ঢাকা ৫ মাঘ ১৪৩১, রোববার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫

সিপিআই (এম)-এর পার্টি কংগ্রেস প্রসঙ্গে

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:১৭ এএম
সিপিআই (এম)-এর পার্টি কংগ্রেস প্রসঙ্গে
গৌতম রায়

পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানসহ সব সংখ্যালঘু মানুষকে জ্যোতিবাবুর আমলে প্রশাসন যে ধরনের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং প্রশাসনিক নিরাপত্তা দিয়েছে, এমন নিরাপত্তা আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুকে ’৪৭-এর স্বাধীনতার পর থেকে কেউ দিতে পারেনি। সেই জায়গাটিকে অব্যাহত রাখার যে ধারাবাহিকতা বামপন্থিরা যখন শাসনক্ষমতায় ছিল, তখন রাখা দরকার ছিল, সেটা কিন্তু রক্ষিত হয়নি।...

ভারতে বামপন্থি-দক্ষিণপন্থি যেসব রাজনৈতিক দল আছে তার মধ্যে সিপিআই (এম), সিপিআই এবং সিপিআই (এমএল) লিবারেশন- এই তিনটি দল প্রতি তিন বছর অন্তর তাদের সংগঠনের একেবারে ভূমিস্তর পর্যন্ত সম্মেলন করে, রাজনৈতিক কার্যক্রমের চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করে, প্রয়োজনে ভোটের সাহায্য নিয়েও একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিজেদের দলের মধ্যে বজায় রাখে। প্রত্যেকটি স্তরের সম্মেলনে বিগত তিন বছরে তাদের কার্যক্রমের খতিয়ান নিয়ে তারা আলোচনা করে এবং আগামী তিন বছর তারা তাদের কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত করবে তারও একটা রূপরেখা নির্মাণের চেষ্টা করে। সেই রূপরেখাটি চূড়ান্ত রূপ পায় তাদের পার্টি কংগ্রেস।

এ ছাড়া এসইউসি, ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি ইত্যাদি কিছু দল আছে, যারা নিজেদের বাইরে একটা বামপন্থি লেবাস রাখতে পছন্দ করে। বামপন্থিদের সঙ্গে একটা সংযোগ রেখে তারা ভোট রাজনীতির ক্ষেত্রে অতীতেও নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে এসেছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ভারতে বামপন্থাকে প্রতিরোধ করে, দক্ষিণ পন্থার বিকাশের ক্ষেত্রে এসব রাজনৈতিক দল বেশির ভাগ সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। 

অতি বিপ্লবীয়ানার পর্যায়ক্রমের ভেতর দিয়ে আরসিপিআই, আরএসপি এবং এসইউসি নিজেদের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে কীভাবে ’৪৭-পূর্ববর্তী সময়কাল থেকেই কমিউনিস্টের নিধন করে, দক্ষিণপন্থি শক্তিকে, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে, মৌলবাদী শক্তিকে জোরদার করার লক্ষ্যে কাজ করে গেছে, তা সোমেন চন্দ হত্যাকাণ্ড, তিন আর চারের দশকে ঢাকার দাঙ্গা, সর্দার ফজলুল করিমের আত্মজীবনী এসব কিছুর মধ্যেই প্রমাণ জড়িয়ে আছে।

পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের সব রাজ্যে সিপিআই (এম) দলটির আসন্ন পার্টি কংগ্রেস উপলক্ষে সর্বস্তরের সম্মেলন চলছে। পশ্চিমবঙ্গের তাদের রাজ্য সম্মেলন আসন্ন। পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই (এম) দলের বিগত রাজ্য সম্মেলনে বিশিষ্ট বামপন্থি ব্যক্তিত্ব সিপিআই (এম) নেতা, তাদের দলের সর্বোচ্চ স্তর পলিটব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিম রাজ্য সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের একাধিক বহুল প্রচলিত খবরের কাগজে লেখা হতে শুরু করে হাওড়া জেলার এক নেতা নাকি রাজ্য সম্পাদক হচ্ছেন। সংবাদকর্মীদের মধ্যে গবেষণা শুরু হয়ে যায় সেই রাজ্য নেতাকে নিয়ে। প্রচারদুনিয়া পাল্লাটাকে তার বেশ উঠিয়ে রাখতেই শুরু করে। যে ব্যক্তির পক্ষে সেদিন প্রচার তুঙ্গে উঠেছিল, সেই ব্যক্তি সিপিআই (এম) দলের অভ্যন্তরীণ পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। 

কিন্তু দলের নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলের বাইরে গোটা বামপন্থি বা দক্ষিণপন্থি রাজনীতি-সচেতন বা রাজনীতিবিমুখ কোনো অংশের কাছেই কোনো স্তরে পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন না তিনি। এ জন্য এই ব্যক্তিত্বকে সামনে রেখে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে সিপিআই (এমে)-এর কোনো সুবিধা হবে না- এটা বুঝতে পেরেই যাতে সিপিআই (এমে)-এর রাজনৈতিক অস্তিত্বের দিকটি আরও বেশি রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাই-ই একটা বড় অংশের সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে প্রচার শুরু করেছিল।

গৌতম দেবের খাস তালুক বসিরহাট ইত্যাদি অঞ্চলের দাঙ্গাকে ঘিরে গৌতম দেব সরাসরি দাঙ্গাকারী হিসেবে মুসলমানদের চিহ্নিত করেছেন। দল-মতনির্বিশেষে পবিত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষকে তিনি চিহ্নিত করেছেন। এ ঘটনা সমাজমাধ্যমে আমরা দেখেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, একে ঘিরে সিপিআই (এম) দল কখনো কোনো রকম ব্যবস্থা গৌতম দেবের বিরুদ্ধে গ্রহণ করেনি। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই (এম) দলের সঙ্গে মুসলমান সম্প্রদায়ের যে বিচ্ছেদ, তার অন্যতম প্রধান কারিগর এই গৌতম দেব। নিউ টাউন, সেক্টর ফাইভ তৈরি করার স্বার্থে গৌতম দেব যেভাবে রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে ওই অঞ্চলের গরিব কৃষিজীবী মুসলমানদের বাস্তচ্যুত করেছেন নানা ধরনের ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে, এটা ইতিহাসের কলঙ্ক।

২০১১ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাদের মূল শক্তি সিপিআই (এম)-এর সংগঠন যতই কমজোরি হয়ে পড়ুক না কেন, আজ দীর্ঘদিন ধরে লোকসভায় বা রাজ্য বিধানসভায় সিপিআই (এম) দলের একজন প্রতিনিধিও নির্বাচিত হয়ে যেতে পারেননি। এমন দুরবস্থা কিন্তু সামগ্রিকভাবে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিদের নয়। বুদ্ধদেব বাবুকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যেভাবে সিপিআই (এম)-এর ভেতরে একটা অংশ এবং বামফ্রন্টভুক্ত দলগুলো একসঙ্গে মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে বা তার সহযোগীদের সঙ্গে কোথাও প্রকাশ্যে, কোথাও গোপনে বন্দোবস্তি করেছিল, ঠিক সেই রকম পরিবেশ পরিস্থিতির জন্যই আজ পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোকসভা বা বিধানসভায় একজন বামপন্থি প্রতিনিধি নেই। 

বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর একটা সময়ে সিপিআই (এম) দলের বা বামফ্রন্টের অন্যান্য দলের যেসব ডাকাবুকো ব্যক্তিত্বরা এখন তৃণমূল কংগ্রেসে অবস্থান করছেন বা বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ, ক্ষমতা ভোগ করছেন, যেমন- লক্ষ্মণ শেঠ, আবদুর রেজ্জাক মোল্লা, মইনুল হাসান ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, আবদুস সাত্তার প্রমুখ। এসব লোকের মাস্টার্ড মাইন্ড কে ছিলেন, পরিচালক কে ছিলেন, সেগুলোর দিকে নজর রাখলেই গোটা ব্যাপারটা আমাদের কাছে পরিষ্কার হবে। এ কথা ’১১ সালের নির্বাচনেও ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত বিধায়ক উদয়ন গ্রহ সম্পর্কে ও প্রযোজ্য।

নির্বাচনে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্র থেকে পরাজিত হন সিপিআই (এম) প্রার্থী মইনুল হাসান। পরবর্তীকালে একজন হেরে যাওয়া প্রার্থীকে ওই দল রাজ্যসভায় পাঠায়। সেই ব্যক্তিই কীভাবে এখন তৃণমূল কংগ্রেসে বিরাজ করছেন এবং সিপিআই (এম) দলে অবস্থানকালে কে তার মূল পরিচালক ছিল তার অনুসন্ধান কি হয়েছে? মইনুল আর তার সাগরেদরা কীভাবে সিপিআই (এম) দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো, ধর্মনিরপেক্ষ পরিকাঠামো, সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ, সর্বোপরি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে বিনষ্ট করার জন্য আদা-জল খেয়ে নেমেছিল, যার ফল আজকে শুধু সিপিআই (এম) দল নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে, সেটা অনুসন্ধান করলেই বুঝতে পারা যাবে যে, বামপন্থিদের সব সভা-সমিতিতেও এত ভিড় হওয়া সত্ত্বেও কেন ভোট রাজনীতিতে খাতা খুলতে পারছে না বামপন্থিরা।

তবু কিন্তু বাংলার মুসলমানদের সার্বিক আস্থার দিক সব সময় ধ্বনিত হয়েছে জ্যোতিবাবুর প্রতি। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানসহ সব সংখ্যালঘু মানুষকে জ্যোতিবাবুর আমলে প্রশাসন যে ধরনের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং প্রশাসনিক নিরাপত্তা দিয়েছে, এমন নিরাপত্তা আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুকে ’৪৭-এর স্বাধীনতার পর থেকে কেউ দিতে পারেনি। সেই জায়গাটিকে অব্যাহত রাখার যে ধারাবাহিকতা বামপন্থিরা যখন শাসনক্ষমতায় ছিল, তখন রাখা দরকার ছিল, সেটা কিন্তু রক্ষিত হয়নি। 

প্রচণ্ডভাবে সমালোচিত হব জেনেও অত্যন্ত সচেতনভাবেই লিখছি, অটল বিহারি বাজপেয়ির প্রধানমন্ত্রিত্বকালে মাদ্রাসা এবং জঙ্গি ঘিরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যে মন্তব্য করেছিলেন, তা পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের হৃদয় থেকে আজও জুড়িয়ে যায়নি। আর এই সুযোগটাকেই ছলেবলে কৌশলে ব্যবহার করে, বামপন্থিদের ক্ষমতাকে খাটো করে, দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

মমতার পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখল এবং ক্ষমতাসীন থাকার এই অন্যতম কারণটির পাশাপাশি একটা কথা অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলতে হয়, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থি আন্দোলনের নেতৃত্ব ভাগ সেলিমের হাতে অর্পিত হওয়ার পর, বামপন্থি আন্দোলনের ধারা, উপধারা যে কল্লোলিনী স্রোতে প্রবাহিত হচ্ছে, তা ঐতিহাসিক হলেও, বামপন্থিদের নিজেদের মধ্যেই নিজেদের পিঠে ছুরি মারার প্রবণতা আর তা ঘিরে ভোট রাজনীতিতে তার যে প্রভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা ভয়ংকর।

পার্টির নির্দেশকে শিরোধার্য করে পার্টি প্রতিনিধিকে জেতাতে হবে- এই জায়গাটি আজকের ভূমিস্তরে একটা বড় অংশের বামপন্থিরা যে ভুলে গেছে নৈহাটি বিধানসভার সম্প্রতিক উপনির্বাচন থেকে তা আমরা দেখতে পেলাম। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বামফ্রন্টভুক্ত দলগুলোর একটা বড় অংশ, ভূমিস্তরের কর্মীরা, বৃহত্তর বাম ঐক্যের প্রশ্নে কোনো রকম রাজনৈতিক বোধগম্যতার মধ্যেই নিজেদের রাখতে জানেন না।

 বুর্জোয়া রাজনীতির যে ঝোঁক, তাকে অনুসরণ করে তারা নিজের পছন্দমতো ব্যক্তি প্রার্থী না হলেই পার্টি নির্দেশিত প্রার্থীকে যে হারাবে, তার পুনরাবৃত্তি আমরা ঠিক ১৯৮৭ সালের মতোই নৈহাটি বিধানসভার উপনির্বাচনে আবার দেখলাম।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গল্পকার
[email protected]

ভারতীয় রাজনীতিতে মোদি এবং তার উপলব্ধি

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:০২ পিএম
ভারতীয় রাজনীতিতে মোদি এবং তার উপলব্ধি
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

তার জন্ম জৈবিক প্রক্রিয়ায় নয়। তার শক্তির উৎস ঈশ্বরপ্রদত্ত। ঈশ্বরের অংশ আছে তার মধ্যে। লোকসভা ভোটের আগে এই কথাগুলো বলতে শোনা গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। যা নিয়ে বিস্তর বিতর্কও হয়েছে। এবার সেই মোদিই বললেন, তিনিও আর পাঁচজনের মতো সাধারণ মানুষ। কোনো ঈশ্বর নন। এমন আবোলতাবোল কথা এই প্রথম নয়, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দিন থেকেই তিনি বলে আসছেন। যেমন, তিনি বলেছিলেন, বছরে ১ কোটি লোককে চাকরি দেবেন। ভারত পাঁচ বছরের মধ্যে ১ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠবে। বিদেশ থেকে ভারতীয় শিল্পপতিদের কালো টাকা ফিরিয়ে এনে প্রত্যেক ভারতবাসীর অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা করে দেবেন ইত্যাদি। সেসব মন্তব্যের কোনো কৈফিয়ত তার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

আসলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক শিল্পপতির পডকাস্টে অতিথি হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। জিরোদার অন্যতম কর্ণধার নিখিল কামাথের ওই পডকাস্টের প্রাথমিক ঝলক প্রকাশ্যে এসেছে। সেই পডকাস্টেই কথা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শোনা গেছে, ‘আমিও সাধারণ মানুষ। কোনো দেবতা নই।’ মোদি বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন একটা ভাষণে অযাচিত মন্তব্য করেছিলাম। কিন্তু ভুল তো আমারও হয়। আমিও মানুষ।’ তবে ঠিক কী প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ওই কথা বলেছেন, সেটা স্পষ্ট নয়।

প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যকে অনেকে লোকসভা ভোটের আগে তার করা মন্তব্যের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রী ঘুরিয়ে দাবি করেছিলেন, তিনি পরমেশ্বরের কৃপাধন্য। এমনকি তার জন্মও আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো জৈবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। লোকসভা ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘মা যতদিন বেঁচে ছিলেন আমার মনে হতো, হয়তো জৈবিক প্রক্রিয়ায় আমার জন্ম হয়েছে। কিন্তু মায়ের মৃতুর পর নানা রকম অভিজ্ঞতা থেকে আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছি যে, আমাকে পরমায়া পাঠিয়েছেন। এত শক্তি আমি কোনো জৈবিক প্রক্রিয়া থেকে পাইনি। ঈশ্বর আমাকে দিয়ে কাজ করাতে চান, সে জন্য আমাকে এই শক্তি তিনিই দিয়েছেন। আমাকে সামর্থ্যও তিনি দিয়েছেন, সদিচ্ছাও তিনি দিয়েছেন, প্রেরণাও তিনিই দিচ্ছেন।’

প্রধানমন্ত্রী জানতেন, তার এই মন্তব্য অনেকেই অপব্যাখ্যা করবে। ভালোভাবে নেওয়া হবে না। সেটাও উল্লেখ করেন ওই সাক্ষাৎকারে। পরে দেখা যায় কংগ্রেসসহ বিরোধীরা মোদিকে ‘নন বায়োলজিক্যাল’ প্রধানমন্ত্রী বলে কটাক্ষ করেছেন। সদ্য পডকাস্টে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কি সেই কটাক্ষেরই জবাব দিলেন প্রধানমন্ত্রী?
কাউকে অনুকরণ নয়, তিনি বরাবরই ট্রেন্ড তৈরি করেছেন। পুরোনো চিন্তাভাবনা ছেড়ে নতুনত্বকে গ্রহণ করতে তার কোনো সমস্যা নেই। এই নীতি নিয়েই দেশ পরিচালনা করেন তিনি। কথা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সম্প্রতিই ডেরোধার সহ-প্রতিষ্ঠাতা নিখিল কানাথের পডকাস্ট শোতে গিয়েও প্রধানমন্ত্রী মোদি জানালেন, তিনি ‘নেশন ফার্স্ট’ নীতিতে বিশ্বাসী। দেশের উন্নয়নে এবং এই নীতির সঙ্গে যদি মিল খায়, তবে পুরোনো চিন্তাধারাকে বাদ নিয়ে নতুন চিন্তাধারা গ্রহণ করতে কোনো সমস্যা নেই। এই প্রথম কোনো পডকাস্ট শোয়ে অংশ নিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেখানে তিনি সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলেন। জানান, নির্বাচনে বিপুল জয়ে আনন্দিত হলেও, তিনি নিজের সাফল্য দেখতে পান কতটা সমস্যা সমাধান করতে পারল তার তৈরি টিম, এর মাধ্যমে।

প্রধানমন্ত্রী জানান, যুব প্রজন্মের মধ্যে তিনি অসীম ক্ষমতা ও সম্ভাবনা দেখেন। কোনো যুবনেতার মধ্যে প্রতিভা দেখেন কি না- এই প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেকের মধ্যেই সম্ভাবনা রয়েছে। এক-দুজনের নাম নিলে বাকিদের প্রতি অবিচার করা হবে।’ 

নিজের জীবনের মন্ত্রও বলে দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। জানান, তিনি ভুল করলেও কখনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু করেন না। এর ব্যাখ্যা দিয়ে পডকাস্টে তিনি বলেন, ‘যখন আমি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হই, তখন বলেছিলাম যে, কঠোর পরিশ্রম করতে কোনো খামতি রাখব না। আমি নিজের জন্য কিছু করব না। আমিও মানুষ। আমিও ভুল করি। কিন্তু খারাপ কাজ করব না। এটাকেই আমার জীবনের মন্ত্র বানিয়ে নিয়েছি। ভুল তো হবেই। আমিও নিশ্চয়ই ভুল করেছি। আমিও তো মানুষ, ঈশ্বর নই।’

কেটে গেছে দুই দশকেরও বেশি সময়। গুজরাটের গোধরায় জ্বলন্ত ট্রেন আর শয়ে শয়ে লাশের ছবি এখনো ফিকে হয়নি ভারতবাসীর মন থেকে। সে সময় সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কীভাবে এত মানুষের মৃতুযন্ত্রণা চেপে রেখে, মন শক্ত করে কড়া হাতে পরিস্থিতি সামলেছিলেন নরেন্দ্র মোদি, এতদিন পর সে কথাই তুলে ধরলেন এক পডকাস্ট চ্যানেলে। বললেন, ‘যতটা পেরেছি, নিজেকে সামলেছি। আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি। কল্পনা করুন, চারদিকে লাশের পাহাড়। আমি তার মাঝে দাঁড়িয়ে।’ নিখিল কামাত নামে এক সাংবাদিকের পডকাস্ট চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ২০০২ সালের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন আজকের প্রধানমন্ত্রী। সে বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন গোধরায় এই ঘটনা ঘটছে, তার ঠিক তিন দিন আগে ভোটে জিতে বিধায়ক হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। তার মধ্যে এমন চিত্র দেখে কার্যত দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে মোদি বলেন, ‘বিধানসভায় ছিলাম সেদিন। হঠাৎ খবরটা পেলাম যে গোধরায় ট্রেনে আগুন লেগে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শুনেই আমি কেঁপে উঠি। অত্যন্ত আশঙ্কা হতে থাকে। 

বিধানসভা থেকে বেরিয়ে আসি। ভাদোদরা থেকে গোধরা যেতে চাই। সে সময় কোনো কপ্টার ছিল না। আমি বলি যে, কোনো কপ্টার লাগবে না। সাধারণ মানুষ যেভাবে যাচ্ছে, সেভাবেই যাব। তা সত্ত্বেও একটা সিঙ্গল ইঞ্জিন কপ্টারের ব্যবস্থা করেছিল ওএনজিসি। তাতেই গেলাম।’

এর পরই সেই হাড়হিম করা দৃশ্য। মোদির কথায়, ‘গিয়ে দেখি, চারপাশে শুধু মানুষের দেহ ছড়িয়ে রয়েছে, পোড়া পোড়া। আমার হৃদয় ভেঙে গেল। কীভাবে যে নিজেকে সামলেছি, আমিও তো একজন মানুষ। তার পর মনে হলো, আমাকে এসবের ওপরে উঠে পরিস্থিতি অনুযায়ী সব ব্যবস্থা করতে হবে। সব যন্ত্রণা বুকে চেপে সেই কাজ করি। এই ঘটনাটা সামলানো আমার পক্ষে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ ছিল। সে সময় যেভাবে পেরেছি, পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি।’ এনিয়ে শুক্রবার সাক্ষাৎকারে তার আবেগের প্রতিফলন ঘটেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই প্রথম পডকাস্টে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আর সেখানেই মহাত্মা গান্ধীকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন তিনি। জানালেন, নেতৃত্ব ও সংযোগ স্থাপনে কীভাবে নজির গড়েছিলেন ‘জাতির জনক’। সেই সঙ্গেই ভাগ করে নিলেন রাজনীতি সম্পর্কে তার উপলব্ধিও। মোদির দাবি, রাজনীতিতে ঢোকা সহজ। কিন্তু সেখানে সাফল্য অর্জন করা সহজ নয়।
জিরোদার অন্যতম কর্ণধার নিখিল কামাথের পডকাস্টে উপস্থিত হয়েছিলেন মোদি। আর সেখানেই তাকে বলতে শোনা গেছে, ‘‘গান্ধী কখনো টুপি পরেননি। কিন্তু গোটা বিশ্ব মনে রেখেছে ‘গান্ধী টুপি’কে। 

এটাই সত্যিকারের নেতৃত্ব ও যোগাযোগের শক্তি।’’ পাশাপাশি মোদির আরও দাবি, গান্ধী নিজে সুবক্তা ছিলেন না। কিন্তু মানুষের সঙ্গে মেশার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। আর তার সাহায্যেই তিনি নিজের ব্যক্তিত্ব ও দক্ষতায় দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। এরই সঙ্গে রাজনীতিতে প্রবেশ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘রাজনীতিতে প্রবেশ সহজ। কিন্তু সাফল্য অর্জন একেবারে আলাদা একটা চ্যালেঞ্জ। রাজনীতিতে সাফল্যের জন্য প্রয়োজন গভীর আত্মোৎসর্গ, মানুষের সঙ্গে লাগাতার সংযোগ স্থাপন, তাদের ভালো ও খারাপ উভয় সময়েই। দলীয় কর্মী হিসেবে কাজ করার যোগ্যতাও থাকতে হবে। যদি কেউ বিশ্বাস করে, তার কথা সবাই শুনবে ও অনুসরণ করবে, তা নয়। এভাবে কয়েকটি নির্বাচনে জেতা যেতে পারে। কিন্তু কোনো গ্যারান্টি নেই যে, তিনি একজন সফল নেতা হয়ে উঠতে পারবেন।’

একবার নয়, পরপর তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। আর প্রতিবারই নতুন ধরনের উপলব্ধি হয়েছে তার। একটি সাক্ষাৎকারে সেই উপলব্ধি ভাগ করে নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। সঙ্গে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন অভিজ্ঞতাও শুনিয়েছেন। মোদি বলেছেন, প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সবাই তাকে দেখছিলেন, তাকে বোঝার চেষ্টা করছিলেন। আর তিনি দেখছিলেন রাজধানী দিল্লিকে।

গত শুক্রবার মোদির সাক্ষাৎকারের ২ ঘণ্টার ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। সকালে এই সাক্ষাৎকারেরই মিনিট দুয়েকের একটি ‘প্রোমো’ প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে তাকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘ভগবান নই, আমি মানুষই’। যা ইতোমধ্যে চর্চার কেন্দ্রে। ওই সাক্ষাৎকারেই তাকে তিনবারের প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। মোদি বলেছেন, ‘প্রথমবার তো আমাকে সবাই বোঝার চেষ্টা করছিল। আমি দিল্লিকে বোঝার চেষ্টা করছিলাম। দ্বিতীয়বার অতীতের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি বিচার-বিবেচনা করার চেষ্টা করতাম। অতীতের দৃষ্টিভঙ্গি কাজে লাগাতাম। কিন্তু তৃতীয়বারে আমার ভাবনা বদলে গেছে। এখন আমার মনোবল আরও জোরদার এবং স্বপ্নগুলোর পরিধিও বেড়ে গেছে।’
২০৪৭ সালের মধ্যে দেশের সব সমস্যার সমাধান করে ‘বিকশিত ভারত’ গড়ে তুলতে চান মোদি। তার কথায়, ‘সরকারি প্রকল্পের ১০০ শতাংশ পরিষেবা নিশ্চিত করতে হবে। এটাই আসল সামাজিক ন্যায় এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। এর চালিকাশক্তি এআই; অ্যাসপিরেশনাল ইন্ডিয়া (উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভারত)।
‘তুই’ বলার কেউ নেই
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাকে আর ‘তুই’ বলে ডাকার কেউ নেই, উপলব্ধি মোদির। সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই ‘বন্ধু’ হারিয়েছেন তিনি। তার কথায়, ‘মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর আমি ছোটবেলার অনেক বন্ধুকে ফোন করেছিলাম। কিন্তু ওরা সবাই আমাকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখছিল। আমাকে তুই বলে ডাকার মতো আর কেউ নেই।’
কাপড়ও কেচেছি
২ ঘণ্টার সাক্ষাৎকারে জীবনের অনেক গল্প বলেছেন মোদি। ছোটবেলার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় আমি কাপড় কাচতাম। বাড়ির সবার জামাকাপড় আমাকেই কাচতে হতো। তার জন্য আমি পুকুরেও যেতাম।’
চীনা দূতাবাসে চিঠি
একবার চীনা দূতাবাসে চিঠিও লিখেছিলেন মোদি। তার কথায়, ‘আমি বড়নগরে থাকতাম। কোথাও পড়েছি, এখানে চিনা পর্যটক হিউয়েন সাং এসেছিলেন। তার ভ্রমণকাহিনি নিয়ে একটি ছবি তৈরি করা হচ্ছিল। আমি চীনা দূতাবাসে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলাম, তাদের ছবিতে যেন আমাদের এই গ্রামকে ভালো করে দেখানো হয়।’ পরে ২০১৪ সালে মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ফোন করে তার কাছে গুজরাটের ওই গ্রাম ঘুরে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা
গোধরাকাণ্ডের পরবর্তী সময়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মোদি বলেন, ‘২০০২ সালে গুজরাটে ভোট ছিল। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। মনে আছে, আমি সবাইকে বলে রেখেছিলাম, দুপুর ১২টার আগে আমাকে ভোটের ফলাফলের কোনো তথ্য না দিতে। পরে জানতে পারলাম, দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে আমি এগিয়ে আছি। আমার ভেতরে তখন অনেক কিছু হচ্ছিল। কিন্তু সেসবে আমি পাত্তা দিইনি। নিজেকে সংযত রেখেছিলাম।’


সাধারণ ছাত্র
স্কুলে সাধারণ ছাত্র ছিলেন মোদি। বলেন, ‘আমি তেমন চোখে পড়ার মতো কিছু করিনি স্কুলে। ভেলজিভাই চৌগবি নামের আমাদের এক শিক্ষক ছিলেন। তিনি আমাকে অনেক উৎসাহ দিতেন। আমার বাবাকে বলেওছিলেন আমার প্রতিভার কথা। পরীক্ষায় কখনো মনোযোগ দিতাম না আমি।’
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটিই তার প্রথম পডকাস্ট সাক্ষাৎকার, মেনে নিয়েছেন মোদি। বলেছেন, ‘জানি না, সাধারণ মানুষ এই সাক্ষাৎকারকে কেমনভাবে নেবে। আমি আগে কখনো এমন কিছু করিনি।’ ইতোমধ্যে ২ ঘণ্টার ভিডিওটি সাড়া ফেলে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর জীবনের অজানা গল্প জানতে অনেকেই সেই সাক্ষাৎকার শুনে ফেলেছেন।
কার মধ্যে তিনি ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখেন। আগামী ২০-৩০ বছর পর কারা রাজনীতির মুখ হয়ে উঠতে পারেন। একটি সাক্ষাৎকারে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি জানিয়েছেন, রাজনীতিতে দল গঠনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনই সেই কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন তিনি। এখনো সেই কাজ করে যাচ্ছেন।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় মুখ হিসেবে কারও নাম করতে চাননি মোদি। তিনি বলেন, ‘অনেকের মধ্যেই সম্ভাবনা রয়েছে। আমি কীভাবে আমার দলকে তৈরি করছি, তার ওপরই আমার সাফল্য নির্ভর করে। সবাই একটি লক্ষ্য ধরে এগিয়ে চলেন। পরিশ্রম করেন। আমি আলাদা করে কারও নাম নেব না। তাহলে অন্যদের প্রতি অবিচার করা হবে। আমার সামনে অনেক সম্ভাবনাময় মুখ রয়েছে। আমি সবার কথাই জানি। কিন্তু কারও সঙ্গে যাতে অবিচার না হয়, সেটা দেখার দায়িত্বও আমার।’


সাফল্যের চাবিকাঠি
রাজনীতিতে সাফল্যের চাবিকাঠি কী। সাক্ষাৎকারে মোদি বলেছেন, ‘রাজনীতিবিদ হওয়া এক জিনিস, কিন্তু রাজনীতিতে সফল হওয়া আর এক। তার জন্য সমর্পণ, একাগ্রতা, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা দরকার। দলের সঙ্গে মানিয়ে চলার মতো খেলোয়াড় হতে হবে। যদি আপনি নিজেকে সবার চেয়ে বড় বলে মনে করেন, ভাবেন বাকিরা আপনাকেই অনুসরণ করবেন, তা হলে আপনি হয়তো ভোটে জিততে পারবেন। কিন্তু রাজনীতিতে আপনার সাফল্যের কোনো নিশ্চয়তা নেই।’


উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়, লক্ষ্য
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়েই মোদি বলেন, ‘আমাদের সব নেতাকে দেখুন, সবাই আলাদা আন্দোলন থেকে উঠে এসেছেন। তাদের ভাবনার পদ্ধতি, অভিজ্ঞতা সব আলাদা। তাদের কথা এবং ব্যবহার থেকেই বোঝা যায়, সমাজের প্রতি তারা কতটা দায়বদ্ধ। তাই আমি মনে করি, ভালো মানুষদের আরও বেশি করে রাজনীতিতে আসা দরকার। কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে নয়, লক্ষ্য নিয়ে।’


গোধরা পর্ব
গুজরাটে রাজনীতি এবং গোধরাকাণ্ডের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মোদি বলেন, ‘২০০২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি আমি প্রথমবার বিধায়ক হয়েছিলাম। গোধরায় যখন ওই ঘটনা ঘটেছিল, বিধায়ক হিসেবে আমার বয়স মাত্র তিন দিন। প্রথমে আমরা ট্রেনে আগুনের খবর পাই। তার পর একে একে মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। খুব চিন্তা হচ্ছিল। গোধরা যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হেলিকপ্টার একটাই ছিল। সিঙ্গল ইঞ্জিন কপ্টার হওয়ায় আমাকে তাতে উঠতে দেওয়া হচ্ছিল না। আমি ওদের সঙ্গে ঝগড়া করে ঝুঁকি নিয়ে গোধরা গেলাম। এত মৃতদেহ, এত বেদনার সব দৃশ্য। আমার নানা রকম অনুভূতি হচ্ছিল। কিন্তু নিজেকে বোঝাচ্ছিলাম, আমি এমন একটা জায়গায় আছি যেখানে আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। স্বাভাবিক প্রবণতাকে দমন করতে হবে।’


গান্ধী এবং সাভারকর
মহাত্মা গান্ধী এবং বিনায়ক দামোদর সাভারকরের পথ আলাদা ছিল, কিন্তু তাদের লক্ষ্য, আদর্শ ছিল একটাই। মোদি বলেন, ‘আদর্শের চেয়ে আদর্শবাদ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আদর্শ ছাড়া রাজনীতি হয় না। কিন্তু আদর্শবাদও জরুরি। স্বাধীনতার আগে সবার আদর্শ ছিল দেশকে স্বাধীন করে তোলা। গান্ধী এবং সাভারকরের পথ আলাদা ছিল, কিন্তু তাদের আদর্শ ছিল এক।’ নিজের আদর্শ প্রসঙ্গে মোদি বলেন, আমি সব সময় দেশকে প্রথমে রাখি। সুবিধা অনুযায়ী নিজের অবস্থান বদল করব, তেমন মানুষ নই। আমার আদর্শ ‘নেশন ফার্স্ট’ (আগে আমার দেশ)। এই আদর্শই আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। আমার জীবন আমি তৈরি করিনি। পরিস্থিতি আমাকে তৈরি করেছে। ছোটবেলায় আমি যে জীবন কাটিয়েছি, তা থেকে অনেক শিক্ষা পেয়েছি।


ভারত নিরপেক্ষ নয়
ভারত নিরপেক্ষ নয়। বিশ্বের সব রাষ্ট্র ভারতকে ভরসা করে। বিদেশনীতি প্রসঙ্গে মোদি বলেন, ‘সারা বিশ্ব ভারতকে ভরসা করে। কারণ, আমাদের মধ্যে নকল কিছু নেই। আমরা যা বলি, স্পষ্ট করেই বলি। অনেক কঠিন পরিস্থিতিতেও আমরা বারবার বলেছি, আমরা নিরপেক্ষ নই। আমরা শান্তির পক্ষে। তার জন্য যা প্রয়োজন, আমি করব। আমি এটা রাশিয়া, ইউক্রেন, ইরান, প্যালেস্টাইন, ইসরায়েল সবাইকে বলেছি। তারা আমাকে বিশ্বাস করে।’


লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক

বায়ুদূষণে বাংলাদেশ এবং স্বাস্থ্যঝুঁকির উচ্চমাত্রা

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৫৭ পিএম
বায়ুদূষণে বাংলাদেশ এবং স্বাস্থ্যঝুঁকির উচ্চমাত্রা
ড. এম এ ফারুখ

বাংলাদেশে বায়ুদূষণ একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান ও গবেষণার আলোকে এই সমস্যার গভীরতা ও এর প্রতিকার নিয়ে বিষদ আলোচনা করা অতি প্রাসঙ্গিক। আইকিউএয়ারের ২০২৩ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। এ দেশের বাতাসে পিএম ২ দশমিক ৫-এর গড় উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটারে ৭৯ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের চেয়ে প্রায় ১৬ গুণ বেশি। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে বায়ুদূষণের মাত্রা অত্যন্ত বেশি। ২০২৩ সালে নয়াদিল্লির পরেই ঢাকা দ্বিতীয় দূষিত বায়ুর শহর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যেখানে পিএম ২ দশমিক ৫-এর মাত্রা ছিল ৮০ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম। একই বছর পাকিস্তান ও ভারতে পিএমের মাত্রা ছিল যথাক্রমে ৭৩ দশমিক ৭ ও ৫৪ দশমিক ৪ মাইক্রোগ্রাম। ২০২২ সালে বিশ্বে দূষিত বায়ুর দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পঞ্চম অবস্থানে এবং ভারত অষ্টম অবস্থানে ছিল। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, বাতাসে পিএম ২ দশমিক ৫-এর মাত্রা ৫ মাইক্রোগ্রামের অধিক হওয়া উচিত নয় এবং প্রবহমান বাতাসে এর মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি সরাসরি ফুসফুস ও রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে থাকে। ২০২৩ সালে শুধু অস্ট্রেলিয়া, এস্তেনিয়া, ফিনল্যান্ড, গ্রানাডা, আইসল্যান্ড, মরিশাস ও নিউজিল্যান্ড বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড বজায় রাখতে পেরেছিল। বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ঢাকা ও শিল্পনগরী গাজীপুরে বিদ্যমান বাতাসের গুণগত মান ২০২১ বা ২০২২ সালের কোনো একটি মাসেও ‘ভালো’ স্কোরে ছিল না। বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। ২০২৪ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে এ দেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় পাঁচ বছর কমে গেছে। বিশেষ করে শিশুদের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রণীত সর্বশেষ ২০২১ সালের গ্লোবাল এয়ার কোয়ালিটি নির্দেশিকা অনুযায়ী বাংলাদেশের জাতীয় গড় দূষণ পরিমাপ করে অনুমান করা হয় যে দূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৪ দশমিক ৮ বছর কমে গেছে। বিশেষ করে ঢাকার নিকটবর্তী জেলা গাজীপুর ও নরসিংদীতে গড় আয়ু হ্রাসের পরিমাণ ছয় বছরেরও বেশি। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শিশুদের মধ্যে বায়ুদূষণজনিত রোগের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে, যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। দ্রুত নগরায়ণ, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ এবং পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রভাবে তীব্র শ্বাসযন্ত্রের রোগ বেড়েই চলছে, সেই সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অর্থনৈতিক ব্যয়ভার। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে পরিবেশগত কারণে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু ঘটেছে, যার মধ্যে বায়ুদূষণ ৫৫ শতাংশ অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী।

বাংলাদেশে পুরোনো ও অপরিচ্ছন্ন যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া বায়ুদূষণের একটি বড় উৎস। এ ছাড়া ইটভাটা ও বিভিন্ন শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া বায়ুদূষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। নগরায়ণের কারণে চলমান নির্মাণকাজ ও রাস্তার ধুলো বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে আবর্জনা ও প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বায়ুতে বিষাক্ত কণার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত 
প্রায় ৫ লাখ ৬৮ হাজার নিবন্ধিত যানবাহনের ফিটনেস সনদ ছিল না। 

পুরোনো যানবাহনে অসম্পূর্ণ জ্বালানি দহনের কারণে বেশি দূষণ ঘটে থাকে এবং পুরোনো যানবাহন থেকে বিপজ্জনক বায়ুদূষণকারী নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। ‘দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার-সাউথ এশিয়া’ তাদের ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে এক গবেষণায় বলেছে, ঢাকার বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড-এর ক্রমবর্ধমান ঘনত্ব এখন ঢাকাবাসীর জন্য গুরুতর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, গ্রামের ৭৭ শতাংশ পরিবার এখনো রান্নার জন্য পাতা, কাঠ, শুকনো গোবর ইত্যাদি ব্যবহার করে, যা গ্রামীণ এলাকায় বায়ুদূষণের প্রধান উৎস।

বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশবান্ধব যানবাহন যেমন, ইলেকট্রিক ও হাইব্রিড যানবাহনের ব্যবহার বৃদ্ধি করা এবং পুরোনো যানবাহনের নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করা অতি আবশ্যক। শিল্প-কারখানায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্গমন কমানো এবং নিয়মিত মনিটরিং করা জরুরি। নির্মাণকাজের সময় ধুলো নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং পরিবেশ সুরক্ষায় জনগণকে উৎসাহিত করার কোনো বিকল্প নেই। আন্তর্দেশীয় বায়ুদূষণ সমস্যার সমাধানে দেশের ভেতর ও বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। সর্বোপরি, বায়ুদূষণ বাংলাদেশের জন্য একটি জটিল সমস্যা; যার সমাধানে সরকার, শিল্প খাত ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। পরিবেশ সুরক্ষা, দূষণরোধ ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।

লেখক: অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
[email protected]

বিপ্লব-পরবর্তী যে রোডম্যাপ ঘোষিত হয়নি

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৫৩ এএম
বিপ্লব-পরবর্তী যে রোডম্যাপ ঘোষিত হয়নি
এ এফ এম আবদুর রহমান

বিপ্লবী ছাত্র-জনতা কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে নিজেদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের জন্য একটি অন্তর্বর্তী বিপ্লবী সরকার গঠন করিলাম এবং পারস্পরিক আলোচনা করিয়া বাংলাদেশের জনগণের জন্য গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থায় সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারসম্পন্ন রাষ্ট্র পরিচালনায় অঙ্গীকারবদ্ধ হইলাম।...


অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সব রাজনৈতিক দলসহ জনগণের একটি প্রত্যাশা ছিল রাষ্ট্র সংস্কারের রোডম্যাপ ঘোষণার। কিন্তু সেটি ঘোষিত হয়নি। যে রোডম্যাপটি ঘোষিত হওয়া অত্যাবশ্যক ছিল সেটি আমার প্রস্তাবনায় নিম্নরূপ হতে পারত:
জুলাই-আগস্ট বিপ্লব ও অন্তর্বর্তী সরকারকে সাংবিধানিক ভিত্তি প্রদান ও ক্ষমতা হস্তান্তরের রোডম্যাপের রূপরেখা:
১. ‘প্রোক্লামেশন অব রেভ্যুলিউশন’ বা ‘বিপ্লবের ফরমান’ জারি করে অন্তর্বর্তী বিপ্লবী সরকারের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা।
২. প্রোক্লামেশন অব রেভ্যুলিউশনে হাসিনা সরকারের পতন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনকে ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান’ তথা ‘বিপ্লব’-এ রূপান্তরিত হওয়ার ঘোষণা দেওয়া।
৩. ‘সফল বিপ্লব’-এর ফলে বিদ্যমান সংবিধান স্বয়ংক্রিয়ভাবে অবলুপ্তি হওয়া বিবেচনা করা।
৪. প্রোক্লামেশন অব রেভ্যুলিউশনের ক্ষমতায় একজন নতুন রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন করা।
৫. স্বৈরাচার সরকার কর্তৃক সৃষ্ট রাষ্ট্রীয়, বিচারিক ও আর্থিক সব প্রতিষ্ঠানের বিশৃঙ্খলার সংস্কার সাধন করা।
৬. প্রোক্লামেশন অব রেভ্যুলিউশনের অধীনে সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করা।
৭. নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যদের দ্বারা নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা।
৮. নতুন সংবিধানের অধীনে সংসদের নির্বাচন করা।
৯. রাষ্ট্রপতির আহ্বানে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের দ্বারা সরকার গঠন করা।
১০. নতুন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা ও অন্তর্বর্তী বিপ্লবী সরকার বিলুপ্ত করা।

এই রোডম্যাপের ভিত্তিতে যে ‘প্রোক্লামেশন অব রেভ্যুলিউশন’ ঘোষিত হতে পারত সেটি নিম্নরূপ-

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
যেহেতু ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে শুরু হওয়া একটি ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জনগণ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করিয়াছে এবং উহার গণপরিষদ গঠন করিয়া ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসের ৪ তারিখে রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নপূর্বক উহা ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর হইতে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে গ্রহণ করিয়াছে;
যেহেতু সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং ১১ অনুচ্ছেদের বিধানে এই মর্মে অঙ্গীকার ও নিশ্চয়তা বিধান করা হইয়াছিল যে, রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে;

যেহেতু রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভাপতিরূপে শেখ হাসিনা নবম সংসদে নির্বাচিত হইয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকার গঠন করেন এবং প্রধানমন্ত্রীরূপে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার মানসিকতায় রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সহায়তায় নির্বাচনব্যবস্থা কলুষিত করিয়া ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন এবং সরকারের সর্বময় ক্ষমতা নিজ হস্তে কুক্ষিগত করেন;

যেহেতু শেখ হাসিনা ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি হইতে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়কালে সরকার পরিচালনাকালীন সর্বগ্রাসী দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক অবকাঠামোয় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিয়া গণতন্ত্রহীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিচারব্যবস্থা অকার্যকরক্রমে নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রকে অকার্যকর করিয়া এক অমানবিক ও নীতি-নৈতিকতাবিহীন স্বৈরাচারী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন; যেহেতু সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সংবিধানে ত্রয়োদশ, চতুর্দশ, পঞ্চদশ ও ষষ্ঠদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশ অসংশোধনযোগ্য রূপে কঠোর বিধান করিয়া ভবিষ্যতের সকল সংসদকে অকার্যকর করিয়া রাখিয়াছিলেন; যেহেতু বাংলাদেশের সকল কার্যকরী বিরোধী দলের সদস্যরা চরম অমানবিক নিষ্পেষণের শিকার হইয়া শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিতে অস্বীকৃত হওয়ায় জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট প্রদানে বিরত থাকে, যাহার ফলে নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সরকার পরিবর্তন অসম্ভব হইয়া পরে;

যেহেতু বিগত পনেরো বছর এক অমানবিক, অনৈতিক, বিচারহীন অগণতান্ত্রিক সমাজে জনগণ মতপ্রকাশে বিপদাপন্ন ছিলেন ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় বসবাস করিতেছিলেন; যেহেতু জুলাই-আগস্ট ২০২৪ মাসে ছাত্র-জনতা এক ঐতিহাসিক আন্দোলনের মাধ্যমে যে সফল বিপ্লব ও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান সংঘটন করেন এবং যাহার দমনে শেখ হাসিনার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিচারে প্রাণঘাতী গুলিবর্ষণে সহস্রাধিক ছাত্র-জনতার জীবনহানি করিয়াছে; যেহেতু এই সফল বিপ্লবের ফলে ৫ আগস্ট ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি বরাবরে পদত্যাগ করিয়া পলায়ন-প্রক্রিয়ায় দেশত্যাগ করিলে দেশ সরকারবিহীনতায় পতিত হয় এবং সংসদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হয় এবং যেহেতু বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের সর্বময় ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং সেই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণের পক্ষে বিপ্লবী ছাত্র-জনতার অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে বিপ্লবী ছাত্র-জনতার দ্বারা আমরা মনোনীত হইয়া বিপ্লবী পরিষদ গঠন করিয়াছি; সেহেতু বিপ্লবী ছাত্র-জনতা কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে নিজেদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের জন্য একটি অন্তর্বর্তী বিপ্লবী সরকার গঠন করিলাম এবং পারস্পরিক আলোচনা করিয়া বাংলাদেশের জনগণের জন্য গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থায় সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারসম্পন্ন রাষ্ট্র পরিচালনায় অঙ্গীকারবদ্ধ হইলাম। আমরা আরও ঘোষণা করিতেছি যে, জুলাই-আগস্ট ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান আন্দোলনটি একটি সফল বিপ্লব হিসেবে পরিসমাপ্ত হইয়াছে।

আমরা আরও ঘোষণা করিতেছি যে, ঘোষিত সফল বিপ্লবের ফলে ১৯৭১ সালে গঠিত গণপরিষদ কর্তৃক ৪ নভেম্বর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে প্রবর্তিত ও ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধান, উহার ষোলোটি সংশোধনীসহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হইয়া যাওয়ায় বর্তমানে উক্ত সংবিধানের কোনো আইনগত কার্যকারিতা ও অস্তিত্ব নাই। আমরা ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা বাংলাদেশের জন্য একজন রাষ্ট্রপতি মনোনীত করিব এবং ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়ন ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি প্রয়োগ করিবেন এবং তিনি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইবেন।

আমরা আরও ঘোষণা করিতেছি যে, স্বৈরাচার সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয়, বিচারিক ও আর্থিক সকল প্রতিষ্ঠানে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হইয়াছে আমরা তাহার সংস্কার সাধন করিব। আমরা আরও ঘোষণা করিতেছি যে, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য আমরা সুবিধাজনক সময়ে গণপরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করিব এবং উক্ত গণপরিষদ দ্বারা প্রণীত সংবিধানের বিধান অনুযায়ী সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করিব। আমরা দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করিতেছি যে, নির্বাচিত সংসদ দ্বারা গঠিত সরকারের নিকট আমরা ক্ষমতা হস্তান্তর করিব ও তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের বিপ্লবী পরিষদের অবলুপ্তি ঘটিবে।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, এই ঘোষণাপত্র ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ আগস্ট দুপুর ২টা ৩১ মিনিট হইতে কার্যকর হইয়াছে মর্মে বিবেচিত হইবে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস
(উপদেষ্টা পরিষদের অনন্য সদস্য)
বিপ্লবী ছাত্র-জনতার মনোনয়নে ক্ষমতাপ্রাপ্ত বিপ্লবী পরিষদ।
বঙ্গভবন, ৮ আগস্ট ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ।
ইতোমধ্যে অনেকটা সময় চলে গেলেও সময় একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। বর্তমান সরকারের বৈধতাসংক্রান্ত বিষয় হওয়ায় ভবিষ্যতের সব জটিলতা এড়ানোর জন্য এখনই এই ‘বিপ্লবের ফরমান’ জারি করা আবশ্যক। নতুবা সমগ্র জাতিকে পস্তাতে হতে পারে।

লেখক: বিচারপতি
(বি. দ্র.: ভাষারীতি ও মতামত লেখকের নিজস্ব।)

গাজা যুদ্ধবিরতি: দীর্ঘ বর্বরতার পর ব্যর্থ ইসরায়েল

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:২৬ এএম
গাজা যুদ্ধবিরতি: দীর্ঘ বর্বরতার পর ব্যর্থ ইসরায়েল

গাজা সব ফিলিস্তিনির এবং বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা সম্পূর্ণ যুদ্ধ সহ্য করতে পারে। ফিলিস্তিনিরা যে ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তা থেকে তারা নড়বে না। এটি বিশ্বকে জানান দেয় যে দখলদাররা তাদের যা কিছু ছিল তাই আমাদের দিকে ছুড়ে ফেলেছে। এটি কোনো নাকবা ছিল না। গাজা ইসরায়েলকে জানান দিয়েছে যে ফিলিস্তিনিরা বিদ্যমান রয়েছে। যতক্ষণ না ইসরায়েলিরা তাদের সঙ্গে সমান অধিকারের বিষয়ে সমান শর্তে কথা না বলে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা শান্ত হবে না।...

কয়েক মাস ধরে নেতানিয়াহু গাজা যুদ্ধবিরতির প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, যার ফলে তার নিজস্ব আলোচকদের মধ্যেও হতাশার সৃষ্টি হয়েছিল। দুই মাসেরও বেশি সময় আগে তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াভ গ্যালান্টের বিদায়ের মাধ্যমে এ বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৫ মাসব্যাপী যুদ্ধের প্রধান স্থপতি গ্যালান্ট স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে গাজায় সেনাবাহিনীর করার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
তবুও নেতানিয়াহু জেদ ধরে রেখেছিলেন। গত বসন্তে তিনি সিআইএ পরিচালক উইলিয়াম বার্নসের উপস্থিতিতে রাফাহর ওপর আক্রমণের পক্ষে হামাসের স্বাক্ষরিত চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। শরৎকালে নেতানিয়াহু জেনারেলদের পরিকল্পনার দিকে মনোনিবেশ করেন, যার লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলিদের পুনর্বাসনের প্রস্তুতির জন্য উত্তর গাজা খালি করা। পরিকল্পনাটি ছিল উত্তর গাজার জনগণকে অনাহারে মারা এবং বোমা হামলা চালিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া। কেউ স্বেচ্ছায় চলে না গেলে তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে গণ্য করা হবে। এটি এতটাই চরম ও আন্তর্জাতিক যুদ্ধের নিয়মের পরিপন্থি ছিল যে সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে ইয়ালন এটিকে যুদ্ধাপরাধ এবং জাতিগত নির্মূল বলে নিন্দা করেছিলেন। এই পরিকল্পনার মূল চাবিকাঠি ছিল গাজা উপত্যকার কেন্দ্রস্থলে ইসরায়েল সীমান্ত থেকে সমুদ্র পর্যন্ত একটি সামরিক রাস্তা ও ফাঁড়ি দিয়ে একটা করিডর করা। নেটজারিম করিডর কার্যকরভাবে অঞ্চলটির স্থলভাগ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনে এবং নতুন উত্তর সীমান্তে পরিণত হয়। উত্তর গাজা থেকে বিতাড়িত কোনো ফিলিস্তিনিকে ফিরে আসতে দেওয়া হতো না।

বাইডেন প্রশাসনের কেউ নেতানিয়াহুকে এই পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজেও নন। তিনি একজন সহজাত ইহুদিবাদী, যিনি তার সব বক্তৃতার মাধ্যমে গাজায় গণহত্যা চালানোর জন্য ইসরায়েলকে সহযোগিতা করেছেন। তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনও এই অঞ্চলের সবচেয়ে কম বিশ্বস্ত কূটনীতিক হিসেবে পরিগণিত হয়েছিলেন। 
যুদ্ধবিরতি চুক্তির চূড়ান্ত সময়ে ব্লিঙ্কেন এক সংবাদ সম্মেলনে হামাসকে পূর্ববর্তী প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার জন্য দোষারোপ করেন। নীতিগতভাবে সত্যটি ছিল বিপরীত। আলোচনা কভার করা প্রত্যেক ইসরায়েলি সাংবাদিক রিপোর্ট করেছেন যে নেতানিয়াহু পূর্ববর্তী সব চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং এই চুক্তিতে বিলম্বের জন্য তিনিই দায়ী।

নেতানিয়াহুর ১৫ মাসের যুদ্ধের বিষয়ে সময় নির্ধারণের জন্য নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ মধ্যপ্রাচ্য দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত বৈঠকে এটি শেষ হয়েছিল। এক বৈঠকের পর নেতানিয়াহু ১৫ মাস ধরে যে রেড লাইনগুলো এঁকেছিলেন, সেগুলো মুছে ফেলা হয়েছে। ইসরায়েলি পণ্ডিত এরেল সেগাল যেমন বলেছিলেন, ‘ট্রাম্পের নির্বাচনের জন্য আমরাই প্রথম মূল্য দিতে যাচ্ছি। (চুক্তিটি) আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে... আমরা ভেবেছিলাম আমরা উত্তর গাজার নিয়ন্ত্রণ নেব, যাতে মানবিক সাহায্যে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।’

কলামিস্ট ইয়োসি ইয়েহোশুয়া ওয়াইনেটে লিখেছেন, ‘এটি একটি ঐকমত্য হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। ইসরায়েলের বিজয়ের মনোভাব নিয়ে পুরোপুরি সন্দেহ রয়েছে। বাস্তবতাকে আড়াল করার কোনো প্রয়োজন নেই। যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি মুক্তি চুক্তি ইসরায়েলের জন্য খারাপ হবে। তবে এটি মেনে নেওয়া ছাড়া এর আর কোনো উপায় নেই।’

যুদ্ধবিরতি চুক্তির খসড়ায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই ফিলাডেলফি ও নেটজারিম করিডর উভয় থেকে ইসরায়েল সরে আসবে। নেতানিয়াহু আগেও এ রকম অনেক শর্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন। 
এমনকি এটি ছাড়াও খসড়া চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে ফিলিস্তিনিরা যাতে তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারে। এর মধ্যে উত্তর গাজাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখান থেকে গাজা বাসিন্দাদের উচ্ছেদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এটি ইসরায়েলের স্থল আক্রমণের সবচেয়ে বড় একক ব্যর্থতা।
ইসরায়েল কেবল গ্লোবাল সাউথকেই হারাচ্ছে না, তারা আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় এই ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিল এবং জনমত হারিয়েছে। বরং পশ্চিমাদের এমন একটি প্রজন্মের সমর্থনও হারিয়েছে। 

কথাটা আমার নয়। জ্যাক লিউ খুব ভালোভাবেই তুলে ধরেছেন। হামাসের হামলার এক মাস আগে বাইডেন যাকে ইসরায়েলে রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মানুষকে যা বলেছি, এই যুদ্ধ শেষ হলে তাদের চিন্তা করতে হবে। প্রজন্ম তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, ছয় দিনের যুদ্ধ, ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধ, এমনকি ইন্তিফাদার সঙ্গে যুদ্ধও স্মৃতি থেকে ভুলে যাবে।’ তার বিদায়ী সাক্ষাৎকারে একজন অর্থোডক্স ইহুদি হিসেবে লিউ টাইমস অব ইসরায়েলকে বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে জনমত এখনো মূলত ইসরায়েলপন্থি, কিন্তু তা পরিবর্তন হচ্ছে। 

আমি এখানকার লোকদের যা বলেছি যে এই যুদ্ধ শেষ হলে তাদের চিন্তা করতে হবে তা হলো প্রজন্মের স্মৃতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, ছয় দিনের যুদ্ধ, ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধ, এমনকি ইন্তিফাদার সঙ্গেও ফিরে যায় না। এটি এই যুদ্ধ দিয়ে শুরু হয় এবং আপনি ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারকদের ওপর এই যুদ্ধের প্রভাব উপেক্ষা করতে পারবেন না। আজ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ব্যক্তিদের ওপর নয়, বরং আজ ২৫, ৩৫, ৪৫ বছর বয়সী এবং যারা পরবর্তী ৩০, ৪০ বছরের জন্য নেতা হবেন।’
নেতানিয়াহুর প্রতি লিউর আক্রমণ সাম্প্রতিক জরিপে ব্যাপকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি আমেরিকান ইহুদি কিশোর হামাসের প্রতি সহানুভূতিশীল দেখিয়েছে। ৪২ শতাংশ আমেরিকান বিশ্বাস করে যে ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে এবং ৬৬ শতাংশ গোটা ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল।

এটি কোনো নতুন ঘটনা নয়। যুদ্ধের দুই বছর আগে করা জরিপে দেখা গেছে , আমেরিকান ইহুদিদের এক-চতুর্থাংশ একমত যে ইসরায়েল একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র। জরিপে উত্তরদাতাদের একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এই বক্তব্যকে ইহুদিবিরোধী বলে মনে করেননি।

গাজার যুদ্ধ ভবিষ্যতের নতুন প্রজন্মের নেতাদের জন্য ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত দেখার বিষয় হয়ে উঠেছে। ২০২৩ সালের ৬ অক্টোবর ভেবেছিল যে তারা ফিলিস্তিনের বিষয়টি বন্ধ করে দিয়েছে এবং বিশ্ব জনমত তাদের নিয়ন্ত্রণে।
যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ, যা পশ্চিমা সরকারগুলো প্রথমে ইহুদিবিদ্বেষী এবং পরে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে আইন প্রণয়ন করে ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য বিশ্বব্যাপী ফ্রন্ট তৈরি করেছে। ইসরায়েলকে বয়কট করার আন্দোলন এখন আগের চেয়েও অনেক শক্তিশালী।

ইসরায়েল এখন আন্তর্জাতিক বিচারের কাঠগড়ায়, যা আগে কখনো হয়নি। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের বিরুদ্ধে কেবল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়নি, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার মামলাও অব্যাহত রয়েছে। 

এ ছাড়া ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সম্প্রতি গাজা অভিযানে অংশগ্রহণকারী সব সৈন্যের পরিচয় গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ তাদের ভয় ছিল, বিদেশ ভ্রমণের সময় তাদের অনুসরণ করা হতে পারে।

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের হাতে নিহত ছয় বছর বয়সী শিশু হিন্দ রজব নামে একটি ক্ষুদ্র কর্মী গোষ্ঠী এই বড় পদক্ষেপ নেয়। বেলজিয়ামভিত্তিক এই গোষ্ঠীটি ভিডিও, অডিও, ফরেনসিক রিপোর্ট এবং অন্যান্য নথিসহ ১ হাজার ইসরায়েলি ব্যক্তির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ দাখিল করেছে।

গাজায় যুদ্ধবিরতি মানেই ফিলিস্তিনের দুঃস্বপ্নের শেষ হওয়া নয়। বরং ইসরায়েলের শুরু। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর গাজায় যা ঘটেছিল তার সত্যতা উন্মোচিত এবং নথিভুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আইনি পদক্ষেপগুলো গতি ফিরে পাবে। 

নেতানিয়াহু যুদ্ধ থেকে এমন একটি দেশে ফিরে আসবেন, যেখানে অভ্যন্তরীণভাবে আগের চেয়েও বেশি বিভক্ত হবে। সেনাবাহিনী এবং সেবা করতে অস্বীকৃতি জানানো হারেদিমদের মধ্যে সংগ্রাম চলছে। ধর্মনিরপেক্ষ এবং জাতীয় ধর্মীয় ইহুদিবাদীদের মধ্যে সংগ্রাম চলছে। গাজায় নেতানিয়াহুর পশ্চাদপসরণের সঙ্গে বসতি স্থাপনকারী অতি-ডানপন্থিরা বুঝতে পারছেন যে বৃহত্তর ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সুযোগ খুবই কম। এই সময়ে ইসরায়েল থেকে ইহুদিদের অভূতপূর্ব যাত্রা শুরু হয়েছে। আঞ্চলিকভাবে লেবানন ও সিরিয়ায় এখনো ইসরায়েলের সৈন্য রয়েছে। চলমান অভিযানগুলোকে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণে ইসরায়েলের হারানো প্রতিরোধক্ষমতা পুনরুদ্ধার হিসেবে ভাবা বোকামি হবে।

হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব নিশ্চিহ্ন হওয়ার পর এবং সিরিয়ায় নিজেদের ব্যাপকভাবে বিস্তৃত দেখতে পাওয়ার পর ইরানের প্রতিরোধ অক্ষটি হয়তো কিছুটা আঘাতের সম্মুখীন হয়েছিল। কিন্তু হামাসের মতো হিজবুল্লাহও যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হয়নি। সুন্নি ও আরববিশ্ব গাজা এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে চলমান দমন-পীড়নের কারণে আগের মতো ক্ষুব্ধ হয়েছে।

সিরিয়াকে ক্যানটনে বিভক্ত করার ইসরায়েলের স্পষ্ট প্রচেষ্টা সব সম্প্রদায় এবং জাতিগত সিরীয়দের জন্য ততটাই উসকানিমূলক, যতটা পশ্চিম তীরের এলাকা ‘বি’ ও ‘সি’ জর্ডানের সঙ্গে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা জর্ডানের জন্য অস্তিত্বগত হুমকি। আম্মানে সংযুক্তি যুদ্ধের জন্য একটি পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। সংঘাত নিরসন হবে কয়েক দশক ধরে পুনর্গঠনের ধৈর্যশীল কাজ। ট্রাম্প ধৈর্যশীল মানুষ নন। হামাস ও গাজা এখন পিছিয়ে পড়বে। বিপুল প্রাণহানির কারণে প্রতিটি পরিবার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু গত ১৫ মাসে গাজা যা অর্জন করেছে তা সংঘাতকে বদলে দিতে পারে।

গাজা সব ফিলিস্তিনির এবং বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা সম্পূর্ণ যুদ্ধ সহ্য করতে পারে। ফিলিস্তিনিরা যে ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তা থেকে তারা নড়বে না। এটি বিশ্বকে জানান দেয় যে দখলদাররা তাদের যা কিছু ছিল তাই আমাদের দিকে ছুড়ে ফেলেছে। এটি কোনো নাকবা ছিল না। গাজা ইসরায়েলকে জানান দিয়েছে যে ফিলিস্তিনিরা বিদ্যমান রয়েছে। যতক্ষণ না ইসরায়েলিরা তাদের সঙ্গে সমান অধিকারের বিষয়ে সমান শর্তে কথা না বলে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা শান্ত হবে না।

এই উপলব্ধি বুঝতে আরও অনেক বছর লাগতে পারে। কিন্তু কেউ কেউ তা উপলব্ধি করতে পেরেছে। কলামিস্ট ইয়ার আসুলিন হারেৎজে লিখেছেন, ‘যদিও আমরা পুরো মধ্যপ্রাচ্য জয় করি এবং সবাই যদি আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তবু আমরা এই যুদ্ধে জিততে পারব না।’ কিন্তু গাজায় যারা বসবাস করছেন, তারা যা অর্জন করেছেন, তা ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।

লেখক: মিডল ইস্ট আইয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান সম্পাদক। 
মিডল ইস্ট আই থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদুল ইসলাম সকাল

সমাজব্যবস্থার কারণে মূল্যবোধের ক্ষয়

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:১১ এএম
সমাজব্যবস্থার কারণে মূল্যবোধের ক্ষয়
ড. মাহবুব উল্লাহ

সমাজব্যবস্থা যে রকম হবে সেই অনুযায়ী শাসক, আমলা, রাজনীতিবিদ, বিচারকদের চরিত্র হবে। এটা সমাজকাঠামোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এটা সিস্টেমের অংশ। সমাজব্যবস্থা খারাপের কারণে মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে। সমাজে দুটি জিনিস থাকে। একটা ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা অবকাঠামো। আরেকটা হলো সুপারস্ট্রাকচার বা পরিকাঠামো। পরিকাঠামো হলো একটা সমাজের মধ্যে বিচারব্যবস্থা থাকে, ধর্ম থাকে, মূল্যবোধ থাকে এবং ন্যায়-অন্যায়ের বিষয়গুলো থাকে। শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতি সব হচ্ছে সমাজের সুপারস্ট্রাকচার। আর ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা অবকাঠামোর মধ্যে থাকে উৎপাদন সম্পর্ক এবং উৎপাদন শক্তি। 

পৃথিবীর সমাজব্যবস্থা আদিম সাম্যবাদ থেকে শুরু করে দাসব্যবস্থা, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তারপর আবার সাম্যবাদী ব্যবস্থা এভাবে বিবর্তনগুলো হয়। সমাজের উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে যদি উৎপাদনের শক্তির বিরোধ হয়ে যায়, তাহলে সমাজ বদলায় বা পরিবর্তিত হয়। একটা সমাজের দিকে যখন আমরা তাকাই তখন দেখি, উৎপাদিকা শক্তিতে বিভিন্ন সময় পরিবর্তন হচ্ছে। প্রযুক্তির পরিবর্তনের ফলে সমাজেও পরিবর্তন হয়। উৎপাদিকা শক্তির পরিবর্তনের কারণে আবার উৎপাদন সম্পর্কেরও পরিবর্তন হয়। প্রযুক্তির পরিবর্তনের ফলে মানুষে মানুষের সম্পর্কের পরিবর্তন হয়। কাজেই এদিক থেকে চিন্তাভাবনা বদলাবে, মূল্যবোধ বদলাবে। কিন্তু কথা হলো, এই চিন্তাভাবনা আর মূল্যবোধ ভালো না মন্দ, সেটা দেখতে হবে। কিন্তু এই ভালো মন্দের বিচারটাও আপেক্ষিক। আমাদের সময়ে আমরা যেভাবে পিতা-মাতা, শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করতাম, সম্মান করতাম, মান্য করতাম, সেভাবে আমাদের প্রজন্ম করছে না। এর কারণ হচ্ছে যুগের পরিবর্তন। এই পরিবর্তনে আমাদের পশ্চিমা দেশের প্রভাব আছে। কারণ এসব দেশ বস্তুগতভাবে উন্নত।

মূল্যবোধের পরিবর্তন হবে, সেটা অবশ্যম্ভাবী। সেই মূল্যবোধ একটা পর্যায় পর্যন্ত সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। যেগুলো অসামঞ্জস্যপূর্ণ, সেটাতে আমাদের সমস্যা হয়। অন্য দেশের প্রযুক্তি, সামাজিক চিন্তাভাবনা যখন আমাদের দেশে আসে, তখন ভালো দিকের সঙ্গে খারাপ দিকও আসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ