ঢাকা ৩০ মাঘ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
English
বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৩০ মাঘ ১৪৩১

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সমীকরণ বদলে যাচ্ছে

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৫২ এএম
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সমীকরণ বদলে যাচ্ছে
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, অভিষেককে ডেকে একরকম ওয়ার্নিংই দিয়েছেন মমতা। সাংগঠনিক ব্যাপারে তার নাক গলানো যে পিসি পছন্দ করছেন না সেটা সুব্রত বক্সীকে সাক্ষী রেখে স্পষ্টাস্পষ্টি জানিয়ে দেওয়ার মধ্যে অনেকেই অন্য রকম গন্ধ পাচ্ছেন। তৃণমূল রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলা লোকজন মনে করছেন, অভিষেককে তাড়ানো হবে, এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। সেই রাস্তাই তৈরি করছেন দলনেত্রী। অভিষেকের অভিজ্ঞতা কম। তাই তিনি আগেভাগে দল থেকে না বেরিয়ে নিজের বহিষ্কারের রাস্তা স্পষ্ট করছেন।...

ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সমীকরণ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে পিসির (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) হাত ছেড়ে ভাইপো (অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়) দূরে চলে যাচ্ছে। ‌‘সাবালক’ ভাইপোর পাশে দাঁড়ানোর জন্য বদ্ধপরিকর নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহর ভারতীয় জনতা পার্টি। ভাইপো যদি সত্যিই দলের একাংশকে ভাঙিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হন, বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একাংশ যদি শেষ পর্যন্ত নয়া নেতার দিকেই ঝোঁকেন, তাহলে তো মুখ্যমন্ত্রীর শিরে সংক্রান্তি। গোটা বিষয়টা ম্যানেজ হবে কী করে? সেই কারণে দিল্লিতে সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ আরও মসৃণ করে তুলছেন তিনি। ভাইপো বেরিয়ে গেলেই ২০২৬-এর লক্ষ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে আঁতাত নিশ্চিত করবেন তৃণমূল নেত্রী। সে ক্ষেত্রে মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুরসহ উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় জোটের উল্লেখযোগ্য লাভ হতে পারে।

কংগ্রেস যে এই জোটের জন্য মুখিয়ে রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। বৃহত্তর জোটের কথা চিন্তা করেই কংগ্রেস হাইকমান্ড প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পদে বদল ঘটিয়ে শুভঙ্কর সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, শুভঙ্করবাবুকে দলে চেয়েছিলেন মমতা। কিন্তু তিনি রাজি হননি। সে যা-ই হোক না কেন, তার সঙ্গে দিদির সম্পর্ক খুবই মসৃণ। মমতা সম্পর্কে কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি যে পাল্টে যাচ্ছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে সম্প্রতি দলের বর্ষীয়ান নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্যের বক্তব্যে। প্রয়াত নেতা সোমেন মিত্র স্মরণে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি বলেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাড়িয়ে কংগ্রেসের অশেষ ক্ষতি হয়েছে।’ তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে কুণাল ঘোষ প্রদীপবাবুর বক্তব্যকে সমর্থন ও স্বাগত জানিয়েছেন। যথারীতি বিরোধিতা করেছেন সাবেক প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। কিন্তু তিনি এখন ব্যাক বেঞ্চে। কংগ্রেস হাইকমান্ড বা রাজ্যের নেতৃত্ব- কেউই তার কথা শুনছে না। এই পরিস্থিতিতে অধীর কী করবেন, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।

সম্প্রতি, সুন্দরবনসংলগ্ন সন্দেশখালীতে একটি সভা করতে গিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে সন্দেশখালী স্টিং অপারেশনের জন্য তিনি ‘আই প্যাক’ সংস্থাকে দোষী করেন। কিন্তু আই প্যাককে যে তিনিই কাজে লাগিয়েছিলেন তা একবারের জন্যও মুখে আনেননি। উল্টো যারপরনাই সমালোচনা করেছেন পিসির। কিন্তু ভাইপো তার কাছে একেবারে ক্লিন চিট পেয়ে  গেছে। কিন্তু কেন? ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, শুভেন্দু খুব ভালো করেই জানেন নতুন দল তৈরির জন্য ভেতরে ভেতরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অনেকটাই এগিয়েছেন। তার সঙ্গে বিজেপির শীর্ষ নেতাদের কথাও হয়েছে। অমিত শাহ নিজে এ ব্যাপারে উৎসাহ দেখিয়েছেন। কাজেই অভিষেক যে বিজেপি জোটে আসছেন, তা এক প্রকার নিশ্চিত। এই সময় খুঁচিয়ে সম্পর্ক অহি নকুল করে লাভ হবে না।

দল ও সরকারের ‘মেদ’ করাবে তৃণমূল কংগ্রেস। নতুন বছরে এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করলেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্য সভাপতির সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনায় এই লক্ষ্যে নিজের মনোভাব স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, অভিষেককে ডেকে একরকম ওয়ার্নিংই দিয়েছেন তিনি। সাংগঠনিক ব্যাপারে তার নাক গলানো যে পিসি পছন্দ করছেন না, সেটা সুব্রত বক্সীকে সাক্ষী রেখে স্পষ্টাস্পষ্টি জানিয়ে দেওয়ার মধ্যে অনেকেই অন্য রকম গন্ধ পাচ্ছেন। তৃণমূল রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলা লোকজন মনে করছেন, অভিষেককে তাড়ানো হবে, এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। সেই রাস্তাই তৈরি করছেন দলনেত্রী। অভিষেকের অভিজ্ঞতা কম। তাই তিনি আগেভাগে দল থেকে না বেরিয়ে নিজের বহিষ্কারের রাস্তা স্পষ্ট করছেন।

অভিষেকের যাবতীয় পরিকল্পনা মমতা ভেস্তে দিয়েছিলেন। সেই কারণে ভাইপো নভেম্বর মাসে নিজের লোকজনকে দলের সংগঠনে বসাতে পারেননি। কিন্তু তিনি যে শেষ দেখে ছাড়বেন, তা আবারও স্পষ্ট হলো। বৃহস্পতিবার তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, রদবদল হবেই। এ কথা স্পষ্ট, যে অভিষেকের রদবদলের পরিকল্পনায় বাধা দেবেন মমতা। আর তখনই নতুন দল তৈরির বড় ধাপ পেরোবেন ‘ভাইপো’।

ঠিক সময়েই দলে সাংগঠনিক রদবদল হবে বলে জানিয়ে দিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার নিজের সংসদীয় কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান কর্মসূচি ‘সেবাশ্রয়’-এর উদ্বোধন করেন তিনি। সেখানেই সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে অভিষেক ফের দলে সাংগঠনিক রদবদলের বিষয়ে মুখ খোলেন। তা ছাড়া আরজি কর, কেন্দ্রীয় বঞ্চনা, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়েও প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।

অভিষেক বলেন, ‘সাংগঠনিক রদবদল হবেই। যারা দলের জন্য কাজ করেছেন, তাদের চিন্তা করতে হবে না। গাছের পরিচয় তার ফলে। আমি কত দক্ষ, কত অভিজ্ঞ, তা তো ফলাফল দেখলেই বোঝা যাবে।’ ডায়মন্ড হারবারের সংসদ সদস্য জানান, দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি ইতোমধ্যেই রদবদলের বিষয়ে নির্দিষ্ট প্রস্তাব দলনেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠিয়েছেন। প্রসঙ্গত, মমতার উপস্থিতিতেই ২১ জুলাইয়ের সভামঞ্চ থেকে সাংগঠনিক রদবদলের কথা জানিয়েছিলেন অভিষেক। তিনি জানিয়েছিলেন, লোকসভায় যেখানে যেখানে দলের খারাপ ফল হয়েছে, সেই সব পুর এলাকায় প্রশাসনিক স্তরে ‘রদবদল’ হবে।

 সেই সূত্রে কমবেশি ৭০টি পুরসভা ও পুরনিগমে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান পদে রদবদলের প্রস্তাব মমতার কাছে অভিষেক পাঠিয়ে দিয়েছিলেন অক্টোবরে বিদেশে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার আগেই। তবে নিজের জন্মদিনে গত ৭ নভেম্বর অভিষেক একান্ত আলোচনায় এও জানিয়েছিলেন, সেই রদবদল থেকে আপাতত বাদ থাকছে কলকাতা। অভিষেক এও বলেছিলেন, রদবদলের নিরিখ হবে লোকসভা ভোটের ফল। ফের তিনি সেটাই স্পষ্ট করতে চেয়েছেন।

রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, অভিষেককে ডেকে একরকম ওয়ার্নিংই দিয়েছেন মমতা। সাংগঠনিক ব্যাপারে তার নাক গলানো যে পিসি পছন্দ করছেন না, সেটা সুব্রত বক্সীকে সাক্ষী রেখে স্পষ্টাস্পষ্টি জানিয়ে দেওয়ার মধ্যে অনেকেই অন্য রকম গন্ধ পাচ্ছেন। তৃণমূল রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলা লোকজন মনে করছেন, অভিষেককে তাড়ানো হবে, এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। সেই রাস্তাই তৈরি করছেন দলনেত্রী। অভিষেকের অভিজ্ঞতা কম। তাই তিনি আগেভাগে দল থেকে না বেরিয়ে নিজের বহিষ্কারের রাস্তা স্পষ্ট করছেন।

বিধানসভা ভোটের আগে রাজনৈতিক পথও মোটামুটি চূড়ান্ত করে ফেলেছেন মমতা। ইংরেজি নতুন বছরের শুরুতেই সংগঠন ও প্রশাসন নিয়ে দীর্ঘ বৈঠক সেরে ফেলেছেন তৃণমূল নেত্রী। তার সঙ্গে এই বৈঠকে ছিলেন অভিষেক। পরে সেখানে উপস্থিত হন রাজ্য সভাপতিও। সেখানেই সংগঠন ও প্রশাসন নিয়ে দলের অন্দরে উদ্ভূত জটিলতা নিয়ে সবিস্তার আলোচনা হয়েছে। এই জটিলতা কাটাতেই মমতার পরামর্শে একগুচ্ছ সিদ্ধান্তও নিয়েছেন অভিষেক। 

দলীয় সূত্রে খবর, গত লোকসভা ভোটের ফলের ভিত্তিতে যেসব পদক্ষেপ নিয়ে অভিষেক এগোতে চেয়েছিলেন, সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানেই এই পরিবর্তনের প্রয়োজন ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। এবং ২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে দলের সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিয়ে সময় নষ্ট না করার কথাও উল্লেখ করেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। জানা গেছে, তার ভাবনায় সায় দিয়ে গোটা বিষয়টিতে সমন্বয় তৈরির ভার দেওয়া হয়েছে রাজ্য সভাপতিকে।

একদা ক্যামাক স্ট্রিটগামী নেতারা ক্রমশ কালীঘাটমুখী হচ্ছেন। ‘কালীঘাটপন্থি’ যে নেতারা মাঝে অভিষেকের খুল্লমখুল্লা প্রশংসা করতেন, তারা ফিরছেন পুরোনো অবস্থানে। নতুন বছরের সবে কয়েক দিন কেটেছে। সমাপতন, কিন্তু বছর বদলের সঙ্গেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে শাসক তৃণমূলের অন্দরে ভরকেন্দ্র বদল। সৌজন্যে শিল্পীদের একাংশকে বয়কট করাসংক্রান্ত বিতর্ক। আরজি কর পর্বে সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা করা শিল্পীদের বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ। 

বৃহস্পতিবার সেই প্রসঙ্গে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, কুণালের বক্তব্য ‘দলের অবস্থান’ নয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেখা গেল, কুশালের পাশে দাঁড়ালেন প্রবীণ তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘কৌশলী’ মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। যার মর্মার্থ; মমতার মতোই তার পথ। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শিল্পীচয়নসংক্রান্ত বিভিন্ন স্তরে দলীয় বার্তার ‘প্রমাণ’ হিসেবে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের একাধিক ‘স্ক্রিনশট’ প্রকাশ্যে এসেছে। যা নিয়ে নতুন করে শোরগোল শুরু হয়েছে তৃণমূলের অন্দরে। প্রসঙ্গক্রমে চলে এসেছে আরজি কর-কাণ্ডও। সেই পর্বে সরকার এবং শাসকদল যখন ‘কোণঠাসা’, তখন তৃণমূলের হয়ে যারা সরব ছিলেন, তাদের মধ্যে কুণাল অন্যতম।

 কল্যাণও বিভিন্ন মন্তব্য করে কুণালের তালে তাল ঠুকেছিলেন। তা মনে করিয়ে দিয়ে শুক্রবার কল্যাণ বলেছেন, ‘আরজি কর পর্বে তো অনেককে কথাই বলতে দেখা যায়নি। যা বলার কুণাল বলত। আর আমি বলতাম।’ তৃণমূলপন্থি জুনিয়র ডাক্তারদের প্রসঙ্গও টেনেছেন কল্যাণ। শ্রীরামপুরের সাংসদের কথায়, ‘আমাদের ছেলেদের ধরে ধরে সাসপেন্ড করেছিল। কুণাল ওদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আর আমি মামলা লড়েছি। 

তখন কেউ ছিল না।’ শিল্পীদের একাংশকে বয়কটের আহ্বান প্রসঙ্গে অভিষেক আরজি করের প্রসঙ্গও তুলেছিলেন। ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ভাবে শুক্রবার আরজি কর পর্বের উল্লেখ করে কুণাল দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের সম্পর্কে বলেছেন, ‘অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ওই সময়টায় বাইরে ছিলেন।’ কারণ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এটা ঠিক যে, আরজি কর আন্দোলন পর্বে অভিষেক সেভাবে সক্রিয় ছিলেন না। তিনি ‘সক্রিয়’ হয়েছিলেন শুধু ১৪ আগস্ট ‘মেয়েদের রাত দখল’ অভিযানের পরে রাতে আরজি করে ও চড়লের পাটনায়। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসের কর্মসূচিতে অভিষেক প্রকাশ্যেই ‘রাত দখল’ অভিযানকে শ্রদ্ধা আউডিদেন। 

অভিষেক ‘বাইরে ছিলেন’ বলে কুণাল শুক্রবার সেটাই মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন। কুণালের বয়কটের ডাককে সমর্থন করে কল্যাণ জানিয়েছেন, তার সংসদীয় এলাকায় দলের লোকেরা যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত, সেখানে এমন কোনো শিয়াকে তিনি ঢুকতে দেবেন না, যারা আরজি কর পর্বে তৃণমূল তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতার সমালোচনা করেছেন। কল্যাণের কথায়, ‘আমাদের সব আবেগ মমতাদিকে ঘিরে। তাকে যারা অসম্মান করেছেন, সেই শিল্পীদের কেন ডাকতে যাব? আমার এলাকায় তো আমি ঢুকতে দেব না।’ আবার শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বলেছেন, ‘দেখাই যাচ্ছে দলে দুই রকমের মত রয়েছে। আমাদের দল রেজিমেন্টেড নয়। অনেক খোলামেলা। তাই কেউ কারও কথা বলতেই পারেন।’ সেই সঙ্গেই ব্রাতোর সংযোজন, ‘দলে অভিষেকের স্থান আমার থেকে অনেক উঁচুতে। তাই অভিষেক ঠিক না কুণাল ঠিক, তা আমি বলতে পারব না। তবে দলের সদস্য হিসেবে বলতে পারি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতই আমার মত।’ ব্রাত্য শুধু মন্ত্রী নন। তিনি নাট্যকার, অভিনেতা এবং পরিচালক। সেই ‘শিল্পীসত্তা’ থেকেও তিনি তার অবস্থান জানিয়েছেন।

 তার বক্তব্য, কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদি সরকার আসার পর থেকে তার পরিচালিত দল কোনো অনুদান নেয়নি। যে শিল্পীরা সমালোচনা করেছিলেন, তারা ঠিক করুন (রাজ্য সরকারের) অনুগ্রহ নেবেন কি না। ব্রাত্যের কথায়, ‘বিরোধিতাও করব আবার অনুদানের জন্য নাকে কাঁদব, দুটো একসঙ্গে হতে পারে না।’ কিন্তু শিল্পী বয়কটের প্রশ্নে মমতার অভিমত কী? এ বিষয়ে তৃণমূল নেত্রীর কোনো মন্তব্য বা বিবৃতি এখনো প্রকাশ্যে আসেনি। তবে কল্যাণের মতো টানা চারবারের সংসদ সদস্য দলের সর্বময় নেত্রীর অনুমোদন ব্যাতিরেকে এমন বলছেন, এ কথা তৃণমূলের কেউই প্রায় বিশ্বাস করছেন না। বৃহস্পতিবার অভিষেকের বক্তব্যের পাল্টা কুণাল বলেছিলেন, ‘মমতাদি বলে দিন, আমি ভুল বলছি। মেনে নেব।’ শুক্রবার পর্যন্ত মমতা বলেননি, কুণাল ‘ভুল’ বলেছেন। যে দিন ব্রাত্য বললেন, মমতার মতামতই তার মত।

ঘটনাচক্রে ঠিক এক বছর আগে অভিষেকের ‘নবীন’ তত্ত্বের পক্ষে দাঁড়িয়ে প্রবীণদের বিঁধেছিলেন কুণাল। কথায় কথায় তিনি বলতেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার নেত্রী। অভিষেক আমার সেনাপতি। সেই তিনি শেষ কবে অভিষেককে ‘সেনাপতি’ বলে উল্লেখ করেছেন, তা অনেকেই মনে করতে পারছেন না। ব্রাত্যও অভিষেকের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলেই পরিচিত ছিলেন। ২০২৩ সালের শেষ দিকে অভিষেক যখন সংগঠন থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন, নিজেকে ডায়মন্ড হারবারের মধ্যে ‘সীমাবদ্ধ’ রেখেছিলেন, তখন যে কয়েকজন নেতা তাকে বোঝাতে দৌত্য চালিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ব্রাত্য এবং কুণাল ছিলেন অন্যতম। একটা সময়ে অভিষেকের বিমানে তার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন ব্রাত্য। আবার কল্যাণ একটা সময়ে অভিষেককে ‘অপছন্দ’ করলেও পরে তার ঢালাও প্রশংসাও করেছেন। সেই তিনিও শিল্পী বয়কট বিতর্কে অভিষেকের বক্তব্যকে খণ্ডন করে কুণালের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

অভিষেকের যাবতীয় পরিকল্পনা মমতা ভেস্তে দিয়েছিলেন। সেই কারণে ভাইপো নভেম্বর মাসে নিজের লোকজনকে দলের সংগঠনে বসাতে পারেননি। কিন্তু তিনি যে শেষ দেখে ছাড়বেন তা আবারও স্পষ্ট হলো। বৃহস্পতিবার তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, রদবদল হবেই। এ কথা স্পষ্ট, যে অভিষেকের রদবদলের পরিকল্পনায় বাধা দেবেন মমতা। আর তখনই নতুন দল তৈরির বড় ধাপ পেরোবেন ‘ভাইপো’।

ঠিক সময়েই দলে সাংগঠনিক রদবদল হবে বলে জানিয়ে দিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার নিজের সংসদীয় কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান কর্মসূচি ‘সেবাশ্রয়’-এর উদ্বোধন করেন তিনি। সেখানেই সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে অভিষেক ফের দলে সাংগঠনিক রদবদলের বিষয়ে মুখ খোলেন। তা ছাড়া আরজি কর, কেন্দ্রীয় বঞ্চনা, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়েও প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।

সাংগঠনিক রদবদল
অভিষেক বলেন, ‘সাংগঠনিক রদবদল হবেই। যারা দলের জন্য কাজ করেছেন, তাদের চিন্তা করতে হবে না। গাছের পরিচয় তার ফলে। আমি কত দক্ষ, কত অভিজ্ঞ, তা তো ফলাফল দেখলেই বোঝা যাবে।’ ডায়মন্ড হারবারের সংসদ সদস্য জানান, দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি ইতোমধ্যেই রদবদলের বিষয়ে নির্দিষ্ট প্রস্তাব দলনেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠিয়েছেন। এ বিষয়ে দলনেত্রীই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান তিনি। অভিষেক বলেন, ‘পরপর ভোট এবং উৎসব ছিল। ঠিক সময়েই হবে (সাংগঠনিক রদবদল)।’ প্রসঙ্গত, মমতার উপস্থিতিতেই ২১ জুলাইয়ের সভামঞ্চ থেকে সাংগঠনিক রদবদলের কথা জানিয়েছিলেন অভিষেক। তিনি জানিয়েছিলেন, লোকসভায় যেখানে যেখানে দলের খারাপ ফল হয়েছে, সেই সব পুর এলাকায় প্রশাসনিক স্তরে ‘রদবদল’ হবে। সেই সূত্রে কমবেশি ৭০টি পুরসভা ও পুরনিগমে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান পদে রদবদলের প্রস্তাব মমতার কাছে অভিষেক পাঠিয়ে দিয়েছিলেন অক্টোবরে বিদেশে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার আগেই। তবে নিজের জন্মদিনে গত ৭ নভেম্বর অভিষেক একান্ত আলোচনায় এও জানিয়েছিলেন, সেই রদবদল থেকে আপাতত বাদ থাকছে কলকাতা। অভিষেক এও বলেছিলেন, রদবদলের নিরিখ হবে লোকসভা ভোটের ফল। ফের তিনি সেটাই স্পষ্ট করতে চেয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২১ জুলাইয়ের সমাবেশ থেকে অভিষেক জানিয়েছিলেন, তিন মাসের মধ্যে রদবদল হবে। কিন্তু সেই সময়সীমা পেরিয়ে গেছে। নভেম্বরে অভিষেক-ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য ছিল, ছয়টি উপনির্বাচনের ফল ঘোষণার পরে রদবদলসংক্রান্ত ঘোষণা হতে পারে। কিন্তু তাও হয়নি। এর মধ্যে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সমীকরণ নিয়ে নানা আলোচনা হয়েছে তৃণমূলে। তার মধ্যেই অভিষেক জানিয়ে দিলেন, রদবদল হবেই। তৃণমূলের একটি সূত্রের বক্তব্য, রদবদলসংক্রান্ত বিষয়ে কাজ চলছে, যা নিজে তত্ত্বাবধান করছেন দলের সর্বময় নেত্রী মমতা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর সঙ্গেও কথা বলছেন তিনি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে কবে রদবদলসংক্রান্ত ঘোষণা হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
দলে বিভাজন নয়, ঐক্য
লোকসভা ভোট-পরবর্তী পর্যায়ে নানা ঘটনায় তৃণমূলের মধ্যে নেতৃত্বের সমীকরণের প্রশ্নে আলোচনা রয়েছে। সম্প্রতি মুখপাত্র তালিকা প্রকাশের পর যা আরও প্রকট হয়েছিল। দলের মধ্যে যারা ‘অভিষেক-ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত, তাদের বাদ পড়া নিয়েও জল্পনা তৈরি হয়েছিল শাসকদলের অন্দরে। যদিও অভিষেক, সেই সব জল্পনায় জল ঢালতে চেয়েছেন বৃহস্পতিবার। তার কথায়, ‘আমার কাজ দলে দলে ঢুকে জোড়া ফুল ফোটানো। রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী আমার কাছে এলে খবর হয়।’ ডায়মন্ড হারবারের সংসদ সদস্যের সংযোজন, ‘আমি পার্টির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। আমার সঙ্গে রাজ্য সভাপতি বৈঠক করতে পারেন কি পারেন না? আমরা তো সহকর্মী, সহযোদ্ধা।’
আরজি কর
অভিষেকের প্রায় সওয়া এক ঘণ্টার বক্তব্যে আসে আরজি কর প্রসঙ্গও। তিনি বলেন, ‘বিরোধীরা বলেছিলেন আরজি করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চক্রান্ত করেছেন। আর আজ দেখুন। এই প্রসঙ্গ তারা তুলছেন না।’ আরজি কর হাসপাতালে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় সিবিআইয়ের দিকে তোপ দেগে অভিষেক বলেন, ‘অভিযুক্তকে ধরেছিল কলকাতা পুলিশই।’ অভিষেকের বক্তব্যে আরও একবার আসে আরজি কর হাসপাতালের কথা। ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রের ৩০০টি স্বাস্থ্যশিবিরে যাওয়া রোগীদের রাউকে কাউকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হবে। অভিষেক জানান, ‘রেফারেল সিস্টেম’-এর মাধ্যমে মোট ১২টি হাসপাতালে রোগীদের পাঠানো হবে। এই ১২ হাসপাতালের তালিকায় এসএসকেএম, ডায়মন্ড হারবার মেডিকেলের মতো হাসপাতালের সঙ্গে রয়েছে আরজি কর হাসপাতালও।

লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক

 

নগরের পয়োনিষ্কাশন ও পানি চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল

প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:৩৩ পিএম
নগরের পয়োনিষ্কাশন ও পানি চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল
ইকবাল হাবিব

প্রতিটি শহরের জন্য সবুজ নেটওয়ার্ক তৈরিতে, সবুজ এলাকা, জলাশয় এবং গণপরিসর রক্ষা ও পুনরুদ্ধারে স্বতন্ত্র রূপকল্প এবং কার্যকর সরকারি নীতির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকার ড্যাপ (২০২২-৩৫) অনুযায়ী প্রস্তাবিত পাঁচটি আঞ্চলিক পার্ক, ২৪টি জলকেন্দ্রিক পার্ক, চারটি ইকোপার্ক এবং অন্যান্য পার্কের অবস্থান, আকার, নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা তৈরি ও তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দেশের বন-নীতিতে নগর সবুজায়ন অন্তর্ভুক্ত করে ছোট পার্ক ও সবুজ করিডোর নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রতিটি এলাকা বা ওয়ার্ডভিত্তিক খেলার মাঠ নিশ্চিত করতে হবে এবং পাবলিক ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত মাঠগুলো থেকে ক্লাব অপসারণ করতে হবে।...

ঢাকার পয়োনিষ্কাশন ও পানি সরবরাহব্যবস্থা বর্তমানে জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে অপর্যাপ্ত। বর্তমানে রাজধানীতে ওয়াসার মাত্র ২০ শতাংশ এলাকায় পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা রয়েছে। বস্তি এলাকায় নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশনের মতো পরিষেবা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। ক্রমাগত উত্তোলনের কারণে রাজধানী ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রায় নিঃশেষিত। এ ছাড়া, নগরের চারপাশের নদনদী ক্রমশ দূষিত হচ্ছে। প্রধানত নয়টি শিল্পঘন এলাকা- টঙ্গী, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, তারাবো, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর, ডিইপিজেড ও ঘোড়াশাল থেকে পাঁচটি নদীতে প্রায় ৬০ হাজার ঘনমিটার বিষাক্ত বর্জ্য নিঃসরণ হয়। বায়ু এবং পানিদূষণের ফলে ক্ষতিকর রাসায়নিক ও ভারী ধাতু নগরবাসীর খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলছে। এর পাশাপাশি, ক্রমবর্ধমান প্লাস্টিকবর্জ্য সর্বত্র এক সংকটের সৃষ্টি করছে। ঢাকায় বর্তমানে মাথাপিছু ২৪ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ঢাকার জলাশয়গুলোয় প্রতি ঘনমিটার পানিতে ৩৬ হাজার পিস মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। নগরে সৃষ্ট কঠিনবর্জ্যের একটি বড় অংশ (প্রায় ৪০ শতাংশ) কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সংগৃহীত হয় না। নগর কর্তৃপক্ষ যেটুকু কঠিনবর্জ্য সংগ্রহ করে তার বেশির ভাগই ল্যান্ডফিলে ফেলা হয়, যা বাংলাদেশের মতো অত্যন্ত ভূমিস্বল্প এবং ঘনবসতির দেশের জন্য উপযোগী পন্থা নয়।

সেহেতু, উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে আধুনিক পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, পানি পরিশোধন প্রকল্প স্থাপন এবং সুষম পানি সরবরাহ নিশ্চিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নগরবাসীদের জন্য বিশেষ করে নারী, শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধীদের জন্য স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে প্রতি আধা কিলোমিটার পর পর গণপ্রক্ষালন কেন্দ্র এবং সুপেয় পানির সংস্থান করতে হবে। রেস্টুরেন্ট, পেট্রোল পাম্প, শপিং মল, গণপরিসরের মতো স্থানগুলোয় নগরবাসীর ব্যবহারের জন্য প্রক্ষালন কেন্দ্রের সংস্থান বাধ্যতামূলক এবং সর্বজনীন করতে হবে। প্রয়োজনে এসব প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স এবং অন্যান্য অনুমতিপত্র প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি, এ ধরনের নগর সুবিধার অবস্থান ও তথ্য মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে জনগণের কাছে সহজে পৌঁছে দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কঠিনবর্জ্যের ক্ষেত্রে, ‘পুনর্ব্যবহার ও চক্রায়িত ব্যবহার’ সুগম করার জন্য বর্জ্যের শ্রেণিভুক্তিকরণ চালু করতে হবে। কঠিনবর্জ্যের পরিমাণ কমানোর লক্ষ্যে ‘কম ব্যবহার, পুনর্ব্যবহার, চক্রায়িত ব্যবহার’-এর নীতি অনুসরণ করতে হবে। বিশেষত, ‘একবার ব্যবহার্য’ (সিঙ্গেল ইউজ) পণ্য কেনা ও ব্যবহারের বিস্তৃতি রোধ এবং জৈবক্ষয়িষ্ণু (বায়ো-ডিগ্রেডেবল) প্লাস্টিক ব্যবহারে উদ্যোগী হতে হবে। কার্যকর বর্জ্যব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গড়ে তুলতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ তৈরির প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে। কঠিনবর্জ্যকে সম্পদ হিসেবে দেখতে হবে এবং তা ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনে সচেষ্ট হতে হবে।
জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে কার্যকর রেফারেলভিত্তিক ত্রিস্তরীয় পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতি গড়ে তোলা প্রয়োজন এবং সে লক্ষ্যে ‘একীভূত স্বাস্থ্য’ ধারণাকে স্বাস্থ্যসেবার মৌলিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। প্রান্তিক নগরবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নেটওয়ার্কের আওতায় এনে স্বাস্থ্য কার্ড প্রদান করতে হবে।

নগরবন্যা, গণপরিসর ও আন্তনীল সংযোগ
যেহেতু, নগরবন্যা ও জলাবদ্ধতা বাংলাদেশের নগরের একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকায় ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিস্তীর্ণ এলাকা নগরবন্যায় প্লাবিত হয়। ২০১০ সালের ড্যাপে চিহ্নিত ঢাকার জলাশয়গুলো অনেকাংশেই বিলীন হয়েছে। তার পরও ড্যাপ (২০২২-২০৩৫)-এ ঢাকা শহরের ৬৬ শতাংশ এলাকা বন্যাপ্রবাহ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে তার ৫৩ শতাংশই ‘শর্তসাপেক্ষে’ উন্নয়নের আওতাধীন করা হয়েছে। ‘রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (RDRC)’ ঢাকার মোট ৭৮টি খাল চিহ্নিত করেছে, যার সঙ্গে ঢাকার পার্শ্বস্ত চারটি নদীর সরাসরি সংযোগ ছিল বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। খাল খননের মাধ্যমেই ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যার প্রায় ৮০ শতাংশের সমাধান হতে পারে। কিন্তু নগরবাসীর কাঙ্ক্ষিত ‘ব্লু নেটওয়ার্ক বা আন্তনীল সংযোগ’ প্রতিষ্ঠায় এখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। গত চার বছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ৭৩০ কোটি টাকা খরচ করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। 

এ ছাড়া, ঢাকা শহর ২০০২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ সবুজ আবরণ হারিয়েছে। ঢাকায় সবুজ আচ্ছাদনের পরিমাণ বর্তমানে ৮ শতাংশেরও কম। অথচ, বাসযোগ্য নগরীতে ১২ শতাংশ উন্মুক্ত স্থান ও ১৫ শতাংশ এলাকায় সবুজের আচ্ছাদন থাকার কথা। বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকার অবস্থান ধারাবাহিকভাবে অবনমিত হচ্ছে। গণপরিসর এবং সবুজ এলাকার অভাব নগরের বাসিন্দাদের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

নগরবন্যা ও জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে, নগরের বারিপাত অঞ্চলগুলোর প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা এবং পানি ধারণের জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে এবং অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রাকৃতিক ঢালের পরিস্থিতি অনুযায়ী পানি নিষ্কাশনের জন্য নতুন নালা (স্টর্ম ড্রেন) নির্মাণ করতে হবে এবং সেই নালাগুলোকে প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশনব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। ২০১০ সালের ড্যাপে চিহ্নিত জলাশয়গুলোকে পুনরুদ্ধার করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে এবং এ লক্ষ্যে ড্যাপ ২০২২-৩৫ সংশোধন আশু প্রয়োজন। উল্লেখ্য, ড্যাপের ২০১৫ সালের সমীক্ষা অনুসারে ঢাকা মহানগরীতে মোট জলাশয় ও জলাধার (নদী, খাল, লেক, পুকুর, নালা, জলাভূমি)-এর পরিমাণ প্রায় ২১৭ বর্গকিলোমিটার। 

বন্যা ও জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকায় এ ধরনের সমস্যা দূরীকরণে সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (যেমন- পানি ধারণ পুকুর, পানি সংরক্ষণ/রিজার্ভার, বৃষ্টিবাগান, ছাদবাগান, সড়ক বিভাজকে বায়ো-সোয়েল স্থাপন ইত্যাদি) গ্রহণ করতে হবে। নগরের অভ্যন্তরীণ খালগুলো সমন্বিতভাবে পুনরুদ্ধার ও পুনরুজ্জীবিত করে এগুলোকে কীভাবে পরস্পরের এবং পার্শ্ববর্তী নদনদীর সঙ্গে সংযুক্ত করা যায় তার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি ‘ব্লু নেটওয়ার্ক বা আন্তনীল সংযোগ’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে, প্রথমেই আন্তনীল সংযোগ পুনরুদ্ধারে ‘ভূ-প্রাকৃতিক সমীক্ষার’ (Geomorphological Survey) মাধ্যমে ডাটাবেজ তৈরি করে খাল ও জলাশয়ের বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করতে হবে। একই সঙ্গে পানির প্রবাহ ও বারিপাতের ধারা বুঝতে গাণিতিক মডেল এবং হাইড্রো-মরফোলজিকাল মডেল ব্যবহার করে জলাবদ্ধতা প্রতিরোধে উপযুক্ত জল ধারণ এলাকা নির্ধারণ করা জরুরি। জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে খাল পুনরুজ্জীবিতকরণের পাশাপাশি এসব জলাশয় ব্যবস্থাপনায় ও রক্ষণাবেক্ষণে নগরবাসীর অভিভাবকত্ব (Stewardship) নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে একটি বাস্তবায়নমুখী রূপরেখা তৈরি করে খাল ও নদীর সংযোগ স্থাপন এবং দুর্যোগব্যবস্থাপনার জন্য আন্তনীল সংযোগ প্রতিষ্ঠা করায় অগ্রাধিকার দিতে হবে। আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন’কে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। এসব জলাশয় পুনরুদ্ধার ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা হ্রাস, জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি এবং নাগরিকদের জন্য বিনোদনমূলক সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব।

পাশাপাশি, প্রতিটি শহরের জন্য সবুজ নেটওয়ার্ক তৈরিতে, সবুজ এলাকা, জলাশয় এবং গণপরিসর রক্ষা ও পুনরুদ্ধারে স্বতন্ত্র রূপকল্প এবং কার্যকর সরকারি নীতির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকার ড্যাপ (২০২২-৩৫) অনুযায়ী প্রস্তাবিত পাঁচটি আঞ্চলিক পার্ক, ২৪টি জলকেন্দ্রিক পার্ক, চারটি ইকোপার্ক এবং অন্যান্য পার্কের অবস্থান, আকার, নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা তৈরি ও তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দেশের বন-নীতিতে নগর সবুজায়ন অন্তর্ভুক্ত করে ছোট পার্ক ও সবুজ করিডোর নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রতিটি এলাকা বা ওয়ার্ডভিত্তিক খেলার মাঠ নিশ্চিত করতে হবে এবং পাবলিক ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত মাঠগুলো থেকে ক্লাব অপসারণ করতে হবে।

পরিশেষে, ঢাকা মহানগরী একটি ‘অপরিপক্ব নগর’, যেখানে নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনযাপনে প্রয়োজনীয় মৌলিক সুবিধাগুলোর প্রবল অভাব রয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন একটি সুসংহত, টেকসই এবং আধুনিক নগর পরিকল্পনা- যা শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন নয়, বরং পরিবেশ, সামাজিক সেবা, নিরাপত্তা এবং নাগরিক সুবিধার ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। সেই লক্ষ্যে, সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন, সুশীল সমাজ এবং নাগরিকদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন কৌশল এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ এবং সুস্থ জীবনযাত্রা নিশ্চিত করা সম্ভব।

লেখক: স্থপতি ও নগরবিদ
[email protected]

মুখে তাকিয়ে কাজে ফাঁকি

প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:২৭ পিএম
মুখে তাকিয়ে কাজে ফাঁকি
ড. পবিত্র সরকার


     সেই গ্রিক মহাকাব্য ‘ইলিয়াডে’ হেলেন নামক এক সুন্দরীকে ইলিয়াম বা ট্রয়ের যুদ্ধের জন্য দায়ী করা হয়েছিল বটে, কিন্তু তার পরে পৃথিবীর অজস্র অপরাধ পুরুষেরা করে চলেছে, খুন-ধর্ষণ থেকে রক্তক্ষয়কারী যুদ্ধ পুরুষেরাই বাঁধিয়েছে, দুটি প্রলয়ংকর বিশ্বযুদ্ধসহ। এখনো ইউক্রেন বা ফিলিস্তিনে যে যুদ্ধ চলছে তা সংঘটনে শতকরা ১০০ ভাগ কৃতিত্ব পুরুষদের। সেখানে ফাঁকিবাজির কোনো ভূমিকা নেই, বরং উদ্যমের আছে। পুতিন বা নেতানিয়াহুর সেই সব উদ্যমের পেছনে তাদের স্ত্রীদের স্বামীর মুখের দিকে (বা ভাইসি ভার্সা) তাকিয়ে থাকার কোনো ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ছিল কি না আমরা জানি না।...

আগেকার বিলিতি কোম্পানি লার্সেন অ্যান্ড টুব্রোর বড় কর্তা নাকি অফিসে, কারখানায়, আদালতে সর্বত্র ৯০ ঘণ্টা কাজ করার জন্য প্ররোচনা দিয়েছেন। এই প্ররোচনার ভাষা রীতিমতো আলংকারিক। তিনি বলেছেন, বাড়িতে কতক্ষণ আপনি আপনার বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবেন, বা বউ-ই বা কতক্ষণ আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবেন। অফিসে আসুন, কাজ করুন। তার ইঙ্গিত, তাতেই দেশের এবং পৃথিবীর উন্নতি, জীবনানন্দের ভাষায় ‘পৃথিবীর ক্রমমুক্তি’ ঘটবে। 
এই সুব্রহ্মণ্যম্ পদবির ভদ্রলোক নিশ্চয়ই বিপুল পরিমাণে শিক্ষিত ও দক্ষ, যে কারণে তিনি, বাপ্ রে! একটা কোম্পানির মাথা হতে পেরেছেন। লাখ লাখ জন্মের সাধনা ও পুণ্যের ফলে মানুষ তা হতে পারে। এর জন্য নিশ্চয়ই তার ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষ থেকে তপস্যা করা হয়েছে। ফলে তিনি মোটামুটি দেড় শ বছর আগেকার মে দিবসের ইতিহাস আবর্জনাস্তূপে ছুড়ে ফেলতে চান এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের নতুন এক নীতি ও মূল্যবোধে দীক্ষা দিতে চান। দিয়ে, মার্কস-এঙ্গেলসের মূর্তি ভেঙে পৃথিবীর ইতিহাসে চিরস্মরণীয় এক চিন্তাবীর ও কর্মবীর হিসেবে চিহ্নিত হতে চান।
আমি জানি না, নিষ্ঠুর ইতিহাস তাকে সেই সুযোগ দেবে কি না। কিন্তু তার কথাগুলো নিয়ে আমরা একটু নাড়াচাড়া করতে চাই। আমরা তুচ্ছ ও হালকা লোক, তার কথায় আমাদের প্রচণ্ড তাজ্জব হওয়ার ব্যাপারটা তিনি অনুমোদন করবেন আশা করি। তিনি এটা রসিকতা করেছেন যদি বলেন, তা আমাদের রসিকতার ধারণার সঙ্গে মেলে না। প্রথমত, তিনি ইঙ্গিতে কর্মীদের কাজ কম করার যে কারণটি দিয়েছেন, সেটিই একমাত্র তার মনে কেন এল, তার মনস্তত্ত্ব আমি বুঝতে পারছি না। যারা বিবাহিত নন তারা কি তার মতে ঠিকঠাক কাজ করেন? তাদের তো স্ত্রী নেই? বলতে পারেন, স্ত্রী না থাকতে পারেন, হয়তো প্রেমিকা আছে। কিন্তু তা কী করে হবে? কুমার পুরুষদের সবার ঘরে ঘরে প্রেমিকা থাকবে পরস্পরের মুখের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকার জন্য, ভারতীয় সমাজব্যবস্থা এ জায়গায় পৌঁছেছে নাকি! তা হলে তাকে প্রেমিকা শুধু নয়, ‘লিভ-ইন পার্টনার’ হতে হবে। ভারতীয় সমাজে এখনো সেই পরিমাণে ‘প্রগতি’ হয়েছে বলে মনে হয় না, যাতে বাংলা সুবচনের মতো বলা যায়, ‘ধনকে নিয়ে বনকে যাব, সেখানে খাব কী? আড়ালে বসিয়া চাঁদের মুখ নিরখি’- ওই ‘চাঁদ কথাটার মানে একটু বদলে নিয়ে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, তিনি কর্মীদের কাজে ফাঁকি দেওয়ার কারণ হিসেবে তাদের স্ত্রীদের অর্ধেক দায়ী করছেন। যেন স্ত্রীরা আছে বলেই যত গণ্ডগোল, স্ত্রীদের অস্তিত্ব ভারতের বা দক্ষিণ এশিয়ার কর্মসংস্কৃতির পক্ষে বিপজ্জনক। স্ত্রী (বা লিভ-ইন সঙ্গী) থাকলেই তার মুখের দিকে তাকিয়ে, বা তিনি গৃহকর্তার (এ কথাটাও নারীবিদ্বেষী হলো, কারণ মেয়েরাও অনিক সংসার চালান, bread-winner হিসেবে) দিকে তাকিয়ে থাকেন। সুব্রহ্মণ্যম্ সাহেব বলেননি, কতক্ষণ তাকিয়ে থাকা তিনি অনুমোদন করেন। তিনি যদি মিনিট সেকেন্ডের হিসাব করে একটা সময় বেঁধে দিতেন, তা হলে আমাদের এই ফাঁকিবাজ, কর্মবিমুখ, কর্মচোরা সমাজের সদস্যদের ভারী উপকার হতো। তারা ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে বা স্টপ-ওয়াচ চালু করে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে, অ্যালার্ম বাজা মাত্রই চোখ বন্ধ করে অফিসে রওনা হতেন। এতে কারও কোনো অভিযোগ থাকত না। আমরা ভবিষ্যতে তার কাছে ওই সময়মাত্রার নির্দেশ চাইব। 
যাই হোক, আমি জানি না, তার ধর্মপত্নী আছেন কি না, থাকলে তার এই বাণীতে তিনি কী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, হাতের কাছে ঝাঁটার খোঁজ করেছেন কি না। হয়তো সুব্রহ্মণ্যম্ সাহেব তার বাড়িতে তার আদর্শ মেনে চলেন, তিনি তার স্ত্রীর মুখের দিকে মোটেই বা বেশিক্ষণ তাকান না, বা তার স্ত্রীও তার মুখের দিকে একদম বা বেশিক্ষণ তাকান না। আদর্শ দাম্পত্য জীবন সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণা নেই, ফলে তাই স্বামী-স্ত্রীর মুখ-তাকাতাকির ব্যাপারটার সীমা কোথায় হওয়া উচিত, সে আমি আদৌ জানি না। কিন্তু আমি দেখছি যে, এই কর্মবীরটি আমাদের যত অফিস-আদালতের প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য মানুষের স্ত্রী থাকাকেই দায়ী করেছেন, এতে আমার ঘোর আপত্তি আছে। আশা করি, নারীবাদীরাও এ ব্যাপারে তাদের প্রতিবাদ জানাবেন। এ যেন সেই কুখ্যাত ফরাসি বিচারকের মতো, যিনি পুলিশ কোনো অপরাধের খবর নিয়ে এসেই নির্দেশের সুরে বলে উঠতেন, cherche la femme, শের্শে লা ফেম্, মানে আগে মেয়েটাকে খুঁজে ধরো, তা হলেই তোমার অপরাধের মীমাংসা হয়ে যাবে। মানে সব অপরাধের মূলে আছে একটি মেয়ে। 
এতে নারীবাদী নন, বরং তার বিপরীত, অর্থাৎ ‘পুরুষবাদী’ এমন পুরুষেরও আপত্তি করা উচিত, কারণ এ কথাটা তাদের পক্ষে মানহানিকর। যেন নারীর সাহায্য ছাড়া তারা নিজেদের ইচ্ছায় আর কৃতিত্বে কোনো অপরাধ করতে পারেন না, তাদের সে মুরোদই নেই। হ্যাঁ, সেই গ্রিক মহাকাব্য ‘ইলিয়াডে’ হেলেন নামক এক সুন্দরীকে ইলিয়াম বা ট্রয়ের যুদ্ধের জন্য দায়ী করা হয়েছিল বটে, কিন্তু তার পরে পৃথিবীর অজস্র অপরাধ পুরুষেরা করে চলেছে, খুন-ধর্ষণ থেকে রক্তক্ষয়কারী যুদ্ধ পুরুষেরাই বাঁধিয়েছে, দুটি প্রলয়ংকর বিশ্বযুদ্ধসহ। এখনো ইউক্রেন বা ফিলিস্তিনে যে যুদ্ধ চলছে তা সংঘটনে শতকরা ১০০ ভাগ কৃতিত্ব পুরুষদের। সেখানে ফাঁকিবাজির কোনো ভূমিকা নেই, বরং উদ্যমের আছে। পুতিন বা নেতানিয়াহুর সেই সব উদ্যমের পেছনে তাদের স্ত্রীদের স্বামীর মুখের দিকে (বা ভাইসি ভার্সা) তাকিয়ে থাকার কোনো ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ছিল কি না আমরা জানি না।
আচ্ছা, বিবাহিত পুরুষরা ছাড়া আর কেউ কাজে ফাঁকি দেয় না? বা আমি এও বুঝতে পারছি না যে, সুব্রহ্মণ্যম্ সাহেব শুধু বিবাহিত ও সংসারী পুরুষদেরই কাজে নেওয়ার পক্ষপাতী কি না। তা হলে তো একটা মহা মুশকিলের ব্যাপার হলো। আগে আমরা লেখাপড়া করতাম চাকরি পাওয়ার জন্য, চাকরি পেলে বিয়ের কথা ভাবতাম। তুমুল প্রেমে নিমগ্ন, এমন তরুণ-তরুণীদের আমরা বলি যে, একটু অপেক্ষা করো, আগে কেউ একটা চাকরি পাক। শ্রীসুব্রহ্মণ্যম্ দেখছি চাকরি পাওয়ার আগেই বিয়ের বিধান দিচ্ছেন। এটাও একটা বৈপ্লবিক নির্দেশ। জানি না, তিনি গৌরীদানের সুপারিশ করছেন কি না। আমরা এও ভাবছি, এ ব্যাপারে ভারতীয় আইনব্যবস্থার সঙ্গে তার কোনো বিবাদ হবে কি না? 
চাকরি করছে এমন বিবাহিত মেয়েদের কথাটা তার মনে নেই, তাদের বোধ হয় তিনি কাজের অযোগ্য বলে মনে করেন। কারণ, তার কথার মূল লক্ষ্য হলো হতভাগা স্বামীরা। তার কথার ব্যাকরণে স্বামীরা ‘তুমি পক্ষ’ বা ‘মধ্যম পুরুষ’, স্ত্রীরা থার্ড পারসন। তারা বাইরের কোনো কাজকর্ম করেন বলে মনে হয় না। তারা শুধু অফিস-কারখানায় যাওয়ার আগে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে দেরি করানোর কাজে পটু। অর্থাৎ মেয়েরা চাকরিবাকরি করুক, এটা সুব্রহ্মণ্যম্জির কল্পিত সংসারের ছবিতে নেই। লেখাপড়া করুক, সেটা কি চান? এ ব্যাপারে ভারতের বর্তমান মনুবাদী শাসকদের সঙ্গে তার গভীর সহমর্মিতা আছে। 
শ্রীসুব্রহ্মণ্যমের মতো আকাট মহাত্মা এই দক্ষিণ এশিয়ায় আর কতজন জন্মেছেন তা জানার ইচ্ছে রইল।

লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

 

প্রয়োজন ছিল সামাজিক ঐক্য, শ্রেণিভেদের অবলুপ্তি

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:০২ পিএম
প্রয়োজন ছিল সামাজিক ঐক্য, শ্রেণিভেদের অবলুপ্তি
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

আমাদের সাহিত্যের বিকাশের মধ্যেই উপ্ত ছিল এর দুর্বলতার বীজ। যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি দায়িত্ব নিল গদ্যের, তার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা ছিল দেশের বিপুল জনসাধারণের, বিচ্ছিন্নতা অপর কিছুর নয়, শ্রেণিরই। এমনকি ‘করুণার সাগর’ যে বিদ্যাসাগর তিনিও সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার চাইতে বিশেষ শ্রেণির জন্য উচ্চতর শিক্ষার আয়োজনের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন। প্রস্তুত ভূমিকে কর্ষণ করাই যে বুদ্ধিমানের কাজ, অপ্রস্তুত অরণ্যকে নিয়ে ধস্তাধস্তি করার তুলনায় তাদের এই পরামর্শ অস্বাভাবিক ছিল না। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও, বঙ্কিমচন্দ্র যে লাখ কথার এক কথা, ‘আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি’ এই সত্য কথাটায় বিশ্বাস রেখেছিলেন সেটাও অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। স্বার্থের অনুরাগী ছিলেন তারা জাতীয়তাবাদী হওয়া সত্ত্বেও, কৃষকপ্রেম থাকা সত্ত্বেও। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যে মানুষে মানুষে ব্যবধানের, অযোগাযোগের একটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তরূপ পরিখা খনন করেছিল তা ভরাট করা পরের কথা, তার ওপরে কোনো একটা প্রশস্ত ও মজবুত সেতু তৈরিতেও অনীহা ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির।

অন্যদিকে আবার এই শ্রেণি জন্মসূত্রেই ইংরেজের সঙ্গে যে তাঁবেদারি সূত্রে আবদ্ধ ছিল শ্রেণিগতভাবে, সেই জন্মগ্রন্থি ছেদ করাও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাঁবেদারির সেই সত্য মধ্যবিত্তের জনবিচ্ছিন্নতা কমায়নি, কমাবার কথাও নয়। মধ্যবিত্তের ‘চৌকস’ অংশ সোৎসাহে ইংরেজির চর্চা করেছে, চর্চা করে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়েছে, সাহেব-সুবো সেজেছে। বলাই বাহুল্য, বিচ্ছিন্নতার এই দুই কারণ আজও অক্ষুণ্ন আছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নেই কিন্তু ধনবৈষম্য চিরস্থায়ী হওয়ার পাঁয়তারা অহরহ করছে এবং ধনবৈষম্য বাড়ছে বৈ কমছে না। সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদারি কমেনি, তা বরঞ্চ অধিকতর ও গভীর হয়েছে। আজও তাই পণ্ডিতি লেখা ইংরেজিতেই লেখা হয়। আজও তাই বাংলা প্রবন্ধে আমরা ভূরি ভূরি ইংরেজি উদ্ধৃতি দিই, এইটা প্রমাণ করার জন্য যে, বাংলায় লিখলেও ইংরেজি যে জানি না, তা নয়। প্রমাণ অন্যে যতটা না চাক, নিজেই চাই তার চেয়ে বেশি। এই হীনম্মন্যতাবোধ অস্বাভাবিক নয়, নতুনও নয়, এ হচ্ছে তাঁবেদারির সুদীর্ঘ ঐতিহ্যধারার পরিণত ফসল। মধ্যবিত্তের জীবনের সীমাবদ্ধতা, তার জীবনে প্রবলতার ও উদ্ভাবনার স্বল্পতা, অভিজ্ঞতার সংকীর্ণতা, দার্শনিক চিন্তার সামান্যতা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির অকার্যকরতা- সবকিছুই প্রতিফলিত হয়েছে ভাষায়।

ধনবৈষম্য গদ্যের বিকাশকে ব্যাহত করছে আরও একভাবে। দারিদ্র্য সৃষ্টি করে। আমরা দরিদ্র বলেই যে অসমান তা তো নয়, অসমান বলেই আমরা দরিদ্র। সম্পদ উৎপাদন করে যে শ্রমশক্তি অসাম্য তাকে শোষণ করে করে পঙ্গু করে ফেলছে এবং কায়েমি স্বার্থে নিজের সুবিধার জন্য শ্রমশক্তিকে বিদেশে রপ্তানি করছে। ফলে উৎপাদন বাড়ছে না। দারিদ্র্যও ঘুচছে না। এবং দারিদ্র্য না ঘুচলে যে গদ্যের মুক্তি সম্ভবই হবে না, তার প্রচলনও যে ব্যাপক ও বিস্তৃত হবে না, সেটা বুঝবার জন্য তো বিশেষ বিবেচনাশক্তির আবশ্যক হয় না।

বাংলা গদ্যের কতকগুলো বৈশিষ্ট্য গদ্যের ব্যাপক অপ্রচলনেই প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া; যেমন- ক্রিয়াপদের বৈচিত্র্যহীনতা। সর্বনামের ক্ষেত্রে আপনি, তুমি, তুই-এর ব্যবহার। মাথায় চন্দ্রবিন্দুর পাগড়ি চাপিয়ে দিয়ে ‘তাকে’কে ‘তাঁকে’তে পরিণত করা যেন ধ্বনির প্রতি অতিরিক্ত মোহ, অনেক সময় অর্থকে খাটো করে ফেলে হলেও। (মন্ত্রশক্তিকে বিশ্বাসের প্রকাশ যেন, ধ্বনির সাহায্যে সম্মোহন সৃষ্টির অভিপ্রায়। এর প্রয়োজন হয় বিশেষভাবে সেই সময়ে যখন বক্তব্য থাকে অল্প।) বিশেষ্যকে ছাড়িয়ে ওঠে বিশেষণ।

এসব ব্যাপার-স্যাপার অপচয়মূলক তো বটেই, এরা আবার ভাষার দ্রুত ও যথার্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকও বটে। সামাজিক শ্রেণি-বিভাজন বাইরে থেকে বাধা দিচ্ছে ভাষার ব্যাপক ব্যবহারকে- ধনবৈষম্যের গভীর পরিখা খনন করে রেখে, সেই পরিখাকে দিনে দিনে গভীরতর করে। সেই শ্রেণি-বিভাজন এত চতুর যে, বাইরের প্রতিবন্ধকের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা না রেখে ভাষার অভ্যন্তরেও নিজেদের লাঠিয়াল বসিয়ে রেখেছে, ভাষা যাতে ব্যাপক প্রচার না লাভ করে, সে যেন কিছুতেই সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারে।

ভাষার ওপর এর চেয়ে স্কুল এবং অনেক সময় হাস্যকর পন্থায় লাঠিসোঁটা হাতে লাফিয়ে পড়ার যে সব ঘটনা একের পর এক ঘটেছে তারা তো ওই একইভাবে সামাজিক বিপ্লববিরোধী এবং সে কারণে গদ্যের মুক্তিবিরোধী, শক্তির কারসাজি। বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কী, এই বিতর্ক একদিন ওঠানো হয়েছিল। উর্দুই যে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা, এই মতবাদ যখন ওই বিতর্কের সাহায্যে কিছুতেই প্রতিষ্ঠা করা গেল না, তখন এল নতুন বিতর্ক। ততদিনে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, তাই বলা হলো- বাংলা ভাষা যথেষ্ট মুসলমানি নয়, তাই এ ভাষা রাষ্ট্রভাষা হবে না। মাতৃভাষা বিতর্কের পর রাষ্ট্রভাষা বিতর্ক। তাতেও ভরসা করা যায় না দেখে চেষ্টা হলো ভাষা সংস্কারের। বলা হলো, হরফ বদলাও, আরবি হরফ নাও, নইলে যথেষ্ট ইসলামি হতে পারবে না, নিলে অন্তত রোমান হরফটা নিয়ে নাও, ভাষার অবৈধজ্ঞানিকতা ঘুচে যাবে।

সেই যে নজরুল ইসলাম একদা আরবি-ফার্সি শব্দের নতুন উৎসমুখ খুলে দিয়েছিলেন বাংলা ভাষার জন্য, সেই কাজটির সূত্র ধরেই বাংলা সাহিত্যে ‘খুনের মামলা’ জমাট বেঁধেছিল এক সময়ে। প্রশ্ন উঠেছিল খুন শব্দ চলবে কি চলবে না। ব্যাপারটা ভাষাতাত্ত্বিক ছিল না আসলে, ছিল সাম্প্রদায়িক। এই সাম্প্রদায়িকতাই উল্টোভাবে এল পাকিস্তান সৃষ্টির পর এবং সেও- শত্রুর শত্রুতা এমনই অভিন্ন- নজরুল ইসলামকে কেন্দ্র করেই, বলা হলো, নজরুলের ‘হিন্দুয়ানি’ শব্দগুলোকে বাদ দিতে হবে ইসলামের স্বার্থে, মহাশ্মশান চলবে না, শ্মশানকে গোরস্থান বানাতে হবে। (প্রচার মাধ্যমগুলোতে কোন শব্দ ব্যবহার করা যাবে, কোনটা যাবে না, সে নিয়েও দ্বন্দ্ব বসেছে, চলছে আজও)। সাধু-চলিতর যে বিরোধটা মাঝে-মাঝেই মাথা চারিয়ে ওঠে, তারও উদ্দেশ্য সাধু নয়, সেও চায় ভাষাকে সামনের দিকে এগিয়ে না দিয়ে ভাষা ব্যবহারকারীদের দুই ভাগে বিভক্ত করে একটি ‘গৃহযুদ্ধের’ সূচনা করতে।

সাধু-চলিতর বিতর্ক অনেক আগেই মীমাংসা হয়ে গেছে আসলে, ঐতিহাসিকভাবে। সাধুকে পেছনে ফেলে এগিয়ে এসেছে চলিত বাংলা। একটা ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই ঘটেছে এই ঘটনা। সাধু ভাষাটা কৃত্রিম ছিল। সংস্কৃত পণ্ডিতদেরই অবদান ওটি, প্রধানত। আলালের, হুতোম পেঁচার, মধুসূদনের প্রহসনের, বিদ্যাসাগরের বিতর্কের ভাষাও চালু ছিল বটে, কিন্তু সে ভাষাকে যথেষ্ট ‘ভদ্র’ মনে করা হয়নি, বা তাকে যথেষ্ট ‘ভদ্র’ করে তোলা হয়নি। বাধাটা ছিল কোথায়? ছিল সামাজিক বিন্যাসের মধ্যেই, ছিল ভদ্রলোকদের শ্রেণিচরিত্রের অভ্যন্তরেই। কথা ছিল গদ্য আরও এগোবে। এগোলোও। এল চলিত ভাষা। কথা ছিল আরও এগোবে কিন্তু তা এগোলো না। কেননা তার শ্রেণি-দূরত্বটা রয়ে গেল। ভদ্রলোকেরা ‘ইতর’জন হতে রাজি হলেন না কিছুতেই, আঞ্চলিক শব্দের চয়ন করবেন বলে আঞ্চলিকতা প্রচার করলেন হয়তো-বা কখনো কখনো, কিন্তু গদ্যকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন ছিল যে সামাজিক ঐক্য, অর্থাৎ শ্রেণিভেদের অবলুপ্তি, তা গড়া সম্ভব হয়নি বলে গদ্যের চরিত্রেও কোনো বড় রকমের পরিবর্তন আসেনি।

বাংলাদেশে আমরা দু-দুবার স্বাধীন হয়েছি। আমরা মুক্তিযুদ্ধে লড়েছি। সামাজিক অগ্রগতি যে হয়নি তা নয়। বস্তুগত উন্নতিও যে হয়নি তা বললে মিথ্যা কথা বলা হবে। কিন্তু গদ্য তো পরিবর্তিত হয়নি। বরঞ্চ উল্টো আজ নাকি চেষ্টা হচ্ছে সেই পরিত্যক্ত সাধু ভাষাকে ফেরত আনবার। এসব ব্যাপারের সারমর্ম একটাই- সমাজব্যবস্থায় বৈপ্লবিক কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, একাধিকবার স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও সমাজ আজও মুক্ত হয়নি।

গদ্যের বিকাশে সংবাদপত্রের ভূমিকা অবহেলার বস্তু নয়। এটা বোধ হয় তাৎপর্যবিহীন নয় যে, আমাদের সংবাদপত্রে সংস্কৃতি পাতাটা আলাদা করে রাখা হয়, ছোটদের পাতার মতো বিচ্ছিন্ন পাতা সেটা। আর সংস্কৃতি বলতে সেখানে বোঝানো হয় চলচ্চিত্র ও নাটককেই। এই যে একদিকে সংস্কৃতিকে সংবাদপত্রের সাধারণ ক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এবং অপরদিকে সংস্কৃতি বলতে দৃশ্যমান বস্তুকে বোঝানো, এর অভ্যন্তরে নিশ্চয়ই একটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির সাংবাদিক তাৎপর্য এই যে, সংবাদপত্রের ভাষার পক্ষে সংস্কৃতিবান হওয়ার কোনো আবশ্যকতা নেই।

 সাংবাদিক গদ্য, সাহিত্যিক গদ্য নয়, এই কথাটা নীরবে-সরবে সব সময়েই বলা হচ্ছে। এবং এই বলাটাই অজুহাত হয়ে দাঁড়াচ্ছে ভাষাকে যথেষ্ট সুসংগত না করার। যেমন তেমন করে লিখলেই চলে যদি মনে করা হয়, তবে সে লেখা দায়সারা গোছের হতে বাধ্য। আর ওই যে আইন আছে, খারাপ মুদ্রা ভালো মুদ্রাকে তাড়িয়ে ছাড়ে, সেই আইন এখানেও চালু হয়ে যাচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই। দ্বিতীয়ত, সংস্কৃতি অর্থই যদি প্রদর্শনী হয় তবে সেই ঘটনা সাংবাদিকতার গদ্যের তুলনায় চিত্রকে প্রধান হতে সাহায্য করবে বৈকি। করছেও তাই। সংবাদপত্র যত বেশি সচিত্র হচ্ছে তত বেশি অসাহিত্যিক হচ্ছে। সলজ্জভাবে নয়, সন্তুষ্টভাবে। অনেক পত্রিকার পরিচালকই বলেন যে, তাদের পত্রিকার দর্শকের সংখ্যা পাঠকের সংখ্যার সমান বটে। ছোটদের পত্রিকাতেও দেখি চিত্র যতটা থাকে, সাহিত্য ততটা থাকে না। এরই নাম বোধ করি স্থূলতা।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য অরেকটি সত্য। সংবাদপত্রে চুরি-ডাকাতি-রাহাজানির খবর থাকে, সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অর্থহীন, অর্বাচীন উক্তিগুলো গলা ফাটিয়ে চেঁচায়, কিন্তু কোনো বইয়ের খবর, কিংবা সমালোচনা অথবা লেখক বুদ্ধিজীবীর কোনো প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য কিছুতেই নিজের জন্য ছোট একটু স্থানও খুঁজে পায় না। বলতে দ্বিধা থাকা উচিত নয়, যে সংস্কৃতির (যথার্থ অর্থে) অবমূল্যায়ন শুধু প্রতিক্রিয়াশীলরাই করেননি (তারা তো করবেনই, তারা জীবনের বিকাশবিরোধী) প্রগতিশীলরা, যারা সমাজবিপ্লব চান, তারাও করেছেন। উভয়ত-অবমূল্যায়িত সংস্কৃতির নিজের মানকে উন্নত করার অবকাশ তেমন একটা পায়নি এ দেশে।

সাংবাদিকতার সাহিত্য-বিরোধিতা আরও একভাবে ঘটেছে। আন্তরিকতাহীনতা যে সাহিত্যের পরম শত্রু এ তো কোনো প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। সাংবাদিকতার আন্তরিকতাহীনতা পদে পদে এসেছে। যা ঘটেছে তা বলা যায়নি, যা বলা গেছে তা ঘটেনি। যা লেখা হয়েছে তাতে আস্থা থাকেনি। না, লেখকের নিজেরও নয়, আর যাতে আস্থা ছিল তা লেখা যায়নি। সত্য গোপনের লুকোচুরি ও মিথ্যার বেসাতি মাশুল আদায় করে নিয়েছে সাংবাদিকতার প্রতি অবিশ্বাসের মূল্যে যেমন, তেমনি সাংবাদিকতার ভাষার ক্ষতিসাধনের মুদ্রাতেও। 

সাংবাদিকতার ক্ষতি গদ্যেরই ক্ষতি; তার প্রতি অনাস্থা ভাষার প্রতি অনাস্থার আকর বটে। এবং লেখকদেরও ধিক্কার এসেছে নিজেদের কাজের ওপর। গ্লানিময় হয়ে উঠেছে সবটা ব্যাপার-গৌরবময় না হয়ে। নজরুল ইসলামের সাংবাদিকতা যে সমান উজ্জ্বল ছিল তার কারণ তার আন্তরিকতা, সেটি না থাকলে শুধু প্রতিভায় কুলাতো না; অথবা প্রতিভা প্রতিভাই হতো না।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

শহরকে বদলে দিতে পারে জাপানি খুদে-বন

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৫৯ পিএম
শহরকে বদলে দিতে পারে জাপানি খুদে-বন
মৃত্যুঞ্জয় রায়

বিশ্বের অনেক শহরেই নগর-বন করার রীতি অনেক দিন ধরে চলে আসছে। নগর-বন করতে বেশ খানিকটা বড় পরিসরের জায়গা লাগে। সাধারণত নগরের কোনো পরিত্যক্ত এলাকা বা পতিত জমিতে কোনো স্থাপনা না বানিয়ে সেখানে ছোট আকারে প্রাকৃতিক বন সৃজন হলো নগর-বনের মূল ধারণা। অবশ্যই সেটি কোনো পার্ক বা উদ্যান হবে না, কোনো সাজানো গোছানো বাগান হবে না। হবে সে স্থানের পরিবেশ ও প্রতিবেশ অনুযায়ী বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালার সমাহার। সে বনে প্রাথমিকভাবে কিছু গাছপালা লাগানো হলেও পরবর্তীতে সেসব গাছের বীজ বা মৃত্তিকাপ্রসারী শিকড় থেকে চারা গজিয়ে আপনা আপনি দ্রুত সেটা একটা প্রাকৃতিক বনে রূপ নেবে। সেসব বনের কোনো ব্যবস্থাপনারই দরকার হয় না। 

নগর-বনের পরিবেশে থাকে নানা ধরনের গাছপালা, জলাশয়, ডোবা, টিলা ইত্যাদি। সেসব গাছের ঝরাপাতা সেখানেই বনতলে তৈরি করে এক আলাদা অণু-পরিবেশ, পাতাগুলো পচে মাটির জন্য সার হয়, গাছেরাও পুষ্টি পায়। সেসব ঝরা পাতা ও ঝোপের ভেতর জন্ম নেয় অনেক পোকামাকড় ও অণুজীব। বৃক্ষ, গুল্ম, তৃণ-লতায় সেখানে এমন এক পরিবেশ তৈরি হয় যেখানে বিভিন্ন জীব-জন্তুও নির্ভয়ে থাকতে ও বংশবিস্তার করতে পারে। সেসব বনে থাকে না কোনো স্থাপনা ও পাকা পথ-ঘাট। বনপথ তৈরি হয় সেসব বনে যাওয়া মানুষদের চলাচলে। আমেরিকায় গিয়ে এরূপ বেশ কিছু নগর-বন দেখেছি, যেগুলো থাকে সাধারণত নগর বা শহরের উপকণ্ঠে, লোকালয় থেকে কিছুটা দূরে। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছপালার ভেতর থাকে পাখি ও প্রজাপতিদের মেলা, এমনকি নির্ভয়ে ঘুরতে দেখেছি বুনো হরিণ ও বুনো হাঁসদের। ঢাকা শহরে এরূপ দুটি নগর-বন করার পরিকল্পনা নিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এর একটি হওয়ার কথা ছিল বনানীতে, অন্যটি কল্যাণপুরে। জানি না সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না।

ব্যস্ত শহরের রাস্তার ধার, সুপ্রশস্ত সড়ক দ্বীপ, খেলার মাঠের কোনা, পার্ক, শপিং সেন্টার, কনডোনিয়াম বা আধুনিক আবাসিক এলাকা, ঝিল ও নদীপাড় ইত্যাদি স্থান সবুজ শ্যামলিমায় ভরিয়ে দিতে সম্প্রতি নতুন আর একটি ধারণার চর্চা চলছে। লন্ডন থেকে লস অ্যাঞ্জেলস পর্যন্ত অনেক শহরেই এখন এই ‘খুদে-বন’ ধারণায় শহরকে শ্যামল করার চেষ্টা চলছে। পৃথিবীর প্রায় ৫৬ শতাংশ লোক বাস করে শহরে, কিন্তু অধিকাংশ শহরে নেই পর্যাপ্ত বৃক্ষাচ্ছাদিত ভূমি। বাংলাদেশের ২১ দশমিক ৪ শতাংশ লোকের বাস শহরে, শহরগুলোতে সবুজ আচ্ছাদিত এলাকা মোট শহরগুলোর আয়তনের ১০ শতাংশের বেশি হবে না, যা থাকা উচিত ছিল কমপক্ষে ২০-২৫ শতাংশ। এদিক দিয়ে নরওয়ের অসলো শহরে নগর-সবুজের পরিমাণ প্রায় ৭২ শতাংশ, ইউরোপীয় দেশগুলোর শহরে ৪২ শতাংশ। যেসব শহরে সবুজের পরিমাণ কম রয়েছে সেসব শহরে ‘খুদে-বন’ সবুজ আচ্ছাদন বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

‘খুদে-বন’ ধারণার প্রবক্তা জনৈক জাপানি উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও উদ্ভিদ-পরিবেশ বিশেষজ্ঞ প্রয়াত অধ্যাপক আকিরা মিয়াওয়াকি। তিনি সত্তুরের দশকে এ ধারণাটি দেন। পরে বিশ্বের অনেক দেশেই ‘খুদে-বন’ চর্চা শুরু হয়। মাত্র ৯ বর্গমিটার অথবা ৩০ বর্গফুট জায়গার মধ্যেই এই খুদে-বন তৈরি করা সম্ভব। জায়গা বেশি থাকলে আরও বড় বন করা যেতে পারে। এ ধারণায় সেই স্বল্প পরিসর জায়গায় স্থানীয় বা সে স্থানে যেসব গাছ ভালো জন্মে সেসব স্থানীয় প্রজাতির গাছ লাগানো হয় ঘন করে। স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত ও আবাসিক দেশি প্রজাতির গাছগুলো লাগানোর সুবিধা হলো, সেসব গাছ দ্রুত সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে এবং দ্রুত বাড়তে পারে। এতে যে বন সৃষ্টি হয় তা হয় টেকসই। 

অধ্যাপক মিয়াওয়াকি জাপানসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এক হাজারেরও বেশি এ ধরনের ‘খুদে-বন’ তৈরি করেন। বর্তমানে তার এ কৌশল ব্যবহার করে নেদারল্যান্ডস, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, ভারত প্রভৃতি দেশের বিভিন্ন শহরে ‘খুদে-বন’ তৈরি করা হচ্ছে। নেদারল্যান্ডসে ২০১৫ সালে এরূপ বন সৃজন শুরু হয়, ২০২১ সালের আগস্টে পাকিস্তানের সাগিয়ান শহরে ১২ দশমিক ৫ একর জায়গাজুড়ে এরূপ একটি শহুর বন তৈরি শুরু হয়। সে বনে এখন ১ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি গাছপালা রয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে হাওড়া জেলা পরিষদ পাইলট প্রকল্প হিসেবে নদীর পাশে শ্যামপুর ১ নম্বর ব্লকের কমলপুর গ্রামে কয়েক বিঘা জমির ওপর করা হয়েছে এরূপ খুদে-বন। এতে মনে হচ্ছে ‘খুদে-বন’ শুধু শহরে না, গ্রামেও হতে পারে।

বাংলাদেশেও চট্টগ্রামে মিরেরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের সোনার পাহাড়ে এ পদ্ধতির একটি খুদে প্রাকৃতিক বন সৃজন করা হয়েছে। ঢাকা শহরে ধানমন্ডি ঝিলের ধারের একটি ছোট্ট অংশে এরূপ একটি বনের অস্তিত্ব রয়েছে, তবে সেটি আধা-প্রাকৃতিক হয়ে টিকে আছে। সেখানে গেলে ঘন গাছপালা ভরা সে অংশটাকেই কিন্তু ধানমন্ডি ঝিল উদ্যানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও গ্রামীণ বন বলে মনে হয়। এ উদাহরণ আমরা দেশের বিভিন্ন শহরের পার্কগুলোতেও সৃষ্টি করতে পারি। দেশে বন গবেষণার নানা দিক নিয়ে গবেষণা হলেও, নগর-বন নিয়ে গবেষণা নেই বললে চলে। তাই এ বিষয়টি নিয়ে গবেষকরা ভাবতে পারেন এবং দেশের প্রতিটি শহরের জন্য খুদে-বনের কয়েকটি মডেল সুপারিশ করতে পারেন। কোন শহরের খুদে-বনের জন্য কী কী প্রজাতির গাছ সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত হবে, সে তালিকাও করে দিতে পারেন বৃক্ষপালনবিদ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা।

নগরে এ ধরনের খুদে-বন তৈরির সুবিধা হলো, শহরে গাছপালা লাগানোর জায়গা পাওয়া যায় কম। আবার শহরে বায়ুদূষণও থাকে দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে অনেক বেশি। তাই এমন কিছু গাছপালা দরকার যেগুলো দ্রুত বাড়তে ও বায়ুদূষণ কমাতে পারে। মিয়াওয়াকি পদ্ধতিতে দেখা গেছে, এরূপ বনে লাগানো গাছগুলো প্রতি বছর গড়ে সাধারণ গাছের তুলনায় ১০ গুণ দ্রুত গতিতে বাড়ে। বছরে একটি গাছ গড়ে ১ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এতে কয়েক বছরের মধ্যেই একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বন তৈরি করা সম্ভব। মাত্র ২০ বছরেই এ পদ্ধতিতে যে বাগান হবে, তা সাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশে হতে সময় লাগবে এর তিন গুণেরও বেশি। তাছাড়া এরূপ বনে লাগানো গাছগুলোর দুই থেকে তিন বছর পর থেকে আর কোনো পরিচর্যার দরকার হয় না। 

এমনকি কোনো গাছ মরে গেলে বা পড়ে গেলে তাকে সেখানে সেভাবেই ফেলে রাখা হয়, সরানো বা পরিষ্কার করা হয় না। সেসব গাছ নিজেরাই বাড়তে থাকে। এমনকি সেসব গাছে কোনো সেচ, সার, বালাইনাশক কিছুই দিতে হয় না। এসব খুদে-বনের গাছগুলো প্রায় ৩০ গুণ বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিশোষণ করতে পারে, যা নগরের পরিবেশ ভালো রাখতে খুবই দরকারি। বর্তমান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ঢাকা শহরের নগর পরিকল্পনায় সবুজায়ন, জীববৈচিত্র্য ও জলাধার সংরক্ষণের ওপর জোর দিয়েছেন, যা একটি বাসযোগ্য শহরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নগর সবুজায়নে ‘খুদে-বন’ সৃষ্টির ধারণাকে বিবেচনা করা যেতে পারে।

লেখক: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক

নীতি সুদহার প্রশংসনীয় হলেও বিনিময় হার নিয়ন্ত্রিত

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৫১ এএম
আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৫৯ এএম
নীতি সুদহার প্রশংসনীয় হলেও বিনিময় হার নিয়ন্ত্রিত
ড. জাহিদ হোসেন

চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, সেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এটি প্রশংসনীয়। কারণ এটা করা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য কোনো উপায় ছিল না।

যদিও নীতি সুদহার কিছুটা কমানোর দাবি ছিল ব্যবসায়ীদের। তবে আমি মনে করছি দেশে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় নীতি সুদহার কমানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আর নতুন সরকার আসার পর ৩ বার নীতি সুদহার বাড়ানোর কারণে এখনই তা পুনরায় বৃদ্ধি যুক্তিযুক্ত নয়।

এখন যে নীতি নেওয়া মার্কেটে তার প্রভাব পড়তে সময় দিতে হবে। সেক্ষেত্রে নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রাখাই যুক্তি সম্পন্ন ছিল। সেই সঙ্গে প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছে, সেটিও বাস্তবসম্মত।

গভর্নর যথার্থভাবেই বলেছেন, চলতি বছর আমাদের প্রবৃদ্ধির দিকে তাকানোর সময় না। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা করাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ।

তবে বিনিময় হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিতে চলছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সেখানে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হলেও নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাই ধরে রাখা হয়েছে। আর এই বিষয়ে গভর্নর যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে আগের গভর্নরের ধারাবাহিকতাই দেখা যাচ্ছে।

তিনি একদিকে বলছেন আমাদের চাহিদা কমে আসছে, রেমিট্যান্স বাড়ছে, রপ্তানি আয়ও বাড়ছে। আবার অন্যদিকে বিনিময় হারে অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছেন। যা সাংঘর্ষিক। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কারণ মার্কেটের চাহিদা অনুযায়ী বিনিময় হারকে ওঠানামা করতে দিতে হবে।

আর বাংলাদেশ ব্যাংক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর ম্যানুপুলেশনের যে বক্তব্য দিচ্ছে তার প্রমাণ কি? তারা কেন শুধু বাংলাদেশকেই টার্গেট করবে। একই রকম বাজার তো শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, পাকিস্তান ও ভারতেও। তাদের কেন টার্গেট করছে না। তার ব্যাখ্যা তো বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া উচিত।

এক কথায় বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক না করে আটকিয়ে রাখা অর্থনীতির জন্য ভালো নয়।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ