ দ্বারা আবদ্ধ একটি ইউনিয়নের সমাপ্তি। সেখানে শান্তি বা যুদ্ধ যা-ই বিরাজ করুক না কেন, আসন্ন যুগ এমন সব হিসাব-নিকাশের প্রতিশ্রুতি দেয়, যা নিশ্চিতভাবে যেকোনো বিজয়ীর তরবারি যেমনটা করে তেমনভাবে এ ভূখণ্ডকে রূপান্তর করবে। যা-ই হোক, এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, পরবর্তী চার বছর ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দেশ ও যুদ্ধ আক্রান্ত বিশ্ব পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেন।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক 
[email protected]

জেলখানা সংস্কারে যে কাজগুলো করতে হবে

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১০ পিএম
জেলখানা সংস্কারে যে কাজগুলো করতে হবে
মাসুদ আহমেদ

বিভিন্ন জেলখানার কর্মকর্তা এবং সংবাদপত্র ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের কারাগারগুলোয় ধারণক্ষমতার চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বেশি কয়েদি অবস্থান করছে। এ তথ্য সর্বনিম্ন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন উপ-কারাগার থেকে শুরু করে উচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা-সংবলিত কেন্দ্রীয় কারাগারের ইন্সপেক্টর জেনারেল প্রিজনের বক্তব্যে প্রায়ই প্রকাশ পাচ্ছে। এসব স্থানে গড়ে প্রতি ৬৪ জন বন্দির জন্য একটি শৌচাগার রয়েছে। এটি মানবেতর অবস্থা। মানুষের ন্যূনতম মর্যাদার ও মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থি এক ব্যবস্থা। কারণ, একজন বিচারাধীন ব্যক্তি তো বটেই, এমনকি একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীরও বর্জ্য নিষ্কাশনের অধিকার রয়েছে। ৬৪ জনের জন্য একটি শৌচাগার বরাদ্দ হলে সেই অধিকারটি কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। এই অবস্থার জন্য দায়ী দেশের বিপুল ফৌজদারি মামলা, যা বিচারকদের সংখ্যার অনুপাতে অত্যন্ত বেশি। 

ফলে কোনো মামলা নিষ্পত্তি হতে ১৮ বছরও লাগছে এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে কোনো না কোনো কারাগারে আটক রাখতে হচ্ছে। সুধীজনরা বলছেন, ঘুণে ধরা ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা এর জন্য দায়ী। তা নাকি সংস্কার করতে হবে, কেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জমির ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে, রেলওয়ে লোকোমোটিভ, বিমানবন্দর, নদীবন্দর, সিআরপিসি যদি পাকিস্তান ও ভারতের মতো জন-অধ্যুষিত দেশে চলতে পারে, তবে তা আমাদের দেশে চলতে পারবে না কেন? জেলখানায় একজন কয়েদির জন্য কত বর্গফুটের বিছানা, কম্বল, চিকিৎসক, খেলাধুলা ও বিনোদন এবং উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের কী ব্যবস্থা রাখতে হবে, তা ব্রিটিশদের প্রণীত জেল কোডে পরিষ্কারভাবে বিদ্যমান আছে।

 মামলার সংখ্যা বৃদ্ধিজনিত অপরাধী ও কয়েদিদের সংখ্যা উপচে পড়াভাবে বৃদ্ধি পাওয়া এবং বিচারক, পেশকার, জেনারেল রেজিস্ট্রার অফিসার (জিআরও), আইনবিদ, কয়েদিদের পরিবহন এবং বিশেষ করে জমিসংক্রান্ত বিবাদের সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে জেলখানায় ধারণক্ষমতার এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বৈধ ও অবৈধভাবে কোনো কারাবন্দির সঙ্গে আত্মীয়স্বজনদের দেখা করার নামে কারারক্ষীরাও অনৈতিক সুযোগ নিচ্ছেন। আবার কারাবন্দিদের দৈহিক নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে তাদের থেকে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করছেন। এসবের জন্য ব্রিটিশ আইন এতটুকু দায়ী নয়। দায়ী তার প্রয়োগজনিত দুর্বলতা এবং জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পরিদর্শন ও পরিবীক্ষণ না করা।

কোন কয়েদির জন্য কত বর্গফুটের শয্যা, একটি কক্ষে কতজন কয়েদি রাত্রীযাপন করবে, কয়জনের জন্য একজন চিকিৎসক, কতদিন অন্তর নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হবে, সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা কী কী উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ড করবেন এবং তা কত কর্মঘণ্টার জন্য, তাদের ক্রীড়া এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড তথা বিনোদনের জন্য ইন্সপেক্টর জেনারেল প্রিজন কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, অসুস্থ হলে তার চিকিৎসা এবং হাসপাতালে ভর্তির কী ব্যবস্থা হবে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রসচিব, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রয়োজনে অন্যান্য ব্যক্তি কীভাবে কারাগারের অবস্থা এবং কারাবন্দিদের মঙ্গল পরিদর্শন করবেন, সে বিষয়গুলো ব্রিটিশদের প্রণীত জেল কোডে সুস্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ আছে।

 এমনকি ইন্সপেক্টর জেনারেল প্রিজন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াও যেসব কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করতে পারবেন তার বিধিব্যবস্থাও একই বইতে নির্ধারণ করা আছে। বিচারাধীন কারাবন্দিদের আদালতে হাজিরার দিনে কীভাবে কোন নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করে উপস্থিত করা হবে এ ব্যাপারেও বিধিবিধান একই বইতে লিপিবদ্ধ আছে। কারাগারে পানি, বিদ্যুৎ, পয়োনিষ্কাশন এবং এগুলোর উন্নয়ন ও সংরক্ষণ খাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বছরভিত্তিক বাজেটও নির্ধারণ করা থাকে। কোনো কারাবন্দিকে আদালতের আদেশ অনুযায়ী শাস্তি প্রদানের নির্ধারিত কক্ষে পাঠানো, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের নির্দিষ্ট প্রকোষ্ঠে স্থানান্তর, সাজার মেয়াদ শেষে মুক্তি দেওয়া এবং মামলার প্রয়োজনে কারা ফটকে পুলিশ কর্তৃক জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতিও ওই জেল কোডে পরিষ্কারভাবে বলা আছে। যারা এগুলো অনুসরণ করছেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করা এবং এগুলো পরিবীক্ষণে দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়িত্ব পালনে অবহেলাজনিত শাস্তির বিধান না করে নতুন সংস্কারের প্রস্তাব সময়ের অপচয় মাত্র। 

দেখা যাচ্ছে, হাই সিকিউরিটি কারাগারেও আটক বা সাজাপ্রাপ্ত কারাবন্দিরা মুঠোফোনের মাধ্যমে মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক পরিচালনা, বিচারাধীন মামলায় বিভিন্ন পক্ষকে উৎকোচ দিয়ে রায় পরিবর্তন, জাল জামিন আদেশ জারি এবং মাদকদ্রব্য গ্রহণের মতো বেআইনি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। জেলের ফটক ভেঙে বা কাঁটাতারের দেয়াল টপকে কোনো কোনো কোনো কয়েদি পালিয়ে যাচ্ছেন। তারা সমাজে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থির অবনতি ঘটানোর সুযোগ পাচ্ছেন। বাদী-বিবাদী ও সাক্ষীকে হত্যার হুমকি, পুলিশ ও বিচার বিভাগীয় কর্মচারীদের ঘুষ দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে বাধা সৃষ্টি করছেন। কারারক্ষীদের অসৎ সহযোগিতা ছাড়া এই কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সংস্কারের নামে অপ্রয়োজনীয় এবং ব্যয়বহুল কনসালটেন্সি ও প্রকল্প গ্রহণ করা পরিহার করতে হবে। মামলাজট দূর করা তো দূরের কথা, তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এই ব্যবস্থাগুলোর সঙ্গে সঙ্গে, যা কিনা বর্তমান আইনে বিদ্যমান রয়েছে, নতুন কারাগার নির্মাণ করে কয়েদিদের আটক রাখার পরিবেশটিকে উন্নত করার উদ্যোগ নিতে হবে। 

যানবাহন, গাড়ি চালনা, ফিটনেস, পিচ, সড়ক, সড়কের বিভিন্ন চিহ্ন, জেলখানা, জেল কোড, বিচারব্যবস্থা, পরিবহন এবং এ-সংক্রান্ত সবকিছুর আবিষ্কারক হচ্ছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ও আইন প্রণেতারা। এগুলো দুর্নীতির মাধ্যমে বিকৃত করে সবার জন্য ন্যায়বিচারের বিপরীতে মুষ্টিমেয় মানুষের বেআইনি মুনাফা অর্জনের যে ব্যবস্থা বিভিন্ন শাসক ও স্বার্থান্বেষী মহল করেছেন, সেগুলো সংস্কার করার জন্য নতুন কোনো পদ্ধতি, প্রথা, আইন বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিষ্কারের কোনো প্রয়োজন নেই। কাজেই দুর্নীতি দূর করে পুরোনো সেই আইন, প্রথা ও পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করার ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। 

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রজাতন্ত্রের সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল
[email protected]

রমজানে নিত্যপণ্যের সরবরাহ বাড়াতে করণীয়

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ পিএম
রমজানে নিত্যপণ্যের সরবরাহ বাড়াতে করণীয়
এস এম নাজের হোসাইন

প্রতিবছর রমজান মাসকে ঘিরে যেসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে তা নিয়ে সংকট তৈরি হয়। ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে এসব পণ্যের মজুত বাড়ায় এবং ভোক্তাদের জিম্মি করে সরবরাহ নিয়ন্ত্রণসহ নানা কৌশলে দাম আকাশচুম্বী করে। এবারও সে রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে না, তা বলা যায় না। বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও কাস্টমসের তথ্যানুযায়ী মজুত পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয় বলে আভাস দিচ্ছে। সে কারণে বলা যাচ্ছে, পবিত্র রমজান মাস সামনে রেখে কয়েকটি নিত্যপণ্যের আমদানি ও মজুত পরিস্থিতি তেমন সন্তোষজনক নয়। বিশেষ করে ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজসহ কয়েকটি পণ্যের আমদানি ও মজুত গতবারের তুলনায় কম। এসব পণ্যের ঘাটতি মেটাতে যে পরিমাণ ঋণপত্র (এলসি) খোলা দরকার ছিল, তা সেভাবে হচ্ছে না। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় রমজানে এসব পণ্যের বাড়তি চাহিদা থাকে।

রমজান সামনে রেখে প্রতিবছর ব্যবসায়ীরা কয়েক মাস আগেই আমদানি ও মজুত বাড়ানোর জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলে। গত ৫ আগস্টের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বড় আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা আত্মগোপনে চলে যান আবার বিগত সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকায় অনেকেই প্রকাশ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না। সে কারণে প্রথম থেকেই রমজানে নিত্যপণ্য সরবরাহ নিয়ে কিছুটা শঙ্কা ছিল।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) চলতি সপ্তাহে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আগামী মার্চে শুরু হওয়া পবিত্র রমজানে ব্যবহার্য বেশ কিছু পণ্যের সংকট দেখা দিতে পারে- এমন পর্যবেক্ষণ ও শঙ্কার কথা জানিয়েছে। বিটিটিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সয়াবিন বীজ, মসুর ডাল ও অপরিশোধিত চিনি ছাড়া সব পণ্যের ঋণপত্র (এলসি) এবার কম খোলা হয়েছে। এদিকে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত দুই ধরনের চিনির দামই এক বছরে বিশ্ববাজারে কমেছে ২১ শতাংশ। তবে দেশীয় বাজারে দাম কোনোভাবেই কমেনি। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এলসি কম খোলা হলে আমদানি কম হবে, আমদানি কম হলে সরবরাহ সংকট হবে, আর সরবরাহ সংকট দেখা দিলে বাজারে দামেও তার প্রভাব পড়তে পারে। তাই সরকারের উচিত আমদানি ও মজুত পরিস্থিতি বিবেচনায় আগেভাগে সংকট মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়া।

ক্যাবসহ বাজার বিশ্লেষকরা বলে আসছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে যেহেতু মূলধারার অনেক বড় বড় আমদানিকারক আত্মগোপনে চলে গেছেন আবার অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছেন, সে কারণে সরকারের উচিত ছিল অন্য যারা সচল আছেন তাদের এলসি খোলার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আমদানিতে উৎসাহিত করা। একই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের একটি পক্ষ বারবার বলে আসছে, এলসি খুলতে ডলারের সংকট ও ব্যাংকের সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি আমলে নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ এখনই না নিলে রমজানের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সরকারের পক্ষ থেকে পণ্যের মজুত ও চাহিদার যেসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়, তা নিয়ে ব্যবসায়ী মহলে এমনিতেই আপত্তি ছিল। তথ্যগুলোর প্রকৃত চিত্র একেবারেই মেলানো যায় না। সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে যেসব তথ্য দেওয়া হয়, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এক একটি দপ্তর এক একবার বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করে, যার সঙ্গে একটির সঙ্গে অন্যটির মিল নেই।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বিটিটিসির পাঠানো এ-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, স্থানীয় চাহিদা, রমজানের চাহিদা, স্থানীয় উৎপাদন, বার্ষিক আমদানি, মাসিক চাহিদা, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে জানা যায়, ২০২৩ সালের জুলাই-অক্টোবরের সঙ্গে ২০২৪ সালের একই সময়ের আমদানি, এলসি ও আমদানির মজুত পরিস্থিতির তুলনা করা হয়েছে। 

প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গতবারের তুলনায় এবার সবচেয়ে বেশি ঘাটতি রয়েছে অপরিশোধিত চিনির। অপরিশোধিত চিনি গত বছরের জুলাই-অক্টোবরের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৫৯১ টন কম আমদানি হয়েছে। পেঁয়াজের বেলায়ও একইভাবে এই সময়ে ২ লাখ ৪০ হাজার ৫৮০ টন কম আমদানি হয়েছে। পেঁয়াজের এলসি খোলাও কমেছে ১ লাখ ৯৪ হাজার ১৪২ টনের। পাম তেল আমদানি কম হয়েছে ১ লাখ ৭৪ হাজার ৩৮৬ টন। আর পাম তেলের এলসি খোলা কমেছে ৭৭ হাজার ৯৩০ টন। এ ছাড়া ছোলা, খেজুর ও পরিশোধিত চিনির এলসিও কম খোলা হয়েছে। সয়াবিন বীজের আমদানি কম হয়েছে এই সময়ে। তবে গত বছরের তুলনায় অপরিশোধিত চিনি ৮৮ হাজার টন এবং সয়াবিন বীজ আমদানির জন্য ৮ হাজার টনের বেশি এলসি খোলা হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নানাবিধ উদ্যোগ নিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো আমদানি শুল্ক কমানো। সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেশ কয়েক সপ্তাহ নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় মাত্রায় ছিল। বিশ্লেষকরা এ জন্য বাজারে ও পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের ছাত্রদের জবাবদিহির মুখোমুখি হওয়া এবং জবাবদিহির ভয়ে অপকর্ম বন্ধ রাখার কথা বলেছেন। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় খাদ্যসংক্রান্ত মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল রাখতে সরকার পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, চাল, ডিম, আলু, ডাল ও চিনির আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর কমিয়েছে। এর বাইরে মসুর ডাল ও ছোলা আমদানিতে শুল্ক-কর একেবারেই শূন্যতে নামিয়ে আনা হয়েছে। 

প্রশ্ন হলো, প্রতিবছর যখন এভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে, তখনই সরকার তাৎক্ষণিকভাবে উদ্যোগ নিয়ে আমদানি শুল্কসহ বিভিন্ন কর কমিয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এই শুল্ক বা কর হ্রাসের সুফল ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছে না। শুল্ক কমানোর প্রস্তাব সরকার অনুমোদন করার পর তারা দুটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। একটি হলো নতুন করে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। অপরটি হলো তারা বলতে শুরু করে, যে লটে শুল্কছাড়ে পণ্য আমদানি হয়েছে তা এখনো বাজারে আসেনি। কম শুল্কে পণ্যটি খালাস হলেই ভোক্তা পর্যায়ে সে সুফল পাওয়া যাবে।

 সরকারের বাজার তদারকিতে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশ্ন করা উচিত, অস্ট্রেলিয়ায় কোনো পণ্যের দাম বাড়লে, সে পণ্যটি বাংলাদেশের মাটিতে না এলেও এখানে দাম বেড়ে যায়। দাম কমাতে বললেই নানা অজুহাত দেখায়। দাম বাড়াতে গেলেই ওই লটের পণ্য না এলেও সমস্যা হয় না। ব্যবসায়ীদের এই দ্বিচারি আচরণ পরিহার করা ও কঠোর হস্তে দমনের জন্য শুল্কছাড়ের বিষয়টি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে (বিটিটিসি) কঠোরভাবে নজরদারি করতে হবে।

বাজার বিশ্লেষক ও বিটিটিসি বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ কমানোর সুপারিশ করে আসছে। বিশেষ করে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণার পর ব্যাংক সুদের হার বেড়ে গেছে। একদিকে ডলারের মূল্য অনেক বেশি, এর বাইরে পণ্য পরিবহন ও বাজারে চাঁদাবাজিও আগের চেয়ে বেড়েছে। তাই ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ ও খেজুর আমদানিতে ব্যাংকের সুদের হার কমানো হলে আমদানি খরচ কিছুটা হলেও কমবে। এ জন্য সরকারের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। প্রয়োজনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে এসব পণ্যের বড় বড় আমদানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করে এলসি খোলার পরিমাণ বাড়ানো, ডলারসংকটের সমাধান এবং পদ্ধতি সহজীকরণ করে দ্রুত আমদানির পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

কয়েক বছর ধরেই খেজুরসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের শুল্কায়ন নিয়ে জটিলতার কথা ব্যবসায়ীরা বলছেন। তারা বিশ্ববাজারের দাম বিবেচনা করে শুল্কায়ন করার কারণে এসব খাদ্যপণ্যের অতিরিক্ত শুল্কায়ন হচ্ছে বলে অভিযোগ করে আসছিলেন। বিষয়টি বিবেচনা করে, খেজুরসহ খাদ্যপণ্যের বিশ্ব বাজারদর নিয়ে প্রকৃত শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নির্ধারণ ও শুল্কায়নের জটিলতা দূর করতে এনবিআর যেন শুল্ক স্টেশনগুলোকে নির্দেশনা দেয়। এ ছাড়া শুল্কায়নের বিষয়টি সহজ করা, দ্বিগুণ বা তারও বেশি যেন শুল্ক নির্ধারণ করা না হয়, সে বিষয়ে পরিষ্কার নির্দেশ থাকা প্রয়োজন। 

ফ্যামিলি কার্ড ও ট্রাক সেলের মাধ্যমে সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) উদ্যোগে সাশ্রয়ী দামে আলুসহ খাদ্যপণ্য বিক্রি কার্যক্রম, খাদ্য বিভাগের ওএমএস চালু রাখা দরকার। এসব কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানো দরকার। এ ছাড়া টিসিবির মাধ্যমে পরিচালিত খাদ্যপণ্য বিক্রির জন্য সরকার টু সরকার পদ্ধতিতে পণ্য সংগ্রহ করা হলে স্থানীয় মজুতের বিরূপ প্রভাব পড়বে না। বাজারে বিকল্প সরবরবাহ ও মজুত সৃষ্টির জন্য এ উদ্যোগগুলোকে আরও জোরদার করা যেতে পারে। 

দেশের ভোক্তারা সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক জনগোষ্ঠী হলেও প্রতিনিয়ত নানা বিষয়ে নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ একেবারেই নগণ্য। ভোক্তারা সুসংগঠিত নয়, তাদের সংগঠন শক্তিশালী না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় ভোক্তাদের ওপর কী প্রভাব ফেলবে, সে বিবেচনা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে বারবার। 

এ অবস্থায় সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় ভোক্তাদের স্বার্থের বিষয়টি তুলে ধরা, ভোক্তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্যক্রমে সমন্বয় সাধন, চাহিদা, উৎপাদন, আমদানির সঠিক পরিসংখ্যান সংরক্ষণ; সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল থেকে দরিদ্র, স্বল্প আয় ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের ভোক্তারা যাতে বঞ্চিত না হয় সে লক্ষ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে রাখার উদ্দেশ্যে ১৫ থেকে ২০টি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য ও নিত্যপণ্য চিহ্নিত করে সেসব খাদ্যপণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি সন্তোষজনক পর্যায়ে এবং মূল্য স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব অর্পণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি পৃথক ডিভিশন অথবা একটি পৃথক ‘ভোক্তাবিষয়ক মন্ত্রণালয়’ করা হলে দ্রুত সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নীতিনির্ধারক মহলে ভোক্তাস্বার্থের দিকগুলো বেশি মনোযোগের কেন্দ্রেবিন্দুতে আসবে। 

লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
[email protected]

ঘাটতি পূরণের পন্থা বের করতে হবে

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৩ এএম
আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৩ এএম
ঘাটতি পূরণের পন্থা বের করতে হবে
ড. এস এম ফায়েজ

সিচুয়েশন (পরিস্থিতি) আমাদের এমন অবস্থায় নিয়ে আসছে। করোনার সময়ে শিক্ষায় বিশ্বব্যাপী ঘাটতি ছিল। আবার সাম্প্রতিক আন্দোলনের একটা বাস্তবতা ছিল। এটাতে দারুণ কিছু জিনিস লক্ষণীয় ছিল। দারুণ একটা মুভমেন্ট (আন্দোলন) হলো। সবাই এপ্রিশিয়েট (প্রশংসা) করছে। ছেলেরা দারুণ স্যাক্রিফাইস (ত্যাগ) করেছে। এখন সময় আসছে সবাইকে একসঙ্গে হয়ে কাজ করার। ছাত্র-শিক্ষকদের চিন্তাভাবনা করতে হবে। অবশ্যই পূরণ করতে হবে আমাদের ঘাটতি। এই ঘাটতি কীভাবে পূরণ করা যায় বের করতে হবে তার উপায়। এ জন্য প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসতে হবে। পারস্পরিক সম্পর্ক বাড়াতে হবে। ছাত্ররাও সচেতন। তাদেরও চিন্তা করতে হবে, তাদের কতটুকু ঘাটতি হয়েছে। শিক্ষকদেরও যদি সহযোগিতা থাকে তাহলে নির্দিষ্টভাবেই একটা পথ বেরিয়ে আসবে।

চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)

শিক্ষা নিয়েই সংস্কার কমিশন হওয়া উচিত

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৭ এএম
আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৭ এএম
শিক্ষা নিয়েই সংস্কার কমিশন হওয়া উচিত
অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান

শিক্ষা তো আর শিক্ষা নেই। এখন ছাত্ররা প্রিন্সিপাল, হেড মাস্টারদের হেনস্তা করছে। এই যদি শিক্ষার অবস্থা হয়, দেশ চলবে কী করে? সব মিলিয়ে হ য ব র ল অবস্থা। কারিকুলাম নতুন করল। তাতে একদিকে হইচই। আবার বাদ দিল। এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি সন্তোষজনক নয়। করোনার পর থেকে একটার পর একটা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। নানা কারণে শিক্ষার বারোটা বাজছে। দেশের ভবিষ্যৎ কী হবে? প্রমোশন, শর্ট সিলেবাস, কয়টা সাবজেক্ট পরীক্ষা দিয়েই বাকি বিষয়ে পাস। আবার যারা ফেল করছে তারাও আন্দোলন করে। শিক্ষায় তো ঘাটতি হয়েছে। এখন ঘাটতি কীভাবে পূরণ হবে এই চিন্তা না করে ভবিষ্যতে যাতে ঘাটতি না হয় সে চিন্তা করতে হবে। ঘাটতি কাটানোর চিন্তা তো দেখতেছি না। 

সবাই যদি সুশিক্ষিত হতো! অধিকাংশ মানুষকে যদি আমরা সুশিক্ষিত করতে পারতাম, তাহলে দেশের সব সমস্যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমাধান হয়ে যেত। মানুষের চরিত্র, আচার-ব্যবহার, জ্ঞান, দক্ষতা, সবকিছুই যদি সঠিকভাবে অগ্রসর হতো, তাহলে মানুষের মতো মানুষ গড়ে উঠত। 

শিক্ষা নিয়েই তো প্রথম সংস্কার কমিশন হওয়া উচিত। যত কমিশনই হোক, মানুষ যদি সুশিক্ষিত না হয় কোনো সিস্টেমে কাজ হবে না। শিক্ষকদের যদি অবমূল্যায়ন করা হয়, তাহলে শিক্ষকতা পেশার প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হবে না। শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে হবে সব দিক দিয়ে। যোগ্যরা শিক্ষকতায় না এলে শিক্ষার আরও বারোটা বাজবে।

সাবেক পরিচালক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

পরীক্ষা বাতিল করা ঠিক হয়নি

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৪ এএম
আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৫ এএম
পরীক্ষা বাতিল করা ঠিক হয়নি
রাশেদা কে চৌধুরী

শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক বিষয়গুলো সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী এসব করছেন। কিন্তু কিছু পদক্ষেপ সরকার যদি শুরুর দিকে নিতে পারত তাহলে ভালো হতো। পরীক্ষা বাতিলের বিষয়টি তো ঠিক হয়নি। গুটিকয়েক শিক্ষার্থীর জন্য ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা আমরা বাতিল করে দিলাম। এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। আবার শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরনের লাঞ্ছনা। বিষয়টি সবার ক্ষেত্রে না হয়তো। যারা দলবাজি, ধান্দাবাজির মধ্যে ছিলেন তাদের চিহ্নিত করে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মনের ক্ষোভ মিটিয়েছে।

শিক্ষায় ক্ষতি হচ্ছে এবং ক্ষতি হয়েই চলেছে। এই মুহূর্তে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। শিক্ষার্থীদের মনোজগতে যে পরিবর্তন, আমরা আশা করেছিলাম, সরকার এটা খুঁজে বের করবে। কে বা কারা এসব (নেতিবাচক কর্মকাণ্ড) করাচ্ছে। সব শিক্ষার্থী কিন্তু এসব চায় না। তিতুমীর কলেজের আন্দোলনে এত সহিংস হওয়ার ছিল না। এখন বড় প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, আমরা কি তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পারছি না? 

খালি শিক্ষার মানটা দেখেছি, মানবিকতার উন্নয়নের দিকে তাকাইনি আমরা। দাবি-দাওয়া পেশ করার অধিকার তো সবারই আছে। কিন্তু সহিংসভাবে দাবি-দাওয়া পেশ করা, রাস্তাঘাটে জটলা তৈরি করে মানুষকে দুর্ভোগে ফেলার অধিকার তো কারও নেই। সেটা তারা বুঝতে পারল কি না, তা বুঝতে পারছি না। আবার এই ইস্যুগুলো জাতীয়ভাবে অতটা গুরুত্বপূর্ণ না। এসব করার মাধ্যমে গণ-অভ্যুত্থানকে ছোট করে ফেলা হচ্ছে। আগে যেটা হয়েছে, সবাই কিন্তু সাপোর্ট করেছে। এখন পাবলিক বিরক্ত। এগুলোর পেছনে যারা ইন্ধন জোগায় তাদের চিহ্নিত করা দরকার। সরকারের পক্ষ থেকে শক্ত বার্তা দেওয়া উচিত। শিক্ষার্থীদের এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যেতে হবে। অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। অন্যথায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে। সব অর্জন বৃথা হয়ে যাবে। 

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা