
ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রের হাল বর্তমানে ভয়াবহ বললেও কম বলা হয়। অথচ একটা সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগৎজোড়া প্রতিপত্তি ছিল। শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার ও নেপালের শিক্ষাব্যবস্থাও নিয়ন্ত্রিত হতো
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেই উচ্চতা থেকে আজকের এই অধঃপতনের পেছনে রয়েছে এক পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।
একে তো নিয়োগ নিয়ে কেলেঙ্কারির কোনো শেষ নেই। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে যে দুর্নীতি হয়েছে, তার জেরে স্কুলের পঠনপাঠন ধ্বংস। টাকা না দিলে নিয়োগ হবে না- এই পরম্পরার জেরে স্কুল সার্ভিস কমিশন প্রায় উঠে যাওয়ার জোগাড়। গত ১৩ বছরে দুবার মাত্র স্কুল সার্ভিস কমিশন পরীক্ষা হয়েছে। টেট পরীক্ষা বা প্রাথমিকে নিয়োগ পরীক্ষাও নানা মামলা-মোকদ্দমার কারণে দীর্ঘদিন আটকে ছিল। সদ্য পরীক্ষা নেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের বহু স্কুল চলছে মাত্র একজন বা দুজন শিক্ষক নিয়ে। সম্প্রতি একটি ভাইরাল ভিডিওয় দেখা গেছে, উত্তরবঙ্গের একটি গ্রামীণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কয়েক বছর আগেও ৪০০ ছাত্রছাত্রী পড়ত। এ বছর সেই সংখ্যাটা নেমে এসেছে মাত্র ৯৭-এ। ২৩ জানুয়ারির অনুষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন, চতুর্থ শ্রেণিতে মাত্র ২৭ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। তারা চলে গেলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা আরও কমে যাবে। কারণ, প্রথম শ্রেণিতে কেউ ভর্তি হচ্ছে না। গ্রামবাসীর কাছে আকুতি করে সেই প্রধান শিক্ষক বলছেন, দয়া করে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠান। ভাবলেশহীন মুখে মা-বাবারা কথা শুনছেন। এটা শুধু যে একটি এলাকার চিত্র, তাই নয়। গোটা রাজ্যেই পড়াশোনার প্রতি অনীহা তৈরি হয়েছে। স্কুলগুলোর অবনমন তো আছেই, সেই সঙ্গে সহজে রোজগারের নানারকম ধান্দা বেরিয়ে গেছে। বাবা-মায়েররা সেই সব কাজে বাচ্চাদের লাগিয়ে দিচ্ছেন। কখনো বা ভিন রাজ্যে কাজে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ঠিক না থাকা, নানা কারণে ছুটি দেওয়া এবং দীর্ঘদিন শিক্ষক নিয়োগ না হওয়ায় পঠনপাঠনের ক্ষতি হচ্ছে বলে শিক্ষকদের একাংশ বারবার অভিযোগ করেছেন। তাদের সেই বক্তব্যই একটি বেসরকারি সংস্থার শিক্ষা রিপোর্টে প্রতিফলিত হয়েছে। সেই রিপোর্ট বলছে, এ রাজ্যে এখনো চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া ৫ দশমিক ২ শতাংশ পড়ুয়ার বাংলা অক্ষরজ্ঞান পর্যন্ত নেই। ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ পড়ুয়া অক্ষর পড়তে পারলেও শব্দ পড়তে পারে না।
অঙ্কের অবস্থাও তথৈবচ। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া ৪ দশমিক ৪ শতাংশ পড়ুয়া ১ থেকে ৯ পর্যন্ত সংখ্যা চেনে না। প্রথম শ্রেণির ক্ষেত্রে যা ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। রিপোর্টে উঠে এসেছে, ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে সরকারি স্কুলেই ভরসা রাখছেন অধিকাংশ অভিভাবক। সেখানে বেসরকারি স্কুল অনেকটাই পিছিয়ে। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘অ্যানুয়াল স্টাটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট, রুরাল’ (এএসইআর)। বহু বছর ধরে ওই সংস্থা শিক্ষার এই সমীক্ষা করছে। দেশজুড়ে ১৯টি ভাষায় প্রাথমিক এবং উচ্চ-প্রাথমিকের গ্রামীণ এলাকার পড়ুয়াদের (৫ থেকে ১৬ বছর) নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছে তারা। সরকারি ও বেসরকারি স্কুলের পড়ুয়াদের নিয়ে এই সমীক্ষা হয়েছে। শিক্ষার মান থেকে শুরু করে স্কুলের পরিকাঠামো কেমন, কী কী সুবিধা রয়েছে, সবই সমীক্ষায় উঠে এসেছে।
রিপোর্ট দেখে শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, সরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে ২০২২ সালে তৃতীয় শ্রেণির মাত্র ৩২ দশমিক ৬ শতাংশ পড়ুয়া দ্বিতীয় শ্রেণির কোনো পাঠ্যবই পড়তে পারত। ২০২৪ সালে দেখা যাচ্ছে, ৩৪ শতাংশ তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়া দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের নির্বাচিত অংশ পড়তে পারে। ২০২২ সালে তৃতীয় শ্রেণির মাত্র ৩২ দশমিক ৪ শতাংশ পড়ুয়া বিয়োগ অঙ্ক করতে পারত। ২০২৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। পঞ্চম শ্রেণির মাত্র ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ এবং অষ্টম শ্রেণির ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ পড়ুয়া ভাগ অঙ্ক করতে পারে। শিক্ষকদের একাংশ জানাচ্ছেন, ২০২২ সালে সমীক্ষার আগের বছরগুলোতে করোনার জন্য স্কুল বন্ধ ছিল। তখন যুক্তি ছিল, করোনার জন্য স্কুল বন্ধ থাকায় পড়াশোনার মান পড়েছে। কিন্তু স্কুল খুলে গেছে দুই বছর হয়ে গেল। এখনো ছবিটা আশাব্যঞ্জক নয়। যদিও শিক্ষকদের একাংশের মতে, কোভিডের পর থেকে পড়াশোনার মান এবং পরিকাঠামোরও কিছুটা উন্নতি হয়েছে, যা এই সমীক্ষায়ও প্রতিফলিত হয়েছে।
১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সীদের স্মার্টফোনের ব্যবহার নিয়েও সমীক্ষা চলেছে। তাদের মধ্যে ৮৪ দশমিক ৪ শতাংশ পড়ুয়ার বাড়িতে স্মার্টফোন আছে। এই পড়ুয়াদের ৬৬ দশমিক ৬ শতাংশ পড়াশোনার কাজে তা ব্যবহার করতে পারে। তবে, সেই ফোন কতজন নিরাপদে ব্যবহার করে, সে প্রশ্ন উঠেছে। ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ প্রয়োজনে কাউকে ব্লক করতে পারে। ডিজিটাল ক্লাসের ওপরে জোর দেওয়া হলেও স্কুলে কম্পিউটার নেই ৯৫ দশমিক ৩ শতাংশের।
রিপোর্ট বলছে, মিড-ডে মিলের ছবিটা ভালো। ৮৪ দশমিক ৯ শতাংশ পড়ুয়া এই খাবার পাচ্ছে। ৭৫ দশমিক ৫ শতাংশ স্কুলে পানীয় জল রয়েছে। ৮২ দশমিক ৩ শতাংশ স্কুলে আছে শৌচালয়। ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ স্কুলে মেয়েদের আলাদা শৌচালয় নেই। আলাদা শৌচালয় রয়েছে, কিন্তু সেটি তালাবদ্ধ ৫ দশমিক ৪ শতাংশ স্কুলে। মেয়েদের শৌচালয় থাকলেও তা ব্যবহারযোগ্য নয় ৮ দশমিক ৯ শতাংশ স্কুলে। মেয়েদের ব্যবহারযোগ্য শৌচালয় রয়েছে ৬৬ দশমিক ২ শতাংশ স্কুলে।
পড়ুয়া ভর্তির ক্ষেত্রে অবশ্য সরকারি স্কুল অনেক এগিয়ে আছে। ৬ থেকে ১৪ বছরের ৮৯ দশমিক ৬ শতাংশ পড়ুয়া সরকারি স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ৮ দশমিক ৭ শতাংশ ভর্তি হয়েছে বেসরকারি স্কুলে। এই রাজ্য প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ভর্তির হারে অন্যান্য রাজ্য থেকে অনেক এগিয়ে। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছেলে পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে ২০১৮ সালে ভর্তির হার ছিল ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২২ সালে তা বেড়ে হয় ৯১ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২৪ সালে তা আবার কমে হয়েছে ৮৬ দশমিক ৪ শতাংশ। মেয়েদের ক্ষেত্রে ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছিল ৮৮ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২২ সালে তা বেড়ে হয় ৯৩ দশমিক ১ শতাংশ। কিন্তু ২০২৪-এ ভর্তি হয়েছে ৮৯ দশমিক ৪ শতাংশ।
এর পাশাপাশি রয়েছে, শিক্ষকদের পড়াশোনার মানের সমস্যা। টাকা দিয়ে যারা চাকরি পেয়েছে, তাদের অধিকাংশই নিজেরা অঙ্ক করতে পারে না। ভুল বাংলা বানান লেখে। ইংরেজি তো জানেই না। এই পরিবেশে ছাত্রছাত্রীরা সঠিক শিক্ষা পাবে কী করে। সরকার যে এ তথ্য জানে না, এমনটা নয়, কিন্তু শিক্ষাকেন্দ্রিক সব ব্যাপারেই তারা একেবারে নির্বিকার।
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থায় এত বড় বিপর্যয় অতীতে কখনো ঘটেনি। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়- সর্বস্তরে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ও নৈরাজ্য বিপর্যস্ত করে তুলেছে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে। কার্যত বাৎসরিক অনুদান পাওয়া কিছু ক্লাব এবং সেই অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যকার পার্থক্য এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দুটোই শাসক দলের দখলদারিতে চলে যাওয়ায় এক ধাঁচা পেয়েছে এবং এই সমস্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ১১ বছরে এই বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছাত্রছাত্রীরা। প্রথম দিকে তা টের না পাওয়া গেলেও এখন তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছেন অভিভাবকমণ্ডলীসহ রাজ্যের মানুষ।
রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থায় নৈরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ এর আগে দেখেনি, তা নয়। বিগত শতাব্দীর সত্তরের দশকের আধা ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসের সময় টার্গেট ছিল রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। পরীক্ষাব্যবস্থায় ঢালাও টোকাটুকি মূল্যায়নের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। সমাজের সর্বস্তরের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মিলিত প্রতিরোধে রক্ষা পেয়েছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।
তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর পুরোপুরি ভেঙে দিয়েছে এই ব্যবস্থা। শিক্ষার সর্বস্তরে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের জায়গা নিল একচেটিয়া দলীয় নিয়ন্ত্রণ। বহুমুখী স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে শাসকদলের ছোট-বড়-মাঝারি নেতারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। প্রথম পাঁচ বছরে এই দখলদারি সুনিশ্চিত করতে বিস্তর হিংসার আশ্রয় নিয়েছে তৃণমূল আশ্রিত গুণ্ডাবাহিনী। ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী এমনকি প্রধান শিক্ষক/ শিক্ষিকা, অধ্যক্ষ, উপাচার্য, কেউ রেহাই পাননি এই আক্রমণের হাত থেকে।
শুধু শিক্ষিকাকে লক্ষ্য করে জলের জগ ছোড়া নয়, পুরোদস্তুর আতঙ্কের আবহ তৈরি করা হয়েছে ক্যাম্পাসের ভেতরে ও লাগোয়া এলাকায়। বিরুদ্ধ মতের ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক আক্রমণের পাশাপাশি নানাভাবে হেনস্তার চেষ্টা হয়েছে। নতুন ধারার প্রশাসনিক আইন চালু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের মত প্রকাশ ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। উদার অর্থনীতির আঁতুড়ে বেড়ে ওঠা এই শাসকদল এটা ভালো বোঝে যে, প্রতিবাদের রাস্তা বন্ধ করতে পারলেই দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ইত্যাদি পাকাপাকি করার রাস্তায় কংক্রিটের ঢালাই দেওয়া সম্ভব। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় যে গোলমালের খবর আমরা পাই, তা মূলত বখরা ভাগাভাগি নিয়ে শাসকদলের নেতাদের মধ্যকার মারামারি, বাইরের কেউ নেই ওখানে। বর্তমানের বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে এই প্রেক্ষিতটুকু বোঝা খুব দরকার। শিকড় উপড়াতে না পারলে শিক্ষাব্যবস্থার এই অনাচার বন্ধ করা সম্ভব নয়।
এখন মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ প্রতিষ্ঠান দুটি তাদের স্বশাসনের গরিমা হারিয়ে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে। ফলে বিদ্যালয় স্তরে পরীক্ষাব্যবস্থায় চরম অরাজকতা ফিরে এসেছে। অবাধে টোকাটুকি চলছে, বছরের পর বছর পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও তথৈবচ। কলেজের ভর্তি নিয়ে দুর্নীতি সর্বজনবিদিত। তোলাবাজির শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে একাধিক ছাত্রছাত্রী। এখানেও বেআইনি আর্থিক লেনদেনের ভাগবাঁটোয়ারায় এক ধরনের সিন্ডিকেটরাজ চালু হয়েছে বলা যেতে পারে।
সর্বস্তরে ঢালাও নম্বর বেড়ে যাওয়ায় মার্কশিটের ওজন বেড়েছে একথা ঠিক, তবে বাস্তব জীবনে ছাত্রছাত্রীরা তার ফল লাভ করতে সক্ষম হচ্ছে না। উলটো প্রতি পদে বিড়ম্বনার শিকার। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী দাবি করছেন, আগে নম্বর দেওয়া হতো না, তাই উনি এখন নম্বর অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ পরীক্ষকদের ভূমিকা যে এখানে গৌণ, তা মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে পরিষ্কার। বোঝাই যায়, সস্তার রাজনীতি করতে গিয়ে নেত্রী ও তার দলবল ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন। বিপদ বুঝতে পেরে বহু ছাত্রছাত্রী এখন ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। ফলে রাজ্যের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রচুর আসন ফাঁকা পড়ে থাকছে। নিয়োগের বাজার তলানিতে ঠেকায় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোরও একই হাল। শুধু স্কুল-কলেজের পরীক্ষা নয়, বর্তমান সরকারের আমলে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরিচালনাধীন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাও প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে, যা অতীতে ভাবাও যেত না। এও সেই দখলদারির ফল, যা এখন বিষময় আকার ধারণ করেছে।
নিয়োগ-দুর্নীতি নিয়ে এখন যা বলার আদালত বলছে। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের শিক্ষা দপ্তর এখন প্রেসিডেন্সি জেলে স্থানান্তরিত হয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলায় এ ঘটনা নজিরবিহীন এবং চরম লজ্জার। জেল খাটছেন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি, উপাচার্য তথা এসএসসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্য, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি তথা বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রশাসক কল্যাণময় গাঙ্গুলিসহ শিক্ষা দপ্তরের বহু কর্তাব্যক্তি। বাকিরা জেলে ঢোকার রাস্তায় লাইনে দাঁড়িয়ে। সব মিলিয়ে কয়েক শ কোটি টাকার দুর্নীতি উঠে এসেছে অভিজিৎ গাঙ্গুলির এজলাসে। মুখ্যমন্ত্রী বারবার একে ছোটখাটো ভুল বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। সাফাই গাইতে এও বলছেন, কাজ করতে গেলে তো এমন ভুল হতেই পারে। তাহলে ধরে নিতেই হয় তার সমর্থনেই এই অনাচার ঘটেছে। নয়তো এই দুর্নীতির নিন্দা না করে এভাবে সাফাই গাইছেন কেন। অবশ্য কয়েক হাজার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করা তার পক্ষেই শোভা পায়। মুখ্যমন্ত্রী ও তার সরকারের এহেন কর্মকাণ্ড দেখে রাজ্যের মানুষ ধিক্কার জানানোর ভাষাটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন।
ইতোমধ্যে সিবিআই তদন্তে উঠে এসেছে, গত ১১ বছরে বিদ্যালয় স্তরে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে অনৈতিক উপায়ে আর্থিক লেনদেনের সাহায্যে অযোগ্য ৮ হাজার ১৬৩ তরুণ-তরুণীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ৯৫২ জন নবম-দশমের শিক্ষক, ৯০৭ জন একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক, ৩ হাজার ৪৮১ জন গ্রুপ সি এবং ২ হাজার ৮২৩ জন গ্রুপ ডি-ভুক্ত শিক্ষাকর্মী। এরা অধিকাংশই সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পেয়েছে। ওএমআর সিটে শূন্য বা এক নম্বরকে ৫২ বা ৫৩ নম্বর করা হয়েছে নিখুঁত কায়দায়। পেশাদার চোর-জোচ্চররাও লজ্জা পাবে এদের কাণ্ডকারখানা দেখে। প্রাথমিকে দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগের সংখ্যা এর কয়েক গুণ বেশি। ২০১৪ বা ২০১৭ সালে যারা টেট উত্তীর্ণ হয়েছেন তাদের মার্কশিট, সার্টিফিকেট কিছুই নেওয়া হয়নি। আদালতের নির্দেশে তা হালে দেওয়া শুরু হয়েছে, তাও ত্রুটিপূর্ণ। দুর্নীতির শিকড় কত গভীরে এর থেকেই তা অনুমান করা যায়।
মানিক ধরা না পড়লে আমরা জানতেও পারতাম না, বাজ্যের ৬০০-এর কাছাকাছি বেসরকারি ডিএলএড কলেজে অর্থের বিনিময়ে এই মাত্রায় বেআইনি ভর্তি ও ডিগ্রি বিক্রি হয়। প্রাথমিকে তো জাল মার্কশিট দেওয়ার চক্রও ধরা পড়েছে। এই দুর্নীতির জাল কতদূর বিস্তার লাভ করেছে এখনো তা জানা যায়নি। শুধু এটুকু বলা যায়, গোটা শিক্ষা দপ্তর দুর্নীতির পাঁকে ডুবে আছে। সরকারের অন্য দপ্তরগুলোও নিশ্চয়ই একই পথের পথিক। শুধু শিক্ষা দপ্তরের দুর্নীতি নিয়েই আদালতে লেজেগোবরে অবস্থা রাজ্য সরকারের। সব অবৈধ নিয়োগ
বাতিল করে যোগ্য ও বঞ্চিত প্রার্থীদের দ্রুত সেই পদে নিয়োগ করতে হবে, এটাই আদালতের
সর্বশেষ বোঝাপড়া, যা সরকার কৌশলে এড়িয়ে যেতে চাইছে।
সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠছে, নিয়োগ-দুর্নীতির জন্য যেসব আবেদনকারী ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন, তাদের নিয়োগের জন্য অতিরিক্ত শূন্য পদ (সুপার নিউমারিক) তৈরি করা হচ্ছে কেন। তবে কি আগের ওইসব শূন্যপদে অর্থ ও অন্যান্য উপঢৌকনের বিনিময়ে বা শাসক দলের রাজনীতিকদের পারিবারিক কোটায় যেসব অযোগ্য প্রার্থী ইতোমধ্যে নিযুক্ত হয়েছেন তাদের রেখে দেওয়া হবে। রাজ্য সরকার অন্তত আদালতকে ঠেকাতে আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে তাই চাইছে, এটা পরিষ্কার।
ইতোমধ্যে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু ঘোষণা করেছেন, মুখ্যমন্ত্রী বা তার সরকার চায় না অভিযুক্তদের কারও চাকরি যাক, তবে যোগ্য প্রার্থীদের আদালতের নির্দেশ মেনে চাকরি দেওয়া হবে। হিসাবটা পরিষ্কার; এতে করে আদালতের নির্দেশকে মান্যতা দেওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতির বোঝাপড়াও আড়াল করা গেল, অতিরিক্ত শূন্য পদে নিয়োগের ঢাকও পেটানো হলো বিস্তর। তা যদি হয়, তবে বিপদ আরও বাড়বে। শুধু তাই নয়, তা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেবে। আগে তো দুর্নীতির চোরাগলি দিয়ে ঢুকে পড়া এসব অযোগ্য শিক্ষক নামধারী মানুষের নিয়োগ বাতিল করে এদের স্কুল ক্যাম্পাসে ঢোকা বন্ধ করা দরকার।
বেকার ছেলেমেয়ে, চাকরিটা পেয়েছে যখন, তখন তাড়ানো ঠিক না, এসব ছেঁদো আবেগের কোনো জায়গা এ ক্ষেত্রে থাকা ঠিক নয়। ভুলে গেলে চলবে না, এরা যোগ্য ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে অনৈতিকভাবে নিযুক্ত হয়েছে। তা না করতে পারলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কয়েক প্রজন্মের ছাত্রছাত্রী, যারা এসব অযোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ক্লাসরুমে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বসতে বাধ্য হবে। এদের কাছ থেকে কী শিখবে ওরা। শিক্ষাব্যবস্থার এই গলদ শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, গোটা সমাজকে অসুস্থ করে তুলবে। পঙ্গু হয়ে যাবে আগামী প্রজন্ম, যারা সমাজ গড়ার কারিগর হতে পারত। কে দায় নেবে তার। আদালত তাই সঠিক যুক্তিতে অতিরিক্ত শূন্য পদে এসব যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগের বিরোধিতা করেছে। আদালতের স্পষ্ট নির্দেশ, অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ বাতিল করে ওই সব শূন্যপদে যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ সুনিশ্চিত করতে হবে, অতিরিক্ত শূন্যপদ সৃষ্টি করে নয়, এতে ন্যায়বিচার যেমন সুনিশ্চিত হবে, সমাজটাও বাঁচবে।
আদালতের নির্দেশে সিবিআই বা ইডির এই তদন্ত কতদূর এগোবে বা কতদিন চলবে জানা নেই। মহামান্য বিচারপতিরাই এনিয়ে বারবার সংশয় প্রকাশ করেছেন। বিজেপির সঙ্গে সেটিং যে চলছে, সে বিষয়ে আমরাও কমবেশি ওয়াকিবহাল। কোনোমতেই এজেন্সি যাতে মাথার দিকে হাত না বাড়ায়, তা সুনিশ্চিত করতে এই সেটিং। ইতোমধ্যে দুর্নীতির এই ডামাডোলে রাজ্য সরকার চুপিসারে সর্বনাশা কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতি এই রাজ্যেও চালু করার বন্দোবস্ত পাকা করে ফেলেছে। হতে পারে সেটিংয়ের শর্তই ছিল এটা। এমনিতেই শিক্ষাক্ষেত্রে ঢালাও বাণিজ্যিকীকরণ চলছে রাজ্যজুড়ে। নানা অজুহাতে বন্ধ হয়েছে বেশ কয়েকটি সরকারি স্কুল। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় একের পর এক আরএসএস-এর স্কুল গড়ে উঠছে সারা রাজ্যে। এবার বাকি কাজটুকুও সেরে ফেলার পালা।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক