
রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, অভিষেককে ডেকে একরকম ওয়ার্নিংই দিয়েছেন মমতা। সাংগঠনিক ব্যাপারে তার নাক গলানো যে পিসি পছন্দ করছেন না সেটা সুব্রত বক্সীকে সাক্ষী রেখে স্পষ্টাস্পষ্টি জানিয়ে দেওয়ার মধ্যে অনেকেই অন্য রকম গন্ধ পাচ্ছেন। তৃণমূল রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলা লোকজন মনে করছেন, অভিষেককে তাড়ানো হবে, এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। সেই রাস্তাই তৈরি করছেন দলনেত্রী। অভিষেকের অভিজ্ঞতা কম। তাই তিনি আগেভাগে দল থেকে না বেরিয়ে নিজের বহিষ্কারের রাস্তা স্পষ্ট করছেন।...
ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সমীকরণ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে পিসির (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) হাত ছেড়ে ভাইপো (অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়) দূরে চলে যাচ্ছে। ‘সাবালক’ ভাইপোর পাশে দাঁড়ানোর জন্য বদ্ধপরিকর নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহর ভারতীয় জনতা পার্টি। ভাইপো যদি সত্যিই দলের একাংশকে ভাঙিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হন, বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একাংশ যদি শেষ পর্যন্ত নয়া নেতার দিকেই ঝোঁকেন, তাহলে তো মুখ্যমন্ত্রীর শিরে সংক্রান্তি। গোটা বিষয়টা ম্যানেজ হবে কী করে? সেই কারণে দিল্লিতে সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ আরও মসৃণ করে তুলছেন তিনি। ভাইপো বেরিয়ে গেলেই ২০২৬-এর লক্ষ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে আঁতাত নিশ্চিত করবেন তৃণমূল নেত্রী। সে ক্ষেত্রে মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুরসহ উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় জোটের উল্লেখযোগ্য লাভ হতে পারে।
কংগ্রেস যে এই জোটের জন্য মুখিয়ে রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। বৃহত্তর জোটের কথা চিন্তা করেই কংগ্রেস হাইকমান্ড প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পদে বদল ঘটিয়ে শুভঙ্কর সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, শুভঙ্করবাবুকে দলে চেয়েছিলেন মমতা। কিন্তু তিনি রাজি হননি। সে যা-ই হোক না কেন, তার সঙ্গে দিদির সম্পর্ক খুবই মসৃণ। মমতা সম্পর্কে কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি যে পাল্টে যাচ্ছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে সম্প্রতি দলের বর্ষীয়ান নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্যের বক্তব্যে। প্রয়াত নেতা সোমেন মিত্র স্মরণে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি বলেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাড়িয়ে কংগ্রেসের অশেষ ক্ষতি হয়েছে।’ তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে কুণাল ঘোষ প্রদীপবাবুর বক্তব্যকে সমর্থন ও স্বাগত জানিয়েছেন। যথারীতি বিরোধিতা করেছেন সাবেক প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। কিন্তু তিনি এখন ব্যাক বেঞ্চে। কংগ্রেস হাইকমান্ড বা রাজ্যের নেতৃত্ব- কেউই তার কথা শুনছে না। এই পরিস্থিতিতে অধীর কী করবেন, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।
সম্প্রতি, সুন্দরবনসংলগ্ন সন্দেশখালীতে একটি সভা করতে গিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে সন্দেশখালী স্টিং অপারেশনের জন্য তিনি ‘আই প্যাক’ সংস্থাকে দোষী করেন। কিন্তু আই প্যাককে যে তিনিই কাজে লাগিয়েছিলেন তা একবারের জন্যও মুখে আনেননি। উল্টো যারপরনাই সমালোচনা করেছেন পিসির। কিন্তু ভাইপো তার কাছে একেবারে ক্লিন চিট পেয়ে গেছে। কিন্তু কেন? ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, শুভেন্দু খুব ভালো করেই জানেন নতুন দল তৈরির জন্য ভেতরে ভেতরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অনেকটাই এগিয়েছেন। তার সঙ্গে বিজেপির শীর্ষ নেতাদের কথাও হয়েছে। অমিত শাহ নিজে এ ব্যাপারে উৎসাহ দেখিয়েছেন। কাজেই অভিষেক যে বিজেপি জোটে আসছেন, তা এক প্রকার নিশ্চিত। এই সময় খুঁচিয়ে সম্পর্ক অহি নকুল করে লাভ হবে না।
দল ও সরকারের ‘মেদ’ করাবে তৃণমূল কংগ্রেস। নতুন বছরে এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করলেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্য সভাপতির সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনায় এই লক্ষ্যে নিজের মনোভাব স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, অভিষেককে ডেকে একরকম ওয়ার্নিংই দিয়েছেন তিনি। সাংগঠনিক ব্যাপারে তার নাক গলানো যে পিসি পছন্দ করছেন না, সেটা সুব্রত বক্সীকে সাক্ষী রেখে স্পষ্টাস্পষ্টি জানিয়ে দেওয়ার মধ্যে অনেকেই অন্য রকম গন্ধ পাচ্ছেন। তৃণমূল রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলা লোকজন মনে করছেন, অভিষেককে তাড়ানো হবে, এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। সেই রাস্তাই তৈরি করছেন দলনেত্রী। অভিষেকের অভিজ্ঞতা কম। তাই তিনি আগেভাগে দল থেকে না বেরিয়ে নিজের বহিষ্কারের রাস্তা স্পষ্ট করছেন।
অভিষেকের যাবতীয় পরিকল্পনা মমতা ভেস্তে দিয়েছিলেন। সেই কারণে ভাইপো নভেম্বর মাসে নিজের লোকজনকে দলের সংগঠনে বসাতে পারেননি। কিন্তু তিনি যে শেষ দেখে ছাড়বেন, তা আবারও স্পষ্ট হলো। বৃহস্পতিবার তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, রদবদল হবেই। এ কথা স্পষ্ট, যে অভিষেকের রদবদলের পরিকল্পনায় বাধা দেবেন মমতা। আর তখনই নতুন দল তৈরির বড় ধাপ পেরোবেন ‘ভাইপো’।
ঠিক সময়েই দলে সাংগঠনিক রদবদল হবে বলে জানিয়ে দিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার নিজের সংসদীয় কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান কর্মসূচি ‘সেবাশ্রয়’-এর উদ্বোধন করেন তিনি। সেখানেই সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে অভিষেক ফের দলে সাংগঠনিক রদবদলের বিষয়ে মুখ খোলেন। তা ছাড়া আরজি কর, কেন্দ্রীয় বঞ্চনা, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়েও প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।
অভিষেক বলেন, ‘সাংগঠনিক রদবদল হবেই। যারা দলের জন্য কাজ করেছেন, তাদের চিন্তা করতে হবে না। গাছের পরিচয় তার ফলে। আমি কত দক্ষ, কত অভিজ্ঞ, তা তো ফলাফল দেখলেই বোঝা যাবে।’ ডায়মন্ড হারবারের সংসদ সদস্য জানান, দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি ইতোমধ্যেই রদবদলের বিষয়ে নির্দিষ্ট প্রস্তাব দলনেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠিয়েছেন। প্রসঙ্গত, মমতার উপস্থিতিতেই ২১ জুলাইয়ের সভামঞ্চ থেকে সাংগঠনিক রদবদলের কথা জানিয়েছিলেন অভিষেক। তিনি জানিয়েছিলেন, লোকসভায় যেখানে যেখানে দলের খারাপ ফল হয়েছে, সেই সব পুর এলাকায় প্রশাসনিক স্তরে ‘রদবদল’ হবে।
সেই সূত্রে কমবেশি ৭০টি পুরসভা ও পুরনিগমে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান পদে রদবদলের প্রস্তাব মমতার কাছে অভিষেক পাঠিয়ে দিয়েছিলেন অক্টোবরে বিদেশে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার আগেই। তবে নিজের জন্মদিনে গত ৭ নভেম্বর অভিষেক একান্ত আলোচনায় এও জানিয়েছিলেন, সেই রদবদল থেকে আপাতত বাদ থাকছে কলকাতা। অভিষেক এও বলেছিলেন, রদবদলের নিরিখ হবে লোকসভা ভোটের ফল। ফের তিনি সেটাই স্পষ্ট করতে চেয়েছেন।
রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, অভিষেককে ডেকে একরকম ওয়ার্নিংই দিয়েছেন মমতা। সাংগঠনিক ব্যাপারে তার নাক গলানো যে পিসি পছন্দ করছেন না, সেটা সুব্রত বক্সীকে সাক্ষী রেখে স্পষ্টাস্পষ্টি জানিয়ে দেওয়ার মধ্যে অনেকেই অন্য রকম গন্ধ পাচ্ছেন। তৃণমূল রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলা লোকজন মনে করছেন, অভিষেককে তাড়ানো হবে, এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। সেই রাস্তাই তৈরি করছেন দলনেত্রী। অভিষেকের অভিজ্ঞতা কম। তাই তিনি আগেভাগে দল থেকে না বেরিয়ে নিজের বহিষ্কারের রাস্তা স্পষ্ট করছেন।
বিধানসভা ভোটের আগে রাজনৈতিক পথও মোটামুটি চূড়ান্ত করে ফেলেছেন মমতা। ইংরেজি নতুন বছরের শুরুতেই সংগঠন ও প্রশাসন নিয়ে দীর্ঘ বৈঠক সেরে ফেলেছেন তৃণমূল নেত্রী। তার সঙ্গে এই বৈঠকে ছিলেন অভিষেক। পরে সেখানে উপস্থিত হন রাজ্য সভাপতিও। সেখানেই সংগঠন ও প্রশাসন নিয়ে দলের অন্দরে উদ্ভূত জটিলতা নিয়ে সবিস্তার আলোচনা হয়েছে। এই জটিলতা কাটাতেই মমতার পরামর্শে একগুচ্ছ সিদ্ধান্তও নিয়েছেন অভিষেক।
দলীয় সূত্রে খবর, গত লোকসভা ভোটের ফলের ভিত্তিতে যেসব পদক্ষেপ নিয়ে অভিষেক এগোতে চেয়েছিলেন, সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানেই এই পরিবর্তনের প্রয়োজন ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। এবং ২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে দলের সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিয়ে সময় নষ্ট না করার কথাও উল্লেখ করেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। জানা গেছে, তার ভাবনায় সায় দিয়ে গোটা বিষয়টিতে সমন্বয় তৈরির ভার দেওয়া হয়েছে রাজ্য সভাপতিকে।
একদা ক্যামাক স্ট্রিটগামী নেতারা ক্রমশ কালীঘাটমুখী হচ্ছেন। ‘কালীঘাটপন্থি’ যে নেতারা মাঝে অভিষেকের খুল্লমখুল্লা প্রশংসা করতেন, তারা ফিরছেন পুরোনো অবস্থানে। নতুন বছরের সবে কয়েক দিন কেটেছে। সমাপতন, কিন্তু বছর বদলের সঙ্গেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে শাসক তৃণমূলের অন্দরে ভরকেন্দ্র বদল। সৌজন্যে শিল্পীদের একাংশকে বয়কট করাসংক্রান্ত বিতর্ক। আরজি কর পর্বে সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা করা শিল্পীদের বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ।
বৃহস্পতিবার সেই প্রসঙ্গে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, কুণালের বক্তব্য ‘দলের অবস্থান’ নয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেখা গেল, কুশালের পাশে দাঁড়ালেন প্রবীণ তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘কৌশলী’ মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। যার মর্মার্থ; মমতার মতোই তার পথ। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শিল্পীচয়নসংক্রান্ত বিভিন্ন স্তরে দলীয় বার্তার ‘প্রমাণ’ হিসেবে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের একাধিক ‘স্ক্রিনশট’ প্রকাশ্যে এসেছে। যা নিয়ে নতুন করে শোরগোল শুরু হয়েছে তৃণমূলের অন্দরে। প্রসঙ্গক্রমে চলে এসেছে আরজি কর-কাণ্ডও। সেই পর্বে সরকার এবং শাসকদল যখন ‘কোণঠাসা’, তখন তৃণমূলের হয়ে যারা সরব ছিলেন, তাদের মধ্যে কুণাল অন্যতম।
কল্যাণও বিভিন্ন মন্তব্য করে কুণালের তালে তাল ঠুকেছিলেন। তা মনে করিয়ে দিয়ে শুক্রবার কল্যাণ বলেছেন, ‘আরজি কর পর্বে তো অনেককে কথাই বলতে দেখা যায়নি। যা বলার কুণাল বলত। আর আমি বলতাম।’ তৃণমূলপন্থি জুনিয়র ডাক্তারদের প্রসঙ্গও টেনেছেন কল্যাণ। শ্রীরামপুরের সাংসদের কথায়, ‘আমাদের ছেলেদের ধরে ধরে সাসপেন্ড করেছিল। কুণাল ওদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আর আমি মামলা লড়েছি।
তখন কেউ ছিল না।’ শিল্পীদের একাংশকে বয়কটের আহ্বান প্রসঙ্গে অভিষেক আরজি করের প্রসঙ্গও তুলেছিলেন। ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ভাবে শুক্রবার আরজি কর পর্বের উল্লেখ করে কুণাল দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের সম্পর্কে বলেছেন, ‘অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ওই সময়টায় বাইরে ছিলেন।’ কারণ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এটা ঠিক যে, আরজি কর আন্দোলন পর্বে অভিষেক সেভাবে সক্রিয় ছিলেন না। তিনি ‘সক্রিয়’ হয়েছিলেন শুধু ১৪ আগস্ট ‘মেয়েদের রাত দখল’ অভিযানের পরে রাতে আরজি করে ও চড়লের পাটনায়। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসের কর্মসূচিতে অভিষেক প্রকাশ্যেই ‘রাত দখল’ অভিযানকে শ্রদ্ধা আউডিদেন।
অভিষেক ‘বাইরে ছিলেন’ বলে কুণাল শুক্রবার সেটাই মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন। কুণালের বয়কটের ডাককে সমর্থন করে কল্যাণ জানিয়েছেন, তার সংসদীয় এলাকায় দলের লোকেরা যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত, সেখানে এমন কোনো শিয়াকে তিনি ঢুকতে দেবেন না, যারা আরজি কর পর্বে তৃণমূল তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতার সমালোচনা করেছেন। কল্যাণের কথায়, ‘আমাদের সব আবেগ মমতাদিকে ঘিরে। তাকে যারা অসম্মান করেছেন, সেই শিল্পীদের কেন ডাকতে যাব? আমার এলাকায় তো আমি ঢুকতে দেব না।’ আবার শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বলেছেন, ‘দেখাই যাচ্ছে দলে দুই রকমের মত রয়েছে। আমাদের দল রেজিমেন্টেড নয়। অনেক খোলামেলা। তাই কেউ কারও কথা বলতেই পারেন।’ সেই সঙ্গেই ব্রাতোর সংযোজন, ‘দলে অভিষেকের স্থান আমার থেকে অনেক উঁচুতে। তাই অভিষেক ঠিক না কুণাল ঠিক, তা আমি বলতে পারব না। তবে দলের সদস্য হিসেবে বলতে পারি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতই আমার মত।’ ব্রাত্য শুধু মন্ত্রী নন। তিনি নাট্যকার, অভিনেতা এবং পরিচালক। সেই ‘শিল্পীসত্তা’ থেকেও তিনি তার অবস্থান জানিয়েছেন।
তার বক্তব্য, কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদি সরকার আসার পর থেকে তার পরিচালিত দল কোনো অনুদান নেয়নি। যে শিল্পীরা সমালোচনা করেছিলেন, তারা ঠিক করুন (রাজ্য সরকারের) অনুগ্রহ নেবেন কি না। ব্রাত্যের কথায়, ‘বিরোধিতাও করব আবার অনুদানের জন্য নাকে কাঁদব, দুটো একসঙ্গে হতে পারে না।’ কিন্তু শিল্পী বয়কটের প্রশ্নে মমতার অভিমত কী? এ বিষয়ে তৃণমূল নেত্রীর কোনো মন্তব্য বা বিবৃতি এখনো প্রকাশ্যে আসেনি। তবে কল্যাণের মতো টানা চারবারের সংসদ সদস্য দলের সর্বময় নেত্রীর অনুমোদন ব্যাতিরেকে এমন বলছেন, এ কথা তৃণমূলের কেউই প্রায় বিশ্বাস করছেন না। বৃহস্পতিবার অভিষেকের বক্তব্যের পাল্টা কুণাল বলেছিলেন, ‘মমতাদি বলে দিন, আমি ভুল বলছি। মেনে নেব।’ শুক্রবার পর্যন্ত মমতা বলেননি, কুণাল ‘ভুল’ বলেছেন। যে দিন ব্রাত্য বললেন, মমতার মতামতই তার মত।
ঘটনাচক্রে ঠিক এক বছর আগে অভিষেকের ‘নবীন’ তত্ত্বের পক্ষে দাঁড়িয়ে প্রবীণদের বিঁধেছিলেন কুণাল। কথায় কথায় তিনি বলতেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার নেত্রী। অভিষেক আমার সেনাপতি। সেই তিনি শেষ কবে অভিষেককে ‘সেনাপতি’ বলে উল্লেখ করেছেন, তা অনেকেই মনে করতে পারছেন না। ব্রাত্যও অভিষেকের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলেই পরিচিত ছিলেন। ২০২৩ সালের শেষ দিকে অভিষেক যখন সংগঠন থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন, নিজেকে ডায়মন্ড হারবারের মধ্যে ‘সীমাবদ্ধ’ রেখেছিলেন, তখন যে কয়েকজন নেতা তাকে বোঝাতে দৌত্য চালিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ব্রাত্য এবং কুণাল ছিলেন অন্যতম। একটা সময়ে অভিষেকের বিমানে তার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন ব্রাত্য। আবার কল্যাণ একটা সময়ে অভিষেককে ‘অপছন্দ’ করলেও পরে তার ঢালাও প্রশংসাও করেছেন। সেই তিনিও শিল্পী বয়কট বিতর্কে অভিষেকের বক্তব্যকে খণ্ডন করে কুণালের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
অভিষেকের যাবতীয় পরিকল্পনা মমতা ভেস্তে দিয়েছিলেন। সেই কারণে ভাইপো নভেম্বর মাসে নিজের লোকজনকে দলের সংগঠনে বসাতে পারেননি। কিন্তু তিনি যে শেষ দেখে ছাড়বেন তা আবারও স্পষ্ট হলো। বৃহস্পতিবার তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, রদবদল হবেই। এ কথা স্পষ্ট, যে অভিষেকের রদবদলের পরিকল্পনায় বাধা দেবেন মমতা। আর তখনই নতুন দল তৈরির বড় ধাপ পেরোবেন ‘ভাইপো’।
ঠিক সময়েই দলে সাংগঠনিক রদবদল হবে বলে জানিয়ে দিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার নিজের সংসদীয় কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান কর্মসূচি ‘সেবাশ্রয়’-এর উদ্বোধন করেন তিনি। সেখানেই সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে অভিষেক ফের দলে সাংগঠনিক রদবদলের বিষয়ে মুখ খোলেন। তা ছাড়া আরজি কর, কেন্দ্রীয় বঞ্চনা, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়েও প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।
সাংগঠনিক রদবদল
অভিষেক বলেন, ‘সাংগঠনিক রদবদল হবেই। যারা দলের জন্য কাজ করেছেন, তাদের চিন্তা করতে হবে না। গাছের পরিচয় তার ফলে। আমি কত দক্ষ, কত অভিজ্ঞ, তা তো ফলাফল দেখলেই বোঝা যাবে।’ ডায়মন্ড হারবারের সংসদ সদস্য জানান, দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি ইতোমধ্যেই রদবদলের বিষয়ে নির্দিষ্ট প্রস্তাব দলনেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠিয়েছেন। এ বিষয়ে দলনেত্রীই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান তিনি। অভিষেক বলেন, ‘পরপর ভোট এবং উৎসব ছিল। ঠিক সময়েই হবে (সাংগঠনিক রদবদল)।’ প্রসঙ্গত, মমতার উপস্থিতিতেই ২১ জুলাইয়ের সভামঞ্চ থেকে সাংগঠনিক রদবদলের কথা জানিয়েছিলেন অভিষেক। তিনি জানিয়েছিলেন, লোকসভায় যেখানে যেখানে দলের খারাপ ফল হয়েছে, সেই সব পুর এলাকায় প্রশাসনিক স্তরে ‘রদবদল’ হবে। সেই সূত্রে কমবেশি ৭০টি পুরসভা ও পুরনিগমে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান পদে রদবদলের প্রস্তাব মমতার কাছে অভিষেক পাঠিয়ে দিয়েছিলেন অক্টোবরে বিদেশে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার আগেই। তবে নিজের জন্মদিনে গত ৭ নভেম্বর অভিষেক একান্ত আলোচনায় এও জানিয়েছিলেন, সেই রদবদল থেকে আপাতত বাদ থাকছে কলকাতা। অভিষেক এও বলেছিলেন, রদবদলের নিরিখ হবে লোকসভা ভোটের ফল। ফের তিনি সেটাই স্পষ্ট করতে চেয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২১ জুলাইয়ের সমাবেশ থেকে অভিষেক জানিয়েছিলেন, তিন মাসের মধ্যে রদবদল হবে। কিন্তু সেই সময়সীমা পেরিয়ে গেছে। নভেম্বরে অভিষেক-ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য ছিল, ছয়টি উপনির্বাচনের ফল ঘোষণার পরে রদবদলসংক্রান্ত ঘোষণা হতে পারে। কিন্তু তাও হয়নি। এর মধ্যে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সমীকরণ নিয়ে নানা আলোচনা হয়েছে তৃণমূলে। তার মধ্যেই অভিষেক জানিয়ে দিলেন, রদবদল হবেই। তৃণমূলের একটি সূত্রের বক্তব্য, রদবদলসংক্রান্ত বিষয়ে কাজ চলছে, যা নিজে তত্ত্বাবধান করছেন দলের সর্বময় নেত্রী মমতা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর সঙ্গেও কথা বলছেন তিনি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে কবে রদবদলসংক্রান্ত ঘোষণা হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
দলে বিভাজন নয়, ঐক্য
লোকসভা ভোট-পরবর্তী পর্যায়ে নানা ঘটনায় তৃণমূলের মধ্যে নেতৃত্বের সমীকরণের প্রশ্নে আলোচনা রয়েছে। সম্প্রতি মুখপাত্র তালিকা প্রকাশের পর যা আরও প্রকট হয়েছিল। দলের মধ্যে যারা ‘অভিষেক-ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত, তাদের বাদ পড়া নিয়েও জল্পনা তৈরি হয়েছিল শাসকদলের অন্দরে। যদিও অভিষেক, সেই সব জল্পনায় জল ঢালতে চেয়েছেন বৃহস্পতিবার। তার কথায়, ‘আমার কাজ দলে দলে ঢুকে জোড়া ফুল ফোটানো। রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী আমার কাছে এলে খবর হয়।’ ডায়মন্ড হারবারের সংসদ সদস্যের সংযোজন, ‘আমি পার্টির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। আমার সঙ্গে রাজ্য সভাপতি বৈঠক করতে পারেন কি পারেন না? আমরা তো সহকর্মী, সহযোদ্ধা।’
আরজি কর
অভিষেকের প্রায় সওয়া এক ঘণ্টার বক্তব্যে আসে আরজি কর প্রসঙ্গও। তিনি বলেন, ‘বিরোধীরা বলেছিলেন আরজি করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চক্রান্ত করেছেন। আর আজ দেখুন। এই প্রসঙ্গ তারা তুলছেন না।’ আরজি কর হাসপাতালে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় সিবিআইয়ের দিকে তোপ দেগে অভিষেক বলেন, ‘অভিযুক্তকে ধরেছিল কলকাতা পুলিশই।’ অভিষেকের বক্তব্যে আরও একবার আসে আরজি কর হাসপাতালের কথা। ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রের ৩০০টি স্বাস্থ্যশিবিরে যাওয়া রোগীদের রাউকে কাউকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হবে। অভিষেক জানান, ‘রেফারেল সিস্টেম’-এর মাধ্যমে মোট ১২টি হাসপাতালে রোগীদের পাঠানো হবে। এই ১২ হাসপাতালের তালিকায় এসএসকেএম, ডায়মন্ড হারবার মেডিকেলের মতো হাসপাতালের সঙ্গে রয়েছে আরজি কর হাসপাতালও।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক