
স্বাস্থ্যক্ষেত্রের দুর্নীতি যত দিন না বন্ধ হচ্ছে, তত দিন। আমাদের লড়াই থামবে না। আমার মেয়ে ওই দুর্নীতির প্রতিবাদ করে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিল বলেই মনে করছি। কিন্তু সেটা তদন্তকারীরা বুঝছেন না। তার দাবি, তাদের মেয়ের ঘটনা দেখিয়ে দিল, শুধু মেধা নয়, বাবা-মাকে প্রভাবশালীও হতে হয়। নির্যাতিতার পরিজনদের দাবি, ‘সঞ্জয় একা এই কাজ করেনি, সেটা সবাই জানেন। তদন্তে একাধিক প্রশ্ন থাকলেও তার উত্তর মিলছে না। যা থেকেই স্পষ্ট, প্রকৃত সত্যকে আড়ালের চেষ্টা চলছে।’...
আর জি করের রায়ে খুশি নন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি চেয়েছিলেন আসামি সঞ্জয় রাইয়ের ফাঁসি দিয়ে আদালত যেন ল্যাঠা চুকিয়ে দেয়। তা হলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রায় আত্মীয়সম অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সাবেক অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ও অন্য ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত থমকে যাবে। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যে বিপুল দুর্নীতির বিষয়টি সামনে চলে আসছে, তাও বন্ধ করা সম্ভব হবে। কিন্তু মমতার সেই আশায় ছাই ঢেলে দিয়েছেন বিচারক অনির্বাণ দাস।
দোষীর শাস্তিতে নিজের মতো জানাতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জয়নগর, ফরাক্কা এবং ওড়াপের ধর্ষণ ও খুনের রায়ের উদাহরণ টেনে আনেন মমতা। ওই তিনটি মামলার তদন্ত করেছিল পুলিশ। তাদের দেওয়া চার্জশিটের ভিত্তিতে নিম্ন আদালত সব কটি মামলায় ফাঁসির সাজা শুনিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘তিনটি কেসেই আমরা ফাঁসির সাজা করিয়ে দিয়েছি। এটা (আর জি কর মামলা) সিরিয়াস কেস।’ আদালতে সিবিআইয়ের আইনজীবীদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘আমাদের হাতে এই মামলা থাকলে অনেক আগেই ফাঁসির রায় করিয়ে দিতে পারতাম। আমি জানি না, কীভাবে লড়াই করেছে, কী যুক্তি দিয়েছে।
সবটাই সিবিআই করেছে। আমাদের হাত থেকে মামলাটা ইচ্ছা করে কেড়ে নিয়ে চলে গেল। আই অ্যাম নট স্যাটিসফাইড (আমি সন্তুষ্ট নই)।’ পরে মমতা জানিয়ে দেন, সঞ্জয়ের ফাঁসির আবেদন জানিয়ে রাজ্য সরকার হাইকোর্টে মামলা করবে। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন আর জি কর-কাণ্ডে দোষীর শাস্তিতে তিনি সন্তুষ্ট নন। শাসক দলের তরফে বিবৃতি দিয়ে কুনাল ঘোষও সে কথা জানান। তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুনাল বলেন, ‘আমরা ফাঁসি চেয়েছিলাম। সাম্প্রতিক সময়ে গুড়াপ, ফরাক্কা, জয়নগরের ঘটনায় রাজ্য পুলিশ তদন্ত করেছিল। সেগুলোর সব কটিতে ফাঁসির সাজা হয়েছে। সিবিআই কেন পারল না, তার ব্যাখ্যা তারাই দিতে পারবে। কলকাতা পুলিশের হাতে তদন্তভার থাকলে এত দিনে ফাঁসির রায় হয়ে যেত।’
সঞ্জয়ের মৃত্যুদণ্ড চেয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা তথা বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী। তিনি বলেন, ‘সমাজ, পরিবার কেউ খুশি নয় এই রায়ে। আমিও ব্যক্তিগতভাবে খুশি নই। এসব লোককে ক্ষুধার্ত নেকড়ের সামনে ছেড়ে দেওয়া উচিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিচারক তার ক্ষমতার বলে রায় দিয়েছেন। আমি সেটা চ্যালেঞ্জ করছি না। তবে সিবিআই সঞ্জয়ের সঙ্গে আরও কয়েকজনকে যুক্ত করেছে।’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদারও দোষীর সর্বোচ্চ শাস্তির পক্ষে। তিনি চান, নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হোক সিবিআই। একই সঙ্গে পুলিশ তথ্যপ্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
সিপিআই (এম)-এর রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের কটাক্ষ, আর জি কর-কাণ্ডের শুরু থেকে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তদন্তে তার প্রতিফলন মেলেনি। তার কথায়, ‘আসলে গোড়াতেই তথ্যপ্রমাণ লোপাট করে অন্য দিকে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রথমে এফআইআর হয়েছিল, তার পর সিবিআই তদন্তটা এমনভাবে করেছে যে, আদালত এটাকে বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনা বলে মান্যতা দেয়নি।’
রায়দান হয়েছে ঘটনার ১৬২ দিনের মাথায়। আর জি করে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় শাস্তি ঘোষণা হলো ১৬৪তম দিনে। আদালতের কাছে চিকিৎসক পড়ুয়ার ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ ঘটনা নয়। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪.৬৬ এবং ১০৩২১৮ কলকাতা পুলিশের সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় যোষ দোষী সাব্যস্ত হলেও তাকে সর্বোচ্চ সাজা দেয়নি শিয়ালদহ আদালত। বিচারক অনিবাধন নির্দেশ দেন যাবজ্জীবন (আনুতা) কারাদণ্ডের। সেই সঙ্গে মোট ১ লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও পাঁচ মাসের কারাদণ্ড। ডিউটি থাকা চিকিৎসকের ধর্ষণ এবং খুনের জন্য রাজ্য সরকারকে ১৭ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়েছে। যদিও ক্ষতিপূরণের অর্থ তারা চান না বলে এজলাসে জানিয়েছেন মৃতের বাবা।
অপরাধীর শাস্তির নির্দেশ শুনে খুশি নয় নির্যাতিতার পরিবার। চিকিৎসক থেকে রাজনৈতিক মহল, বেশির ভাগ অংশের সাধারণ প্রতিক্রিয়া তারা আশা করেছিলেন অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু আর জি কর-কাণ্ডকে বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনা মনে করছে না আদালত। আইনজীবীরা বিচারক অনির্বাণ দাসের মন্তব্য শুনে রীতিমতো স্তম্ভিত। তারা বলছেন, হাসপাতালের ভেতর একজন চিকিৎসক ধর্ষিত ও খুন হয়ে গেলেন, এর চেয়ে বিরলতম অপরাধ আর কী হতে পারে। শুধু তাই নয়, যার নিরাপত্তা দেওয়ার কথা ছিল, সেই সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয়ই খুনি ও ধর্ষক এটাও কি বিরলতম ঘটনা নয়।
সোমবার শাস্তি ঘোষণার গেড়ো থেকে সিবিআই সঞ্জয়ের মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে সওয়াল করেছে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তরফে আইনজীবী সওয়াল করেন বিরলের মধ্যে বিরলতম অপরাধ এটি। বলা হয়, গত ৮ আগস্ট রাতে ওই চিকিৎসক ডিউটিতে ছিলেন। তার ধর্ষণ এবং হত্যায় কেবল শুধু পরিবার একজন সদস্যকে নয়, এক চিকিৎসককে সমাজ হারিয়েছে। যে নির্মমতার সঙ্গে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তা পুরো সমাজকে নাড়িয়ে। তাই বার্তা দিতে অপরাধীকে কঠিন এবং সর্বোচ্চ সাজা দিক আদালত। সিবিআইয়ের এক আইনজীবী আদালতে বলেন, যাদের কন্যাসন্তান বাইরে কাজে যাচ্ছেন বা অন্য কোনো কারণে বাইরে যাচ্ছেন, এ ঘটনা সেসব কন্যাসন্তানের মা-বাবাকে ভাবিয়ে তুলেছে। তিনটির মধ্যে দুটি অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে। কঠিন শাস্তির প্রার্থনা করছি আমরা। সমাজে বার্তা দেওয়ার জন্য দোষীর সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত। নির্যাতিতার আইনজীবী দোষীর সর্বোচ্চ শাস্তির পক্ষে সওয়াল করে বলেন, ‘একজন সিভিক ভলান্টিয়ার, হাসপাতাল যাকে বিশ্বাস করে প্রবেশ (হাসপাতালের মধ্যে) করতে দিয়েছিল, সেখানে তিনি এই কাজ করেছেন। পুরো বিষয়টি তিনি জানতেন।’
আর জি কর-কাণ্ডের পর থেকে চিকিৎসকদের আন্দোলনে অন্যতম মুখ ছিলেন কিঞ্জল নন্দ। সঞ্জয়ের শাস্তি যোষণার অব্যবহিত পরে তিনি ফেসবুকে লেখেন, ‘হতাশ লাগছে তো। লাগুক, হতাশ হওয়া দরকার, কারণ সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই।’ আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা আবার পথে নামার ডাক দিয়েছেন। তাদের দাবি, এখনো সব অপরাধী ধরা পড়েনি। ন্যায়বিচার পাওয়া পর্যন্ত তাদের লড়াই চলবে।
তাদের মেয়ের খুন ও ধর্ষণের ঘটনার তদন্তে অসংখ্য প্রশ্ন ও ধোঁয়াশা থাকলেও তা কাটাতে পারেনি সিবিআই। সিবিআইয়ের সেটিংই শেষ পর্যন্ত সঞ্জয়কে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল। আদালতে অপরাধগুলো ঠিকমতো প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। অথবা ইচ্ছাকৃতভাবেই বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের বিষয়টি চেপে গিয়ে অপরাধকে লঘু করে দেখানো হয়েছে। সেই কারণে আর জি কর মামলাকে বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনা বলে বিচারক মনে করেননি; এমনই অভিযোগ করলেন নির্যাতিতার বাবা-মা। মা বললেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে কর্তব্যরত অবস্থায় আমাদের মেয়ের এমন পরিণতি। যা বিশ্বে বিরলতম ঘটনা বলেই মনে করি। কিন্তু সিবিআই সঠিকভাবে সবকিছু প্রমাণ করতে পারল না। তাই বিচারক এমন মন্তব্য করলেন।’ তবে বিচারক তাদের কষ্ট ও যন্ত্রণাকে সঠিকভাবে মর্যাদা দিয়েছেন বলে এদিন জানান নির্যাতিতার পরিজনরা। তরুণী চিকিৎসক পড়ুয়ার বাবা বলেন, ‘আইনি লড়াই আরও জোরদারভাবে শুরু হলো। পরবর্তী ধাপগুলোতে পৌঁছানোর জন্য বিচারক সহযোগিতা করবেন বলেই আশা রাখছি।’
এদিন আর জি কর মামলায় সঞ্জয় রায়কে আমৃত্যু কারাবাসের সাজা দিয়েছে শিয়ালদহ আদালত। এই সিভিক ভলান্টিয়ারকে ফাঁসি বা আমৃত্যু কারাবাস, যা-ই সাজা দেওয়া হোক না কেন, তাতে তাদের সন্তুষ্ট কিংবা অসন্তুষ্ট হওয়ার কোনো ব্যাপার নেই বলে আগেই দাবি করেন নির্যাতিতার বাবা-মা। এদিন বাড়ি থেকে আদালতের জন্য বেরোনোর সময়ে তারা বলেছিলেন, ‘একমাত্র মেয়ে যেদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, সেদিনই সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। এখন আমাদের বেঁচে থাকতে হবে লড়াইয়ের পথে থেকে। কারণ সঞ্জয় একা নয়, আরও যারা এই ঘটনায় জড়িত, তাদের সবাইকে সামনে এনে কঠোরতম শাস্তির দাবিতে আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’
এদিন বিকেলে আদালত থেকে বেরোনোর সময়ে নির্যাতিতার মা বলেন, ‘স্বাস্থ্যক্ষেত্রের দুর্নীতি যত দিন না বন্ধ হচ্ছে, তত দিন। আমাদের লড়াই থামবে না। আমার মেয়ে ওই দুর্নীতির প্রতিবাদ করে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিল বলেই মনে করছি। কিন্তু সেটা তদন্তকারীরা বুঝছেন না।’ তার দাবি, তাদের মেয়ের ঘটনা দেখিয়ে দিল, শুধু মেধা নয়, বাবা-মাকে প্রভাবশালীও হতে হয়। নির্যাতিতার পরিজনদের দাবি, ‘সঞ্জয় একা এই কাজ করেনি, সেটা সবাই জানেন। তদন্তে একাধিক প্রশ্ন থাকলেও তার উত্তর মিলছে না। যা থেকেই স্পষ্ট, প্রকৃত সত্যকে আড়ালের চেষ্টা চলছে।’
আর জি করের ঘটনার নেপথ্যের কারণ কী, কারা ওই বৃহত্তর ষড়যন্ত্রে জড়িত; সেসব সামনে এনে সব অভিযুক্তের কঠিন শাস্তির দাবিতে এদিন শিয়ালদহ আদালতের বাইরে উপস্থিত হয়েছিলেন বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠন, নার্সেস ইউনিটি ও অভয়া মঞ্চের সদস্যরা। জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্টের সদস্য আশফাকউল্লা নাইয়া বলেন, ‘এই রকম শাস্তি সমাজে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে পারে না। ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনো উদাহরণ তৈরি হলো না বলেই আমার ব্যক্তিগত মত। প্রান্তিক স্তরের নির্যাতিতারা কোথায় যাবেন। শুধু সঞ্জয় নয়, ঘটনায় যুক্ত অন্যদেরও সামনে আনার দাবি জানাচ্ছি আমরা।’
‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অব ডক্টরস’-এর সদস্য পুণ্যব্রত গুণ বলেন, ‘প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতে প্রথম থেকেই পুলিশ প্রশাসনের যে প্রচেষ্টা, তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ও বিচার ব্যবস্থাও হয়তো মুক্ত হয়ে গেছে।’ আবার ‘মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার’-এর রাজ্য সম্পাদক বিপ্লব চন্দ্রের অভিযোগ, ‘ইতোমধ্যে সিবিআই আর জি করের ঘটনাকে বিরলতম বলে সুপ্রিম কোর্টে রিপোর্ট পেশ করেছে এবং বিচারপতিরাও তা দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। আজ সেটা বিরলতম নয় বলে অপরাধীর সর্বোচ্চ সায়া হলো না।’
সুটিয়ার বাসিন্দা, নিহত বরুণ বিশ্বাসের দিদি প্রমীলা রায় বিশ্বাস এদিন আদালতের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন। তার কথায়, ‘একজনকে সাজা দিয়ে সব শেষ করার প্রচেষ্টার নেপথ্যে কেন্দ্র ও রাজ্যের আঁতাত সবাই বুঝতে পারছে।’ চিকিৎসক তমোনাশ চৌধুরী উল্লেখ করেন, প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া না গেলে তদন্ত ও বিচারব্যবস্থার ওপরে মানুষের ভরসা কমতে পারে। নির্যাতিতার বাবাও বলেন, ‘ন্যায়বিচারের লড়াইয়ের শেষ নয়। বরং দ্বিতীয় ধাপে পা রাখলাম।’
আর জি করে নারী চিকিৎসক গড়ুয়াকে ধর্ষণ-খুনের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে সঞ্জয় রায়কে আজীবন কারাবাসের নির্দেশ দিয়েছেন শিয়ালদহ আদালত। তবে শুধু সঞ্জয়ের শাস্তি ঘোষণাই নয়, আর জি কর-কাণ্ডে পুলিশ এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নিয়েও বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ রায়ের নির্দেশনামায় লিপিবদ্ধ করেছেন বিচারক অনির্বাণ দাস। পুলিশি তদন্তে কোথায় কোথায় খামতি থেকে গেছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভূমিকায় কোথায় গাফিলতি রয়েছে, তাও উল্লেখ করেছেন বিচারক এই গাফিলতি যে ইচ্ছাকৃত তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। সন্দীপ ঘোষসহ স্বাস্থ্য দপ্তরের বহু রথীমহারথীকে আড়াল করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ১ আগস্ট যে ভূমিকা নিয়েছিল তা যথাসম্ভব রায়ে উল্লেখ করেছেন বিচারক। এতে পরিষ্কার যে সিবিআই যেভাবে মামলা মাড়িয়েছে তাতে তিনি মোটেই খুশি নন। স্পষ্ট ভাষায় সিবিআইয়ের সেটিংয়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ না করলেও কীভাবে তথ্যপ্রমাণ লোপাট করার চেষ্টা করা হয়েছে, তা বিচারকের রায়ে স্পষ্ট হয়েছে।
রায়ের নির্দেশনামায় বিচারক দাস জানিয়েছেন, ঘটনার এফআইআর করার সময়েই পুলিশের দিক থেকে বেশ কিছু খামতি থেকে গেছে। নিয়মের বাইরে গিয়ে কাজ করেছেন টালা থানার এসআই সুব্রত চট্টোপাধ্যায়। লালবাজারের তৎকালীন উইমেন্স বিস্ময়াদ সেলের অতিরিক্ত ওসি রূপালী মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকারও সমালোচনা করেছেন বিচারক। সমালোচনা করেছেন হাসপাতাল অজিতের ভূমিকারও। নারী চিকিৎসককে যৌন হেনস্তা এবং তাকে খুন করা হয়েছে, দেহ উদ্ধারের পর এমন মত উঠে আসা সত্ত্বেও কেন হাসপাতালের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ দেহ মর্গে পাঠানোর কথা বলেছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বিষয়টি কেন সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানানো হয়নি, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিচারক।
বিচারক জানিয়েছেন, তথ্যপ্রমাণ বলছে, ঘটনার দিন অর্থাৎ গত ১ আগস্ট এসআই সুব্রত কাজে যোগ দিয়েছিলেন বেলা ৩টায়। এর পরেই এসআই চিন্ময় বিশ্বাসের ফোন আসে তার কাছে। এসআই চিন্ময় তাকে আর জি করের ঘটনার কথা জানান। এর পরেই তিনি আর জি কর হাসপাতালে যান। পরে রাতে টালা থানায় ফিরে এসে তিনি জানতে পারেন, নির্যাতিতার বাবা থানায় অভিযোগ করেছেন। তার পরেই এফআইআর করা হয়। তখন রাত ১১টা ৪৫ মিনিট। কিন্তু সেই নথিতে সময় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল সকাল ১০টা ১০ মিনিট। যখন তিনি নিজে থানাতেই উপস্থিত ছিলেন না। এসআই নিজেই যে সে কথা জানিয়েছিলেন, তাও রায়ের নির্দেশনামায় উল্লেখ করেছেন বিচারক। এসআইয়ের এমন কাজকে ‘অবৈধ’ বলে বর্ণনা করেছেন তিনি। নির্দেশনামায় লেখা হয়েছে, ‘কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যেভাবে নিজের অবৈধ কাজকর্মের কথা উল্লেখ করেছিলেন এসআই, তা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়।’ অভিযোগ করার জন্য কেন নির্যাতিতার পরিবারকে ৯ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়ে রাখা হয়েছিল, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিচারক।
বিচারক জানিয়েছেন, ঘটনার দিন অর্থাৎ ১ আগস্ট অভিযুক্তের ফোন নিয়ে টালা থানায় রেখে দেওয়া হয়েছিল। লালবাজারের তৎকালীন উইমেন্স গ্রিভ্যান্স সেলের অতিরিক্ত ওসি রূপালী সেই কাজটি করেছিলেন। কিন্তু তিনি কেন সেই কাজটি করেছিলেন, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বিচারক। তিনি জানিয়েছেন, তথ্যপ্রমাণ থেকে এটা প্রমাণিত হয়নি যে, ফোনে কোনো কারসাজি করা হয়েছিল। তবে রূপালী যে যুক্তি দিয়েছিলেন, তা খুবই দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন বিচারক। নির্দেশনামায় লেখা হয়েছে, রূপালী জানিয়েছিলেন, মোবাইল ফোনটি অভিযুক্তকে ফেরত দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে গ্রেপ্তারের সময় বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল সেটি। কলকাতা পুলিশ অভিযুক্তকে আটক করার পরেও কেন সেই কাজ করেছিলেন রূপালী, তা তার বোধগম্য হয়নি বলেই জানিয়েছেন বিচারক।
বিচারক জানিয়েছেন, দেহ উদ্ধারের পর সিনিয়র চিকিৎসক সুমিত রায় তপাদারই প্রথম ব্যক্তি, যিনি মনে করেছিলেন, নারী চিকিৎসককে যৌন হেনস্তা এবং তাকে খুন করা হয়েছে। তিনিই এক নার্সকে পুলিশে খবর দেওয়ার জন্য বলেছিলেন, যাতে ঘটনাস্থল ঘিরে ফেলা হয়। এর পরেই তিনি বিষয়টি হাসপাতালের বক্ষরোগ বিভাগের প্রধানকে জানান। বক্ষরোগ বিভাগের প্রধানই সুমিতকে বলেছিলেন হাসপাতালের তৎকালীন সুপার সঞ্জয় বশিষ্ঠ এবং অধ্যক্ষ সন্দীপকে বিষয়টি জানাতে। সেই মতো সুমিত তাদের ফোন করেছিলেন। কিন্তু তারা ফোন তোলেননি। পরে সন্দীপ তাকে ফোন করেন। সন্দীপই সেই সময় দেহ মর্গের পাঠানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু সন্দীপের সেই নির্দেশ তিনি পালন করেননি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেন সেই সময় পুলিশকে বিষয়টি জানায়নি, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিচারক। নির্দেশনামায় লেখা হয়েছে, ‘এটা বাস্তব যে ময়নাতদন্ত না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুর কারণ বলা সম্ভব নয়। কিন্তু চিকিৎসক হওয়া সত্ত্বেও ওই মৃত্যুকে কেন অস্বাভাবিক মৃত্যু হিসাবে বিবেচনা করে পুলিশকে বিষয়টি জানালেন না তারা?’
বিচারক জানিয়েছেন, সাক্ষীদের বয়ান অনুযায়ী সেদিন হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন সহকারী সুপার (নন-মেডিকেল) সুচরিতা। তিনিই নির্যাতিতার পরিবারকে ফোন করে জানিয়েছিলেন যে, তাদের মেয়ের শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। নির্যাতিতার মা-বাবাকে শিগগিরই আর জি কর হাসপাতালে আসার জন্য বলেছিলেন সুচরিতা। তথ্যপ্রমাণ থেকে দেখা গেছে, ওই কথোপকথনের পর নির্যাতিতার বাবা ফের সুচরিতাকে ফোন করেছিলেন। সেই সময় সুচরিতা তাকে জানিয়েছিলেন, তার মেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। সুমিতের সামনেই সেই ঘটনা ঘটেছিল। সুমিত তার প্রতিবাদও করেছিলেন। এমনকি সুচরিতাকে প্রশ্নও করেছিলেন, কেন আত্মহত্যার কথা বললেন পরিবারকে?
বিচারক জানিয়েছেন, নারী চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হওয়ার পর একটি বৈঠক ডেকেছিলেন সন্দীপ। সেই বৈঠকে সুমিতকেও ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বৈঠকে ঢুকতে পারেননি। ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সুমিত জানিয়েছেন, হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগ মিলিয়ে মোট সাতজন ছিলেন বৈঠকে।
সেখানে প্রত্যেকের বয়ান নথিবদ্ধ হয়েছিল। পুলিশ বা সিবিআই কেন সেই রিপোর্ট সংগ্রহ করল না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিচারক। বিচারক জানিয়েছেন, বিচার পর্বের সময়েও তা আদালতে জমা করা হয়নি। সেই রিপোর্ট কি মামলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারত? বিচারক অবশ্য মনে করেন, এতে মামলার বিচারে কোনো ক্ষতি হয়নি।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক