ঢাকা ৩০ মাঘ ১৪৩১, বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
English
বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৩০ মাঘ ১৪৩১

প্রতিটি প্রজাতির গাছকেই রক্ষা করা দরকার

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:০৮ পিএম
প্রতিটি প্রজাতির গাছকেই রক্ষা করা দরকার
মৃত্যুঞ্জয় রায়

গাছ আছে বলেই আমরা এ পৃথিবীতে বেঁচে আছি। আমাদের আগে এ পৃথিবীতে উদ্ভিদ এসেছে। উদ্ভিদ আসার পর এ পৃথিবী সবুজ গ্রহ হয়ে উঠেছে। জীবন ও জীববৈচিত্র্যের জন্য প্রতিটি উদ্ভিদ প্রজাতিই গুরুত্বপূর্ণ। এ পৃথিবীতে প্রতিটি জীবই একে অপরের সঙ্গে এক অদৃশ্য মধুর বন্ধনে আবদ্ধ। একজন অন্যজনকে ছাড়া চলতে, এমনকি বাঁচতেও পারে না। কোনো একটি গাছের বিলুপ্তি মানে সে গাছের ওপর আত্মনির্ভরশীল আরও অন্তত ৩০ প্রজাতি জীবের বিলুপ্ত হওয়া। অথচ প্রকৃতির এই অদৃশ্য সুতার বাঁধনকে আমরা প্রায় কেউই হয় বুঝি না অথবা বুঝেও অবহেলা করি। যার পরিণাম দিনশেষে আমাদেরই ভোগ করতে হচ্ছে। 

পারস্পরিক নির্ভরশীলতার এই মহাজালের কেন্দ্রস্থলে আছে উদ্ভিদ। কেননা উদ্ভিদ প্রতিটি জীবকে অক্সিজেন দান করে বাঁচিয়ে রেখেছে, ফল ও বীজ খাইয়ে পুষ্ট করছে। প্রতিটি জীবের খাদ্য গ্রহণ অনেকটাই উদ্ভিদের প্রজাতি সুনির্দিষ্ট। অর্থাৎ এক এক প্রজাতির জীব এক এক প্রজাতির উদ্ভিদ থেকে আহার ও আশ্রয় পায়। আবার একাধিক প্রজাতির ক্ষেত্রে একটি উদ্ভিদ প্রজাতিরও নির্ভরশীলতা রয়েছে। যেমন- ধানগাছের বীজ আমরা খাই আবার পাখিরাও খায়, ইঁদুর খায়। আবার কোনো কোনো পাখিকে মানুষ খায়, ইঁদুরকে খায় পেঁচা। এভাবে প্রকৃতির খাদ্যচক্র এক সুশৃঙ্খল নিয়মে চলছে সুপ্রাচীনকাল থেকে। হঠাৎ সে শিকলের কোথাও ছিঁড়ে গেলে প্রকৃতিরই তাতে বিপর্যয় ঘটে।  

পৃথিবীতে আনুমানিক ৮ দশমিক ৭ মিলিয়ন প্রজাতির জীব রয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত আমরা মাত্র ১ দশমিক ২ মিলিয়ন মানে ১২ লাখ প্রজাতির জীবকে শনাক্ত করতে পেরেছি, যার মধ্যে সাড়ে ৯ লাখ প্রজাতিই প্রাণী। পৃথিবীর এখনো ৮৬ শতাংশ জীব শনাক্ত করা হয়নি। তেমনি সাগরেও আছে অনেক প্রজাতির জীব; যার ৯১ শতাংশ এখনো অশনাক্তিত। পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রজাতির সংখ্যা গণনা যেন অনেকটা সাগরের বেলাভূমিতে বসে বালুকণা গোনার মতোই ব্যাপার। বিশ্বে প্রায় ৩ লাখ ৮২ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে, যার মধ্যে ২ লাখ ৮৩ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ হলো সেসব প্রজাতির উদ্ভিদ যেগুলোতে ফুল ফোটে ও বীজ হয়। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ২ হাজার প্রজাতির নতুন উদ্ভিদ আবিষ্কৃত ও শনাক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক সময়ে অনেক উদ্ভিদ বিদেশ থেকে এসেছে এবং এ দেশে থাকা বেশ কিছু উদ্ভিদকে নতুন হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। 

বাংলাদেশ ভূখণ্ডে থাকা গাছপালার প্রথম প্রণালিবদ্ধ রেকর্ড পাওয়া যায় এ অঞ্চলে ইবনে বতুতার (৯৮০-১০৩৭) ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে। পরবর্তী সময়ে সম্রাট আকবরের মুখ্য সচিব ও সভাসদ আবুল ফজল (১৫৫১-১৬০২) ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে ভারতবর্ষের অনেক উদ্ভিদের নাম উল্লেখ করে গেছেন। এরপর সতেরো ও আঠারো শতকে অনেক ইউরোপীয় উদ্ভিদবিদ এ দেশের গাছপালা অনুসন্ধান কাজে লিপ্ত হয়ে ব্যাপক কাজ করেন। ফলে আমরা এ দেশের উদ্ভিদ প্রজাতিগুলোর একটি সমৃদ্ধ বিবরণ পাই। বর্তমানে বাংলাদেশে উদ্ভিদসম্পর্কিত সবচেয়ে সমৃদ্ধ বইটি হলো এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ’। সে বইয়ে মোট ৩ হাজার ৮১৩টি উদ্ভিদ প্রজাতির বর্ণনা রয়েছে। বাস্তবে এ দেশে প্রায় ৬ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। প্রতিবছর যে হারে বিদেশি গাছপালা এ দেশে আসছে তাতে সংখ্যাটা আরও বাড়বে। এ দেশের উদ্ভিদবিদরা ও শৌখিন উদ্ভিদপ্রেমীরা এ দেশের উদ্ভিদ প্রজাতির অনুসন্ধানে কাজ করে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে এ দেশের উদ্ভিদ প্রজাতিগুলো সাধারণের কাছে পরিচিত করানো ও রেকর্ডভুক্ত করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংবাদপত্রও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। 
সম্প্রতি বাংলাদেশের ১ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ প্রজাতির বর্তমান অবস্থা জানার জন্য আইইউসিএন এক গবেষণা চালিয়েছে। মূল্যায়নের পর ২০২৪ সালে প্রকাশ করেছে বিশাল দুই খণ্ড ‘বাংলাদেশের উদ্ভিদ লাল তালিকা’ বই। দীর্ঘদিনের শ্রমসাধ্য কাজটি করার ফলে আমরা এখন জানতে পেরেছি আমাদের উদ্ভিদ জগতের বর্তমান অবস্থা। এ গবেষণায় দেখা গেছে যে, এ দেশের ৩৯৫ প্রজাতির উদ্ভিদ সম্মিলিতভাবে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে, যা মূল্যায়িত উদ্ভিদের প্রায় ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ। 

এ ছাড়া আরও ৭০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে প্রায় বিপদগ্রস্ত অবস্থায়। যে ৩৯৫ প্রজাতির উদ্ভিদ হুমকিতে রয়েছে তার মধ্যে ২৬৩ প্রজাতি রয়েছে সংকটাপন্ন, ১২৭টি প্রজাতি বিপন্ন ও ৫টি প্রজাতি রয়েছে মহাবিপন্ন অবস্থায়। অন্যদিকে এ দেশের উদ্ভিদজগৎ থেকে ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে ৭ প্রজাতির উদ্ভিদ। বনাঞ্চলে বিলুপ্ত হলো তালিপাম গাছ। সারা পৃথিবীর মধ্যে এ গাছ শুধু বাংলাদেশের বনেই ছিল, ছিল ঢাকা শহরেও। সুখের কথা হলো, এ দেশের উদ্ভিদপ্রেমীরা ঢাকা শহরের সে গাছটি মরে যাওয়ার আগে তার ফল থেকে চারা তৈরি করে সেসব চারা ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিয়েছেন। 

এতে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে তালিপাম। এভাবে আঞ্চলিকভাবে বিলুপ্ত হলেও সেসব উদ্ভিদ অন্য দেশে নিশ্চয়ই আছে। সেখান থেকে তা সংগ্রহ করে এ দেশে আবার সেসব প্রজাতিকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া যায়। যে পাঁচটি প্রজাতির উদ্ভিদ মহাবিপন্ন অবস্থায় রয়েছে, সেগুলোও যেন বিলুপ্ত হয়ে না যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন- এ দেশে মহাবিপন্ন বাঁশপাতা গাছের মাত্র ১১১টি গাছ টিকে আছে। এর মধ্যে বনাঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে বেঁচে আছে মাত্র ১২টি গাছ, বাকি ৯৯টি বিভিন্ন উদ্যানে লাগানো। বলধা গার্ডেন ও জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানেও এ গাছ আছে। এভাবে মহাবিপন্ন গাছগুলোকে তার প্রাকৃতিক পরিবেশে ও লালিত অবস্থায় রক্ষা করতে হবে। 

বাংলাদেশে উদ্ভিদ সম্পদের সবচেয়ে বড় স্থান হলো মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান। সেখানে জানা মতে, ১০৪১ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। সেখানে কেন বাংলাদেশের তালিকাভুক্ত প্রায় সব উদ্ভিদই থাকতে পারে না? একই প্রজাতির শত উদ্ভিদ থাকার চেয়ে হাজার প্রজাতির হাজার উদ্ভিদ থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। স্থান সংকুলান না হলে এ দেশের যে ৫৩টি রক্ষিত বন ও ১৮টি জাতীয় উদ্যান রয়েছে, সেখানে সংকটাপন্ন ও বিপন্ন উদ্ভিদ প্রজাতিগুলোকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ছোট ছোট উদ্ভিদ উদ্যান করে সেখানে এসব বিপন্ন উদ্ভিদ লাগানোর ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

 বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্ভিদ উদ্যান এ ক্ষেত্রে অন্যতম উদাহরণ। পৃথিবীর অনেক দেশেই একাধিক বড় বড় উদ্ভিদ উদ্যান আছে, আমাদের দেশে কেন থাকতে পারে না? বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি উদ্ভিদপ্রজাতির বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এলাকা হলো চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট। উদ্ভিদ প্রজাতির অনুসন্ধান ও তথ্য লিপিবদ্ধকরণ হালনাগাদ করতে এসব অঞ্চলে ব্যাপক অনুসন্ধান চালাতে হবে।

উদ্ভিদের প্রাকৃতিক বাসস্থান ধ্বংস থেমে নেই। দিন দিন এ দেশে মানুষ বাড়ছে, বনভূমি চলে যাচ্ছে কৃষিজমিতে, ঘরবাড়ি এবং বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে। প্রাকৃতিক সব সম্পদের ওপরই এতে চাপ বাড়ছে। এর ওপর আছে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত। এসব নানা কারণে বর্তমানে বাংলাদেশের ৮ থেকে ১০ শতাংশ উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ঝুঁকি নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। একটি উদ্ভিদ প্রজাতিও যেন আর এ দেশ থেকে হারিয়ে না যায়।

লেখক: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক

নগরের পয়োনিষ্কাশন ও পানি চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল

প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:৩৩ পিএম
নগরের পয়োনিষ্কাশন ও পানি চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল
ইকবাল হাবিব

প্রতিটি শহরের জন্য সবুজ নেটওয়ার্ক তৈরিতে, সবুজ এলাকা, জলাশয় এবং গণপরিসর রক্ষা ও পুনরুদ্ধারে স্বতন্ত্র রূপকল্প এবং কার্যকর সরকারি নীতির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকার ড্যাপ (২০২২-৩৫) অনুযায়ী প্রস্তাবিত পাঁচটি আঞ্চলিক পার্ক, ২৪টি জলকেন্দ্রিক পার্ক, চারটি ইকোপার্ক এবং অন্যান্য পার্কের অবস্থান, আকার, নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা তৈরি ও তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দেশের বন-নীতিতে নগর সবুজায়ন অন্তর্ভুক্ত করে ছোট পার্ক ও সবুজ করিডোর নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রতিটি এলাকা বা ওয়ার্ডভিত্তিক খেলার মাঠ নিশ্চিত করতে হবে এবং পাবলিক ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত মাঠগুলো থেকে ক্লাব অপসারণ করতে হবে।...

ঢাকার পয়োনিষ্কাশন ও পানি সরবরাহব্যবস্থা বর্তমানে জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে অপর্যাপ্ত। বর্তমানে রাজধানীতে ওয়াসার মাত্র ২০ শতাংশ এলাকায় পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা রয়েছে। বস্তি এলাকায় নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশনের মতো পরিষেবা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। ক্রমাগত উত্তোলনের কারণে রাজধানী ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রায় নিঃশেষিত। এ ছাড়া, নগরের চারপাশের নদনদী ক্রমশ দূষিত হচ্ছে। প্রধানত নয়টি শিল্পঘন এলাকা- টঙ্গী, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, তারাবো, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর, ডিইপিজেড ও ঘোড়াশাল থেকে পাঁচটি নদীতে প্রায় ৬০ হাজার ঘনমিটার বিষাক্ত বর্জ্য নিঃসরণ হয়। বায়ু এবং পানিদূষণের ফলে ক্ষতিকর রাসায়নিক ও ভারী ধাতু নগরবাসীর খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলছে। এর পাশাপাশি, ক্রমবর্ধমান প্লাস্টিকবর্জ্য সর্বত্র এক সংকটের সৃষ্টি করছে। ঢাকায় বর্তমানে মাথাপিছু ২৪ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ঢাকার জলাশয়গুলোয় প্রতি ঘনমিটার পানিতে ৩৬ হাজার পিস মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। নগরে সৃষ্ট কঠিনবর্জ্যের একটি বড় অংশ (প্রায় ৪০ শতাংশ) কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সংগৃহীত হয় না। নগর কর্তৃপক্ষ যেটুকু কঠিনবর্জ্য সংগ্রহ করে তার বেশির ভাগই ল্যান্ডফিলে ফেলা হয়, যা বাংলাদেশের মতো অত্যন্ত ভূমিস্বল্প এবং ঘনবসতির দেশের জন্য উপযোগী পন্থা নয়।

সেহেতু, উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে আধুনিক পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, পানি পরিশোধন প্রকল্প স্থাপন এবং সুষম পানি সরবরাহ নিশ্চিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নগরবাসীদের জন্য বিশেষ করে নারী, শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধীদের জন্য স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে প্রতি আধা কিলোমিটার পর পর গণপ্রক্ষালন কেন্দ্র এবং সুপেয় পানির সংস্থান করতে হবে। রেস্টুরেন্ট, পেট্রোল পাম্প, শপিং মল, গণপরিসরের মতো স্থানগুলোয় নগরবাসীর ব্যবহারের জন্য প্রক্ষালন কেন্দ্রের সংস্থান বাধ্যতামূলক এবং সর্বজনীন করতে হবে। প্রয়োজনে এসব প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স এবং অন্যান্য অনুমতিপত্র প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি, এ ধরনের নগর সুবিধার অবস্থান ও তথ্য মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে জনগণের কাছে সহজে পৌঁছে দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কঠিনবর্জ্যের ক্ষেত্রে, ‘পুনর্ব্যবহার ও চক্রায়িত ব্যবহার’ সুগম করার জন্য বর্জ্যের শ্রেণিভুক্তিকরণ চালু করতে হবে। কঠিনবর্জ্যের পরিমাণ কমানোর লক্ষ্যে ‘কম ব্যবহার, পুনর্ব্যবহার, চক্রায়িত ব্যবহার’-এর নীতি অনুসরণ করতে হবে। বিশেষত, ‘একবার ব্যবহার্য’ (সিঙ্গেল ইউজ) পণ্য কেনা ও ব্যবহারের বিস্তৃতি রোধ এবং জৈবক্ষয়িষ্ণু (বায়ো-ডিগ্রেডেবল) প্লাস্টিক ব্যবহারে উদ্যোগী হতে হবে। কার্যকর বর্জ্যব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গড়ে তুলতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ তৈরির প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে। কঠিনবর্জ্যকে সম্পদ হিসেবে দেখতে হবে এবং তা ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনে সচেষ্ট হতে হবে।
জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে কার্যকর রেফারেলভিত্তিক ত্রিস্তরীয় পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতি গড়ে তোলা প্রয়োজন এবং সে লক্ষ্যে ‘একীভূত স্বাস্থ্য’ ধারণাকে স্বাস্থ্যসেবার মৌলিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। প্রান্তিক নগরবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নেটওয়ার্কের আওতায় এনে স্বাস্থ্য কার্ড প্রদান করতে হবে।

নগরবন্যা, গণপরিসর ও আন্তনীল সংযোগ
যেহেতু, নগরবন্যা ও জলাবদ্ধতা বাংলাদেশের নগরের একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকায় ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিস্তীর্ণ এলাকা নগরবন্যায় প্লাবিত হয়। ২০১০ সালের ড্যাপে চিহ্নিত ঢাকার জলাশয়গুলো অনেকাংশেই বিলীন হয়েছে। তার পরও ড্যাপ (২০২২-২০৩৫)-এ ঢাকা শহরের ৬৬ শতাংশ এলাকা বন্যাপ্রবাহ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে তার ৫৩ শতাংশই ‘শর্তসাপেক্ষে’ উন্নয়নের আওতাধীন করা হয়েছে। ‘রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (RDRC)’ ঢাকার মোট ৭৮টি খাল চিহ্নিত করেছে, যার সঙ্গে ঢাকার পার্শ্বস্ত চারটি নদীর সরাসরি সংযোগ ছিল বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। খাল খননের মাধ্যমেই ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যার প্রায় ৮০ শতাংশের সমাধান হতে পারে। কিন্তু নগরবাসীর কাঙ্ক্ষিত ‘ব্লু নেটওয়ার্ক বা আন্তনীল সংযোগ’ প্রতিষ্ঠায় এখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। গত চার বছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ৭৩০ কোটি টাকা খরচ করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। 

এ ছাড়া, ঢাকা শহর ২০০২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ সবুজ আবরণ হারিয়েছে। ঢাকায় সবুজ আচ্ছাদনের পরিমাণ বর্তমানে ৮ শতাংশেরও কম। অথচ, বাসযোগ্য নগরীতে ১২ শতাংশ উন্মুক্ত স্থান ও ১৫ শতাংশ এলাকায় সবুজের আচ্ছাদন থাকার কথা। বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকার অবস্থান ধারাবাহিকভাবে অবনমিত হচ্ছে। গণপরিসর এবং সবুজ এলাকার অভাব নগরের বাসিন্দাদের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

নগরবন্যা ও জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে, নগরের বারিপাত অঞ্চলগুলোর প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা এবং পানি ধারণের জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে এবং অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রাকৃতিক ঢালের পরিস্থিতি অনুযায়ী পানি নিষ্কাশনের জন্য নতুন নালা (স্টর্ম ড্রেন) নির্মাণ করতে হবে এবং সেই নালাগুলোকে প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশনব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। ২০১০ সালের ড্যাপে চিহ্নিত জলাশয়গুলোকে পুনরুদ্ধার করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে এবং এ লক্ষ্যে ড্যাপ ২০২২-৩৫ সংশোধন আশু প্রয়োজন। উল্লেখ্য, ড্যাপের ২০১৫ সালের সমীক্ষা অনুসারে ঢাকা মহানগরীতে মোট জলাশয় ও জলাধার (নদী, খাল, লেক, পুকুর, নালা, জলাভূমি)-এর পরিমাণ প্রায় ২১৭ বর্গকিলোমিটার। 

বন্যা ও জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকায় এ ধরনের সমস্যা দূরীকরণে সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (যেমন- পানি ধারণ পুকুর, পানি সংরক্ষণ/রিজার্ভার, বৃষ্টিবাগান, ছাদবাগান, সড়ক বিভাজকে বায়ো-সোয়েল স্থাপন ইত্যাদি) গ্রহণ করতে হবে। নগরের অভ্যন্তরীণ খালগুলো সমন্বিতভাবে পুনরুদ্ধার ও পুনরুজ্জীবিত করে এগুলোকে কীভাবে পরস্পরের এবং পার্শ্ববর্তী নদনদীর সঙ্গে সংযুক্ত করা যায় তার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি ‘ব্লু নেটওয়ার্ক বা আন্তনীল সংযোগ’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে, প্রথমেই আন্তনীল সংযোগ পুনরুদ্ধারে ‘ভূ-প্রাকৃতিক সমীক্ষার’ (Geomorphological Survey) মাধ্যমে ডাটাবেজ তৈরি করে খাল ও জলাশয়ের বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করতে হবে। একই সঙ্গে পানির প্রবাহ ও বারিপাতের ধারা বুঝতে গাণিতিক মডেল এবং হাইড্রো-মরফোলজিকাল মডেল ব্যবহার করে জলাবদ্ধতা প্রতিরোধে উপযুক্ত জল ধারণ এলাকা নির্ধারণ করা জরুরি। জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে খাল পুনরুজ্জীবিতকরণের পাশাপাশি এসব জলাশয় ব্যবস্থাপনায় ও রক্ষণাবেক্ষণে নগরবাসীর অভিভাবকত্ব (Stewardship) নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে একটি বাস্তবায়নমুখী রূপরেখা তৈরি করে খাল ও নদীর সংযোগ স্থাপন এবং দুর্যোগব্যবস্থাপনার জন্য আন্তনীল সংযোগ প্রতিষ্ঠা করায় অগ্রাধিকার দিতে হবে। আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন’কে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। এসব জলাশয় পুনরুদ্ধার ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা হ্রাস, জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি এবং নাগরিকদের জন্য বিনোদনমূলক সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব।

পাশাপাশি, প্রতিটি শহরের জন্য সবুজ নেটওয়ার্ক তৈরিতে, সবুজ এলাকা, জলাশয় এবং গণপরিসর রক্ষা ও পুনরুদ্ধারে স্বতন্ত্র রূপকল্প এবং কার্যকর সরকারি নীতির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকার ড্যাপ (২০২২-৩৫) অনুযায়ী প্রস্তাবিত পাঁচটি আঞ্চলিক পার্ক, ২৪টি জলকেন্দ্রিক পার্ক, চারটি ইকোপার্ক এবং অন্যান্য পার্কের অবস্থান, আকার, নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা তৈরি ও তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দেশের বন-নীতিতে নগর সবুজায়ন অন্তর্ভুক্ত করে ছোট পার্ক ও সবুজ করিডোর নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রতিটি এলাকা বা ওয়ার্ডভিত্তিক খেলার মাঠ নিশ্চিত করতে হবে এবং পাবলিক ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত মাঠগুলো থেকে ক্লাব অপসারণ করতে হবে।

পরিশেষে, ঢাকা মহানগরী একটি ‘অপরিপক্ব নগর’, যেখানে নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনযাপনে প্রয়োজনীয় মৌলিক সুবিধাগুলোর প্রবল অভাব রয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন একটি সুসংহত, টেকসই এবং আধুনিক নগর পরিকল্পনা- যা শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন নয়, বরং পরিবেশ, সামাজিক সেবা, নিরাপত্তা এবং নাগরিক সুবিধার ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। সেই লক্ষ্যে, সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন, সুশীল সমাজ এবং নাগরিকদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন কৌশল এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ এবং সুস্থ জীবনযাত্রা নিশ্চিত করা সম্ভব।

লেখক: স্থপতি ও নগরবিদ
[email protected]

মুখে তাকিয়ে কাজে ফাঁকি

প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:২৭ পিএম
মুখে তাকিয়ে কাজে ফাঁকি
ড. পবিত্র সরকার


     সেই গ্রিক মহাকাব্য ‘ইলিয়াডে’ হেলেন নামক এক সুন্দরীকে ইলিয়াম বা ট্রয়ের যুদ্ধের জন্য দায়ী করা হয়েছিল বটে, কিন্তু তার পরে পৃথিবীর অজস্র অপরাধ পুরুষেরা করে চলেছে, খুন-ধর্ষণ থেকে রক্তক্ষয়কারী যুদ্ধ পুরুষেরাই বাঁধিয়েছে, দুটি প্রলয়ংকর বিশ্বযুদ্ধসহ। এখনো ইউক্রেন বা ফিলিস্তিনে যে যুদ্ধ চলছে তা সংঘটনে শতকরা ১০০ ভাগ কৃতিত্ব পুরুষদের। সেখানে ফাঁকিবাজির কোনো ভূমিকা নেই, বরং উদ্যমের আছে। পুতিন বা নেতানিয়াহুর সেই সব উদ্যমের পেছনে তাদের স্ত্রীদের স্বামীর মুখের দিকে (বা ভাইসি ভার্সা) তাকিয়ে থাকার কোনো ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ছিল কি না আমরা জানি না।...

আগেকার বিলিতি কোম্পানি লার্সেন অ্যান্ড টুব্রোর বড় কর্তা নাকি অফিসে, কারখানায়, আদালতে সর্বত্র ৯০ ঘণ্টা কাজ করার জন্য প্ররোচনা দিয়েছেন। এই প্ররোচনার ভাষা রীতিমতো আলংকারিক। তিনি বলেছেন, বাড়িতে কতক্ষণ আপনি আপনার বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবেন, বা বউ-ই বা কতক্ষণ আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবেন। অফিসে আসুন, কাজ করুন। তার ইঙ্গিত, তাতেই দেশের এবং পৃথিবীর উন্নতি, জীবনানন্দের ভাষায় ‘পৃথিবীর ক্রমমুক্তি’ ঘটবে। 
এই সুব্রহ্মণ্যম্ পদবির ভদ্রলোক নিশ্চয়ই বিপুল পরিমাণে শিক্ষিত ও দক্ষ, যে কারণে তিনি, বাপ্ রে! একটা কোম্পানির মাথা হতে পেরেছেন। লাখ লাখ জন্মের সাধনা ও পুণ্যের ফলে মানুষ তা হতে পারে। এর জন্য নিশ্চয়ই তার ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষ থেকে তপস্যা করা হয়েছে। ফলে তিনি মোটামুটি দেড় শ বছর আগেকার মে দিবসের ইতিহাস আবর্জনাস্তূপে ছুড়ে ফেলতে চান এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের নতুন এক নীতি ও মূল্যবোধে দীক্ষা দিতে চান। দিয়ে, মার্কস-এঙ্গেলসের মূর্তি ভেঙে পৃথিবীর ইতিহাসে চিরস্মরণীয় এক চিন্তাবীর ও কর্মবীর হিসেবে চিহ্নিত হতে চান।
আমি জানি না, নিষ্ঠুর ইতিহাস তাকে সেই সুযোগ দেবে কি না। কিন্তু তার কথাগুলো নিয়ে আমরা একটু নাড়াচাড়া করতে চাই। আমরা তুচ্ছ ও হালকা লোক, তার কথায় আমাদের প্রচণ্ড তাজ্জব হওয়ার ব্যাপারটা তিনি অনুমোদন করবেন আশা করি। তিনি এটা রসিকতা করেছেন যদি বলেন, তা আমাদের রসিকতার ধারণার সঙ্গে মেলে না। প্রথমত, তিনি ইঙ্গিতে কর্মীদের কাজ কম করার যে কারণটি দিয়েছেন, সেটিই একমাত্র তার মনে কেন এল, তার মনস্তত্ত্ব আমি বুঝতে পারছি না। যারা বিবাহিত নন তারা কি তার মতে ঠিকঠাক কাজ করেন? তাদের তো স্ত্রী নেই? বলতে পারেন, স্ত্রী না থাকতে পারেন, হয়তো প্রেমিকা আছে। কিন্তু তা কী করে হবে? কুমার পুরুষদের সবার ঘরে ঘরে প্রেমিকা থাকবে পরস্পরের মুখের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকার জন্য, ভারতীয় সমাজব্যবস্থা এ জায়গায় পৌঁছেছে নাকি! তা হলে তাকে প্রেমিকা শুধু নয়, ‘লিভ-ইন পার্টনার’ হতে হবে। ভারতীয় সমাজে এখনো সেই পরিমাণে ‘প্রগতি’ হয়েছে বলে মনে হয় না, যাতে বাংলা সুবচনের মতো বলা যায়, ‘ধনকে নিয়ে বনকে যাব, সেখানে খাব কী? আড়ালে বসিয়া চাঁদের মুখ নিরখি’- ওই ‘চাঁদ কথাটার মানে একটু বদলে নিয়ে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, তিনি কর্মীদের কাজে ফাঁকি দেওয়ার কারণ হিসেবে তাদের স্ত্রীদের অর্ধেক দায়ী করছেন। যেন স্ত্রীরা আছে বলেই যত গণ্ডগোল, স্ত্রীদের অস্তিত্ব ভারতের বা দক্ষিণ এশিয়ার কর্মসংস্কৃতির পক্ষে বিপজ্জনক। স্ত্রী (বা লিভ-ইন সঙ্গী) থাকলেই তার মুখের দিকে তাকিয়ে, বা তিনি গৃহকর্তার (এ কথাটাও নারীবিদ্বেষী হলো, কারণ মেয়েরাও অনিক সংসার চালান, bread-winner হিসেবে) দিকে তাকিয়ে থাকেন। সুব্রহ্মণ্যম্ সাহেব বলেননি, কতক্ষণ তাকিয়ে থাকা তিনি অনুমোদন করেন। তিনি যদি মিনিট সেকেন্ডের হিসাব করে একটা সময় বেঁধে দিতেন, তা হলে আমাদের এই ফাঁকিবাজ, কর্মবিমুখ, কর্মচোরা সমাজের সদস্যদের ভারী উপকার হতো। তারা ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে বা স্টপ-ওয়াচ চালু করে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে, অ্যালার্ম বাজা মাত্রই চোখ বন্ধ করে অফিসে রওনা হতেন। এতে কারও কোনো অভিযোগ থাকত না। আমরা ভবিষ্যতে তার কাছে ওই সময়মাত্রার নির্দেশ চাইব। 
যাই হোক, আমি জানি না, তার ধর্মপত্নী আছেন কি না, থাকলে তার এই বাণীতে তিনি কী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, হাতের কাছে ঝাঁটার খোঁজ করেছেন কি না। হয়তো সুব্রহ্মণ্যম্ সাহেব তার বাড়িতে তার আদর্শ মেনে চলেন, তিনি তার স্ত্রীর মুখের দিকে মোটেই বা বেশিক্ষণ তাকান না, বা তার স্ত্রীও তার মুখের দিকে একদম বা বেশিক্ষণ তাকান না। আদর্শ দাম্পত্য জীবন সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণা নেই, ফলে তাই স্বামী-স্ত্রীর মুখ-তাকাতাকির ব্যাপারটার সীমা কোথায় হওয়া উচিত, সে আমি আদৌ জানি না। কিন্তু আমি দেখছি যে, এই কর্মবীরটি আমাদের যত অফিস-আদালতের প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য মানুষের স্ত্রী থাকাকেই দায়ী করেছেন, এতে আমার ঘোর আপত্তি আছে। আশা করি, নারীবাদীরাও এ ব্যাপারে তাদের প্রতিবাদ জানাবেন। এ যেন সেই কুখ্যাত ফরাসি বিচারকের মতো, যিনি পুলিশ কোনো অপরাধের খবর নিয়ে এসেই নির্দেশের সুরে বলে উঠতেন, cherche la femme, শের্শে লা ফেম্, মানে আগে মেয়েটাকে খুঁজে ধরো, তা হলেই তোমার অপরাধের মীমাংসা হয়ে যাবে। মানে সব অপরাধের মূলে আছে একটি মেয়ে। 
এতে নারীবাদী নন, বরং তার বিপরীত, অর্থাৎ ‘পুরুষবাদী’ এমন পুরুষেরও আপত্তি করা উচিত, কারণ এ কথাটা তাদের পক্ষে মানহানিকর। যেন নারীর সাহায্য ছাড়া তারা নিজেদের ইচ্ছায় আর কৃতিত্বে কোনো অপরাধ করতে পারেন না, তাদের সে মুরোদই নেই। হ্যাঁ, সেই গ্রিক মহাকাব্য ‘ইলিয়াডে’ হেলেন নামক এক সুন্দরীকে ইলিয়াম বা ট্রয়ের যুদ্ধের জন্য দায়ী করা হয়েছিল বটে, কিন্তু তার পরে পৃথিবীর অজস্র অপরাধ পুরুষেরা করে চলেছে, খুন-ধর্ষণ থেকে রক্তক্ষয়কারী যুদ্ধ পুরুষেরাই বাঁধিয়েছে, দুটি প্রলয়ংকর বিশ্বযুদ্ধসহ। এখনো ইউক্রেন বা ফিলিস্তিনে যে যুদ্ধ চলছে তা সংঘটনে শতকরা ১০০ ভাগ কৃতিত্ব পুরুষদের। সেখানে ফাঁকিবাজির কোনো ভূমিকা নেই, বরং উদ্যমের আছে। পুতিন বা নেতানিয়াহুর সেই সব উদ্যমের পেছনে তাদের স্ত্রীদের স্বামীর মুখের দিকে (বা ভাইসি ভার্সা) তাকিয়ে থাকার কোনো ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ছিল কি না আমরা জানি না।
আচ্ছা, বিবাহিত পুরুষরা ছাড়া আর কেউ কাজে ফাঁকি দেয় না? বা আমি এও বুঝতে পারছি না যে, সুব্রহ্মণ্যম্ সাহেব শুধু বিবাহিত ও সংসারী পুরুষদেরই কাজে নেওয়ার পক্ষপাতী কি না। তা হলে তো একটা মহা মুশকিলের ব্যাপার হলো। আগে আমরা লেখাপড়া করতাম চাকরি পাওয়ার জন্য, চাকরি পেলে বিয়ের কথা ভাবতাম। তুমুল প্রেমে নিমগ্ন, এমন তরুণ-তরুণীদের আমরা বলি যে, একটু অপেক্ষা করো, আগে কেউ একটা চাকরি পাক। শ্রীসুব্রহ্মণ্যম্ দেখছি চাকরি পাওয়ার আগেই বিয়ের বিধান দিচ্ছেন। এটাও একটা বৈপ্লবিক নির্দেশ। জানি না, তিনি গৌরীদানের সুপারিশ করছেন কি না। আমরা এও ভাবছি, এ ব্যাপারে ভারতীয় আইনব্যবস্থার সঙ্গে তার কোনো বিবাদ হবে কি না? 
চাকরি করছে এমন বিবাহিত মেয়েদের কথাটা তার মনে নেই, তাদের বোধ হয় তিনি কাজের অযোগ্য বলে মনে করেন। কারণ, তার কথার মূল লক্ষ্য হলো হতভাগা স্বামীরা। তার কথার ব্যাকরণে স্বামীরা ‘তুমি পক্ষ’ বা ‘মধ্যম পুরুষ’, স্ত্রীরা থার্ড পারসন। তারা বাইরের কোনো কাজকর্ম করেন বলে মনে হয় না। তারা শুধু অফিস-কারখানায় যাওয়ার আগে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে দেরি করানোর কাজে পটু। অর্থাৎ মেয়েরা চাকরিবাকরি করুক, এটা সুব্রহ্মণ্যম্জির কল্পিত সংসারের ছবিতে নেই। লেখাপড়া করুক, সেটা কি চান? এ ব্যাপারে ভারতের বর্তমান মনুবাদী শাসকদের সঙ্গে তার গভীর সহমর্মিতা আছে। 
শ্রীসুব্রহ্মণ্যমের মতো আকাট মহাত্মা এই দক্ষিণ এশিয়ায় আর কতজন জন্মেছেন তা জানার ইচ্ছে রইল।

লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

 

প্রয়োজন ছিল সামাজিক ঐক্য, শ্রেণিভেদের অবলুপ্তি

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:০২ পিএম
প্রয়োজন ছিল সামাজিক ঐক্য, শ্রেণিভেদের অবলুপ্তি
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

আমাদের সাহিত্যের বিকাশের মধ্যেই উপ্ত ছিল এর দুর্বলতার বীজ। যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি দায়িত্ব নিল গদ্যের, তার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা ছিল দেশের বিপুল জনসাধারণের, বিচ্ছিন্নতা অপর কিছুর নয়, শ্রেণিরই। এমনকি ‘করুণার সাগর’ যে বিদ্যাসাগর তিনিও সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার চাইতে বিশেষ শ্রেণির জন্য উচ্চতর শিক্ষার আয়োজনের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন। প্রস্তুত ভূমিকে কর্ষণ করাই যে বুদ্ধিমানের কাজ, অপ্রস্তুত অরণ্যকে নিয়ে ধস্তাধস্তি করার তুলনায় তাদের এই পরামর্শ অস্বাভাবিক ছিল না। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও, বঙ্কিমচন্দ্র যে লাখ কথার এক কথা, ‘আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি’ এই সত্য কথাটায় বিশ্বাস রেখেছিলেন সেটাও অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। স্বার্থের অনুরাগী ছিলেন তারা জাতীয়তাবাদী হওয়া সত্ত্বেও, কৃষকপ্রেম থাকা সত্ত্বেও। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যে মানুষে মানুষে ব্যবধানের, অযোগাযোগের একটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তরূপ পরিখা খনন করেছিল তা ভরাট করা পরের কথা, তার ওপরে কোনো একটা প্রশস্ত ও মজবুত সেতু তৈরিতেও অনীহা ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির।

অন্যদিকে আবার এই শ্রেণি জন্মসূত্রেই ইংরেজের সঙ্গে যে তাঁবেদারি সূত্রে আবদ্ধ ছিল শ্রেণিগতভাবে, সেই জন্মগ্রন্থি ছেদ করাও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাঁবেদারির সেই সত্য মধ্যবিত্তের জনবিচ্ছিন্নতা কমায়নি, কমাবার কথাও নয়। মধ্যবিত্তের ‘চৌকস’ অংশ সোৎসাহে ইংরেজির চর্চা করেছে, চর্চা করে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়েছে, সাহেব-সুবো সেজেছে। বলাই বাহুল্য, বিচ্ছিন্নতার এই দুই কারণ আজও অক্ষুণ্ন আছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নেই কিন্তু ধনবৈষম্য চিরস্থায়ী হওয়ার পাঁয়তারা অহরহ করছে এবং ধনবৈষম্য বাড়ছে বৈ কমছে না। সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদারি কমেনি, তা বরঞ্চ অধিকতর ও গভীর হয়েছে। আজও তাই পণ্ডিতি লেখা ইংরেজিতেই লেখা হয়। আজও তাই বাংলা প্রবন্ধে আমরা ভূরি ভূরি ইংরেজি উদ্ধৃতি দিই, এইটা প্রমাণ করার জন্য যে, বাংলায় লিখলেও ইংরেজি যে জানি না, তা নয়। প্রমাণ অন্যে যতটা না চাক, নিজেই চাই তার চেয়ে বেশি। এই হীনম্মন্যতাবোধ অস্বাভাবিক নয়, নতুনও নয়, এ হচ্ছে তাঁবেদারির সুদীর্ঘ ঐতিহ্যধারার পরিণত ফসল। মধ্যবিত্তের জীবনের সীমাবদ্ধতা, তার জীবনে প্রবলতার ও উদ্ভাবনার স্বল্পতা, অভিজ্ঞতার সংকীর্ণতা, দার্শনিক চিন্তার সামান্যতা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির অকার্যকরতা- সবকিছুই প্রতিফলিত হয়েছে ভাষায়।

ধনবৈষম্য গদ্যের বিকাশকে ব্যাহত করছে আরও একভাবে। দারিদ্র্য সৃষ্টি করে। আমরা দরিদ্র বলেই যে অসমান তা তো নয়, অসমান বলেই আমরা দরিদ্র। সম্পদ উৎপাদন করে যে শ্রমশক্তি অসাম্য তাকে শোষণ করে করে পঙ্গু করে ফেলছে এবং কায়েমি স্বার্থে নিজের সুবিধার জন্য শ্রমশক্তিকে বিদেশে রপ্তানি করছে। ফলে উৎপাদন বাড়ছে না। দারিদ্র্যও ঘুচছে না। এবং দারিদ্র্য না ঘুচলে যে গদ্যের মুক্তি সম্ভবই হবে না, তার প্রচলনও যে ব্যাপক ও বিস্তৃত হবে না, সেটা বুঝবার জন্য তো বিশেষ বিবেচনাশক্তির আবশ্যক হয় না।

বাংলা গদ্যের কতকগুলো বৈশিষ্ট্য গদ্যের ব্যাপক অপ্রচলনেই প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া; যেমন- ক্রিয়াপদের বৈচিত্র্যহীনতা। সর্বনামের ক্ষেত্রে আপনি, তুমি, তুই-এর ব্যবহার। মাথায় চন্দ্রবিন্দুর পাগড়ি চাপিয়ে দিয়ে ‘তাকে’কে ‘তাঁকে’তে পরিণত করা যেন ধ্বনির প্রতি অতিরিক্ত মোহ, অনেক সময় অর্থকে খাটো করে ফেলে হলেও। (মন্ত্রশক্তিকে বিশ্বাসের প্রকাশ যেন, ধ্বনির সাহায্যে সম্মোহন সৃষ্টির অভিপ্রায়। এর প্রয়োজন হয় বিশেষভাবে সেই সময়ে যখন বক্তব্য থাকে অল্প।) বিশেষ্যকে ছাড়িয়ে ওঠে বিশেষণ।

এসব ব্যাপার-স্যাপার অপচয়মূলক তো বটেই, এরা আবার ভাষার দ্রুত ও যথার্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকও বটে। সামাজিক শ্রেণি-বিভাজন বাইরে থেকে বাধা দিচ্ছে ভাষার ব্যাপক ব্যবহারকে- ধনবৈষম্যের গভীর পরিখা খনন করে রেখে, সেই পরিখাকে দিনে দিনে গভীরতর করে। সেই শ্রেণি-বিভাজন এত চতুর যে, বাইরের প্রতিবন্ধকের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা না রেখে ভাষার অভ্যন্তরেও নিজেদের লাঠিয়াল বসিয়ে রেখেছে, ভাষা যাতে ব্যাপক প্রচার না লাভ করে, সে যেন কিছুতেই সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারে।

ভাষার ওপর এর চেয়ে স্কুল এবং অনেক সময় হাস্যকর পন্থায় লাঠিসোঁটা হাতে লাফিয়ে পড়ার যে সব ঘটনা একের পর এক ঘটেছে তারা তো ওই একইভাবে সামাজিক বিপ্লববিরোধী এবং সে কারণে গদ্যের মুক্তিবিরোধী, শক্তির কারসাজি। বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কী, এই বিতর্ক একদিন ওঠানো হয়েছিল। উর্দুই যে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা, এই মতবাদ যখন ওই বিতর্কের সাহায্যে কিছুতেই প্রতিষ্ঠা করা গেল না, তখন এল নতুন বিতর্ক। ততদিনে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, তাই বলা হলো- বাংলা ভাষা যথেষ্ট মুসলমানি নয়, তাই এ ভাষা রাষ্ট্রভাষা হবে না। মাতৃভাষা বিতর্কের পর রাষ্ট্রভাষা বিতর্ক। তাতেও ভরসা করা যায় না দেখে চেষ্টা হলো ভাষা সংস্কারের। বলা হলো, হরফ বদলাও, আরবি হরফ নাও, নইলে যথেষ্ট ইসলামি হতে পারবে না, নিলে অন্তত রোমান হরফটা নিয়ে নাও, ভাষার অবৈধজ্ঞানিকতা ঘুচে যাবে।

সেই যে নজরুল ইসলাম একদা আরবি-ফার্সি শব্দের নতুন উৎসমুখ খুলে দিয়েছিলেন বাংলা ভাষার জন্য, সেই কাজটির সূত্র ধরেই বাংলা সাহিত্যে ‘খুনের মামলা’ জমাট বেঁধেছিল এক সময়ে। প্রশ্ন উঠেছিল খুন শব্দ চলবে কি চলবে না। ব্যাপারটা ভাষাতাত্ত্বিক ছিল না আসলে, ছিল সাম্প্রদায়িক। এই সাম্প্রদায়িকতাই উল্টোভাবে এল পাকিস্তান সৃষ্টির পর এবং সেও- শত্রুর শত্রুতা এমনই অভিন্ন- নজরুল ইসলামকে কেন্দ্র করেই, বলা হলো, নজরুলের ‘হিন্দুয়ানি’ শব্দগুলোকে বাদ দিতে হবে ইসলামের স্বার্থে, মহাশ্মশান চলবে না, শ্মশানকে গোরস্থান বানাতে হবে। (প্রচার মাধ্যমগুলোতে কোন শব্দ ব্যবহার করা যাবে, কোনটা যাবে না, সে নিয়েও দ্বন্দ্ব বসেছে, চলছে আজও)। সাধু-চলিতর যে বিরোধটা মাঝে-মাঝেই মাথা চারিয়ে ওঠে, তারও উদ্দেশ্য সাধু নয়, সেও চায় ভাষাকে সামনের দিকে এগিয়ে না দিয়ে ভাষা ব্যবহারকারীদের দুই ভাগে বিভক্ত করে একটি ‘গৃহযুদ্ধের’ সূচনা করতে।

সাধু-চলিতর বিতর্ক অনেক আগেই মীমাংসা হয়ে গেছে আসলে, ঐতিহাসিকভাবে। সাধুকে পেছনে ফেলে এগিয়ে এসেছে চলিত বাংলা। একটা ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই ঘটেছে এই ঘটনা। সাধু ভাষাটা কৃত্রিম ছিল। সংস্কৃত পণ্ডিতদেরই অবদান ওটি, প্রধানত। আলালের, হুতোম পেঁচার, মধুসূদনের প্রহসনের, বিদ্যাসাগরের বিতর্কের ভাষাও চালু ছিল বটে, কিন্তু সে ভাষাকে যথেষ্ট ‘ভদ্র’ মনে করা হয়নি, বা তাকে যথেষ্ট ‘ভদ্র’ করে তোলা হয়নি। বাধাটা ছিল কোথায়? ছিল সামাজিক বিন্যাসের মধ্যেই, ছিল ভদ্রলোকদের শ্রেণিচরিত্রের অভ্যন্তরেই। কথা ছিল গদ্য আরও এগোবে। এগোলোও। এল চলিত ভাষা। কথা ছিল আরও এগোবে কিন্তু তা এগোলো না। কেননা তার শ্রেণি-দূরত্বটা রয়ে গেল। ভদ্রলোকেরা ‘ইতর’জন হতে রাজি হলেন না কিছুতেই, আঞ্চলিক শব্দের চয়ন করবেন বলে আঞ্চলিকতা প্রচার করলেন হয়তো-বা কখনো কখনো, কিন্তু গদ্যকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন ছিল যে সামাজিক ঐক্য, অর্থাৎ শ্রেণিভেদের অবলুপ্তি, তা গড়া সম্ভব হয়নি বলে গদ্যের চরিত্রেও কোনো বড় রকমের পরিবর্তন আসেনি।

বাংলাদেশে আমরা দু-দুবার স্বাধীন হয়েছি। আমরা মুক্তিযুদ্ধে লড়েছি। সামাজিক অগ্রগতি যে হয়নি তা নয়। বস্তুগত উন্নতিও যে হয়নি তা বললে মিথ্যা কথা বলা হবে। কিন্তু গদ্য তো পরিবর্তিত হয়নি। বরঞ্চ উল্টো আজ নাকি চেষ্টা হচ্ছে সেই পরিত্যক্ত সাধু ভাষাকে ফেরত আনবার। এসব ব্যাপারের সারমর্ম একটাই- সমাজব্যবস্থায় বৈপ্লবিক কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, একাধিকবার স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও সমাজ আজও মুক্ত হয়নি।

গদ্যের বিকাশে সংবাদপত্রের ভূমিকা অবহেলার বস্তু নয়। এটা বোধ হয় তাৎপর্যবিহীন নয় যে, আমাদের সংবাদপত্রে সংস্কৃতি পাতাটা আলাদা করে রাখা হয়, ছোটদের পাতার মতো বিচ্ছিন্ন পাতা সেটা। আর সংস্কৃতি বলতে সেখানে বোঝানো হয় চলচ্চিত্র ও নাটককেই। এই যে একদিকে সংস্কৃতিকে সংবাদপত্রের সাধারণ ক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এবং অপরদিকে সংস্কৃতি বলতে দৃশ্যমান বস্তুকে বোঝানো, এর অভ্যন্তরে নিশ্চয়ই একটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির সাংবাদিক তাৎপর্য এই যে, সংবাদপত্রের ভাষার পক্ষে সংস্কৃতিবান হওয়ার কোনো আবশ্যকতা নেই।

 সাংবাদিক গদ্য, সাহিত্যিক গদ্য নয়, এই কথাটা নীরবে-সরবে সব সময়েই বলা হচ্ছে। এবং এই বলাটাই অজুহাত হয়ে দাঁড়াচ্ছে ভাষাকে যথেষ্ট সুসংগত না করার। যেমন তেমন করে লিখলেই চলে যদি মনে করা হয়, তবে সে লেখা দায়সারা গোছের হতে বাধ্য। আর ওই যে আইন আছে, খারাপ মুদ্রা ভালো মুদ্রাকে তাড়িয়ে ছাড়ে, সেই আইন এখানেও চালু হয়ে যাচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই। দ্বিতীয়ত, সংস্কৃতি অর্থই যদি প্রদর্শনী হয় তবে সেই ঘটনা সাংবাদিকতার গদ্যের তুলনায় চিত্রকে প্রধান হতে সাহায্য করবে বৈকি। করছেও তাই। সংবাদপত্র যত বেশি সচিত্র হচ্ছে তত বেশি অসাহিত্যিক হচ্ছে। সলজ্জভাবে নয়, সন্তুষ্টভাবে। অনেক পত্রিকার পরিচালকই বলেন যে, তাদের পত্রিকার দর্শকের সংখ্যা পাঠকের সংখ্যার সমান বটে। ছোটদের পত্রিকাতেও দেখি চিত্র যতটা থাকে, সাহিত্য ততটা থাকে না। এরই নাম বোধ করি স্থূলতা।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য অরেকটি সত্য। সংবাদপত্রে চুরি-ডাকাতি-রাহাজানির খবর থাকে, সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অর্থহীন, অর্বাচীন উক্তিগুলো গলা ফাটিয়ে চেঁচায়, কিন্তু কোনো বইয়ের খবর, কিংবা সমালোচনা অথবা লেখক বুদ্ধিজীবীর কোনো প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য কিছুতেই নিজের জন্য ছোট একটু স্থানও খুঁজে পায় না। বলতে দ্বিধা থাকা উচিত নয়, যে সংস্কৃতির (যথার্থ অর্থে) অবমূল্যায়ন শুধু প্রতিক্রিয়াশীলরাই করেননি (তারা তো করবেনই, তারা জীবনের বিকাশবিরোধী) প্রগতিশীলরা, যারা সমাজবিপ্লব চান, তারাও করেছেন। উভয়ত-অবমূল্যায়িত সংস্কৃতির নিজের মানকে উন্নত করার অবকাশ তেমন একটা পায়নি এ দেশে।

সাংবাদিকতার সাহিত্য-বিরোধিতা আরও একভাবে ঘটেছে। আন্তরিকতাহীনতা যে সাহিত্যের পরম শত্রু এ তো কোনো প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। সাংবাদিকতার আন্তরিকতাহীনতা পদে পদে এসেছে। যা ঘটেছে তা বলা যায়নি, যা বলা গেছে তা ঘটেনি। যা লেখা হয়েছে তাতে আস্থা থাকেনি। না, লেখকের নিজেরও নয়, আর যাতে আস্থা ছিল তা লেখা যায়নি। সত্য গোপনের লুকোচুরি ও মিথ্যার বেসাতি মাশুল আদায় করে নিয়েছে সাংবাদিকতার প্রতি অবিশ্বাসের মূল্যে যেমন, তেমনি সাংবাদিকতার ভাষার ক্ষতিসাধনের মুদ্রাতেও। 

সাংবাদিকতার ক্ষতি গদ্যেরই ক্ষতি; তার প্রতি অনাস্থা ভাষার প্রতি অনাস্থার আকর বটে। এবং লেখকদেরও ধিক্কার এসেছে নিজেদের কাজের ওপর। গ্লানিময় হয়ে উঠেছে সবটা ব্যাপার-গৌরবময় না হয়ে। নজরুল ইসলামের সাংবাদিকতা যে সমান উজ্জ্বল ছিল তার কারণ তার আন্তরিকতা, সেটি না থাকলে শুধু প্রতিভায় কুলাতো না; অথবা প্রতিভা প্রতিভাই হতো না।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

শহরকে বদলে দিতে পারে জাপানি খুদে-বন

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৫৯ পিএম
শহরকে বদলে দিতে পারে জাপানি খুদে-বন
মৃত্যুঞ্জয় রায়

বিশ্বের অনেক শহরেই নগর-বন করার রীতি অনেক দিন ধরে চলে আসছে। নগর-বন করতে বেশ খানিকটা বড় পরিসরের জায়গা লাগে। সাধারণত নগরের কোনো পরিত্যক্ত এলাকা বা পতিত জমিতে কোনো স্থাপনা না বানিয়ে সেখানে ছোট আকারে প্রাকৃতিক বন সৃজন হলো নগর-বনের মূল ধারণা। অবশ্যই সেটি কোনো পার্ক বা উদ্যান হবে না, কোনো সাজানো গোছানো বাগান হবে না। হবে সে স্থানের পরিবেশ ও প্রতিবেশ অনুযায়ী বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালার সমাহার। সে বনে প্রাথমিকভাবে কিছু গাছপালা লাগানো হলেও পরবর্তীতে সেসব গাছের বীজ বা মৃত্তিকাপ্রসারী শিকড় থেকে চারা গজিয়ে আপনা আপনি দ্রুত সেটা একটা প্রাকৃতিক বনে রূপ নেবে। সেসব বনের কোনো ব্যবস্থাপনারই দরকার হয় না। 

নগর-বনের পরিবেশে থাকে নানা ধরনের গাছপালা, জলাশয়, ডোবা, টিলা ইত্যাদি। সেসব গাছের ঝরাপাতা সেখানেই বনতলে তৈরি করে এক আলাদা অণু-পরিবেশ, পাতাগুলো পচে মাটির জন্য সার হয়, গাছেরাও পুষ্টি পায়। সেসব ঝরা পাতা ও ঝোপের ভেতর জন্ম নেয় অনেক পোকামাকড় ও অণুজীব। বৃক্ষ, গুল্ম, তৃণ-লতায় সেখানে এমন এক পরিবেশ তৈরি হয় যেখানে বিভিন্ন জীব-জন্তুও নির্ভয়ে থাকতে ও বংশবিস্তার করতে পারে। সেসব বনে থাকে না কোনো স্থাপনা ও পাকা পথ-ঘাট। বনপথ তৈরি হয় সেসব বনে যাওয়া মানুষদের চলাচলে। আমেরিকায় গিয়ে এরূপ বেশ কিছু নগর-বন দেখেছি, যেগুলো থাকে সাধারণত নগর বা শহরের উপকণ্ঠে, লোকালয় থেকে কিছুটা দূরে। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছপালার ভেতর থাকে পাখি ও প্রজাপতিদের মেলা, এমনকি নির্ভয়ে ঘুরতে দেখেছি বুনো হরিণ ও বুনো হাঁসদের। ঢাকা শহরে এরূপ দুটি নগর-বন করার পরিকল্পনা নিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এর একটি হওয়ার কথা ছিল বনানীতে, অন্যটি কল্যাণপুরে। জানি না সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না।

ব্যস্ত শহরের রাস্তার ধার, সুপ্রশস্ত সড়ক দ্বীপ, খেলার মাঠের কোনা, পার্ক, শপিং সেন্টার, কনডোনিয়াম বা আধুনিক আবাসিক এলাকা, ঝিল ও নদীপাড় ইত্যাদি স্থান সবুজ শ্যামলিমায় ভরিয়ে দিতে সম্প্রতি নতুন আর একটি ধারণার চর্চা চলছে। লন্ডন থেকে লস অ্যাঞ্জেলস পর্যন্ত অনেক শহরেই এখন এই ‘খুদে-বন’ ধারণায় শহরকে শ্যামল করার চেষ্টা চলছে। পৃথিবীর প্রায় ৫৬ শতাংশ লোক বাস করে শহরে, কিন্তু অধিকাংশ শহরে নেই পর্যাপ্ত বৃক্ষাচ্ছাদিত ভূমি। বাংলাদেশের ২১ দশমিক ৪ শতাংশ লোকের বাস শহরে, শহরগুলোতে সবুজ আচ্ছাদিত এলাকা মোট শহরগুলোর আয়তনের ১০ শতাংশের বেশি হবে না, যা থাকা উচিত ছিল কমপক্ষে ২০-২৫ শতাংশ। এদিক দিয়ে নরওয়ের অসলো শহরে নগর-সবুজের পরিমাণ প্রায় ৭২ শতাংশ, ইউরোপীয় দেশগুলোর শহরে ৪২ শতাংশ। যেসব শহরে সবুজের পরিমাণ কম রয়েছে সেসব শহরে ‘খুদে-বন’ সবুজ আচ্ছাদন বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

‘খুদে-বন’ ধারণার প্রবক্তা জনৈক জাপানি উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও উদ্ভিদ-পরিবেশ বিশেষজ্ঞ প্রয়াত অধ্যাপক আকিরা মিয়াওয়াকি। তিনি সত্তুরের দশকে এ ধারণাটি দেন। পরে বিশ্বের অনেক দেশেই ‘খুদে-বন’ চর্চা শুরু হয়। মাত্র ৯ বর্গমিটার অথবা ৩০ বর্গফুট জায়গার মধ্যেই এই খুদে-বন তৈরি করা সম্ভব। জায়গা বেশি থাকলে আরও বড় বন করা যেতে পারে। এ ধারণায় সেই স্বল্প পরিসর জায়গায় স্থানীয় বা সে স্থানে যেসব গাছ ভালো জন্মে সেসব স্থানীয় প্রজাতির গাছ লাগানো হয় ঘন করে। স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত ও আবাসিক দেশি প্রজাতির গাছগুলো লাগানোর সুবিধা হলো, সেসব গাছ দ্রুত সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে এবং দ্রুত বাড়তে পারে। এতে যে বন সৃষ্টি হয় তা হয় টেকসই। 

অধ্যাপক মিয়াওয়াকি জাপানসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এক হাজারেরও বেশি এ ধরনের ‘খুদে-বন’ তৈরি করেন। বর্তমানে তার এ কৌশল ব্যবহার করে নেদারল্যান্ডস, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, ভারত প্রভৃতি দেশের বিভিন্ন শহরে ‘খুদে-বন’ তৈরি করা হচ্ছে। নেদারল্যান্ডসে ২০১৫ সালে এরূপ বন সৃজন শুরু হয়, ২০২১ সালের আগস্টে পাকিস্তানের সাগিয়ান শহরে ১২ দশমিক ৫ একর জায়গাজুড়ে এরূপ একটি শহুর বন তৈরি শুরু হয়। সে বনে এখন ১ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি গাছপালা রয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে হাওড়া জেলা পরিষদ পাইলট প্রকল্প হিসেবে নদীর পাশে শ্যামপুর ১ নম্বর ব্লকের কমলপুর গ্রামে কয়েক বিঘা জমির ওপর করা হয়েছে এরূপ খুদে-বন। এতে মনে হচ্ছে ‘খুদে-বন’ শুধু শহরে না, গ্রামেও হতে পারে।

বাংলাদেশেও চট্টগ্রামে মিরেরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের সোনার পাহাড়ে এ পদ্ধতির একটি খুদে প্রাকৃতিক বন সৃজন করা হয়েছে। ঢাকা শহরে ধানমন্ডি ঝিলের ধারের একটি ছোট্ট অংশে এরূপ একটি বনের অস্তিত্ব রয়েছে, তবে সেটি আধা-প্রাকৃতিক হয়ে টিকে আছে। সেখানে গেলে ঘন গাছপালা ভরা সে অংশটাকেই কিন্তু ধানমন্ডি ঝিল উদ্যানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও গ্রামীণ বন বলে মনে হয়। এ উদাহরণ আমরা দেশের বিভিন্ন শহরের পার্কগুলোতেও সৃষ্টি করতে পারি। দেশে বন গবেষণার নানা দিক নিয়ে গবেষণা হলেও, নগর-বন নিয়ে গবেষণা নেই বললে চলে। তাই এ বিষয়টি নিয়ে গবেষকরা ভাবতে পারেন এবং দেশের প্রতিটি শহরের জন্য খুদে-বনের কয়েকটি মডেল সুপারিশ করতে পারেন। কোন শহরের খুদে-বনের জন্য কী কী প্রজাতির গাছ সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত হবে, সে তালিকাও করে দিতে পারেন বৃক্ষপালনবিদ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা।

নগরে এ ধরনের খুদে-বন তৈরির সুবিধা হলো, শহরে গাছপালা লাগানোর জায়গা পাওয়া যায় কম। আবার শহরে বায়ুদূষণও থাকে দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে অনেক বেশি। তাই এমন কিছু গাছপালা দরকার যেগুলো দ্রুত বাড়তে ও বায়ুদূষণ কমাতে পারে। মিয়াওয়াকি পদ্ধতিতে দেখা গেছে, এরূপ বনে লাগানো গাছগুলো প্রতি বছর গড়ে সাধারণ গাছের তুলনায় ১০ গুণ দ্রুত গতিতে বাড়ে। বছরে একটি গাছ গড়ে ১ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এতে কয়েক বছরের মধ্যেই একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বন তৈরি করা সম্ভব। মাত্র ২০ বছরেই এ পদ্ধতিতে যে বাগান হবে, তা সাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশে হতে সময় লাগবে এর তিন গুণেরও বেশি। তাছাড়া এরূপ বনে লাগানো গাছগুলোর দুই থেকে তিন বছর পর থেকে আর কোনো পরিচর্যার দরকার হয় না। 

এমনকি কোনো গাছ মরে গেলে বা পড়ে গেলে তাকে সেখানে সেভাবেই ফেলে রাখা হয়, সরানো বা পরিষ্কার করা হয় না। সেসব গাছ নিজেরাই বাড়তে থাকে। এমনকি সেসব গাছে কোনো সেচ, সার, বালাইনাশক কিছুই দিতে হয় না। এসব খুদে-বনের গাছগুলো প্রায় ৩০ গুণ বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিশোষণ করতে পারে, যা নগরের পরিবেশ ভালো রাখতে খুবই দরকারি। বর্তমান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ঢাকা শহরের নগর পরিকল্পনায় সবুজায়ন, জীববৈচিত্র্য ও জলাধার সংরক্ষণের ওপর জোর দিয়েছেন, যা একটি বাসযোগ্য শহরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নগর সবুজায়নে ‘খুদে-বন’ সৃষ্টির ধারণাকে বিবেচনা করা যেতে পারে।

লেখক: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক

নীতি সুদহার প্রশংসনীয় হলেও বিনিময় হার নিয়ন্ত্রিত

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৫১ এএম
আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৫৯ এএম
নীতি সুদহার প্রশংসনীয় হলেও বিনিময় হার নিয়ন্ত্রিত
ড. জাহিদ হোসেন

চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, সেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এটি প্রশংসনীয়। কারণ এটা করা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য কোনো উপায় ছিল না।

যদিও নীতি সুদহার কিছুটা কমানোর দাবি ছিল ব্যবসায়ীদের। তবে আমি মনে করছি দেশে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় নীতি সুদহার কমানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আর নতুন সরকার আসার পর ৩ বার নীতি সুদহার বাড়ানোর কারণে এখনই তা পুনরায় বৃদ্ধি যুক্তিযুক্ত নয়।

এখন যে নীতি নেওয়া মার্কেটে তার প্রভাব পড়তে সময় দিতে হবে। সেক্ষেত্রে নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রাখাই যুক্তি সম্পন্ন ছিল। সেই সঙ্গে প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছে, সেটিও বাস্তবসম্মত।

গভর্নর যথার্থভাবেই বলেছেন, চলতি বছর আমাদের প্রবৃদ্ধির দিকে তাকানোর সময় না। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা করাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ।

তবে বিনিময় হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিতে চলছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সেখানে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হলেও নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাই ধরে রাখা হয়েছে। আর এই বিষয়ে গভর্নর যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে আগের গভর্নরের ধারাবাহিকতাই দেখা যাচ্ছে।

তিনি একদিকে বলছেন আমাদের চাহিদা কমে আসছে, রেমিট্যান্স বাড়ছে, রপ্তানি আয়ও বাড়ছে। আবার অন্যদিকে বিনিময় হারে অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছেন। যা সাংঘর্ষিক। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কারণ মার্কেটের চাহিদা অনুযায়ী বিনিময় হারকে ওঠানামা করতে দিতে হবে।

আর বাংলাদেশ ব্যাংক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর ম্যানুপুলেশনের যে বক্তব্য দিচ্ছে তার প্রমাণ কি? তারা কেন শুধু বাংলাদেশকেই টার্গেট করবে। একই রকম বাজার তো শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, পাকিস্তান ও ভারতেও। তাদের কেন টার্গেট করছে না। তার ব্যাখ্যা তো বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া উচিত।

এক কথায় বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক না করে আটকিয়ে রাখা অর্থনীতির জন্য ভালো নয়।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ