
তার জন্ম জৈবিক প্রক্রিয়ায় নয়। তার শক্তির উৎস ঈশ্বরপ্রদত্ত। ঈশ্বরের অংশ আছে তার মধ্যে। লোকসভা ভোটের আগে এই কথাগুলো বলতে শোনা গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। যা নিয়ে বিস্তর বিতর্কও হয়েছে। এবার সেই মোদিই বললেন, তিনিও আর পাঁচজনের মতো সাধারণ মানুষ। কোনো ঈশ্বর নন। এমন আবোলতাবোল কথা এই প্রথম নয়, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দিন থেকেই তিনি বলে আসছেন। যেমন, তিনি বলেছিলেন, বছরে ১ কোটি লোককে চাকরি দেবেন। ভারত পাঁচ বছরের মধ্যে ১ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠবে। বিদেশ থেকে ভারতীয় শিল্পপতিদের কালো টাকা ফিরিয়ে এনে প্রত্যেক ভারতবাসীর অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা করে দেবেন ইত্যাদি। সেসব মন্তব্যের কোনো কৈফিয়ত তার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।
আসলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক শিল্পপতির পডকাস্টে অতিথি হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। জিরোদার অন্যতম কর্ণধার নিখিল কামাথের ওই পডকাস্টের প্রাথমিক ঝলক প্রকাশ্যে এসেছে। সেই পডকাস্টেই কথা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শোনা গেছে, ‘আমিও সাধারণ মানুষ। কোনো দেবতা নই।’ মোদি বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন একটা ভাষণে অযাচিত মন্তব্য করেছিলাম। কিন্তু ভুল তো আমারও হয়। আমিও মানুষ।’ তবে ঠিক কী প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ওই কথা বলেছেন, সেটা স্পষ্ট নয়।
প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যকে অনেকে লোকসভা ভোটের আগে তার করা মন্তব্যের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রী ঘুরিয়ে দাবি করেছিলেন, তিনি পরমেশ্বরের কৃপাধন্য। এমনকি তার জন্মও আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো জৈবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। লোকসভা ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘মা যতদিন বেঁচে ছিলেন আমার মনে হতো, হয়তো জৈবিক প্রক্রিয়ায় আমার জন্ম হয়েছে। কিন্তু মায়ের মৃতুর পর নানা রকম অভিজ্ঞতা থেকে আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছি যে, আমাকে পরমায়া পাঠিয়েছেন। এত শক্তি আমি কোনো জৈবিক প্রক্রিয়া থেকে পাইনি। ঈশ্বর আমাকে দিয়ে কাজ করাতে চান, সে জন্য আমাকে এই শক্তি তিনিই দিয়েছেন। আমাকে সামর্থ্যও তিনি দিয়েছেন, সদিচ্ছাও তিনি দিয়েছেন, প্রেরণাও তিনিই দিচ্ছেন।’
প্রধানমন্ত্রী জানতেন, তার এই মন্তব্য অনেকেই অপব্যাখ্যা করবে। ভালোভাবে নেওয়া হবে না। সেটাও উল্লেখ করেন ওই সাক্ষাৎকারে। পরে দেখা যায় কংগ্রেসসহ বিরোধীরা মোদিকে ‘নন বায়োলজিক্যাল’ প্রধানমন্ত্রী বলে কটাক্ষ করেছেন। সদ্য পডকাস্টে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কি সেই কটাক্ষেরই জবাব দিলেন প্রধানমন্ত্রী?
কাউকে অনুকরণ নয়, তিনি বরাবরই ট্রেন্ড তৈরি করেছেন। পুরোনো চিন্তাভাবনা ছেড়ে নতুনত্বকে গ্রহণ করতে তার কোনো সমস্যা নেই। এই নীতি নিয়েই দেশ পরিচালনা করেন তিনি। কথা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সম্প্রতিই ডেরোধার সহ-প্রতিষ্ঠাতা নিখিল কানাথের পডকাস্ট শোতে গিয়েও প্রধানমন্ত্রী মোদি জানালেন, তিনি ‘নেশন ফার্স্ট’ নীতিতে বিশ্বাসী। দেশের উন্নয়নে এবং এই নীতির সঙ্গে যদি মিল খায়, তবে পুরোনো চিন্তাধারাকে বাদ নিয়ে নতুন চিন্তাধারা গ্রহণ করতে কোনো সমস্যা নেই। এই প্রথম কোনো পডকাস্ট শোয়ে অংশ নিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেখানে তিনি সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলেন। জানান, নির্বাচনে বিপুল জয়ে আনন্দিত হলেও, তিনি নিজের সাফল্য দেখতে পান কতটা সমস্যা সমাধান করতে পারল তার তৈরি টিম, এর মাধ্যমে।
প্রধানমন্ত্রী জানান, যুব প্রজন্মের মধ্যে তিনি অসীম ক্ষমতা ও সম্ভাবনা দেখেন। কোনো যুবনেতার মধ্যে প্রতিভা দেখেন কি না- এই প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেকের মধ্যেই সম্ভাবনা রয়েছে। এক-দুজনের নাম নিলে বাকিদের প্রতি অবিচার করা হবে।’
নিজের জীবনের মন্ত্রও বলে দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। জানান, তিনি ভুল করলেও কখনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু করেন না। এর ব্যাখ্যা দিয়ে পডকাস্টে তিনি বলেন, ‘যখন আমি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হই, তখন বলেছিলাম যে, কঠোর পরিশ্রম করতে কোনো খামতি রাখব না। আমি নিজের জন্য কিছু করব না। আমিও মানুষ। আমিও ভুল করি। কিন্তু খারাপ কাজ করব না। এটাকেই আমার জীবনের মন্ত্র বানিয়ে নিয়েছি। ভুল তো হবেই। আমিও নিশ্চয়ই ভুল করেছি। আমিও তো মানুষ, ঈশ্বর নই।’
কেটে গেছে দুই দশকেরও বেশি সময়। গুজরাটের গোধরায় জ্বলন্ত ট্রেন আর শয়ে শয়ে লাশের ছবি এখনো ফিকে হয়নি ভারতবাসীর মন থেকে। সে সময় সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কীভাবে এত মানুষের মৃতুযন্ত্রণা চেপে রেখে, মন শক্ত করে কড়া হাতে পরিস্থিতি সামলেছিলেন নরেন্দ্র মোদি, এতদিন পর সে কথাই তুলে ধরলেন এক পডকাস্ট চ্যানেলে। বললেন, ‘যতটা পেরেছি, নিজেকে সামলেছি। আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি। কল্পনা করুন, চারদিকে লাশের পাহাড়। আমি তার মাঝে দাঁড়িয়ে।’ নিখিল কামাত নামে এক সাংবাদিকের পডকাস্ট চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ২০০২ সালের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন আজকের প্রধানমন্ত্রী। সে বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন গোধরায় এই ঘটনা ঘটছে, তার ঠিক তিন দিন আগে ভোটে জিতে বিধায়ক হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। তার মধ্যে এমন চিত্র দেখে কার্যত দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে মোদি বলেন, ‘বিধানসভায় ছিলাম সেদিন। হঠাৎ খবরটা পেলাম যে গোধরায় ট্রেনে আগুন লেগে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শুনেই আমি কেঁপে উঠি। অত্যন্ত আশঙ্কা হতে থাকে।
বিধানসভা থেকে বেরিয়ে আসি। ভাদোদরা থেকে গোধরা যেতে চাই। সে সময় কোনো কপ্টার ছিল না। আমি বলি যে, কোনো কপ্টার লাগবে না। সাধারণ মানুষ যেভাবে যাচ্ছে, সেভাবেই যাব। তা সত্ত্বেও একটা সিঙ্গল ইঞ্জিন কপ্টারের ব্যবস্থা করেছিল ওএনজিসি। তাতেই গেলাম।’
এর পরই সেই হাড়হিম করা দৃশ্য। মোদির কথায়, ‘গিয়ে দেখি, চারপাশে শুধু মানুষের দেহ ছড়িয়ে রয়েছে, পোড়া পোড়া। আমার হৃদয় ভেঙে গেল। কীভাবে যে নিজেকে সামলেছি, আমিও তো একজন মানুষ। তার পর মনে হলো, আমাকে এসবের ওপরে উঠে পরিস্থিতি অনুযায়ী সব ব্যবস্থা করতে হবে। সব যন্ত্রণা বুকে চেপে সেই কাজ করি। এই ঘটনাটা সামলানো আমার পক্ষে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ ছিল। সে সময় যেভাবে পেরেছি, পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি।’ এনিয়ে শুক্রবার সাক্ষাৎকারে তার আবেগের প্রতিফলন ঘটেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই প্রথম পডকাস্টে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আর সেখানেই মহাত্মা গান্ধীকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন তিনি। জানালেন, নেতৃত্ব ও সংযোগ স্থাপনে কীভাবে নজির গড়েছিলেন ‘জাতির জনক’। সেই সঙ্গেই ভাগ করে নিলেন রাজনীতি সম্পর্কে তার উপলব্ধিও। মোদির দাবি, রাজনীতিতে ঢোকা সহজ। কিন্তু সেখানে সাফল্য অর্জন করা সহজ নয়।
জিরোদার অন্যতম কর্ণধার নিখিল কামাথের পডকাস্টে উপস্থিত হয়েছিলেন মোদি। আর সেখানেই তাকে বলতে শোনা গেছে, ‘‘গান্ধী কখনো টুপি পরেননি। কিন্তু গোটা বিশ্ব মনে রেখেছে ‘গান্ধী টুপি’কে।
এটাই সত্যিকারের নেতৃত্ব ও যোগাযোগের শক্তি।’’ পাশাপাশি মোদির আরও দাবি, গান্ধী নিজে সুবক্তা ছিলেন না। কিন্তু মানুষের সঙ্গে মেশার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। আর তার সাহায্যেই তিনি নিজের ব্যক্তিত্ব ও দক্ষতায় দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। এরই সঙ্গে রাজনীতিতে প্রবেশ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘রাজনীতিতে প্রবেশ সহজ। কিন্তু সাফল্য অর্জন একেবারে আলাদা একটা চ্যালেঞ্জ। রাজনীতিতে সাফল্যের জন্য প্রয়োজন গভীর আত্মোৎসর্গ, মানুষের সঙ্গে লাগাতার সংযোগ স্থাপন, তাদের ভালো ও খারাপ উভয় সময়েই। দলীয় কর্মী হিসেবে কাজ করার যোগ্যতাও থাকতে হবে। যদি কেউ বিশ্বাস করে, তার কথা সবাই শুনবে ও অনুসরণ করবে, তা নয়। এভাবে কয়েকটি নির্বাচনে জেতা যেতে পারে। কিন্তু কোনো গ্যারান্টি নেই যে, তিনি একজন সফল নেতা হয়ে উঠতে পারবেন।’
একবার নয়, পরপর তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। আর প্রতিবারই নতুন ধরনের উপলব্ধি হয়েছে তার। একটি সাক্ষাৎকারে সেই উপলব্ধি ভাগ করে নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। সঙ্গে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন অভিজ্ঞতাও শুনিয়েছেন। মোদি বলেছেন, প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সবাই তাকে দেখছিলেন, তাকে বোঝার চেষ্টা করছিলেন। আর তিনি দেখছিলেন রাজধানী দিল্লিকে।
গত শুক্রবার মোদির সাক্ষাৎকারের ২ ঘণ্টার ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। সকালে এই সাক্ষাৎকারেরই মিনিট দুয়েকের একটি ‘প্রোমো’ প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে তাকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘ভগবান নই, আমি মানুষই’। যা ইতোমধ্যে চর্চার কেন্দ্রে। ওই সাক্ষাৎকারেই তাকে তিনবারের প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। মোদি বলেছেন, ‘প্রথমবার তো আমাকে সবাই বোঝার চেষ্টা করছিল। আমি দিল্লিকে বোঝার চেষ্টা করছিলাম। দ্বিতীয়বার অতীতের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি বিচার-বিবেচনা করার চেষ্টা করতাম। অতীতের দৃষ্টিভঙ্গি কাজে লাগাতাম। কিন্তু তৃতীয়বারে আমার ভাবনা বদলে গেছে। এখন আমার মনোবল আরও জোরদার এবং স্বপ্নগুলোর পরিধিও বেড়ে গেছে।’
২০৪৭ সালের মধ্যে দেশের সব সমস্যার সমাধান করে ‘বিকশিত ভারত’ গড়ে তুলতে চান মোদি। তার কথায়, ‘সরকারি প্রকল্পের ১০০ শতাংশ পরিষেবা নিশ্চিত করতে হবে। এটাই আসল সামাজিক ন্যায় এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। এর চালিকাশক্তি এআই; অ্যাসপিরেশনাল ইন্ডিয়া (উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভারত)।
‘তুই’ বলার কেউ নেই
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাকে আর ‘তুই’ বলে ডাকার কেউ নেই, উপলব্ধি মোদির। সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই ‘বন্ধু’ হারিয়েছেন তিনি। তার কথায়, ‘মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর আমি ছোটবেলার অনেক বন্ধুকে ফোন করেছিলাম। কিন্তু ওরা সবাই আমাকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখছিল। আমাকে তুই বলে ডাকার মতো আর কেউ নেই।’
কাপড়ও কেচেছি
২ ঘণ্টার সাক্ষাৎকারে জীবনের অনেক গল্প বলেছেন মোদি। ছোটবেলার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় আমি কাপড় কাচতাম। বাড়ির সবার জামাকাপড় আমাকেই কাচতে হতো। তার জন্য আমি পুকুরেও যেতাম।’
চীনা দূতাবাসে চিঠি
একবার চীনা দূতাবাসে চিঠিও লিখেছিলেন মোদি। তার কথায়, ‘আমি বড়নগরে থাকতাম। কোথাও পড়েছি, এখানে চিনা পর্যটক হিউয়েন সাং এসেছিলেন। তার ভ্রমণকাহিনি নিয়ে একটি ছবি তৈরি করা হচ্ছিল। আমি চীনা দূতাবাসে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলাম, তাদের ছবিতে যেন আমাদের এই গ্রামকে ভালো করে দেখানো হয়।’ পরে ২০১৪ সালে মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ফোন করে তার কাছে গুজরাটের ওই গ্রাম ঘুরে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা
গোধরাকাণ্ডের পরবর্তী সময়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মোদি বলেন, ‘২০০২ সালে গুজরাটে ভোট ছিল। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। মনে আছে, আমি সবাইকে বলে রেখেছিলাম, দুপুর ১২টার আগে আমাকে ভোটের ফলাফলের কোনো তথ্য না দিতে। পরে জানতে পারলাম, দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে আমি এগিয়ে আছি। আমার ভেতরে তখন অনেক কিছু হচ্ছিল। কিন্তু সেসবে আমি পাত্তা দিইনি। নিজেকে সংযত রেখেছিলাম।’
সাধারণ ছাত্র
স্কুলে সাধারণ ছাত্র ছিলেন মোদি। বলেন, ‘আমি তেমন চোখে পড়ার মতো কিছু করিনি স্কুলে। ভেলজিভাই চৌগবি নামের আমাদের এক শিক্ষক ছিলেন। তিনি আমাকে অনেক উৎসাহ দিতেন। আমার বাবাকে বলেওছিলেন আমার প্রতিভার কথা। পরীক্ষায় কখনো মনোযোগ দিতাম না আমি।’
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটিই তার প্রথম পডকাস্ট সাক্ষাৎকার, মেনে নিয়েছেন মোদি। বলেছেন, ‘জানি না, সাধারণ মানুষ এই সাক্ষাৎকারকে কেমনভাবে নেবে। আমি আগে কখনো এমন কিছু করিনি।’ ইতোমধ্যে ২ ঘণ্টার ভিডিওটি সাড়া ফেলে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর জীবনের অজানা গল্প জানতে অনেকেই সেই সাক্ষাৎকার শুনে ফেলেছেন।
কার মধ্যে তিনি ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখেন। আগামী ২০-৩০ বছর পর কারা রাজনীতির মুখ হয়ে উঠতে পারেন। একটি সাক্ষাৎকারে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি জানিয়েছেন, রাজনীতিতে দল গঠনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনই সেই কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন তিনি। এখনো সেই কাজ করে যাচ্ছেন।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় মুখ হিসেবে কারও নাম করতে চাননি মোদি। তিনি বলেন, ‘অনেকের মধ্যেই সম্ভাবনা রয়েছে। আমি কীভাবে আমার দলকে তৈরি করছি, তার ওপরই আমার সাফল্য নির্ভর করে। সবাই একটি লক্ষ্য ধরে এগিয়ে চলেন। পরিশ্রম করেন। আমি আলাদা করে কারও নাম নেব না। তাহলে অন্যদের প্রতি অবিচার করা হবে। আমার সামনে অনেক সম্ভাবনাময় মুখ রয়েছে। আমি সবার কথাই জানি। কিন্তু কারও সঙ্গে যাতে অবিচার না হয়, সেটা দেখার দায়িত্বও আমার।’
সাফল্যের চাবিকাঠি
রাজনীতিতে সাফল্যের চাবিকাঠি কী। সাক্ষাৎকারে মোদি বলেছেন, ‘রাজনীতিবিদ হওয়া এক জিনিস, কিন্তু রাজনীতিতে সফল হওয়া আর এক। তার জন্য সমর্পণ, একাগ্রতা, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা দরকার। দলের সঙ্গে মানিয়ে চলার মতো খেলোয়াড় হতে হবে। যদি আপনি নিজেকে সবার চেয়ে বড় বলে মনে করেন, ভাবেন বাকিরা আপনাকেই অনুসরণ করবেন, তা হলে আপনি হয়তো ভোটে জিততে পারবেন। কিন্তু রাজনীতিতে আপনার সাফল্যের কোনো নিশ্চয়তা নেই।’
উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়, লক্ষ্য
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়েই মোদি বলেন, ‘আমাদের সব নেতাকে দেখুন, সবাই আলাদা আন্দোলন থেকে উঠে এসেছেন। তাদের ভাবনার পদ্ধতি, অভিজ্ঞতা সব আলাদা। তাদের কথা এবং ব্যবহার থেকেই বোঝা যায়, সমাজের প্রতি তারা কতটা দায়বদ্ধ। তাই আমি মনে করি, ভালো মানুষদের আরও বেশি করে রাজনীতিতে আসা দরকার। কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে নয়, লক্ষ্য নিয়ে।’
গোধরা পর্ব
গুজরাটে রাজনীতি এবং গোধরাকাণ্ডের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মোদি বলেন, ‘২০০২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি আমি প্রথমবার বিধায়ক হয়েছিলাম। গোধরায় যখন ওই ঘটনা ঘটেছিল, বিধায়ক হিসেবে আমার বয়স মাত্র তিন দিন। প্রথমে আমরা ট্রেনে আগুনের খবর পাই। তার পর একে একে মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। খুব চিন্তা হচ্ছিল। গোধরা যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হেলিকপ্টার একটাই ছিল। সিঙ্গল ইঞ্জিন কপ্টার হওয়ায় আমাকে তাতে উঠতে দেওয়া হচ্ছিল না। আমি ওদের সঙ্গে ঝগড়া করে ঝুঁকি নিয়ে গোধরা গেলাম। এত মৃতদেহ, এত বেদনার সব দৃশ্য। আমার নানা রকম অনুভূতি হচ্ছিল। কিন্তু নিজেকে বোঝাচ্ছিলাম, আমি এমন একটা জায়গায় আছি যেখানে আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। স্বাভাবিক প্রবণতাকে দমন করতে হবে।’
গান্ধী এবং সাভারকর
মহাত্মা গান্ধী এবং বিনায়ক দামোদর সাভারকরের পথ আলাদা ছিল, কিন্তু তাদের লক্ষ্য, আদর্শ ছিল একটাই। মোদি বলেন, ‘আদর্শের চেয়ে আদর্শবাদ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আদর্শ ছাড়া রাজনীতি হয় না। কিন্তু আদর্শবাদও জরুরি। স্বাধীনতার আগে সবার আদর্শ ছিল দেশকে স্বাধীন করে তোলা। গান্ধী এবং সাভারকরের পথ আলাদা ছিল, কিন্তু তাদের আদর্শ ছিল এক।’ নিজের আদর্শ প্রসঙ্গে মোদি বলেন, আমি সব সময় দেশকে প্রথমে রাখি। সুবিধা অনুযায়ী নিজের অবস্থান বদল করব, তেমন মানুষ নই। আমার আদর্শ ‘নেশন ফার্স্ট’ (আগে আমার দেশ)। এই আদর্শই আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। আমার জীবন আমি তৈরি করিনি। পরিস্থিতি আমাকে তৈরি করেছে। ছোটবেলায় আমি যে জীবন কাটিয়েছি, তা থেকে অনেক শিক্ষা পেয়েছি।
ভারত নিরপেক্ষ নয়
ভারত নিরপেক্ষ নয়। বিশ্বের সব রাষ্ট্র ভারতকে ভরসা করে। বিদেশনীতি প্রসঙ্গে মোদি বলেন, ‘সারা বিশ্ব ভারতকে ভরসা করে। কারণ, আমাদের মধ্যে নকল কিছু নেই। আমরা যা বলি, স্পষ্ট করেই বলি। অনেক কঠিন পরিস্থিতিতেও আমরা বারবার বলেছি, আমরা নিরপেক্ষ নই। আমরা শান্তির পক্ষে। তার জন্য যা প্রয়োজন, আমি করব। আমি এটা রাশিয়া, ইউক্রেন, ইরান, প্যালেস্টাইন, ইসরায়েল সবাইকে বলেছি। তারা আমাকে বিশ্বাস করে।’
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক