পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানসহ সব সংখ্যালঘু মানুষকে জ্যোতিবাবুর আমলে প্রশাসন যে ধরনের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং প্রশাসনিক নিরাপত্তা দিয়েছে, এমন নিরাপত্তা আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুকে ’৪৭-এর স্বাধীনতার পর থেকে কেউ দিতে পারেনি। সেই জায়গাটিকে অব্যাহত রাখার যে ধারাবাহিকতা বামপন্থিরা যখন শাসনক্ষমতায় ছিল, তখন রাখা দরকার ছিল, সেটা কিন্তু রক্ষিত হয়নি।...
ভারতে বামপন্থি-দক্ষিণপন্থি যেসব রাজনৈতিক দল আছে তার মধ্যে সিপিআই (এম), সিপিআই এবং সিপিআই (এমএল) লিবারেশন- এই তিনটি দল প্রতি তিন বছর অন্তর তাদের সংগঠনের একেবারে ভূমিস্তর পর্যন্ত সম্মেলন করে, রাজনৈতিক কার্যক্রমের চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করে, প্রয়োজনে ভোটের সাহায্য নিয়েও একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিজেদের দলের মধ্যে বজায় রাখে। প্রত্যেকটি স্তরের সম্মেলনে বিগত তিন বছরে তাদের কার্যক্রমের খতিয়ান নিয়ে তারা আলোচনা করে এবং আগামী তিন বছর তারা তাদের কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত করবে তারও একটা রূপরেখা নির্মাণের চেষ্টা করে। সেই রূপরেখাটি চূড়ান্ত রূপ পায় তাদের পার্টি কংগ্রেস।
এ ছাড়া এসইউসি, ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি ইত্যাদি কিছু দল আছে, যারা নিজেদের বাইরে একটা বামপন্থি লেবাস রাখতে পছন্দ করে। বামপন্থিদের সঙ্গে একটা সংযোগ রেখে তারা ভোট রাজনীতির ক্ষেত্রে অতীতেও নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে এসেছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ভারতে বামপন্থাকে প্রতিরোধ করে, দক্ষিণ পন্থার বিকাশের ক্ষেত্রে এসব রাজনৈতিক দল বেশির ভাগ সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
অতি বিপ্লবীয়ানার পর্যায়ক্রমের ভেতর দিয়ে আরসিপিআই, আরএসপি এবং এসইউসি নিজেদের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে কীভাবে ’৪৭-পূর্ববর্তী সময়কাল থেকেই কমিউনিস্টের নিধন করে, দক্ষিণপন্থি শক্তিকে, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে, মৌলবাদী শক্তিকে জোরদার করার লক্ষ্যে কাজ করে গেছে, তা সোমেন চন্দ হত্যাকাণ্ড, তিন আর চারের দশকে ঢাকার দাঙ্গা, সর্দার ফজলুল করিমের আত্মজীবনী এসব কিছুর মধ্যেই প্রমাণ জড়িয়ে আছে।
পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের সব রাজ্যে সিপিআই (এম) দলটির আসন্ন পার্টি কংগ্রেস উপলক্ষে সর্বস্তরের সম্মেলন চলছে। পশ্চিমবঙ্গের তাদের রাজ্য সম্মেলন আসন্ন। পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই (এম) দলের বিগত রাজ্য সম্মেলনে বিশিষ্ট বামপন্থি ব্যক্তিত্ব সিপিআই (এম) নেতা, তাদের দলের সর্বোচ্চ স্তর পলিটব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিম রাজ্য সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের একাধিক বহুল প্রচলিত খবরের কাগজে লেখা হতে শুরু করে হাওড়া জেলার এক নেতা নাকি রাজ্য সম্পাদক হচ্ছেন। সংবাদকর্মীদের মধ্যে গবেষণা শুরু হয়ে যায় সেই রাজ্য নেতাকে নিয়ে। প্রচারদুনিয়া পাল্লাটাকে তার বেশ উঠিয়ে রাখতেই শুরু করে। যে ব্যক্তির পক্ষে সেদিন প্রচার তুঙ্গে উঠেছিল, সেই ব্যক্তি সিপিআই (এম) দলের অভ্যন্তরীণ পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব।
কিন্তু দলের নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলের বাইরে গোটা বামপন্থি বা দক্ষিণপন্থি রাজনীতি-সচেতন বা রাজনীতিবিমুখ কোনো অংশের কাছেই কোনো স্তরে পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন না তিনি। এ জন্য এই ব্যক্তিত্বকে সামনে রেখে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে সিপিআই (এমে)-এর কোনো সুবিধা হবে না- এটা বুঝতে পেরেই যাতে সিপিআই (এমে)-এর রাজনৈতিক অস্তিত্বের দিকটি আরও বেশি রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাই-ই একটা বড় অংশের সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে প্রচার শুরু করেছিল।
গৌতম দেবের খাস তালুক বসিরহাট ইত্যাদি অঞ্চলের দাঙ্গাকে ঘিরে গৌতম দেব সরাসরি দাঙ্গাকারী হিসেবে মুসলমানদের চিহ্নিত করেছেন। দল-মতনির্বিশেষে পবিত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষকে তিনি চিহ্নিত করেছেন। এ ঘটনা সমাজমাধ্যমে আমরা দেখেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, একে ঘিরে সিপিআই (এম) দল কখনো কোনো রকম ব্যবস্থা গৌতম দেবের বিরুদ্ধে গ্রহণ করেনি। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই (এম) দলের সঙ্গে মুসলমান সম্প্রদায়ের যে বিচ্ছেদ, তার অন্যতম প্রধান কারিগর এই গৌতম দেব। নিউ টাউন, সেক্টর ফাইভ তৈরি করার স্বার্থে গৌতম দেব যেভাবে রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে ওই অঞ্চলের গরিব কৃষিজীবী মুসলমানদের বাস্তচ্যুত করেছেন নানা ধরনের ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে, এটা ইতিহাসের কলঙ্ক।
২০১১ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাদের মূল শক্তি সিপিআই (এম)-এর সংগঠন যতই কমজোরি হয়ে পড়ুক না কেন, আজ দীর্ঘদিন ধরে লোকসভায় বা রাজ্য বিধানসভায় সিপিআই (এম) দলের একজন প্রতিনিধিও নির্বাচিত হয়ে যেতে পারেননি। এমন দুরবস্থা কিন্তু সামগ্রিকভাবে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিদের নয়। বুদ্ধদেব বাবুকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যেভাবে সিপিআই (এম)-এর ভেতরে একটা অংশ এবং বামফ্রন্টভুক্ত দলগুলো একসঙ্গে মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে বা তার সহযোগীদের সঙ্গে কোথাও প্রকাশ্যে, কোথাও গোপনে বন্দোবস্তি করেছিল, ঠিক সেই রকম পরিবেশ পরিস্থিতির জন্যই আজ পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোকসভা বা বিধানসভায় একজন বামপন্থি প্রতিনিধি নেই।
বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর একটা সময়ে সিপিআই (এম) দলের বা বামফ্রন্টের অন্যান্য দলের যেসব ডাকাবুকো ব্যক্তিত্বরা এখন তৃণমূল কংগ্রেসে অবস্থান করছেন বা বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ, ক্ষমতা ভোগ করছেন, যেমন- লক্ষ্মণ শেঠ, আবদুর রেজ্জাক মোল্লা, মইনুল হাসান ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, আবদুস সাত্তার প্রমুখ। এসব লোকের মাস্টার্ড মাইন্ড কে ছিলেন, পরিচালক কে ছিলেন, সেগুলোর দিকে নজর রাখলেই গোটা ব্যাপারটা আমাদের কাছে পরিষ্কার হবে। এ কথা ’১১ সালের নির্বাচনেও ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত বিধায়ক উদয়ন গ্রহ সম্পর্কে ও প্রযোজ্য।
নির্বাচনে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্র থেকে পরাজিত হন সিপিআই (এম) প্রার্থী মইনুল হাসান। পরবর্তীকালে একজন হেরে যাওয়া প্রার্থীকে ওই দল রাজ্যসভায় পাঠায়। সেই ব্যক্তিই কীভাবে এখন তৃণমূল কংগ্রেসে বিরাজ করছেন এবং সিপিআই (এম) দলে অবস্থানকালে কে তার মূল পরিচালক ছিল তার অনুসন্ধান কি হয়েছে? মইনুল আর তার সাগরেদরা কীভাবে সিপিআই (এম) দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো, ধর্মনিরপেক্ষ পরিকাঠামো, সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ, সর্বোপরি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে বিনষ্ট করার জন্য আদা-জল খেয়ে নেমেছিল, যার ফল আজকে শুধু সিপিআই (এম) দল নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে, সেটা অনুসন্ধান করলেই বুঝতে পারা যাবে যে, বামপন্থিদের সব সভা-সমিতিতেও এত ভিড় হওয়া সত্ত্বেও কেন ভোট রাজনীতিতে খাতা খুলতে পারছে না বামপন্থিরা।
তবু কিন্তু বাংলার মুসলমানদের সার্বিক আস্থার দিক সব সময় ধ্বনিত হয়েছে জ্যোতিবাবুর প্রতি। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানসহ সব সংখ্যালঘু মানুষকে জ্যোতিবাবুর আমলে প্রশাসন যে ধরনের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং প্রশাসনিক নিরাপত্তা দিয়েছে, এমন নিরাপত্তা আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুকে ’৪৭-এর স্বাধীনতার পর থেকে কেউ দিতে পারেনি। সেই জায়গাটিকে অব্যাহত রাখার যে ধারাবাহিকতা বামপন্থিরা যখন শাসনক্ষমতায় ছিল, তখন রাখা দরকার ছিল, সেটা কিন্তু রক্ষিত হয়নি।
প্রচণ্ডভাবে সমালোচিত হব জেনেও অত্যন্ত সচেতনভাবেই লিখছি, অটল বিহারি বাজপেয়ির প্রধানমন্ত্রিত্বকালে মাদ্রাসা এবং জঙ্গি ঘিরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যে মন্তব্য করেছিলেন, তা পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের হৃদয় থেকে আজও জুড়িয়ে যায়নি। আর এই সুযোগটাকেই ছলেবলে কৌশলে ব্যবহার করে, বামপন্থিদের ক্ষমতাকে খাটো করে, দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতার পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখল এবং ক্ষমতাসীন থাকার এই অন্যতম কারণটির পাশাপাশি একটা কথা অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলতে হয়, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থি আন্দোলনের নেতৃত্ব ভাগ সেলিমের হাতে অর্পিত হওয়ার পর, বামপন্থি আন্দোলনের ধারা, উপধারা যে কল্লোলিনী স্রোতে প্রবাহিত হচ্ছে, তা ঐতিহাসিক হলেও, বামপন্থিদের নিজেদের মধ্যেই নিজেদের পিঠে ছুরি মারার প্রবণতা আর তা ঘিরে ভোট রাজনীতিতে তার যে প্রভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা ভয়ংকর।
পার্টির নির্দেশকে শিরোধার্য করে পার্টি প্রতিনিধিকে জেতাতে হবে- এই জায়গাটি আজকের ভূমিস্তরে একটা বড় অংশের বামপন্থিরা যে ভুলে গেছে নৈহাটি বিধানসভার সম্প্রতিক উপনির্বাচন থেকে তা আমরা দেখতে পেলাম। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বামফ্রন্টভুক্ত দলগুলোর একটা বড় অংশ, ভূমিস্তরের কর্মীরা, বৃহত্তর বাম ঐক্যের প্রশ্নে কোনো রকম রাজনৈতিক বোধগম্যতার মধ্যেই নিজেদের রাখতে জানেন না।
বুর্জোয়া রাজনীতির যে ঝোঁক, তাকে অনুসরণ করে তারা নিজের পছন্দমতো ব্যক্তি প্রার্থী না হলেই পার্টি নির্দেশিত প্রার্থীকে যে হারাবে, তার পুনরাবৃত্তি আমরা ঠিক ১৯৮৭ সালের মতোই নৈহাটি বিধানসভার উপনির্বাচনে আবার দেখলাম।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গল্পকার
[email protected]