ঢাকা ১২ মাঘ ১৪৩১, রোববার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫
English
রোববার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ মাঘ ১৪৩১

খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:০৭ পিএম
খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি
সৈয়দ ফারুক হোসেন

দেশের ২ কোটি ৩৬ লাখ বা ২৬ শতাংশ মানুষ উচ্চমাত্রার খাদ্যসংকটে ভুগছেন। সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কাজনক এ চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত খাদ্যসংকটে থাকা মানুষগুলো তীব্র খাদ্য নিরাপত্তহীনতায় ভুগতে পারেন। তাদের মধ্যে মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ৩ লাখ রোহিঙ্গাও রয়েছে। এ অবস্থায় তীব্র খাদ্যসংকটে থাকা ১৬ লাখ মানুষের জন্য জরুরি খাদ্যসহায়তা প্রয়োজন।

 জাতিসংঘসহ বাংলাদেশে কাজ করা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর যৌথভাবে পরিচালিত ‘সমন্বিত খাদ্যনিরাপত্তার পর্যায় চিহ্নিতকরণ’ শীর্ষক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ৭ নভেম্বর প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। ২০ বছর ধরে এই জরিপ করা হচ্ছে। বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশে দুই বছর ধরে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে দেশের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষের ভৌগোলিক অবস্থানও চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব মানুষের বেশির ভাগ বাস করেন চট্টগ্রাম, রংপুর, খুলনা ও সিলেট বিভাগে। দেশের ৪০টি এলাকায় খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, ৩৩টি এলাকার মানুষ সংকটজনক অবস্থায় রয়েছেন। জরিপে দেখা গেছে, ১৬ লাখ ৪৭ হাজার মানুষের জরুরি খাদ্যসহায়তা দরকার। খাদ্য নিয়ে সংকটময় অবস্থায় আছেন ২ কোটি ১৯ লাখ ৩৩ হাজার মানুষ। আর ৩ কোটি ৩৪ লাখ ১১ হাজার মানুষ চাপে আছেন। শুধু ৩ কোটি ৩৯ লাখ মানুষ পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছেন।

দেশে খাদ্যপণ্যের দাম ও কৃষি-উপকরণের বিষয়টিকে বর্তমান সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। সরকার পণ্য সরবরাহ ও খাদ্য বণ্টনব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে না পারলে সামনের দিনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। বন্যা ও অন্যান্য দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার কৃষকদের জন্য খাদ্যসহায়তার পাশাপাশি আসন্ন বোরো-রবি মৌসুমে বিনামূল্যে কৃষি-উপকরণ সহায়তা দেওয়া দরকার। শুধু রিজার্ভের উন্নতি হলেই অর্থনীতির গতি ফিরে আসবে না। দেশের খাদ্যপণ্য সরবরাহব্যবস্থায় দ্রুত পরিবর্তনের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের দিয়ে ওই ঘাটতি পূরণের উদ্যোগ নিতে হবে।

 বাংলাদেশে গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সব ধরনের সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। বিশেষ করে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে। ওই অভ্যুত্থানের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নিয়েছে। অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে। নানা কারণে খাদ্যপণ্যের দাম তুলনামূলক বেশি বেড়েছে। ফলে সরকারকে সারা দেশে ন্যায্যমূল্যে খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এদিকে ২০২৪ সালের শুরুতে দেশের মানুষের আয় কমে গেছে এবং ব্যয় বেড়ে গেছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও সংঘাতের কারণে ওই সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে। আমদানি-রপ্তানি ও বাণিজ্য ব্যাহত হয়েছে। ফলে খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হয়েছে।

চলতি বছরের বন্যা ও খরার মতো দুর্যোগে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাদের বড় অংশই কৃষিজীবী। এদের আবার এক-চতুর্থাংশ কৃষি-মজুর। বন্যা, দুর্যোগ ও তাপপ্রবাহের কারণে তারা ঠিকমতো কাজ পাননি। কাজ পেলেও মজুরি পেয়েছেন কম। এই জনগোষ্ঠীর বড় অংশ শুধু কৃষি মজুরি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদের দৈনিক আয়ের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ খাদ্যের পেছনে ব্যয় হয়। ফলে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের খাদ্য গ্রহণ কমাতে হচ্ছে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যার কারণে ফসল, গবাদিপশু, মৎস্যসম্পদ এবং মজুত খাদ্যের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে।

 এতে খাদ্য উৎপাদন কমতে পারে এবং গৃহস্থের আয় কমে আসতে পারে। মহামারির প্রায় তিনটি বছর অতিবাহিত হলো! এরপর যুক্ত হলো ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাত। এ সংঘাতের কারণে এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বজুড়ে ৩ বিলিয়ন মানুষ এখনো স্বাস্থ্যকর খাবারের সামর্থ্য রাখে না। তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষির ওপর নির্ভর করে। এমতাবস্থায় একটি টেকসই বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য আমাদের সংহতি এবং সম্মিলিত পদক্ষেপের শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে, এমনটি মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যেখানে প্রত্যেকেরই পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারের নিয়মিত নিশ্চয়তা থাকবে। বাংলাদেশে ক্ষুধার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের জন্য সবচেয়ে কার্যকর ও অন্যতম বড় উদ্যোগ বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে কাজ করছে বর্তমান সরকার। কৃষি ও খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সরকারের কার্যকর উদ্যোগের মাধ্যমেই এই খাদ্যসংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। ২০৩০ সালে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ১৩ লাখ মানুষ ক্ষুধার ঝুঁকিতে থাকবে। 

বিশ্ব খাদ্যনিরাপত্তার মূল উদ্দেশ্য হলো ক্ষুধা, অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা, কৃষির উন্নতিতে মনোযোগ দেওয়া, কৃষিভিত্তিক উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়া, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা গ্রহণে উৎসাহ দান, গ্রামীণ জনগণ বিশেষ করে নারী ও পিছিয়ে পড়া মানুষের অবদানে উৎসাহ এবং প্রযুক্তির সমৃদ্ধিকে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। কৃষিকে কেন্দ্র করে বিশ্বের মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগান, দরিদ্র ও পুষ্টিহীনতা দূর করে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার নিতে হবে সবাইকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক সংকটে বেশি নিপতিত হয় পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী। একটি ভালো ভবিষ্যতের আশায় সবার জন্য খাদ্যনিরাপত্তা, শান্তি ও সমতাকে অগ্রাধিকার দিতে সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি খাত, একাডেমিয়া এবং সুশীল সমাজকে একত্রে কাজ করা দরকার।

খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় কাউকে পিছিয়ে না রাখার হাতিয়ার হিসেবে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে এগোতে হবে। তাদের আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে ফসলের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির দিকে বিশেষ মনোনিবেশ দরকার। কৃষিপ্রযুক্তি গ্রহণে কোন শ্রেণির কৃষক পেছনে আছে তা চিহ্নিত করে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ দরকার। এ ছাড়া সুবিধাভোগী শ্রেণি ব্যবধান কমাতে নীতিগুলো ডিজাইন করা, আসন্ন বৈশ্বিকসংকট ও খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি বিষয়ে প্রান্তিক কৃষকসহ সব সম্প্রদায়কে সতর্ক করা, প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক করা খুবই প্রয়োজন।

 অপরদিকে বিনিয়োগনীতিগুলোকে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে উপযোগী করে গড়ে তোলার পাশাপাশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করা, কৃষি-খাদ্যব্যবস্থায় সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; প্রান্তিক কৃষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান অত্যাবশ্যকীয়। টেকসইভাবে উৎপাদিত খাবার সরবরাহ করতে খাদ্যশৃঙ্খল ঠিক রাখা; খাদ্যের ক্ষয়ক্ষতি ও অপচয় রোধ করতে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও টেকসই প্যাকেজিং-ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে হবে। দরিদ্র এবং দুর্বল কৃষি পরিবারকে ফসল উৎপাদন করতে উন্নত বীজ, রোপণের উপকরণ, সার, বাগান করার সরঞ্জামসহ প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ চলমান রাখা; টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনার আলোকে কৃষক এবং পরিবেশের জন্য সবচেয়ে স্মার্ট সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন।

 পিছিয়ে পড়া কৃষক পরিবার যাতে ফসল ফলিয়ে আয় বাড়িয়ে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে পারে এবং কৃষক ব্যয়বহুল রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করে অর্থ সাশ্রয় করতে পারে, সে জন্য উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার। পিছিয়ে পড়া কৃষকদের বসতবাড়ির আঙিনায় বা তাদের ক্ষুদ্র জমিতে প্রদর্শনী প্লট স্থাপনে সহযোগিতা করা দরকার। বিভিন্ন শাকসবজি ও ফলের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার চালানো; চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল হিসেবে জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহারের সুফল পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারলে জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে দেশে একটি সহনশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই কৃষি-খাদ্যব্যবস্থার রূপান্তর ঘটাতে পারলে আগামীতে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে।

লেখক: সাবেক রেজিস্ট্রার, বিএসএফএমএসটিইউ
[email protected]

মতৈক্য ছাড়া সংস্কার নয়, সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয়

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ পিএম
আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:২০ পিএম
মতৈক্য ছাড়া সংস্কার নয়, সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয়
মাসুদ আহমেদ

সরকারপ্রধান জাতীয় ঐক্য এবং সংস্কারের ওপর অতিশয় গুরুত্বারোপ করে চলেছেন। বলা হচ্ছে, প্রথমত, ঐকমত্য হতে হবে সংস্কারের ব্যাপারে এবং তার পর নির্বাচনে যাওয়া যাবে। এখন দেখা যাচ্ছে, এই ঐক্যের বা সমন্বয়ের বিষয়ে গরমিল রয়েছে। তিনি বললেন, নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়রেখার কথা। পরদিন তার প্রেস সচিব বললেন, একটি ভিন্ন সময়রেখার কথা। এ ব্যাপারে আবার বিভিন্ন উপদেষ্টা বিভিন্ন কথা বলছেন। যেমন- কেউ বলছেন, পতিত আওয়ামী লীগকে শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে নির্বাচনে আনতে হবে। এই শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে চিফ প্রসিকিউটর বলছেন, এক বছরের মধ্যে তা সম্পন্ন হবে। 

তিনি যেহেতু বিচারক নন, তার এই কথায় নির্ভর করার আগে বিবেচনা করা দরকার যে, পতিত সরকারের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ১০৫২টির মতো। যাতে জড়িত, অভিযুক্ত ও সাক্ষীর সংখ্যা দেড় লাখ। তো এসব মামলার চার্জশিট প্রণয়ন, সাক্ষী তলব, অভিযুক্তদের আদালতের উপস্থিতি, আদালতের বিচারক ও আইনজীবীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং বিচার বিভাগের সময় লাভ ইত্যাদি করে এই মামলাগুলোর বিচার, রায় প্রদান, আপিল করার প্রক্রিয়া, তথা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের স্তরগুলো পার হয়ে শেষ স্তর পর্যন্ত যেতে এক বছরে এই কাজ কোনোভাবেই করা সম্ভব নয়। কারণ, এ দেশে একটি ফৌজাদারি মামলা নিষ্পত্তি হতে ১৮ বছরও লাগে। এগুলো পার হওয়ার পরও পতিত সরকারের অপরাধীরা যে আনীত অভিযোগের ভিত্তিতে কোনো শাস্তি পাবেন, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এখানে আরেকটি বড় অনৈক্য খুব মোটা দাগে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তা হলো পতিত সরকারের অপরাধীদের শাস্তিসংক্রান্ত অভিপ্রায়।

 যে জনতার কথা এত বলা হচ্ছে যে, এটা জনগণের ইচ্ছা, তারা রাজপথ প্রকম্পিত করে কয়েক মাস ধরে এই মর্মে দাবি করেছেন যে, ওই অপরাধীদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তথা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এই লক্ষ্য অর্জনে দেশের বিচার বিভাগের প্রতি তাদের আস্থা না থাকায় দাবি উঠেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার করার এবং জাতিসংঘের তদন্তকারী দল কর্তৃক তদন্ত করা। এখানেও সংঘাত দৃশ্যমান। কারণ অপরাধ হলো আমার দেশে, তা আমাদের আইনে তদন্ত, বিচার এবং রায় হবে।

 কিন্তু জাতিসংঘ যদি তদন্ত করে, যা কিনা বাংলাদেশ পুলিশের কোনো শাখা নয়, তার চার্জশিট বাংলাদেশ সরকারবহির্ভূত বা স্বাধীন বিচার বিভাগবহির্ভূত কোনো আদালতে বিচার্য ও শাস্তিযোগ্য হবে? ধরা যাক তা জাতিসংঘে যাবে। তাহলে এর ফল যে জন-অভিপ্রায়ের একান্ত বিরুদ্ধে যাবে, তা সুস্পস্ট ঘোষণা কিন্তু জাতিসংঘের তদন্তকারী দলের প্রধান এই বাংলাদেশের মাটিতে বসেই দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করি না’। তার মানে অপরাধ যা-ই হোক এবং বিচারে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিতভাবেই বজায় রইল কিন্তু শাস্তি হলে কারাদণ্ড। তাহলে জন-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে এর সংগতি কোথায় রইল? আবার তাদের একটি সূত্র জানিয়েছে যে, তারা তদন্তের তথ্য প্রাপ্তিতে সরকারের সব ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছেন না। এটি তো স্বাভাবিক কথা।
 
যে আইন বলবৎকারীরা বিপ্লবের আগে ১ হাজার ৬০০ মানুষকে খুন করেছেন এবং নিজেরাও অর্ধশতসংখ্যক খুনের শিকার হয়েছেন, তাদের হাতেই তো তথ্য দেওয়ার দায়িত্ব। তো তারা কি নিজেদের শাস্তির জালে নেওয়ার লক্ষ্যে তথ্য দেবেন? সুন্দর ব্যবস্থা, তাদের ডেকে আনলাম আমরা, কারণ দেশের তদন্ত ও বিচারব্যবস্থায় আস্থা নেই। অথচ তাদের আবার তথ্যও দিচ্ছি না। শাস্তি  হবে? ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সব অভিযুক্ত ২৬ বছর পর সম্পূর্ণ খালাস পেলেন। আবার বিভিন্ন হিসাব মতে, এই পতিত দল নাকি ভোটারদের শতকরা ৪০ ভাগের সমর্থন পেয়ে থাকেন। আবার জাতীয় পার্টি (একাংশ) কোনো কিছুতে অংশগ্রহণে এখন সরকারের থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্তির ফলে তারা যে ৩০টির মতো আসন লাভ করতেন, সেটিও অন্তর্ভুক্ত করা যাচ্ছে না। 

তাহলে এই দুটি দল বিবেচনায় যদি ৫০ ভাগ ভোটারের সমর্থনও আছে বলে ধরি এবং তারা নির্বাচনের বাইরে থাকে তাহলে ঐক্য হলো কোথায়? আবার দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি নেতারা এখন বলছেন যে, জামায়াত স্বাধীনতাবিরোধী এবং রগ কাটা দল। জামায়াত এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। তাহলে এই দুটি দলের মধ্যে যে ঐক্য হয়েছে বলে সম্প্রতি প্রতীয়মান হয়েছিল, তাও নড়বড়ে। এর ওপর ছাত্র সমন্বয়করা বলছেন, খুব শিগগির আরও দুটি রাজনৈতিক দলের সদয় উপস্থিতি ঘটবে। তার মানে ৫৯টি দল এখন আছে, সেই সঙ্গে আরও দুটি। ১০-১২ জন হোক কিংবা কোটি কোটিই হোক, এই ৬১টি দলের মধ্যে ভোটাররা বিভাজিত।

 তাহলে ঐকমত্যটা কীভাবে হবে? অথচ ঐকমত্য ছাড়া সংস্কার সম্ভব নয়। এর ওপর আবার ছাত্র সমন্বয়করা বলছেন, এক নতুন ঘোষণার কথা। তার মানে এটিও আরেকটি ভিন্ন মতের স্রোত। তাহলে মতের সংঘাত দাঁড়াচ্ছে ছয়মুখী যথা- সরকার, পতিত সরকার, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি ও ছাত্র সমন্বয়ক। সমন্বয়করা এবং একদল উপদেষ্টা যখন বললেন, ১৯৭২-এর মুজিববাদী শাসনতন্ত্র কবর দেওয়া হবে। তখন বৃহত্তম দলটির দুই নেতা সমস্বরে বললেন, রক্তের অক্ষরে লেখা শাসনতন্ত্র কবর দেওয়া যাবে না। আরেক  বাগ্মী  উপদেষ্টা বলছেন,  সংস্কারে পিছপা হলে চলবে না, এই কথার অর্থ কী? ক্ষমতায় তো ওনারাই। সংস্কার করার দায়িত্ব তাদেরই। তাহলে তারাই আবার পিছপা হবেন কেন? এ কথা কাকে শোনানো হচ্ছে? তিনি আরও বলছেন, ক্ষমতা শুধু সরকার নয় মানুষও প্রয়োগ করবে। এ তো একটি অদ্ভুত কথা। 

মানুষ তো তার অধিকার থেকেই বঞ্চিত, যেটি গত পালানো সরকার রুদ্ধ করে রেখেছিল। তো সে ক্ষমতা পাবে কোথায়? ক্ষমতা তো প্রশাসন, পুলিশ, কর, বিচার বিভাগ ও অন্যান্য সরকারি দপ্তরের। সাধারণ মানুষ কার ওপর কী ক্ষমতা প্রয়োগ করবে? এগুলো কি স্ববিরোধী হয়ে যাচ্ছে না? আবার সমন্বয়করা বলছেন, রাজনীতিবিদরা প্রতিপক্ষ। মতানৈক্য ছাড়া সংস্কার নয় এবং সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয়, বর্তমান বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এই কথার অর্থ দ্বিমতের তথা ভিন্ন মত প্রকাশের কোনো সুযোগ থাকছে না। আবার ঐকমত্যে উপনীত না হতে পারলে সংস্কারও হবে না এবং নির্বাচনও পিছিয়ে যাবে। তার মানে নির্বানের সময়সীমা পেছাতে থাকবে। আন্দোলনের কৃতিত্ব কাদের, তা নিয়ে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে অন্তত তিনটি বিভাজনের দাবি ও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। পদে থাকা উপদেষ্টারাও বিভিন্নজন বিভিন্ন কথা বলছেন। একই দিনে অর্থ উপদেষ্টা বলছেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর বলছেন, এটি ফিরতে আরও এক বছর সময় লাগবে। পরিকল্পনা উপদেষ্টা আবার বলছেন, মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যে রয়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণি। 

রাজনৈতিক নেতারাও একই বিষয়ে বিভিন্ন কথা বলছেন। রিজভী আহমেদ বলছেন, জামায়াত মোনাফেক, চাঁদাবাজ তারাও, রগ কাটে কারা, জনগণ তা জানে। তাহলে বৃহৎ এই দুই দলে ঐক্য হবে কী করে? বৃহৎ বলছি এই জন্য যে, আওয়ামী লীগ মাঠের বাইরে, আর তাদের সহযোগী সংসদের ৩৫টি আসনের জনপ্রিয় দল জাতীয় পার্টি এখন ছাত্রদের একান্ত অপছন্দের। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারেও এদের বিভিন্ন মত রয়েছে। বিএনপি বলছে, জামায়াত রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টায় লিপ্ত। একদল যদি বলে সংশোধনের মাধ্যমে বিতাড়িত দলটিকে নির্বাচনে আনা যায়, তখন অন্য দলের বেশ বড় মাপের ব্যক্তি আবার বলেন, হাসিনাকে ক্ষমা করা শহিদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা হবে। কোনো দলকে জাতীয় বেইমান ঘোষণার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। আবার শাসনতন্ত্র সংস্কারের ব্যাপারে দলীয় ব্যারিস্টাররা বলছেন, ’৭২-এর শাসনতন্ত্রে সবকিছু রয়েছে, সংস্কারের প্রয়োজন নেই। আরও বড় নেতা বলছেন, বর্তমান অনির্বাচিত সরকার সংস্কার করতে পারে না। এটা পারে গণপরিষদ। কাজেই নির্বাচন কি সংসদের হবে নাকি গণপরিষদের জন্য হবে, তা নিয়ে তিনটি মত রয়েছে। 

সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েও রয়েছে মতদ্বৈধতা। ছাত্র সমন্বয়করা সরকারের পক্ষে তেমন কিছু বলছেন না। তারা আওয়ামী লীগের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে এবং জাতীয় পার্টিরও বিরুদ্ধে। আবার বিএনপি ও জামায়াতের দিকে ইঙ্গিত করে তারা যা বলছেন তাতেও তাদের প্রতি এদের বিরোধিতা সুস্পষ্ট। এখন এসেছে আরেক ইস্যু। তা হলো ঘোষণাপত্রে জাতীয় ঐকমত্য লাগবে। প্রায় ৪৫ ভাগ জনসমর্থনকে হিসাবের বাইরে রেখে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র যেভাবেই প্রণীত হোক, তা জাতীয় ঐকমত্যভিত্তিক কীভাবে হয়? জাতীয় নির্বাচনের আগে এখন এসেছে আরেকটি বিষয়, তা হলো স্থানীয় নির্বাচন নাকি আগে হতে হবে এবং এ ব্যাপারে বিভিন্ন রাজনৈতিক গ্রুপের পরস্পরবিরোধী মন্তব্য আগেভাগেই শোনা যাচ্ছে। 

এত শতধা বিভক্ত জনগোষ্ঠীকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে ঐকমত্যে আনা যে কতটা সম্ভব তার বড় নমুনা এই যে, আমরা দুটি পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলের মধ্যে আপস আনয়নের লক্ষ্যে সাবেক অস্ট্রেলিয়ান গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ানকে ভাড়া করে এনেছিলাম। কিন্তু তার উদ্যোগ সফল হয়নি। আর কোনো পদ্ধতিতে এই ঐকমত্য যদি আনাও যায় অথচ সংস্কারের বিষয়গুলোতে প্রকৃতপক্ষে আদর্শগতভাবে সমর্থন নেই, এমন কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী নির্বাচনে জয়লাভ করলে তারা তো এক ফুৎকারে ওই সংস্কার উড়িয়ে দেবেন। সরকারপ্রধানের মতে, ছাত্ররাই বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় আনার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন। তারাই এই আন্দোলনের meticulous planner। তাই বিশেষ করে ছাত্র সমন্বয়করা তা ভেবে দেখবেন বলে আশা করি। নইলে এই ধারণা দুটি অকৃত্রিম বলে জনগোষ্ঠীর কাছে প্রতীয়মান হবে না।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রজাতন্ত্রের সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল
[email protected]

পৃথিবীতে আমি প্রথম

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৫৮ এএম
পৃথিবীতে আমি প্রথম
ড. পবিত্র সরকার

আপনারা সবাই গিনেস বুক অব রেকর্ডস নামে একটা ব্যাপারের সঙ্গে পরিচিত। আমাদের ভারতেও একসময় লিমকা রেকর্ডস নামে একটা এ ধরনের ব্যাপার চালু হয়েছিল, এখন সেটার কী অবস্থা জানি না। তাতে কোনো ব্যক্তির বা দলের কোনো অনন্য কীর্তির খবর নথিবদ্ধ করা থাকে। তার প্রচারও হয় এবং সেই ব্যক্তি বা দলের গৌরব বাড়ে। পৃথিবীতে এমনটা আর নেই, বাপ রে, এ কী কম কথা! এতে কোনো পক্ষের কোনো সাংসারিক বা আধ্যাত্মিক সুবিধে হয় কি না জানি না। কিন্তু গৌরবরটাই কী কম! ‘দ্যাখো আমার কাণ্ড, দ্যাখো, আর সবাই মুগ্ধ হও! মুগ্ধ না হলে তোমরা বেরসিক আর হিংসুটে’- এই রকম একটা অপবাদের ভাগী হতে হবে। 

তার জন্য মানুষ কত কি না করে! পরশুরামের একটা গল্পে একজন চ্যাম্পিয়ন ‘ওয়ান-লেগার’-এর কথা পড়েছিলাম, যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধুনালুপ্ত সিনেট হলের বারান্দায় ঝাড়া একাত্তর ঘণ্টা এক পায়ে দাঁড়িয়ে থেকে ওই খেতাব অর্জন করেছিল। সে তো লেখকের কল্পনা। কিন্তু ৩০-৪০ বছর আগে কলকাতার যাদবপুর অঞ্চলেই দেখেছি এক ব্যক্তিকে, যিনি বাঁ হাতের নখ না কেটে সেগুলো বাড়তে দিয়েছিলেন এবং সেগুলো বাড়তে বাড়তে গাছের লতা বা বটের ঝুরির মতো ঝুলে পড়েছিল। তিনি সেগুলোকে গুটিয়ে এনে হাতের ওপরেই রাখতেন আর একটা রুমাল দিয়ে ঢেকে রাখতেন, কৌতূহলী দর্শকের অনুরোধে দেখাতেন। তার জন্য দক্ষিণা নিতেন কি না জানি না। আমি একবার বিদেশি চিত্রকার রিপলির ‘বিলিভ ইট অর নট’ খোপে তার ওই নখগুলোর ছবি দেখে শিহরিত হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র, সত্যতিৎ রায়- এ রকম কত বাঙালিকে নিয়েই তো আমরা কত গর্ব করি, তা এ রকম একজন বাঙালিকে নিয়ে কি আমরা গর্ব করতে পারি না? তা ব্যাপারটা নিয়ে বাঙালি কোনো হইচই করল না দেখে আমি বেশ হতাশ হয়েছিলাম।

অন্য রকম কিছু করব, তা নিয়ে অবশ্য মানুষ দীর্ঘদিন ধরে আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে এসেছে। আমি প্রাণিতত্ত্ববিদ নই, কাজেই বলতে পারব না, অন্য প্রাণীদের মধ্যে এ ধরনের কোনো উচ্চাভিলাষ দেখা যায় কি না। প্রকৃতি তাদের নিয়মবদ্ধতার একটা প্রোগ্রামে ঢুকিয়ে দিয়েছে বলে মনে হয়। মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি হলো বানররা, তাদের মধ্যেও এ ধরনের কোনো ইচ্ছে আছে বলে প্রমাণ পাইনি। হ্যাঁ, বাঁদরেরা গাছের ডাল ঝাঁকাতে বা বটগাছের ঝুরি ধরে দোল খেতে ভালোবাসে- কিন্তু কোনো বাঁদরের মনে এমন ইচ্ছা হয়েছে এবং সে ঘোষণা করেছে যে, আমি ১ লাখ ৭ হাজার ৩৮৩ বার এই ঝুরিতে দোল খাব এবং আমার বাঁদরগোষ্ঠীর সদস্যরা তোমরা সবাই দাঁড়িয়ে তা দ্যাখো এবং বাঁদর-সভ্যতার ইতিহাসে এই কীর্তি আর্কাইভ করে রাখো- এর কোনো প্রমাণ আমি পাইনি। সে হিসেবে মানুষই অনন্য। ওই যে অলিম্পিকের স্লোগান আছে- Citius, Altius, Fortius, যা লাতিন উচ্চারণে হয়তো হবে কিতিউস, আলটিউস, ফরতিউস, যার মানে ‘আরও জলদি, আরও উঁচুতে, আরও জোর দিয়ে’- এই পাগলামো শুধু মানুষের; আর কারও নয়। অলিম্পিকের প্রতিযোগিতায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

কিন্তু অলিম্পিকের খেলাধুলার তালিকায় নেই, এমন অনেক কিছু নিয়েও মানুষ এই খেলা খেলে। যেমন আগে এই বাংলাতেই হতো, নিশ্চয়ই এখনো হয়, ছাপ্পান্ন প্রহরের কীর্তন। সে কীর্তন হয়েই চলেছে তো হয়েই চলেছে। অবশ্য এখন ঠিক মনে নেই তা একটি দলই ছাপ্পান্ন প্রহর ধরে চালাত কি না, কারণ একই ব্যক্তি বা দল অতক্ষণ ধরে তা চালালে তো গলার দফারফা হয়ে যাওয়ার কথা। সে এক রেকরর্ডের ব্যাপার। আবার আমাদের কাছাকাছি গ্রামগঞ্জের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখতাম এ রকম একটা জিনিস- ‘অবিরাম সাইকেল চালনা’। আমি যতক্ষণ থেকেছি ততক্ষণের মধ্যে তাকে দু-একবার জলের জন্য ইশারা করতে দেখেছি বটে, এবং একজন কেউ সাইকেলের সঙ্গে ছুটে ছুটে তার হাতে জলের গ্লাস ধরিয়ে দিয়েছে, সে এক হাতে সাইকেল চালাতে চালাতে জল খেয়ে জলের গ্লাস ফেরত দিয়েছে। কিন্তু এই তিন দিনে সে ওই জল এবং তার সঙ্গে মেলে আর একটা জিনিস কীভাবে ত্যাগ করেছে, তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমরা ফেরত এসেছি, প্রচুর মাথা ঘামিয়েও কোনো সমাধান খুঁজে পাইনি। 

আমার কোনো রেকর্ডের দিকে যাওয়ার সামর্থ্য কোনো দিন হয়নি, আর জীবনের যে ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ বাকি আছে তাতে হবেও না। কিন্তু আমাকে কিছু কিছু রেকর্ড-সন্ধানীর লক্ষ্য হতে হয়। কারণ, তাদের মতে আমি ও-সবের গুণের যোগ্য বিচারক। আমার বারণ তারা শোনে না। বলে, পড়ে আমাকে একটা প্রশংসাপত্র লিখে দিতে হবে। যেমন- একজন একটা উপন্যাস লিখে আনলেন, মাত্র দুটি শব্দের- ‘জন্ম, মৃত্যু’। বললেন, এটি কোনো পত্রিকার শারদ সংখ্যায় দেবেন। শারদ সংখ্যায় কেন? উত্তরে বললেন, আজকাল শারদ সংখ্যা ছাড়া উপন্যাসের দিকে কেউ তাকিয়েও দেখে না। আমি বললাম, কিন্তু এটা বাঁধানো মলাটের বই হবে কী করে? লেখক তাতে দমলেন না, বললেন, সে দেখা যাবে। 

আমি তার আখ্যানের ব্যঞ্জনা মানলাম, বেশির ভাগ মহৎ উপন্যাস জীবন ও মৃত্যু নিয়ে, কিন্তু দুটি মাত্র শব্দ যে উপন্যাসের পক্ষে, এমনকি গল্প বা কবিতার পক্ষেও যথেষ্ট নয়- তা তাকে বোঝাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। আজকাল এই ‘অর্জিন্যাল’ কিছু করার আগ্রহ এমন বেড়েছে যে, লোকে কারও উপদেশকে পাত্তাই দেয় না। বলে, মশাই, এটা উত্তর-আধুনিকতার যুগ, এখানে আপনাদের পুরোনো দিনের সংজ্ঞা-টংজ্ঞা চলে না। আমরা যেমন খুশি সৃষ্টি করব।

সেদিন এলেন এক গল্পকার। আমি তার গল্প আগে পড়িনি, কিন্তু তার গল্পের বই বেরিয়েছে ছাপা হয়ে, ফলে তিনি যে গল্পকার তা আমার অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু তার কবিতার একটা অভিনবত্ব, ওই ‘অর্জিন্যালিটি’, আছে। তিনি একটা গল্প লিখেছেন বেশির ভাগ অ আদ্যবর্ণের শব্দ দিয়ে সর্বনাম আর ক্রিয়াপদের জন্য একটু জায়গা ছেড়ে। যেমন- ‘আনন্ত অদ্য অদ্ভুত অধ্যবসায়ে অবসন্ন। অবশেষে অনুরাধার জন্য তার অন্তহীন অপেক্ষার অন্ত হতে চলেছে। অনুরাধা তার অন্তরের অন্বেষণ, তার অনন্তের অভীপ্সা’  ইত্যাদি। এ রকম করে বেশ কিছুটা এগিয়ে গল্প শেষ হয়েছে। ‘গল্প’ শেষ হয়েছে’ বললাম, কিন্তু গল্পের কোনো মাথামুণ্ডু খুঁজে পেলাম না। যদিও তার অভিধানের ওপর দখল দেখে আমার মাথা নিচু হয়ে এল। আমি বিনীতভাবে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, শব্দ তো দারুণ সাজিয়েছেন, কিন্তু গল্পটা কোথায়? তিনি কথাটাতে গুরুত্বই দিলেন না, বললেন, পৃথিবীতে আমিই প্রথম এটা করেছি।

পৃথিবী ধরে টান দিয়েছেন বলে আমি আর কিছু বলতে সাহস করলাম না। তাকে দুটো মিষ্টি খাইয়ে নমস্কার জানিয়ে বিদায় করলাম। 

লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু  সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৩৩ এএম
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু 
সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে দেশে দীর্ঘদিন ধরে চলছে আলোচনা ও বিতর্ক। কিন্তু এখনো এ সংকট উত্তরণ সম্ভব হয়নি। এ সংকট মাথায় নিয়ে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই তিনটি নির্বাচনের মধ্যে একটি নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করলেও বাকি দুটি নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ বেশির ভাগ বিরোধী দল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে বছরের পর বছর তারা আন্দোলন করে।

 এ জন্য তারা আইনি লড়াইও করছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জোরালো হয়। বিশিষ্টজনরা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে এলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে- এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তারা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় দেশে রাজনৈতিক স্থিরতা এসেছিল, আবার তা চলেও গিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যেসব বিতর্ক উঠেছিল তা সমাধান না করলে দীর্ঘ মেয়াদে সমস্যা থেকেই যাবে। 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে আপিল বিভাগে একটি মামলায় লড়ছেন নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনেরও প্রধান, যার নেতৃত্বে কমিশন এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ-সংক্রান্ত সুপারিশও জমা দিয়েছে। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা মামলায় জিতলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে আসার পথ তৈরি হবে। তবে এর মানে এই নয় যে, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে। 

পরবর্তী সময়ে জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে ফিরিয়ে আনলে সেখানেই স্পষ্ট হবে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কী রূপে ফিরছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে আমাদের বিগত দিনের যে অভিজ্ঞতা, ভবিষ্যৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে যেন সেই জটিলতাগুলো ফিরে না আসে, সংসদে নিশ্চয়ই এ নিয়ে আলোচনা হবে।’ 
সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেছেন, ‘যতদিন না দলীয় বিবেচনায় বিচারপতি নিয়োগ বন্ধ হবে, ততদিন পর্যন্ত বিচারপতিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা উচিত হবে না। এ ক্ষেত্রে বিকল্প ভাবা উচিত।’

ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত হয়। সংশোধনীতে বলা হয়, কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে কিংবা সংসদের মেয়াদের অবসান হলে এর ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে। তবে সরকারের মেয়াদ নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলা ছিল না। এ সময়টিতে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। তখন নির্বাচন দেয় এই সরকার। ওই নির্বাচনে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। তবে ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানের সংশোধনী আনে। তবে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল সংবিধানের যে সংশোধনীর মাধ্যমে, সেই সংশোধনী বাতিল চেয়ে রিভিউ আবেদনটি বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। এদিকে ২০১১ সালের ২৪ এপ্রিল বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করে বিশেষ কমিটি। 

ওই দিন বিশেষ কমিটি সাবেক প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে তাদের প্রায় সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে কোনো বিচারপতিকে নিয়োগ না দেওয়ার বিধান রেখে সংবিধান সংশোধনের পরামর্শ দেন। তাদের অভিমত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বিচারপতিদের নিয়োগ দেওয়াটা স্বাধীন বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে বিচার বিভাগকে বিতর্কিত করা হয়েছে। বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখতে এ বিতর্কের অবসান হওয়া প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিচারপতিদের যুক্ত করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে এলে সেই আগের পরিস্থিতি আরও প্রকট হয়ে ফেরার আশঙ্কা রয়েছে। 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা দীর্ঘদিনের একটি অমীমাংসিত বিষয়। বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে এ বিষয়টি আবারও নতুন করে সামনে এসেছে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান এ নিয়ে বেশ কিছু সুপারিশও রেখেছেন। বিষয়টির জটিল সমীকরণ এখন সমাধান পর্যায়ে নিতে হলে রাজনৈতিক সমঝোতার বিকল্প নেই। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদি এ সমস্যার সমাধানে সফল হবে, এটাই প্রত্যাশা।

 

পুঁজিবাদী ঈশ্বর সর্বাধিক শক্তিশালী

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫:২২ পিএম
পুঁজিবাদী ঈশ্বর সর্বাধিক শক্তিশালী
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

পুঁজিবাদী ঈশ্বর অন্য যেকোনো ঈশ্বরের তুলনায় অধিক ক্ষমতা রাখে। তার প্রধান কারণ সারা পৃথিবীকে সে পদানত করার আয়োজন করে ফেলেছে। বিশ্ব এখন একটাই, কেননা সর্বত্রই পুঁজিবাদের দীর্ঘবাহু প্রসারিত। এর ফলে পৃথিবী একাধারে ছোট ও খাটো হয়ে এসেছে। ছোট হচ্ছে বৈচিত্র্যহীনতা ও ঐতিহ্য-বিযুক্তির দিক থেকে, খাটো হচ্ছে নৈতিকতা। পুঁজিবাদ সবকিছুতেই মুনাফা খোঁজে, দাম জানে, মূল্য জানে না। লাভ-লোকসানের হিসাবের বাইরে কোনো অর্জন ও পেশাকেই সম্মান করে না। এর বস্তুতান্ত্রিক হাত যাকে স্পর্শ করে তাকেই পরিণত করে পণ্যে, যেমন সংগীতকে করেছে, করেছে খেলাধুলাকে।...


আগের উপনিবেশবাদ এখন আর নেই, বিদেশিরা এসে স্থায়ীভাবে এখানে বসবাস করছে, এমন ঘটনা ঘটবে না, সাম্রাজ্যবাদের জন্য তেমন ব্যবস্থার প্রয়োজনও নেই। এখন রয়েছে বাজার দখল, রয়েছে ক্রেতা সৃষ্টি, আছে লগ্নি পুঁজির তৎপরতা, যে পুঁজি ঋণ হিসেবেও কাজ করবে। ইংরেজ লেখক জর্জ অরওয়েল একসময়ে সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছিলেন, আরও অনেক তরুণের মতো; পরে আবিষ্কার করেছিলেন যে, সমাজতন্ত্র মানুষকে ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’ দেয় না। ১৯৪৪-এ লেখা তার অ্যানিমেল ফার্ম বইতে অরওয়েল স্ট্যালিনের রাশিয়ায় স্বাধীনতা হারিয়ে অনেক মানুষই শুয়োরে পরিণত হচ্ছে, এমনটা দেখিয়েছেন। পাঁচ বছর পরের উপন্যাস নাইনটিন এইটটি ফোরে তিনি আর রুশ দেশে যাননি, নিজের দেশ ইংল্যান্ডেই সমাজতন্ত্র এসে গেছে বলে কল্পনা করেছেন। তখন মানুষের যে কী দুর্দশা হবে তার ছবি আঁকা আছে ওই বইতে। সেখানে বাইরে থাকবে আউটার পার্টি, ভেতরে ইনার পার্টি এবং ইনার পার্টির ভেতরে বিগ ব্রাদার। সব মিলিয়ে একটি পুলিশি রাষ্ট্র, যেখানে ব্যক্তির স্বাধীনতা থাকার প্রশ্ন তো ওঠেই না, কোনো প্রকার আড়ালও নেই। টেলিভিশন সম্পর্কে লোকে তখন তেমন জানতই না। অরওয়েল কল্পনা করেছেন যে, ওই রাষ্ট্রে সর্বত্র পাতা রয়েছে টেলিভিশনের পর্দা, এমনকি গোসলখানাতেও; ওই পর্দার সাহায্যে বিগ ব্রাদার সবকিছু দেখছেন এবং নিয়ন্ত্রণ করছেন। সেখানে ভিন্নমত সহ্য করা হয় না, ভিন্নমতাবলম্বীকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। ভালোবাসা, চিন্তা, ভাষা- সবকিছু নিয়ন্ত্রণের জন্য ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয় রয়েছে। ভাষাও বদলে গেছে, ভাষা থেকে ‘ঈশ্বর’ নির্বাসিত হয়েছেন।

ঈশ্বরের আশীর্বাদে তেমন ঘটনা ঘটেনি, ১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডে সমাজতন্ত্র আসেনি, এমনকি ২০০১ সালেও নয়। বিশ্বময় আজ পুঁজিবাদের আধিপত্য। অরওয়েল জীবিত থাকলে স্বীকার করতেন কি না জানি না, পুঁজিবাদ নিজেই আজ ঈশ্বর হয়ে বসেছে। পৃথিবীব্যাপী সে ঢল নামিয়ে দিয়েছে প্রমোদ ও লালসার। ভোগের পীড়নে তপ্ত হয়ে উঠেছে ধরিত্রী, ফুলে উঠছে পানির উচ্চতা, বাড়ছে ঝড় ও বন্যা। ব্যক্তি তার চিন্তার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা হারিয়েছে। পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে সর্বস্তরে। না, সশস্ত্র পুলিশের দরকার নেই। পুলিশের কাজ করছে টেলিভিশন, ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে তথাকথিত বিপ্লব। এসব অবশ্য বিড়ম্বনা ধনীর জন্যই শুধু, গরিব মানুষ এসব থেকে অনেক দূরে। তাদের ওপর চেপে বসে আছে পুঁজিবাদী শোষণ, যার দরুন তাদের ন্যূনতম চাহিদাগুলো মিটছে না। ওদিকে ভোগভিক্ষা সব মানুষের সৃষ্টিশীলতাকেই স্তিমিত করছে, নৈতিকতা পরিণত হচ্ছে স্থূল আত্মসুখসন্ধানে। অরওয়েলের নরক এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়।

পুঁজিবাদী ঈশ্বর অন্য যেকোনো ঈশ্বরের তুলনায় অধিক ক্ষমতা রাখে। তার প্রধান কারণ সারা পৃথিবীকে সে পদানত করার আয়োজন করে ফেলেছে। বিশ্ব এখন একটাই, কেননা সর্বত্রই পুঁজিবাদের দীর্ঘবাহু প্রসারিত। এর ফলে পৃথিবী একাধারে ছোট ও খাটো হয়ে এসেছে। ছোট হচ্ছে বৈচিত্র্যহীনতা ও ঐতিহ্য-বিযুক্তির দিক থেকে খাটো হচ্ছে নৈতিকতা। পুঁজিবাদ সবকিছুতেই মুনাফা খোঁজে, দাম জানে, মূল্য জানে না। লাভ-লোকসানের হিসাবের বাইরে কোনো অর্জন ও পেশাকেই সম্মান করে না। এর বস্তুতান্ত্রিক হাত যাকে স্পর্শ করে তাকেই পরিণত করে পণ্যে, যেমন সংগীতকে করেছে, করেছে খেলাধুলাকে।

এই ব্যবস্থা বৈষম্য বৃদ্ধি করে। নারীকে মর্যাদা দেওয়ার কথা বলে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাকে শিকারে পরিণত করে বৈষম্যের। মেয়েদের নিরাপত্তা দেয় না, মজুরির ক্ষেত্রে নর-নারীতে বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার নাম করে অসম্মান ঘটায় নারীর ব্যক্তিত্বের। পুঁজিবাদের দাঁত ও নখর রঞ্জিত শ্রমজীবী মানুষের রক্তে। এখন যন্ত্রের ব্যবহার বাড়িয়ে চেষ্টা চলছে শ্রমের মূল্য যতটা পারা যায় কমিয়ে আনার।

তথ্যবিপ্লবের কথা বলা হচ্ছে। এই বিপ্লব নাকি পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। তা পৃথিবী তো আগেও বদলেছে, একাধিকবার; বাষ্পযান, বেতার, বিদ্যুৎ- এরা প্রত্যেকেই প্রায়োগিক ও কারিগরি ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, কিন্তু তাতে মানবিক সমস্যাগুলো বেড়েছে বৈকি, কমার পরিবর্তে। মানবিক সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে নিজের এবং অপরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, যেমন- ভালোবাসা, স্নেহ, মৈত্রী, শোষণ। অবাধ তথ্যপ্রবাহ ধনবৈষম্য হ্রাস করবে এমন সম্ভাবনা একবারেই নেই; এই প্রবাহ নিজেই বরঞ্চ বৈষম্য বৃদ্ধির একটি নতুন উপাদান হয়ে দাঁড়াবে, পার্থক্য দাঁড়াবে প্রবাহের সুযোগভোগকারী ও সুযোগবঞ্চিতদের মধ্যে। ওদিকে মুক্তবাজার অর্থনীতি দুর্বল ও স্থানীয় উৎপাদন উদ্যমগুলোকে একেবারে পথে বসিয়ে দিচ্ছে। পুঁজিবাদী বিশ্ব দরিদ্র বিশ্বে ভোগ্যপণ্য তো বটেই, সমরাস্ত্র ও প্রকৌশল বিক্রি করছে, লগ্নি পুঁজি পাঠাচ্ছে, যেমন বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে, তেমনি ঋণের সাহায্যে।

এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ জমে উঠছে, খোদ পুঁজিবাদী দেশগুলোতেই পুঁজিবাদবিরোধী বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। মূল যে সমস্যা, সেটি শোষণের, তাকে অস্পষ্ট করার জন্য নানা প্রকার তাত্ত্বিক ও দার্শনিক বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ১৯৮৯-তে ফুকুয়ামা নামে এক ভদ্রলোক একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘দ্য অ্যান্ড অব হিস্ট্রি’ নাম দিয়ে; প্রবন্ধের শিরোনামে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছিল, পরে প্রবন্ধটির বক্তব্য যেভাবে প্রচার পেয়েছে তাতে কোনো প্রশ্ন নেই, যেন গোটা পুঁজিবাদী বিশ্বেরই প্রশ্নহীন বক্তব্য এটি। সেটি এই যে, ইতিহাস তার গন্তব্যে পৌঁছে গেছে; এখন অতীতের স্মৃতি অনাবশ্যক, প্রত্নতত্ত্ব তবু পাঠ করা যাবে, ইতিহাস পাঠ করে লাভ নেই, কেননা এখন বর্তমানই প্রলম্বিত হবে ভবিষ্যতের দিকে এবং সেই ভবিষ্যৎ দ্বন্দ্ববিহীন সুখের।

পুঁজিবাদীরা আজ এই কথাটাই বলতে চাইছে। তারা নানা রকমের সমাধিফলক রচনায় ব্যস্ত। বলছে মৃত্যু ঘটেছে সর্বজনীনতার এবং আদর্শবাদের। সেই রেনেসাঁসের কাল থেকে এই বিশ্বাস মানুষের মনে বিকশিত হচ্ছিল যে, মনুষ্যত্বের একটি কেন্দ্রীয় সত্তা আছে, যেটা সর্বজনীনও বটে। বিশেষ করে জার্মান দেশীয় দার্শনিকরা ওই সর্বজনীনতার ওপর জোর দিয়ে আসছিলেন। সর্বজনীনতার কথা কান্ট, হেগেল বলেছেন, মার্কসও বলেছেন। পরবর্তীকালে মার্কসের সর্বজনীনতাই সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে, কেননা তাতে রয়েছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে এবং শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যে ধ্বংস হবে এই অনিবার্যতার কথা। মৃত্যুর নানাবিধ সংবাদ ঊনবিংশতেও প্রচার পেয়েছিল; ঔপন্যাসিকরা বলেছেন তারা নায়ককে খুঁজে পাচ্ছেন না, সম্ভবত সে মারা গেছে; দার্শনিক নিৎশে বলেছেন, ঈশ্বর চলে গেছেন পরলোকে। কিন্তু এসব সংবাদে সর্বজনীনতাকে অস্বীকার করা হয়নি। অধুনা যা বলা হচ্ছে তা হলো, সর্বজনীন বলে কিছু নেই। সবকিছুই আপেক্ষিক; তাই সবার জন্য গ্রহণযোগ্য কোনো আদর্শও থাকবে না, থাকবে বহু চিন্তা, বিভিন্ন আদর্শ। স্বপ্ন থাকবে, তবে সেটা যোদ্ধাদের স্বপ্নের মতো সমষ্টিগত নয়, ভিক্ষুকের স্বপ্নের মতো ব্যক্তিগত। অথচ আদর্শ যে নেই, এই দাবিটাও একটি আদর্শের প্রচারই আসলে এবং একে দাঁড় করানো হচ্ছে সর্বজনীন সত্য হিসেবেই। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মতো পুঁজিবাদী আদর্শও চাইছে একচেটিয়া আধিপত্য। প্রচারণার মূল উদ্দেশ্যটা প্রচ্ছন্ন রাখা হচ্ছে। সেটা হলো শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বের যে সর্বজনীনতা ও আদর্শবাদ তাকে দুর্বল করা। এ কাজে তথাকথিত উত্তর-আধুনিকতার প্রবক্তারা বেশ পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছেন। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছেন দুজন, ফুকো এবং দেরিদা। ফুকো মার্কসবাদকে অস্বীকার করছেন না, কিন্তু বলছেন, শ্রেণি সম্পর্কই একমাত্র সম্পর্ক নয়। মূল ব্যাপারটা হচ্ছে ক্ষমতার, ক্ষমতার ক্ষেত্রে বর্ণ আছে, রয়েছে নারী-পুরুষ সম্পর্ক। ফুকো আরও বলছেন, মানুষ হচ্ছে একটি বহুমাত্রিক প্রাণী, তাকে বুঝতে হলে অনেক কিছুকে বিবেচনায় আনতে হবে; নৃতত্ত্ব, জ্ঞানতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, যৌনতা, আকাঙ্ক্ষা, উন্মাদনা, ভাষাতত্ত্ব, শৃঙ্খলা- এসব কোনো কিছুই অগ্রাহ্য নয়। তা গ্রাহ্য নিশ্চয়ই, দ্বন্দ্বও আছে বহুবিধ। কিন্তু সামাজিক ক্ষেত্রে প্রধান যে দ্বন্দ্ব, সেটি যে শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির, সেই সত্যটার কী হবে? উত্তর-আধুনিকতার অভিপ্রায় ওই দ্বন্দ্বকে অনেক দ্বন্দ্বের একটিতে পর্যবসিত করা এবং আপেক্ষিকতাকে সামনে নিয়ে আসা, যাতে করে নিপীড়িত মানুষ ও তাদের পক্ষাবলম্বীরা প্রধান দ্বন্দ্বের মীমাংসাকে আশু কর্তব্যজ্ঞান করে সংঘবদ্ধ না হতে পারে, যাতে তারা বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়ে পড়ে, যুদ্ধটা ভুলে যায়।

 বহুমাত্রিকতা ও আপেক্ষিকতার এই ধারণা আসলে মানুষকে দ্বিমাত্রিক করে তুলতে চায়, তার ভেতরকার দার্শনিক সামগ্রিকতা ও প্রতিরোধের সজীবতাকে নষ্ট করে দিয়ে তাকে তেমন প্রাণীতে পরিণত করতে চায়, যার জগতে বিষয় থাকবে প্রচুর কিন্তু বিষয়ী থাকবে না এবং বিষয়ের ঘাত-প্রতিঘাতে সে কখনো অস্থির কখনো নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকবে। মার্কসবাদীরা ইতিহাসকে প্রায় ঈশ্বরের মর্যাদা দিতে চায়; উত্তর-আধুনিকরা ইতিহাসকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলতে আগ্রহী, তারা বলতে চায় যে, ইতিহাস এক নয়, বহুবিধ; মানুষ যেমন সামগ্রিক নয়, বহু খণ্ডে বিভক্ত, ইতিহাসও তেমনি বিক্ষিপ্ত। শত্রু তো একটা নয়, অনেক এবং তাদের শত্রুতাও আপেক্ষিক, স্থান-কাল-পাত্রভেদে বিভিন্ন; তাহলে কার বিরুদ্ধে কীভাবে স্বতঃস্ফূর্ত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়বে তুমি? তার চেয়ে ভালো নিজেরটা দেখা। পরামর্শটা এই প্রকারের। এ হচ্ছে বিচ্ছিন্নকে আরও বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা, যাতে তারা যুদ্ধ ছেড়ে ভিক্ষার দিকে চলে যায়। উত্তর-আধুনিকতা খুবই চটপটে, কিন্তু তার কারণ হয়তো এই যে, তার ভেতরে বস্তুর অসদ্ভাব।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

পড়ালেখা ডিভাইসে, শিক্ষার্থীরা সংকটে

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫:১৩ পিএম
পড়ালেখা ডিভাইসে, শিক্ষার্থীরা সংকটে

বিগত কয়েক বছরে যেকোনো অজুহাতে অটো পাসের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তার প্রভাব পড়েছে গোটা শিক্ষাব্যবস্থায়। অনেক শিক্ষার্থীর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বেসিক পড়াশোনা দুর্বল হওয়ায় উচ্চশিক্ষায় এসেও তারা হিমমিশ খাচ্ছে। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমসিকিউ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা হওয়ায় যথাযথ মেধা মূল্যায়ন হচ্ছে কি না, সেটিও পরিষ্কার নয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত মেধা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া যথাযথভাবে না হওয়ায় অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের মধ্যে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ 
পেয়ে যাচ্ছে।...

আমার সন্তান ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থী। ইতোমধ্যেই তার শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে। এ বছর এখনো নতুন বইয়ের ঘ্রাণ পায়নি। ডাউনলোডকৃত বইয়ের অংশবিশেষ প্রিন্ট করে নিয়মিত ক্লাসে নিয়ে যায়। প্রায় প্রতিদিনই আমি নিজে প্রয়োজনীয় পাঠ্যাংশ প্রিন্ট করে দিই। অবশ্য এ সুযোগটি দেশের সব শিশু পাচ্ছে না। কারণ প্রিন্ট করে দেওয়ার মতো সামর্থ্যও অনেকের নেই। আর এ কারণে অনেকেরই পড়াশোনার যথেষ্ট ব্যাঘাত ঘটছে। গত ২০ জানুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘স্কুলে বই গেছে কম, লেখাপড়া টেনেটুনে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন পড়লাম। সেখানে বিস্তর বর্ণনা করা হয়েছে বিদ্যালয় পর্যায়ে বই এবং পড়াশোনার হালহকিকত নিয়ে। বিশেষ করে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এখনো বই পায়নি বলে বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। 


ইতোমধ্যেই জানুয়ারি মাসের তিন সপ্তাহ চলে গেলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণ না হওয়ায় সারা দেশের শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক যে হতাশ, সে বিষয়েও ওই প্রতিবেদনে তথ্য উঠে এসেছে। অবশ্য অনেক বিদ্যালয়ে ইতোমধ্যেই বাংলা ভার্সনের বই পৌঁছে গেছে। কিন্তু ইংরেজি ভার্সনের বইয়ের দেখা এখন পর্যন্ত নেই বললেই চলে। আবার বাংলা ভার্সনের বই সব শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পায়নি। শিক্ষা বিভাগ থেকে বলা হচ্ছে, সব বই পেতে ফেব্রুয়ারি মাস লেগে যাবে। মার্চের শুরু থেকেই পবিত্র রমজান মাস। সাধারণত রমজানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় বেশি সময়জুড়েই ছুটি থাকে। তা ছাড়া রমজান মাসে পড়াশোনায় কিছুটা ঢিলেঢালা থাকাটাটাই স্বাভাবিক। মার্চের শেষে পবিত্র ঈদ। ঈদের পর বিদ্যালয় খুলতে খুলতে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ চলে যাবে। তাহলে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মোটামুটিভাবে নতুন বই ছাড়াই শিক্ষার্থীদের একটা অংশ পড়াশোনা করবে। 

অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে, সময় চলে যাচ্ছে কিন্তু পড়াশোনা কি হচ্ছে? এসব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আমরা কিছুটা হতাশ হই। আমাদের মনে সব সময়ই একটা শঙ্কা তৈরি হয় যে, আমাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ায় কি ঠিকমতো এগোতে পারছে। নিয়মিত পড়াশোনার সুযোগ থাকছে কি না, সেটিও এখন আমাদের ভাবনার কারণ হয়ে উঠেছে। করোনার সময় থেকে আমাদের দেশের প্রায় সর্বস্তরের শিক্ষার্থী বিভিন্নভাবে পড়াশোনাবিমুখ হয়েছে। বিশেষ করে স্কুলের শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল ডিভাইসকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। যাদের ডিজিটাল ডিভাইস ছিল না, তারাও এখন ডিভাইস ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছে। পড়াশোনার স্বার্থে কোনো রকমে অর্থ জোগাড় করে অভিভাবকরা ডিজিটাল ডিভাইস কিনেছে তাদের বাচ্চাদের জন্য। আমি অনেক অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলেছি ডিজিটাল ডিভাইসের বিষয়ে। তারা আমাকে জানিয়েছে, এসব ডিভাইসের ফলে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা শেষ হয়ে গেছে। তারা অনেকটা সময় গেম কিংবা ইউটিউবে কাটায়। অনেক সময় রাত জেগে বন্ধুদের সঙ্গে অনলাইনে আড্ডা দিচ্ছে। পরীক্ষার সময় এলে কোনো রকমে পড়াশোনা করে পরীক্ষার হলে যাচ্ছে। এ বছর বই পেতে পেতে তিন মাস চলে যাওয়ায় ডাউনলোডকৃত বই পড়ার জন্যও ডিজিটাল ডিভাইসের প্রয়োজনীয়তা নতুন করে দেখা গেছে। 

ঈদের ছুটিসহ যদি বছরের প্রথম তিন থেকে চার মাস পড়াশোনা না করেই কেটে যায়, তাহলে আমাদের বাচ্চাদের পরিণতি কী হতে পারে! এর পরই শুরু হবে দ্রুত শর্টকার্ট পদ্ধতিতে সিলেবাস শেষ করে পরীক্ষার প্রস্তুতি। অবশ্য যাদের সামর্থ্য আছে তারা কেউ কেউ পুরো বই প্রিন্ট করে নিয়েছে। আবার ঢাকায় নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানেও টাকার বিনিময়ে বোর্ডের বই পাওয়া যাচ্ছে। নীলক্ষেতের মীম বুক হাউস, প্রিমিয়ার বুক হাউস, আরাফাত বুক হাউস, শহীদ বুক সেন্টার, বুক লাইন এবং আরিয়ান বুক লাইব্রেরিসহ বিভিন্ন লাইব্রেরিতে সরকারের বিনামূল্যের পাঠ্যবই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে (বাংলা ট্রিবিউন, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫)।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পড়ালেখার বিষয়ে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে অনেকেই চিন্তিত হয়ে উঠেছি। বিশেষ করে ডিজিটাল ডিভাইসের কারণে বাচ্চারা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইদানীং আমরা লক্ষ করছি অসংখ্য বাচ্চার চোখে চশমা লেগে গেছে। কারণ হিসেবে অত্যধিক ডিভাইস ব্যবহার করে গেম খেলাকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। আমরা বেশির ভাগ অভিভাবকই শঙ্কিত হচ্ছি পড়ালেখার মান এবং হালহকিকত দেখে। 

তা ছাড়া বিগত কয়েক বছরে যেকোনো অজুহাতে অটো পাসের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তার প্রভাব পড়েছে গোটা শিক্ষাব্যবস্থায়। অনেক শিক্ষার্থীর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বেসিক পড়াশোনা দুর্বল হওয়ায় উচ্চশিক্ষায় এসেও তারা হিমমিশ খাচ্ছে। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমসিকিউ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা হওয়ায় যথাযথ মেধা মূল্যায়ন হচ্ছে কি না, সেটিও পরিষ্কার নয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত মেধা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া যথাযথভাবে না হওয়ায় অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের মধ্যে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় আছি বিধায় শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার, কর্মসংস্থান প্রাসঙ্গিকভাবে আমাদের ভাবতে হয়। এমনকি শিক্ষার্থীদের মান এবং যোগ্যতার বিষয়েও আমাদের নজর বাদ পড়ে না। প্রতিবছর নবীন শিক্ষার্থীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে পা দেয়, তখন থেকেই তাদের জীবন ও করণীয় বিষয়ক আলোচনায় তারা নিজেরাই তাদের দুর্বলতার কথা স্বীকার করে। এসব পরিস্থিতির দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য ইতোমধ্যেই বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গঠন নিয়ে সংকট তৈরি হচ্ছে। শিশু শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশেষ আচরণগত পরিবর্তন যেমন হয়েছে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদেরও আচরণের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা এখন সহজেই সবকিছু পাবে- এমন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যেকোনোভাবে শিক্ষার্থীরা শুধু ক্লাস বদল করতে পারলেই খুশি হচ্ছে। যথার্থ জ্ঞান অর্জন হচ্ছে কি না, তা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই শিক্ষার্থীদের। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম খুব ইতিবাচকভাবে যে এগোচ্ছে না, সেটি মোটামুটি ধারণা করা যায়।

নানা ক্ষেত্রে শিক্ষায় যে বেহাল দশার উদ্ভব হয়েছে তা থেকে মুক্তি পাওয়া কোনো এক অজানা কারণে সম্ভব হয়ে উঠছে না। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে শিক্ষাব্যবস্থার চরম ভঙ্গুর অবস্থা তৈরি হতে আর বাকি থাকবে না। কাজেই শিক্ষা উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান সংকট চিহ্নিত করে একটি সুন্দর কাঠামোগত শিক্ষাব্যবস্থা আগামীর বাংলাদেশের জন্য উপহার দেবেন।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]